সমালোচনা,আত্মসমালোচনা ও আলেম—ওলামার মতানৈক্য : প্রাসঙ্গিক দুটি কথা

মানুষ হিসেবে আমরা সামাজিক পরিবেশে বসবাস করি। মিশতে হয় নানা মানসিকতার, নানা মতের মানুষের সাথে। আর যেখানে যত বেশি মানুষ, সেখানে ততবেশি মতামতের সমাগম ঘটে। সমালোচনা করা আমাদের এমন একটি নিয়মিত অভ্যাস যা থেকে বেঁচে থাকতে পারেন এমন ব্যক্তির সংখ্যা সমাজে খুবই কম, যা খুবই নিকৃষ্ট অভ্যাস। আর এটি শিষ্টাচারবিরোধী এবং অসামাজিক কার্যকলাপের অন্তর্ভুক্ত। যার দোষ বর্ণনা করা হচ্ছে, প্রকৃতপক্ষে যদি সেই দোষ তার মধ্যে থাকে তাহলে গীবত হিসেবে ধর্তব্য হবে। আর যদি না থাকে, তাহলে তা অপবাদ হিসেবে গণ্য হবে। অথচ অপবাদ গীবতের চেয়েও নিকৃষ্ট ও ঘৃণিত। পক্ষান্তরে পরচর্চা ও অতি প্রশংসা মানুষের ব্যক্তিত্বকে ক্ষুণ্ন করে, সমাজে বিশৃঙ্খলা তৈরি করে। তাই ইসলামে এমন বাড়াবাড়িমূলক কাজকেও খুবই নিন্দনীয় ও হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। অনুরুপভকবে আত্মপ্রশংসাও দোষের। মহান আল্লাহ বলেন, ‘অতএব তোমরা আত্মপ্রশংসা করো না, তিনিই সম্যক জানেন কে আল্লাহভীরু।’ আর মানুষ যদি আত্মসমালোচনায় প্রবৃত্ত হয়, তাহলে অন্য কারও তার কাজের সমালোচনা করার সুযোগ থাকে না। আত্মসমালোচনার আরেকটি ইতিবাচক দিক হলো ভবিষ্যৎ পথচলায় তা টর্চলাইটের কাজ করে। পথ চলতে টর্চের আলো যেমন পথিককে সঠিক পথের দিকনির্দেশ করে, আত্মসমালোচনাও একই ভুল দ্বিতীয়বার করা থেকে মানুষকে বিরত থাকতে সহায়তা করে। তাই বলা হয় সমালোচনা করার প্রথম ও প্রধান এবং উত্তম মাধ্যম হলো আত্মসমালোচনা করা। ইরশাদ হচ্ছে, يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوا اتَّقُوا اللهَ وَلْتَنْظُرْ نَفْسٌ مَا قَدَّمَتْ لِغَدٍ وَاتَّقُوا اللهَ إِنَّ اللهَ خَبِيْرٌ بِمَا تَعْمَلُوْنَ، وَلاَ تَكُونُوْا كَالَّذِيْنَ نَسُوا اللهَ فَأَنْسَاهُمْ أَنْفُسَهُمْ أُوْلَئِكَ هُمُ الْفَاسِقُوْنَ ‘ অর্থাৎ হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য উচিত আগামী কালের জন্য (অর্থাৎ আখিরাতের জন্য) সে কি প্রেরণ করেছে, তা চিন্তা করা। আর তোমরা তাদের মত হয়ো না, যারা আল্লাহকে ভুলে গিয়েছে, ফলে আল্লাহ তাদেরকে আত্মভোলা করে দিয়েছেন। নিশ্চয়ই তারা ফাসিক’ । ইমাম ইবনুল ক্বাইয়িম বলেন, এই আয়াতের মাধ্যমে রব্বে করিম প্রত্যেক মুমিনের জন্য আত্মসমালোচনাকে ওয়াজিব করে দিয়েছেন এবং পরের সমালোচনা বর্জন করার প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। পবিত্র কুরআনুল করিমে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন , তোমাদের অবশ্যই চিন্তা করা আবশ্যক যে, আগামী দিনের জন্য তুমি যা প্রেরণ করেছ তা তোমার জান্নাতের পথ সুগম করছে, না—কি তোমাকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে? অথচ মানুষ অপরের সমালোচনা করা, কে কোথায় কী করল? সেই চিন্তায় ব্যতিব্যস্ত থেকে দিনের একটি বড় অংশ ব্যয় করে। বস্তুত অন্যের সমালোচনা গর্হিত কাজ, যার