হালাল- হারামের মিশ্রণ ও শরয়ি বিধান

হালাল ও হারাম ইসলামী শরিয়তের গুরুত্বপূর্ণ দুটি পরিভাষা। যা আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত। ইরশাদ হচ্ছে- তিনি তাদের জন্য পবিত্র (ও উত্তম) বস্তু হালাল করেছেন এবং অপবিত্র (ও অনুত্তম) বস্তু হারাম করেছেন। ’ (সুরা আরাফ, আয়াত : ১৫৭) বস্তুত হালাল-হারাম এর পার্থক্য রক্ষা করে না চললে মানুষের মনুষ্যত্ব রক্ষা পেতে পারে না বরং মানুষপশুর স্তরে নেমে যাওয়া অবধারিত।  আল্লাহ তায়ালা যখন কোন একটি বিষয় হারাম করেন, সাথে সাথে এর বিকল্পে অন্য কিছু সেট করেন। যেমন ব্যভিচার করা হারাম; এর বিকল্প বিয়ে হালাল। অনুরূপভাবে আল্লাহ তায়ালা সুদ করেছেন হারাম; এর বিকল্প ব্যবসা করেছেন হালাল। আর যখন আল্লাহ তায়ালা কোন কিছুকে হালাল সাব্যস্ত করেন; কারো সাধ্য নেই তা হারাম করার। আর যা হারাম করেছেন; কারো সাধ্য নেই তা হালাল করার। ঈমানদার মাত্রই হালাল রুজি উপার্জন করার কোন বিকল্প নেই। রাসূলে আরবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন , ‘হালাল জীবিকার সন্ধান করা ফরজ ইবাদতের পরই অপরিহার্য কর্তব্য।’ অর্থাৎ মৌলিক ইবাদতের পরই রয়েছে হালাল জীবিকার জন্য কর্মপ্রচেষ্টার তাগিদ। আর কোরআন-সুন্নাহ নির্দেশিত পন্থায় জীবিকা নির্বাহ করলে উপার্জন হালাল হয়। এই বসুন্ধরায় কোটি কোটি মানুষ খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার জন্য জীবিকা উপার্জনের বিভিন্ন পথ ও পন্থা অবলম্বন করে থাকে। কেউ বা চাকরিজীবী, কেউ ব্যবসায়ী। তা ছাড়া মানুষ আরো অন্য যেসব কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে আয়-রোজগার করে সেগুলোও কোনো না কোনোভাবে ব্যবসায়ের আদলে হয়ে থাকে। আমাদের সমাজে চাকরি দুধরনের। তথা সরকারি চাকরিজীবী ও বেসরকারি চাকরিজীবী। উভয় ক্ষেত্রে জীবিকা হালাল হওয়ার জন্য কিছু বিষয় শরিয়াহসম্মত হওয়া বাঞ্ছনীয়। প্রথমত, প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ড ইসলামী নীতির মধ্যে আছে কি না। কোন অবৈধ বা অনৈসলামিক বিষয় নিয়ে ওই প্রতিষ্ঠান কাজ-কারবার করে কি না। সুদ বা জুলুম প্রভৃতি বিষয়ের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের সম্পর্ক আছে কি না। সরকারি অনেক প্রতিষ্ঠানই রাষ্ট্রের নানা কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। জনগণের কল্যাণ ও সেবার কাজে জড়িত। তাই যিনি চাকরি করবেন, তাকে অবশ্যই সৎভাবে, ঘুষ ও প্রতারণা ছাড়া তার কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে হবে। সততা ও দায়িত্ববোধের জায়গা থেকে তাঁকে নিষ্ঠাবান হতে হবে। তাহলেই ওই ব্যক্তির উপার্জন বা বেতন হালাল হবে। উপার্জনের অনন্য পাথেয় ব্যবসা, যার পরিধি অনেক বড়। পৃথিবীর বেশির ভাগ মানুষ নানান ধরনের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। দোকান-পাট, কল-কারখানায় উৎপাদন ইত্যাদি। ব্যবসা পরিচালনায় ইসলামী নীতি মেনে চলার গুরুত্ব অপরিসীম। হুযূর পুরনূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যবসার মাধ্যমে হালাল জীবিকা অর্জনকে উৎসাহিত করেছেন। ইরশাদ করেন, ‘তোমরা বাণিজ্য করো। কেননা তোমাদের জীবিকা ১০ ভাগে বিভক্ত এবং এর ৯ ভাগই রয়েছে ব্যবসা-বাণিজ্যের মধ্যে।’ তিনি ব্যবসাকে উৎকৃষ্ট ঘোষণা করেই ক্ষান্ত হননি, তিনি ব্যবসায়ীদের মর্যাদাকে সমুন্নত করতে গিয়ে আরো ইরশাদ করেন, ‘কিয়ামতের দিন সৎ ব্যবসায়ীরা সিদ্দিক ও শহীদদের সঙ্গে উঠবেন।’ বর্তমান ব্যবসায় সবচেয়ে বেশি মাত্রায় ভেজাল সংযুক্তকরণ, প্রতারণা ও মিথ্যা শপথের ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। ব্যবসার বিভিন্ন সেক্টর রয়েছে আর প্রতিটি সেক্টরে সাধারণ পদ্ধতিতে কিংবা ডিজিটাল পদ্ধতিতে হারামের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে ব্যাপক অর্থ উপার্জনে ব্যবসায়ী ভাইয়েরা খুব বেশি তৎপর। এ প্রসঙ্গে হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘এমন এক যুগ আসবে, যখন মানুষ পরোয়া করবে না যে, সে কোথা থেকে সম্পদ উপার্জন করল, হালাল থেকে না হারাম।’ (সহিহ বুখারি,হাদীস:২০৫৯) তবে কোনো ব্যবসায়ীর উপার্জন ততক্ষণ পর্যন্ত হালাল বা বৈধ হবে না, যতক্ষণ না সে নিম্নোক্ত মূলনীতি মেনে চলবে। যথা- ব্যবসায় স্বচ্ছতা : একজন ব্যবসায়ী সৎ, নিষ্ঠাবান ও ওয়াদা পালনকারী। সে প্রতারণা, প্রবঞ্চনার ঊর্ধ্বে উঠে সৎভাবে আয়-রোজগার করবেন এবং ব্যবসা পরিচালনার সব অসৎ ও অন্যায় কাজ থেকে মুক্ত থাকবেন। ইসলাম অন্যায়ভাবে অর্থ উপার্জনকে নিষিদ্ধ করেছে। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা নিজেদের মধ্যে একে অন্যের অর্থ-সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস কোরো না।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৮৮) ব্যবসায় সততা : ইসলামে ব্যবসাকে হালাল করার পাশাপাশি এ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সততার নীতি অবলম্বন করার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। ব্যবসায়ীকে অবশ্যই সৎ হতে হবে। আল্লাহ বলেন, ‘যে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সত্যবাদীদের সঙ্গী হয়ে যাও।’ (সূরা তাওবা, আয়াত : ১১৯) প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘কোনো লেনদেনে যারা মিথ্যা বলবে এবং কিছু লুকাবে, তাদের লেনদেনের বরকত নিঃশেষ হয়ে যাবে।’ ব্যবসায় প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা : অঙ্গীকার রক্ষা একজন সৎ ব্যবসায়ীর অন্যতম কর্তব্য। ইরশাদ হচ্ছে, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা অঙ্গীকার পূর্ণ করবে।’ (সূরা মায়েদা,আয়াত: ১) রাসূলে আরবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘যে প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করে না, দ্বিন-ইসলামে তার কোনো অংশ নেই।’ (সহিহ বুখারি) কতিপয় ব্যবসায়ীর কিছু বৈশিষ্ট্যের কারণে তাদের ব্যবসা হালাল থেকে হারামে রূপ নেয়। যথা- ক.মজুদদারি : হাদিস ও ফিকহের ভাষায় মজুদদারিকে ‘ইহতিকার’ বলা হয়। আর মজুদদারকে বা ব্যক্তিকে বলা হয় ‘মুহতাকির’। ফকিহদের বিশ্লেষণ মতে, মজুদদারি হচ্ছে কোনো সঙ্কট বা দুর্ভিক্ষের সময় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য মজুদ করে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করা এবং জোগান-চাহিদা ব্যাহত করা। অতঃপর অতিরিক্ত মুনাফায় তা বিক্রি করে দেয়া। যা ইসলাম অবৈধ করেছে। কেননা এর ফলে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পায় এবং অনেক মানুষ দুর্গতির মধ্যে পতিত হয়। এ ধরনের কাজ মানুষের কষ্টকে বাড়িয়ে দেয়। এ প্রসঙ্গে নূরনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি ৪০ দিন খাদ্যশস্য মজুদ রাখে, আল্লাহ তার প্রতি অসন্তুষ্ট এবং সে আল্লাহ তাআলার ওপর অসন্তুষ্ট।’ অন্যত্র ইরশাদ করেন, ‘গোনাহগার ছাড়া কেউ পণ্য মজুদ করে রাখে না।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস:১২৮৫) খ.প্রতারণা ও প্রবঞ্চনা : এমন অনেক ব্যবসায়ী আছে, যারা বেশি মুনাফার আশায় অথবা তার খারাপ সম্পদ বিক্রির জন্য ক্রেতার সঙ্গে প্রতারণার আশ্রয় নেয়। দেখতে একই ব্র্যান্ডের মোবাইল, একই ধরনের ওষুধ, একই ডিজাইনের কাপড় ইত্যাদি নকল পণ্য বিক্রি করে আসল পণ্যের দর হাতিয়ে নেয়ার মতো ধোঁকাবাজির কোনো অভাব নেই।ইসলাম এ ধরনের প্রতারণা করে কোনো কিছু বিক্রি করাকে অবৈধ করেছে। হুযূর পুরনূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘যখন কোনো বেচাকেনা হবে, তখন প্রতারণা করো না।’ এ ছাড়াও অনেকে ভালো পণ্যের সাথে ত্রুটিযুক্ত পণ্য মিশ্রিত করে চালিয়ে দেন। এ প্রসঙ্গে হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, একদা রাসূলে আরবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খাদ্যশস্যের একটি স্তূপের পাশ দিয়ে অতিক্রম করলেন। তিনি স্তূপের ভেতর হাত ঢুকিয়ে দিলেন, ফলে হাতের আঙুলগুলো ভিজে গেল। তিনি বলেন, হে স্তূপের মালিক, একি ব্যাপার? লোকটি বলল, ইয়া রাসূলুল্লাহ, এতে বৃষ্টির পানি পড়েছে। তিনি বলেন, সেগুলো তুমি স্তূপের ওপর রাখলে না কেন? তাহলে লোকেরা দেখে নিতে পারত। যে ধোঁকাবাজি করে সে আমার দলভুক্ত নয়।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস:২৯৫) গ. ওজন ও মাপে কম দেওয়া : ব্যবসার লেনদেনে ওজন ও মাপে কম দেওয়া সম্পূর্ণভাবে অবৈধ। কোনো ভালো ব্যবসায়ী কখনো এ কাজ করতে পারে না। যখন ব্যবসায়ীরা নিজেরা পণ্য ক্রয় করেন তখন পূর্ণমাত্রায় তা ওজন করে নেন। কিন্তু অন্যকে বিক্রির সময় ওজন কমিয়ে দেন। এটা চরম প্রতারণা এবং হক নষ্ট। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘যারা মেপে দেওয়ার সময় পূর্ণ মাপে দেবে এবং ওজন করবে সঠিক দাঁড়িপাল্লায়, এটাই উত্তম এবং পরিণামে উৎকৃষ্ট।’