বিজয় দিবসের চার কর্মসূচি

اِنَّا فَتَحْنَا لَكَ فَتْحًا مُّبِیْنًا অর্থাৎ নিশ্চয়ই আমি আপনাকে দিয়েছি সুস্পষ্ট বিজয়...। (সূরা ফাতহ, আয়াত : ১) আয়াত নাযিল হওয়ার সময়—কাল: অধিকাংশ সাহাবী, তাবেয়ী ও তাফসীরবিদ বর্ণনা করেন, ষষ্ঠ হিজরীতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় স্বপ্ন দেখলেন তিনি সাহাবায়ে কেরামসহ মক্কায় নির্ভয়ে ও নির্বিঘ্নে প্রবেশ করছেন এবং ইহরামের কাজ সমাপ্ত করে কেউ কেউ নিয়মানুযায়ী মাথা মুণ্ডন করেছেন, কেউ কেউ চুল কাটিয়েছেন এবং তিনি বায়তুল্লাহ প্রবেশ করেছেন ও বায়তুল্লাহর চাবি তার হস্তগত হয়েছে। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সাহাবায়ে কেরামকে স্বপ্নের বৃত্তান্ত শুনালেন, তখন তারা সবাই পরম আগ্রহের সাথে মক্কা মুয়াজ্জমায় যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু করে দিলেন। সাহাবায়ে কেরামের প্রস্তুতি দেখে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও ইচ্ছা করে ফেললেন। কেননা, স্বপ্নে কোন বিশেষ সাল অথবা মাস নির্দিষ্ট ছিল না। কাজেই এই মুহূর্তেই উদ্দেশ্য সিদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনাও ছিল। যিলকাদ মাসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উমরার উদ্দেশ্যে সাহাবায়ে কেরামকে সাথে নিয়ে মক্কা মুকাররম তাশরীফ নিয়ে যান এবং হারাম শরীফের সন্নিকটে হুদাইবিয়া নামক স্থান পৌছে অবস্থান করেন। হুদাইবিয়া মক্কার বাইরে হারামের সীমানার সন্নিকটে অবস্থিত একটি স্থানের নাম। যাকে বর্তমানে সুমাইছী বলা হয়। কিন্তু মক্কার কাফেররা তাকে মক্কা প্রবেশে বাধা দান করে। অতঃপর তারা এই শর্তে সন্ধি করতে সম্মত হয় যে, এ বছর তিনি মদীনায় ফিরে যাবেন এবং পরবর্তী বছর তিনি উমরা করতে আসবেন। সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে অনেকেই বিশেষত উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু এ ধরনের সন্ধি করতে অসম্মত ছিলেন। কিন্তু নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই সন্ধিকে পরিণামে মুসলিমদের জন্যে সাফল্যের উপায় মনে করে গ্রহণ করে নেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন উমরার এহরাম খুলে হুদাইবিয়া থেকে ফেরত রওয়ানা হলেন, তখন পথিমধ্যে এই পূর্ণ সূরা অবতীর্ণ হয়। এতে বলা হয়েছে যে, রাসূলে আরবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার স্বপ্ন সত্য এবং অবশ্যই বাস্তবরূপ লাভ করবে। কিন্তু তার সময় এখনও হয়নি। পরে মক্কা বিজয়ের সময় এই স্বপ্ন বাস্তবরূপ লাভ করে। এই সন্ধি প্রকৃতপক্ষে মক্কা বিজয়ের কারণ হয়েছিল। তাই একে প্রকাশ্য বিজয় বলে ব্যক্ত করা হয়েছে। প্রাসঙ্গিক আলোচনা: পবিত্র কুরআনুল করিমে দু’টি সুরায় বিজয় দিবসের কর্মসূচি বর্ণনা করা হয়েছে। সূরাদ্বয়ের একটির নাম সুরা ফাতাহ, অপরটির নাম সুরা নাসর। ‘ফাতাহ’ অর্থ বিজয়, আর ‘নাসর’ অর্থ মুক্তি বা সাহায্য। দেশ—স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব রক্ষার আন্দোলন করতে গিয়ে দেশ ও মাটির গাদ্দারদের বিরুদ্ধে লড়াই করে দেশ দখলমুক্ত করার নাম বিজয়। আর বিজয় অর্জনের পেছনে অলৌকিক শক্তির নাম হচ্ছে নাসর বা সাহায্য। প্রত্যেক জাতিরই বিজয় আছে, আমাদের মুসলমানেরও আছে, কিন্তু মুসলমানের বিজয় নানা দিক থেকে আলাদা। চিন্তা ও মূল্যায়ন, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, কর্ম ও কর্মপন্থা সব দিক থেকেই মুসলমানের বিজয় ভিন্ন মাত্রার। কুরআনুল করিমে বিজয়ের দুটো