কারণে আমলনামায় গুনাহ লেখা হয়। ইসলামে পরনিন্দা, পরচর্চা,অহেতুক সমালোচনা ও অনর্থক তিরস্কার যেমন নিষিদ্ধ, তেমনি সমাজ—সংস্কৃতি, গণমানুষের স্বার্থ, সর্বজনীন নীতিনৈতিকতা ও জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সঠিক সমালোচনাও শর্ত সাপেক্ষে অনুমোদিত। আলোচনা—সমালোচনায় বা উপদেশ প্রদানে কারও প্রতি অসম্মান, অশ্রদ্ধা, অভক্তি প্রকাশ বা প্রদর্শন এবং এসব উদ্রেকের সহায়ক হওয়া বৃহৎ পাপের কারণ। প্রকৃতপক্ষে বিকৃত সমালোচনা এবং ভুলভাবে উপদেশ প্রদান সমস্যা সমাধান করে না, বরং আরও বৃদ্ধি করে। সর্বোপরি সমালোচক পূর্বাপর সব পাপের ভাগীদার হন। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনুল করিমে ইরশাদ হচ্ছে, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা অনুমান হতে বেঁচে থাকো, নিশ্চয়ই ধারণা করা অনেক ক্ষেত্রেই পাপ; আর তোমরা অন্যের গোপন বিষয় সন্ধান কোরো না এবং পরের পশ্চাতে নিন্দা কোরো না। তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পছন্দ করবে? তোমরা তা ঘৃণাই করবে। তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, অল্লাহ তওবা গ্রহণকারী, পরম দয়ালু।’ তবে বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে প্রয়োজনের তাগিদে অন্যের দোষ—ত্রুটি বর্ণনা করার সুযোগ রয়েছে; যখন তা শরিয়ত—সমর্থিত হয়। যথা— ১.অন্যায় থেকে বাঁচতে: কারো জুলুম থেকে বাঁচার জন্য মজলুম ব্যক্তি, শাসকের কাছে জালিমের বিরুদ্ধে বিস্তারিত অভিযোগ করতে পারবে। এ ক্ষেত্রে তার যে দোষ রয়েছে তা সবিস্তারে তুলে ধরার অনুমতি আছে। ২.অসৎ কাজ থেকে বারণ করার জন্য : কাউকে অসৎ কাজ থেকে ফেরানোর জন্য কারো কাছে সাহায্য চাওয়ার ক্ষেত্রে ওই ব্যক্তির দোষ বর্ণনা করা জায়েয। ৩.ফতোয়া জানার জন্য: কোন বিজ্ঞ মুফতির কাছে মাসআলা জানতে চাওয়া, অর্থাৎ এভাবে বলা যে অমুক ব্যক্তি আমার ওপর অন্যায় করেছে, সে আমার প্রাপ্য কেড়ে নিয়েছে অথবা সে আমাকে ভালো কাজে বাধা দান করে। সে ক্ষেত্রে আমার করণীয় কী? এভাবে সুনির্দিষ্ট কোন ব্যক্তির ব্যাপারে জানতে চাওয়া বৈধ। তার খারাপ স্বভাবের ফিরিস্তি বয়ান করা যাবে। এ প্রসঙ্গে হযরত আয়েশা ছিদ্দিকা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেন, একদা মুআবিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর মা হিন্দা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামাকে বললেন, আবু সুফিয়ান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু একজন কৃপণ ব্যক্তি। এ অবস্থায় আমি যদি তার সম্পদ থেকে গোপনে কিছু গ্রহণ করি, তাতে কি গুনাহ হবে? তিনি বলেন, তুমি তোমার ও সন্তানদের প্রয়োজন অনুযায়ী ন্যায়ভাবে গ্রহণ করতে পারো। ৪.