(সূরা বনি ইসরাঈল, আয়াত:৩৫) ঘ. বেচাকেনায় অতিরিক্ত শপথ করা : অসৎ ব্যবসায়ী তার খারাপ দ্রব্য বা পণ্যকে ভালো বোঝানোর জন্য শপথ কাটে। পণ্য বেশি পরিমাণ বিক্রির জন্য ক্রেতার কাছে তার জিনিসের উৎকৃষ্ট হওয়ার গুণগান করে। বিশেষ করে বাংলাদেশে এর মাত্রা আরো তীব্রতর রূপ ধারণ করে যখন রমজান মাস উপস্থিত হয়। ঈদের কেনাকাটা অত্যধিক হারে বৃদ্ধি পেতে থাকলে, তারা এর সুযোগ ব্যবহার করে বেশি অর্থ আয়ের জন্য এ অসৎ পথ অবলম্বন করে থাকে। বলে যে, ভাই, ওয়াল্লাহ! আমার এই জিনিসটার ক্রয়মূল্য এত টাকা, আপনাকে এত টাকা দিতে হবে; না হয় আমাদের লস হবে। এ প্রসঙ্গে রাসূলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘তোমরা বেচাকেনার সময় অতিরিক্ত শপথ করা থেকে বিরত হও।’ অন্যত্র ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহ তায়ালা কিয়ামতের দিন তিন শ্রেণীর লোকের সাথে কথা বলবেন না, তাদের দিকে তাকাবেনও না এবং তাদের পবিত্র করবেন না; বরং তাদের জন্য রয়েছে ভয়ানক শাস্তি। তারা কারা, হে আল্লাহর রাসূল! তিনি বলেন, টাখনুর নিচে কাপড় পরিধানকারী, অনুগ্রহ করে খোঁটা দানকারী এবং মিথ্যা শপথ করে পণ্য বিক্রয়কারী।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৩০৬) ঙ.পণ্যের দোষ গোপন করা: পণ্যের ত্রুটি বর্ণনা না করে পণ্য বিক্রি করাও একটি জঘন্য প্রতারণা। বিশেষত, এই প্রতারণা করার টেকনিক হলো ১০টা ভালোর মধ্যে এক-দুটি ত্রুটিযুক্ত পণ্য চালিয়ে দেয়া যা সাধারণত আলাদা করে বিক্রি করা সম্ভব নয়। এ ধরনের প্রতারণাও নিষিদ্ধ। নূরনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি পণ্যের ত্রুটি বর্ণনা না করে (বরং গোপন করে) বিক্রয় করে, সে সর্বদা আল্লাহর গজবের মধ্যে থাকে এবং ফেরেশতারা সবসময় তাকে অভিশাপ করতে থাকে।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস:২২৪৭) চ. জুলুম করা: অর্থাৎ, একটি পণ্য ১০০ টাকায় ক্রয় করে সেটা বিক্রি করার সময় তিন-চারগুণ দামে বিক্রি করা। নিশ্চয়ই একজন ক্রেতার ওপর এটা বড় জুলুম। জুলুমের হাজার প্রকার-পদ্ধতি থাকতে পারে। মানুষ ভিন্ন ভিন্ন জুলুমের শিকার হতে পারে। কিন্তু, জুলুম শুধু জুলুমই হয়ে থাকে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘জালিমরা কখনো সফলকাম হয় না’। (সূরা আনআম, আয়াত:৫৭) এ প্রসঙ্গে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে আমার বান্দারা! আমি আমার জন্য জুলুম হারাম করেছি আর তা (জুলুম) তোমাদের পরস্পরের মধ্যেও হারাম করেছি। অতএব তোমরা একে অপরের ওপর জুলুম করো না।