রূপ খুব স্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। প্রথমত: স্বার্থ ও সা¤্রাজ্যবাদী বিজয়ের রূপ। দ্বিতীয়ত: কল্যাণ ও আদর্শবাদী বিজয়ের রূপ। প্রথমটির বর্ণনা সূরা নমলের ৩৪ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে— اِنَّ الْمُلُوْكَ اِذَا دَخَلُوْا قَرْیَةً اَفْسَدُوْهَا وَ جَعَلُوْۤا اَعِزَّةَ اَهْلِهَاۤ اَذِلَّةً. অর্থাৎ “রাজা—বাদশা যখন কোনো জনপদে প্রবেশ করে তখন তা বিপর্যস্ত করে এবং সেখানকার মর্যাদাবান—লোকদের অপদস্থ করে।” কুরআনুল করিমে ‘বিপর্যস্ত করে’ ও ‘অপদস্থ করে’ এই দুটি মাত্র শব্দে যে বাস্তবতা বর্ণনা করেছে, যুগে যুগে রাজ্য বিস্তার ও সাম্রাজ্য বিস্তারের উদ্দেশ্যে সংঘটিত যুদ্ধ ও যুদ্ধজয়ের রূপটি কি তার চেয়ে কিছুমাত্রও পৃথক ছিল? এই যুদ্ধ ও যুদ্ধজয় যে কত জনপদ বিনষ্ট করেছে! কত মানুষের রক্তে পৃথিবী রঞ্জিত করেছে! কত নারীর সম্ভ্রম ভূলুণ্ঠিত করেছে! কিন্তু এর বিনিময়ে মানবতা কী পেয়েছে প্রভু বদল ও দাসত্বের পালাবদল ছাড়া? এ কারণে বিজয়ের এই প্রকারটি মানবতার বিজয় নয়, একটি সম্প্রদায়ের বিজয়। বিজয়ের অপর রূপ বর্ণনায় পবিত্র কুরআনুল করিমের সূরা হজ্বে ইরশাদ হচ্ছে, اَلَّذِیْنَ اِنْ مَّكَّنّٰهُمْ فِی الْاَرْضِ اَقَامُوا الصَّلٰوةَ وَ اٰتَوُا الزَّكٰوةَ وَ اَمَرُوْا بِالْمَعْرُوْفِ وَ نَهَوْا عَنِ الْمُنْكَرِ وَ لِلهِ عَاقِبَةُ الْاُمُوْرِ. অর্থাৎ আমি এদের পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা দান করলে এরা সালাত আদায় করবে, যাকাত দান করবে এবং সৎ কাজের আদেশ করবে ও অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করবে, আর সকল কর্মের পরিণাম আল্লাহর ইখতিয়ারে। এ হচ্ছে সত্য ও আদর্শের বিজয় এবং মানব ও মানবতার বিজয়। বিজয়ের এই রূপটিই মুসলিম জাতির। শুধু নীতিগত দিক থেকে নয়, বাস্তব ইতিহাসেও এ রূপটিই আমাদের বিজয়ের রূপ। যার বাস্তব সাক্ষী পৃথিবীর ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম বিজয় মক্কা বিজয়। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে জানা যায়, যখনই কোনো জাতির এক অংশ অন্য অংশের দ্বারা নিজেদের স্বাধীন অধিকার খর্ব হতে দেখেছে, একে অন্যের দ্বারা শোষিত ও বঞ্চিত হয়েছে, তখনই শোষিত জনগোষ্ঠী শোষণকারীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে এবং নিজেদের মুক্ত করতে সংগ্রাম করেছে। একই ধারায় পশ্চিম পাকিস্তানের শোষকদের বিরুদ্ধে সাড়ে ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের সৃষ্টি এবং স্বাধীন বাঙালি জাতির অভ্যুদয় হয়েছিল ১৯৭১ সালে। আল্লাহ তায়াআলার অশেষ করুণার বদৌলতেই আমাদের পূর্বপুরুষ বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ উক্ত বিজয়ে সক্ষম হয়েছিলেন। স্বদেশপ্রেম প্রতিটি মানুষের স্বভাবজাত অভ্যাস, বিশেষত মুসলমানদের প্রতিটি রক্তকণিকায়ই দেশপ্রেমের শিহরণ থাকা বাঞ্ছনীয়। দেশপ্রেমের অন্যতম বহিঃপ্রকাশ হলো, দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করা। হাদিস শরিফে এসেছে, ‘আল্লাহর পথে এক দিন ও এক রাত সীমান্ত পাহারা দেওয়া এক মাস পর্যন্ত সিয়াম পালন ও এক মাস ধরে রাতে সালাত আদায়ের চেয়ে বেশি কল্যাণকর। যদি এ অবস্থায় সে মৃত্যুবরণ করে, তাহলে যে কাজ সে করে যাচ্ছিল, মৃত্যুর পরও তা তার জন্য অব্যাহত থাকবে, তার রিজিক অব্যাহত থাকবে, কবর—হাশরের ফিতনা থেকে সে নিরাপদ থাকবে।’ বিজয় দিবস উদযাপনে মুসলমানদের জন্য রয়েছে সুনির্দিষ্ট কিছু নীতিমালা। এ সম্পর্কে সুরা নসরে মহান রাব্বুল আলামিন তিনটি কর্মসুচি ঘোষণার মাধ্যমে ইঙ্গিত প্রদান করেছেন। যথা— ১.