পরামর্শ চাওয়া: কেউ যদি পাত্র—পাত্রী নির্বাচন বা অন্য কোনো বিষয়ে পরামর্শ চায়, তাহলে প্রকৃত জিনিস বলতে অসুবিধা নেই। ফাতেমা বিনতে কায়স রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা যখন বিবাহের ব্যাপারে রাসূলে আরবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার কাছে পরামর্শ চেয়েছেন, তখন নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, মুআবিয়া তো একজন গরিব মানুষ, তার কোনো ধনসম্পদ নেই। আর আবু জাহম, সে তো স্ত্রীদের প্রহারকারী। তবে ওসামাকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করতে পারো। [উপর্যুক্ত হাদীস শরীফে আবু জাহম ও মুআবিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা—এর দোষ বর্ণনা করা হয়েছে] ৫. সাধারণ মুসলমানদের সতর্ক করার জন্য: যদি কোনো সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি কোনো ফাসেক ব্যক্তির সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করে, তাহলে সে ক্ষেত্রে ওই ব্যক্তিকে সতর্ক করার জন্য তার দোষ—ত্রুটি বর্ণনা করা বৈধ। যাতে সেই ফাসেক ব্যক্তির রোগ তার ভেতর সংক্রমিত না হয়, আর সে সম্মানিত ব্যক্তি তার সঙ্গে চলার কারণে অভিযুক্ত না হয়। কিংবা কেউ কোনো শ্রমিক ভাড়া নেয়, আর তার ভেতর যদি কোনো গোপন ত্রুটি থাকে, যেমন চুরি করা, খিয়ানত করা বা কোনো ব্যক্তি তার পণ্যে ভেজাল মিশ্রণ করে—তাহলে এসব বিষয়ে সেবা গ্রহণকারীকে বলতে সমস্যা নেই; বরং ক্ষেত্রবিশেষে বলা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। আত্মসমালোচনা হলো নিজের সমালোচনা অথার্ৎ নিজের ইহকালিন বা পরকালীন জীবনের ভালো—মন্দ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সংশোধন মূলক আলোচনা—পর্যালোচনা, চিন্তা—ভাবনা করাই আত্মসমালোচনা। যা জান্নাতী মানুষেদের গুণ, জান্নাতী সাহাবীর আমল। হযরত আনাস ইবনে মালেক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার দরবারে (মসজিদে নববীতে) উপবিষ্ট ছিলাম। এমতাবস্থায় তিনি বললেন, তোমাদের নিকট এখন একজন জান্নাতী মানুষ আগমন করবে। (বর্ণনাকারী বলেন) অতঃপর একজন সাহাবী আগমন করলেন। তাঁর দাড়ি থেকে সদ্যকৃত অযুর পানির ফোটা ঝরে পড়ছিল। তিনি তার বাম হাতে জুতা নিয়ে মসজিদে প্রবেশ করলেন। তার পরদিনও নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে অনুরূপ কথা বললেন এবং প্রথম দিনের মতো সেই সাহাবী যথা নিয়মে আগমন করলেন। যখন তৃতীয় দিন হল, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেই কথা আবার বললেন এবং যথারীতি সেই সাহাবী পূর্বের অবস্থায় আগমন করলেন। রাসূলে আরবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন আলোচনা শেষ করে উঠে দাঁড়ালেন তখন হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আছ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু সেই সাহাবীর অনুগামী হলেন। তিনি তাঁকে বললেন, আমি আমার পিতার সাথে ঝগড়া করে শপথ করেছি, তিনদিন পর্যন্ত তার ঘরে যাব না। এই তিনদিন আমাকে যদি আপনার ঘরে থাকার সুযোগ করে দিতেন, তবে আমি সেখানে থাকতাম। তিনি বললেন, হ্যাঁ,থাকতে পারেন। বর্ণনাকারী হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, তিনি (আবদুল্লাহ) তাঁর সাথে সেখানে সেই তিন রাত অতিবাহিত করলেন। তিনি তাঁকে রাতে উঠে তাহাজ্জুদ নামায পড়তে কিংবা বিশেষ কোন ইবাদত করতে দেখলেন না। তবে তিনি যখন ঘুমাতেন, বিছানায় পার্শ্ব পরিবর্তন করে আল্লাহর যিকির করতেন। হযরত আবদুল্লাহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, তাঁর মুখ থেকে কিন্তু ভালো কথা ছাড়া কোনো মন্দ কথা শুনিনি। যখন তিনদিন অতিবাহিত হয়ে গেল এবং তার আমলকে সাধারণ ও মামুলি মনে করতে লাগলাম, তখন তাঁকে বললাম, হে আল্লাহর বান্দা! আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আপনার সম্পর্কে তিনবার একথা বলতে শুনেছি যে, এখনই তোমাদের নিকট একজন জান্নাতী মানুষ আগমন করবে। উক্ত তিনবারই আপনি আগমন করেছেন। তাই আমি ইচ্ছা করেছিলাম আপনি কী আমল করেন তা দেখতে আপনার নিকট থাকব। যাতে আমিও তা করতে পারি। আপনাকে তো বেশি আমল করতে দেখিনি। তাহলে কোন গুণ আপনাকে এই মহান মর্যাদায় অভিসিক্ত করেছে, যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন? তিনি বললেন, আপনি যা দেখেছেন, ঐ অতটুকুই। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর রাদ্বিয়াল্লঅহু আনহু বলেন, যখন আমি ফিরে আসছিলাম তখন তিনি আমাকে ডাকলেন। তারপর বললেন, আমার আমল বলতে ঐ অতটুকুই, যা আপনি দেখেছেন। তবে আমি আমার অন্তরে কোনো মুসলমানের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করি না এবং আল্লাহ তাআলা কাউকে কোনো নেয়ামত দান করলে সেজন্য তার প্রতি হিংসা রাখি না। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর রাদ্বিয়াল্লঅহু আনহু বলেন, এ গুণই আপনাকে এত বড় মর্যাদায় উপনীত করেছে। আর সেটাই আমরা করতে পারি না। রব্বে করিম আত্মসমালোচনাকারীদের প্রসংশা করে বলেন, إِنَّ الَّذِيْنَ اتَّقَواْ إِذَا مَسَّهُمْ طَائِفٌ مِّنَ الشَّيْطَانِ تَذَكَّرُواْ فَإِذَا هُمْ مُّبْصِرُوْنَ— অর্থাৎ ‘যাদের মনে আল্লাহর ভয় রয়েছে তাদের উপর শয়তানের আগমন ঘটার সাথে সাথেই তারা সতর্ক হয়ে যায় এবং তখনই তাদের বিবেচনা শক্তি জাগ্রত হয়ে উঠে’ । আর এটি দু ধরনের। যথা— ১. নিজে নিজের সমালোচনা ২. পারষ্পরিক আলোচনা (আলেম/ দক্ষ—অভিজ্ঞ ব্যাক্তি)। এক্ষেত্রে হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু নিম্নোক্ত বাণীটি প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন— حَاسِبُوْا أَنْفُسَكُمْ قَبْلَ أَنْ تُحَاسَبُوْا، وَزِنُوْا أَنْفُسَكُمْ قَبْلَ أَنْ تُوْزِنُوْا. فَإِنَّّهُ أَهْوَنُ عَلَيْكُمْ فِيْ الْحِسَابِ غَدًا، أَنْ تُحَاسَبُوْا أَنْفُسَكُمُ الْيَوْمَ، وَتَزَيَّنُوْا لِلْعَرْضِ الأَكْبَرِ يَوْمَئِذٍ تُعْرَضُوْنَ لاَ تَخْفَى مِنْكُمْ خَافِيَةٌ অর্থাৎ ‘তোমরা নিজেদের আমলনামার হিসাব নিজেরাই গ্রহণ কর, চূড়ান্ত হিসাব দিবসে তোমাদের কাছ থেকে হিসাব গৃহীত হবার পূর্বেই। আর তোমরা তোমাদের আমলনামা মেপে নাও চূড়ান্ত দিনে মাপ করার পূর্বেই। কেননা আজকের দিনে নিজের হিসাব নিজেই গ্রহণ করতে পারলে আগামীদিনের চূড়ান্ত মুহূর্তে তা তোমাদের জন্য সহজ হয়ে যাবে। তাই সেই মহাপ্রদর্শনীর দিনের জন্য তোমরা নিজেদেরকে সুসজ্জিত করে নাও, যেদিন তোমরা (তোমাদের আমলসহ) উপস্থিত হবে এবং তোমাদের কিছুই সেদিন গোপন থাকবে না’। বস্তুত সৎকর্মশীল বান্দাগণ নিজেদের অবহেলার ব্যাপারে আত্মসমালোচনা করতেন, ভুলত্রুটির জন্য নিজেকে নিজে তিরস্কার করতেন, নিজের ‘নাফস’—এর জন্য তাকওয়ার বিষয়টিকে অপরিহার্য ও অবিচ্ছেদ্য বিষয় বলে ধারণ করতেন এবং তাকে নিজের খেয়াল—খুশি মত চলা থেকে বিরত রাখতেন। কারণ, আল্লাহ তা‘আলা বলেন: وَأَمَّا مَنۡ خَافَ مَقَامَ رَبِّهِۦ وَنَهَى ٱلنَّفۡسَ عَنِ ٱلۡهَوَىٰ فَإِنَّ ٱلۡجَنَّةَ هِيَ ٱلۡمَأۡوَىٰ অর্থাৎ “আর যে তার রবের অবস্থানকে ভয় করে এবং কুপ্রবৃত্তি হতে নিজকে বিরত রাখে; জান্নাতই হবে তার আবাসস্থল।” এ প্রসঙ্গে নবী করিম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন ্র الْكَيِّسُ مَنْ دَانَ نَفْسَهُ ، وَعَمِلَ لِمَا بَعْدَ الْمَوْتِ ، وَالْعَاجِزُ مَنِ أَتْبَعَ نَفْسَهُ هَوَاهَا ، وَتَمَنَّى عَلَى اللَّهِ . অর্থাৎ “বুদ্ধিমান সেই ব্যক্তি, যে তার নফসের হিসাব নেয় এবং মৃত্যুর পরবর্তী জীবনের জন্য কাজ করে; আর দুর্বল ঐ ব্যক্তি, যে নিজের নফসের কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ করে এবং আল্লাহর কাছেও আশা—আকাঙ্খা রাখে।” কেন আত্মসমালোচনা করবো: ১. নিজের দোষ—ত্রুটি নিজের সামনে প্রকাশ করার মাধ্যমে মানুষ স্বীয় ভুল—ত্রুটি জানতে পারে। ফলে তার হৃদয় ভাল কাজের দিকে আকৃষ্ট হয় এবং মন্দ কাজ থেকে দূরে থাকতে পারে। ২. আত্মসমালোচনা দ্বীনের উপর দৃঢ়তা অর্জনের সবচেয়ে কার্যকরী মাধ্যম, যা মানুষকে আল্লাহর দরবারে মুহসিন ও মুখলিছ বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করে। ৩. আত্মসমালোচনার মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর নে‘মতসমূহ, অধিকারসমূহ জানতে পারে। আর সে যখন আল্লাহর নে‘মত ও তার অবস্থান সম্পর্কে চিন্তা—ভাবনা করে, তখন সে আল্লাহর নে‘মতের শুকরিয়া আদায়ে উদ্বুদ্ধ হয়। ৪. আত্মসমালোচনার মাধ্যমে মানুষের মাঝে পরকালীন জওয়াবদিহিতার উপলব্ধি সৃষ্টি হয়। মাইমুন বিন মিহরান বলতেন, ‘মুত্তাক্বী ব্যক্তি সেই, যে নিজের জওয়াবদিহিতা এমন কঠোরভাবে গ্রহণ করে যেন সে একজন অত্যাচারী শাসক’। আত্মসমালোচনা না করার কুফল : ইবনুল ক্বাইয়িম বলেন, মুহাসাবা পরিত্যাগ করার অর্থ কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ করে চলা। এতে মানুষের অন্তর পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। অর্থাৎ মুহাসাবা পরিত্যাগ করার ফলে দ্বীনের প্রতি তার শিথিলতা চলে আসে, যা তাকে নিশ্চিতভাবেই দুনিয়াবী জীবন ও পরকালীন জীবনে ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়। কেবলমাত্র আত্মগর্বী, প্রতারিত আত্মাই মুহাসাবা পরিত্যাগ করতে পারে। ফলশ্রুতিতে সে কোন কিছুর পরিণাম চিন্তা করে না। সমস্ত পাপ তার কাছে অত্যন্ত সহজ বিষয় হয়ে যায়। অবশেষে একসময় পাপ থেকে বেরিয়ে আসাটা তার কাছে অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। কখনো যদি সে সৎপথের সন্ধান পায়ও, তবুও সে তার অন্যায় অভ্যাস থেকে বেরিয়ে আসা অত্যন্ত কঠিন বলে মনে করে। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ তাআলা বলেন— وَلَقَدۡ ذَرَاۡنَا لِجَهَنَّمَ کَثِیۡرًا مِّنَ الۡجِنِّ وَ الۡاِنۡسِ ۖ لَهُمۡ قُلُوۡبٌ لَّا یَفۡقَهُوۡنَ بِهَا ۫ وَ لَهُمۡ اَعۡیُنٌ لَّا یُبۡصِرُوۡنَ بِهَا ۫ وَ لَهُمۡ اٰذَانٌ لَّا یَسۡمَعُوۡنَ بِهَا ؕ اُولٰٓئِکَ کَالۡاَنۡعَامِ بَلۡ هُمۡ اَضَلُّ ؕ اُولٰٓئِکَ هُمُ الۡغٰفِلُوۡنَ অর্থাৎ আর আমি তো বহু জ্বিন ও মানুষকে জাহান্নামের জন্য সৃষ্টি করেছি; তাদের হৃদয় আছে, কিন্তু তা দিয়ে তারা উপলব্ধি করে না, তাদের চক্ষু আছে, কিন্তু তা দিয়ে তারা দর্শন করে না এবং তাদের কর্ণ আছে, কিন্তু তা দিয়ে তারা শ্রবণ করে না। এরা চতুষ্পদ জন্তুর ন্যায়; বরং তা অপেক্ষাও অধিক বিভ্রান্ত! তারাই হল উদাসীন। আলেম—ওলামার মতানৈক্যে করণীয়: তাঁরাই প্রকৃত আলেম, যাঁরা ইলম ও দ্বীনদারিতায় নির্ভরযোগ্য; যারা ইসলাম ও ইল্ম বিষয়ে মুসলিম উম্মাহকে হিতোপদেশ দিয়ে প্রসিদ্ধি অর্জন করেছেন। বিভিন্ন সময়ে ইসলামের নানান সূক্ষ্ম মাসআলা নিয়ে তাদের মধ্যে মতভেদ পরিলক্ষিত হয়। ফলে মানুষ হতাশ হয়ে পড়ে এবং বলে বসে, কুরআন এক হওয়া সত্ত্বেও আলেমদের মধ্যে বিভিন্ন মাসআলায় মতভেদ হয় কেন? প্রকৃতপক্ষে কুরআন ও হাদিস তো সবার সামনেই আছে, কিন্তু তারপরও বিভিন্ন মাসআলায় প্রতিটি যুগে বিজ্ঞ আলেমগণের মাঝে মতানৈক্য হয়েছে। এমনকি সাহাবায়ে কেরামের যুগেও মতভেদ হয়েছে। এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। মুলত মতানৈক্য হওয়ার কয়েকটি কারণ রয়েছে। যথা—প্রথমত: যিনি ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে মতভেদ করছেন তাঁর কাছে সঠিক দলিল পৌঁছেনি। অথবা দলিল পৌঁছেছে, কিন্তু যে পথে পৌঁছেছে তা তাঁর কাছে সন্তোষজনক নয়। যেমন—আমিরুল মুমিনিন হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু যখন সিরিয়া সফরে বের হলেন, তখন পথিমধ্যে খবর পেলেন, সেখানে প্লেগ রোগ বিস্তার লাভ করেছে। অতঃপর তিনি থেমে গিয়ে মুহাজির ও আনসারী সাহাবাদের সঙ্গে পরামর্শ করলেন যে, এখন সিরিয়া প্রবেশ করা উচিত হবে কি না? কারণ এই রোগটি ছিল সংক্রামক। কিন্তু এই বিষয়ে দুই পক্ষের সিদ্ধান্ত দুই ধরনের। একদল বললেন, ফিরে যাওয়া হোক। জেনে শুনে রোগের মুখে পড়া উচিত নয়। অন্যদল বললেন, সিরিয়ায় প্রবেশ করা হোক। কারণ, যা হওয়ার তা হবেই, ভয়ের কিছু নেই। আল্লাহর তাকদীর থেকে পালিয়ে যাওয়ার পথ নেই। অথচ এ ক্ষেত্রে তাঁদের ফিরে যাওয়াই যুক্তিযুক্ত ছিল। বর্ণনাকারী বলেন, এমন সময় আবদুর রহমান ইবনে আউফ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এলেন। তিনি এতক্ষণ যাবৎ তাঁর কোনো প্রয়োজনের