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস:৬৭৩৭) অতএব, মানুষ ব্যবসা করতে গিয়ে যদি তাতে উপর্যুক্ত বিষয়াবলির মাধ্যমে হারামের মিশ্রণ ঘটায় তাহলে ব্যবসা হালাল হলেও তা হারামে রূপ নেয়। আর যে ব্যক্তিই এমনটা করবে আল্লাহ তায়ালা তার জন্য প্রস্তুত রেখেছেন জাহান্নামের ভয়াবহতা। হারাম ব্যবসা নিষিদ্ধ : এমন অনেক বস্তু আছে, যার ব্যবসা করাকে ইসলাম বৈধ মনে করে না। যেমন মূর্তি, মৃত প্রাণীর ব্যবসা, শূকর বেচা-কেনা, হারাম বস্তু বিক্রি করা কিংবা হারামের প্রসার ঘটিয়ে ব্যবসা করা । দেশের মধ্যে কত হাজার ধরনের প্রকাশ্য হারাম ব্যবসার ঘাঁটি রয়েছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। বর্ডিংয়ের নামে দেহ ব্যবসায় যা প্রকাশ্য জেনা, মদের ব্যবসা, ইয়াবার ব্যবসা, জুয়ার ব্যবসা ও সুদভিত্তিক ব্যাংকিং লেনদেনের নামে অবৈধ ব্যবসা ইত্যাদি। যে জিনিস হারাম তাকে কেন্দ্র করে ব্যবসা করাও হারাম। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, ‘হে মুমিনগণ! মদ, জুয়া, মূর্তিপূজার দেবী ও ভাগ্য নির্ণায়ক শর, ঘৃণ্য বস্তু শয়তানের কাজ।’ (সূরা মায়েদা,আয়াত:৯০) নূরনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, কুকুরের মূল্য, ব্যভিচারের বিনিময়, গণকের বখশিশ ভোগ করতে নিষেধ করেছেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস:২১২২; সহিহ মুসলিম, হাদিস:৪০৯২) হালাল বস্তু পরিহার করা অশোভনীয় : আল্লাহ মানুষের জন্য যা কিছু বৈধ করেছেন যা পরিহার করা মুমিনের জন্য শোভনীয় নয়। ইরশাদ হচ্ছে, ‘বলুন! আল্লাহ স্বীয় বান্দাদের জন্য যেসব শোভার বস্তু ও বিশুদ্ধ জীবিকা সৃষ্টি করেছেন তা কে হারাম করেছে? বলুন! পার্থিব জীবনে বিশেষ করে কিয়ামতের দিন এসব তাদের জন্য, যারা ঈমান আনে। ’ (সূরা আরাফ, আয়াত : ৩২) হালাল পরিহার বঞ্চিত হওয়ার নামান্তর : আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক হালালকৃত বস্তু পরিহার করা আল্লাহর অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত হওয়ারই নামান্তর। ইরশাদ হচ্ছে , ‘তারা তাদের ধারণা অনুসারে বলে, এসব গবাদি পশু ও শস্য ক্ষেত নিষিদ্ধ; আমি যাকে ইচ্ছা করি সে ছাড়া কেউ এসব আহার করতে পারবে না। ’ (সূরা আনআম, আয়াত : ১৩৮) মানুষের সন্তুষ্টির জন্য হালাল বস্তু বর্জন নয় : কোনো মানুষকে সন্তুষ্ট করার জন্য আল্লাহ যা বৈধ করেছেন তা পরিহার করার অবকাশ নেই। ইরশাদ হচ্ছে, ‘হে নবী, আল্লাহ আপনার জন্য যা বৈধ করেছেন আপনি তা নিষিদ্ধ করছেন কেন? আপনি তো আপনার স্ত্রীদের সন্তুষ্টি চাচ্ছেন, আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। ’ (সূরা তাহরিম, আয়াত : ১) হালাল-হারাম সম্পর্কের ঊর্ধ্বে : মহান আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত হালাল ও হারামের বিধান যেকোনো ধরনের সম্পর্ক ও সম্প্রীতির ঊর্ধ্বে। এ জন্য ইহুদি ধর্ম ত্যাগের পরও সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনে সালাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ও তাঁর সঙ্গীরা যখন শনিবারকে মর্যাদার চোখে দেখতেন এবং উটের গোশত খেতে অপছন্দ করতেন, তখন আল্লাহ তাআলা তাদের সতর্ক করে বললেন, ‘হে মুমিনগণ, তোমরা ইসলামে পূর্ণরূপে প্রবেশ করো এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ কোরো না। ’ (সূরা বাকারা, আয়াত : ২০৮; তাফসিরে তাবারি) হালাল বর্জনকারীদের প্রতি নূরনবীর হুঁশিয়ারি : যখন মদিনার একদল সাহাবি নিজেদের ওপর কঠোরতা আরোপ করেছেন এবং বৈধ জিনিস নিজেদের জন্য নিষিদ্ধ করেছেন বলে প্রকাশ পায়, তখন বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘সাবধান! চরমপন্থীরা ধ্বংস হয়েছে। তিনি এ কথা তিনবার বলেন। ’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ৪৬০৮) হালাল বস্তু কখন পরিহার করা বৈধ : কোনো হালাল বস্তুকে হালাল মনে করার পর যদি ইসলামে অনুমোদিত কোনো কারণে কেউ তা পরিহার করে, তাহলে তার অবকাশ আছে। যেমন— ১. সন্দেহযুক্ত হওয়া : কোনো হালাল বস্তু যদি সন্দেহযুক্ত হয় তাহলে তা পরিহারের সুযোগ আছে। কেননা রাসূলে আরবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন , ‘যে সন্দেহজনক জিনিস থেকে বেঁচে থাকবে সে নিজের দ্বীন ও সম্মানকে রক্ষা করবে। ’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫২) ২. চিকিৎসকের বারণ থাকা : যখন কোনো দ্বীনদার চিকিৎসক রোগীর জন্য কোনো হালাল বস্তু ক্ষতিকর মন্তব্য করেন, তখন তা পরিহার করা বৈধ। যেমন- ডায়েবেটিক রোগীর জন্য চিনি না খাওয়া। ৩. হারামের দিকে নিয়ে যাওয়ার ভয় থাকা : কোন হালাল জিনিস দ্বারা যদি কারো ভেতর মন্দ প্রবণতা তৈরির ভয় থাকে, তাহলে পরিহার করা বৈধ। যেমন—এমন ঝাঁঝালো পানীয় পরিহার করা, যা ব্যক্তিকে মদপানে উৎসাহিত করতে পারে। (হেদায়া, পানীয় অধ্যায়) ৪. স্বভাবজাত অপছন্দ : কোনো বস্তুকে নিজের ও অন্যের জন্য বৈধ মনে করার পরও ব্যক্তিগত অপছন্দের জন্য তা এড়িয়ে যাওয়া বৈধ। একদা নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত মায়মুনা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহার ঘরে গেলে তিনি রাসূলুল্লাহর সামনে ‘দব’ (গুইসাপ সদৃশ একটি মরুচারী প্রাণী) পেশ করেন। নবীজি তা থেকে হাত উঠিয়ে নিলে খালিদ বিন ওয়ালিদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, হে আল্লাহর রাসুল, দব খাওয়া কি হারাম? তিনি বলেন, না। কিন্তু যেহেতু এটা আমাদের এলাকায় নেই, তাই এটি খাওয়া আমি পছন্দ করি না। খালিদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি সেটা টেনে নিয়ে খেতে থাকলাম। আর হুযূর পুরনূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫৩৯১) আরবি প্রভাষক, তাজুশ শরীআহ মাদরাসা, ষোলশহর, চট্টগ্রাম। https://www.anjumantrust.org/2023/08/10/%E0%A6%B9%E0%A6%BE%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%B2-%E0%A6%B9%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%AE%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%AE%E0%A6%BF%E0%A6%B6%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%A3-%E0%A6%93-%E0%A6%B6%E0%A6%B0/