ফাসাব্বিহ, (আল্লাহর তাসবিহ পাঠ তথা পবিত্রতা বর্ণনা করা)। ২. বিহামদী রাব্বিক, (আল্লাহর হামদ তথা শুকরিয়া আদায় করা) ৩. ওয়াসতাগফীর (যুদ্ধের সময় ভুলভ্রান্তি তথা সীমালংঘন থেকে প্রতিপালকের কাছে ক্ষমা চাওয়া প্রার্থনা করা)। বস্তুত বিজয়ের দিন মহান রবের কাছে সিজদাবনত হয়ে লুটিয়ে পড়ে শুকরিয়া আদায় করা নৈতিক ও ঈমানি দায়িত্ব। বিজয়ের দিন শুকরিয়া নামায পড়া হুযূর পুরনূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার সুন্নাত। সীরাতে রাসূলে রয়েছে, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন দশ বছর পর বিজয়েরবেশে সহ¯্র সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে যখন মক্কা নগরীতে প্রবেশ করলেন, তখন তিনি চেহারা নিম্নগামী অবস্থায় একটি উটের ওপর বসা ছিলেন। প্রথমে হযরত উম্মে হানী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহার গৃহে প্রবেশ করে আট রাকাত নামায আদায় করেন। সেই নামাযকে সালাতুল ফাতহ বা বিজয়ের নামায বলা হয়। উপর্যুক্ত পর্যালোচনা থেকে জানা যায় যে,বিজয় দিবসের দিন আমাদের নিম্নোক্ত কার্যাদি করতে হবে— ক. আল্লাহর বড়ত্ব ও পবিত্রতার বর্ণনা করা। খ. যুদ্ধ চলাকালীন আমাদের অজান্তে যেসব ভুলত্রুটি হয়েছে, তার জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া। গ. আট রাকাত নামায আদায় করা। ঘ. কুরআনুল করিমের তেলাওয়াতসহ বিভিন্নভাবে শাহাদাত বরণকারীদের জন্য ইসালে সওয়াবের ব্যবস্থা করা। কাক্সিক্ষত বিজয় গৌরবের। কিন্তু বিজয় যদি হয় লক্ষ্যভ্রষ্ট আর বিজেতারা যদি হন নীতিভ্রষ্ট; কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর হীন স্বার্থ যদি পায় অগ্রাধিকার, তাহলে সে বিজয় প্রকৃত আনন্দ উপহার দেয় না। সমাজে যদি আইনের শাসন না থাকে, দুষ্ট ব্যক্তি তার অন্যায় কর্মের শাজা না পেয়ে অন্যায়ের মাধ্যমে লাভবান হতে থাকে, সৎ ও যোগ্য ব্যক্তি তার যোগ্যতার মূল্যায়ন ও পুরস্কার না পান তবে সে সমাজের সাধারণ মানুষের মধ্যে হতাশা ও দুর্নীতি মুখিতা সৃষ্টি হয়। যা দেশ ও সমাজ ধ্বংসের প্রধান বাহন। তাই স্বাধীনতা লাভকারী জনগোষ্ঠীর অন্যতম দায়িত্ব সমাজের সর্বস্তরে আইনের শাসন, ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়র নিষেধের শক্তিশালী ধারা তৈরি করা। রাসূলে আরবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মক্কা বিজয় করেন, তখন আল্লাহ তাআলা বিজয়—পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে নির্দেশনা প্রদান করেন। ইরশাদ হচ্ছে – ‘তারা এমন জাতি যদি আমি তাদেরকে পৃথিবীতে বিজয় দানের মাধ্যমে ক্ষমতাবান করি, তবে তারা সালাত কায়েম করবে, যাকাত আদায় করবে এবং সৎকাজের নির্দেশ দেবে ও অসৎকাজ নিষেধ করবে। আসন্ন বিজয়—দিবসে আমরা যদি উপর্যুক্ত গুণগুলো গ্রহণ করতে পারি তাহলে তা হবে শেকড়ের সাথে যুক্ত হওয়া এবং আদর্শের আলোকে আলোকিত হওয়া। রব্বে করিম আমাদেরকে মহান প্রতিপালকের সেই নির্দেশনা বাস্তবায়ন করার তাওফিক দান করুন। https://www.anjumantrust.org/2023/08/10/%E0%A6%B9%E0%A6%BE%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%B2-%E0%A6%B9%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%AE%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%AE%E0%A6%BF%E0%A6%B6%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%A3-%E0%A6%93-%E0%A6%B6%E0%A6%B0/