কারণে অনুপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেন, এ ব্যাপারে আমার কাছে একটি তথ্য আছে, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামাকে বলতে শুনেছি, তোমরা যখন কোনো এলাকায় রোগ (প্লেগের) বিস্তারের কথা শোনো, তখন সেখানে প্রবেশ করো না। আর যদি কোনো এলাকায় এর প্রাদুর্ভাব নেমে আসে, আর তোমরা সেখানে থাকো, তাহলে সেখান থেকে বেরিয়ে যেয়ো না। বর্ণনাকারী বলেন, এরপর হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু আল্লাহর প্রশংসা করলেন, তারপর প্রত্যাবর্তন করলেন। দ্বিতীয়ত:এমনও হতে পারে যে, হাদীস ইমামের কাছে পৌঁছেছে বটে, কিন্তু তিনি তা ভুলে গেছেন। মানুষ হিসেবে ভুল হওয়াই স্বাভাবিক। একবার রাসূলে আরবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওমর ইবনে খাত্তাব ও আম্মার বিন ইয়াসের রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমাকে কোথাও প্রেরণ করলেন। সফরে তারা উভয়ে (স্বপ্নদোষ হওয়ার ফলে) অপবিত্র হয়ে যান। পবিত্রতার জন্য তাঁদের কাছে পানি ছিল না। আম্মার রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ইজতিহাদ করলেন, পানি যেমন দেহকে পবিত্র করে, তেমনি মাটিও পবিত্র করবে। ফলে তিনি পশু মাটিতে গড়াগড়ি দেওয়ার মতো গড়াগড়ি দিলেন। কারণ তিনি সারা শরীরে মাটি লাগানো জরুরি মনে করলেন এবং এভাবে পবিত্রতা অর্জন করে নামায আদায় করলেন। পক্ষান্তরে ওমর ইবনে জ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম নামাযই পড়লেন না। অতঃপর তাঁরা উভয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার কাছে উপস্থিত হয়ে ঘটনা জানালেন। এবং নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁদের তায়াম্মুমের নিয়ম শিখিয়ে দিলেন। কিন্তু অনেক দিন ওমর ইবনে খাত্তাব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এই ঘটনাটি সম্পূর্ণ ভুলে গিয়েছিলেন। এবং বড় নাপাকি থেকে পবিত্রতা অর্জনে তায়াম্মুম যথেষ্ট মনে করতেন না। এ বিষয়ে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমাও তাঁর অনুগামী ছিলেন। সুতরাং এই বিষয়ে অবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ ও আবু মুসা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমার মধ্যে মতভেদ হয়। আবু মুসা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হযরত আম্মারের এই ঘটনা তুলে ধরলেন, ইবনে মাসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বললেন, দেখো না, হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু তো আম্মাার রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর কথার সঙ্গে একমত হননি।’ তখন আবু মুসা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু তাঁকে বললেন, আম্মার রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর কথা ছাড়ো, সুরা মায়েদার তায়াম্মুম সম্পর্কীয় আয়াতের ব্যাপারে তোমার মতামত কী? তখন ইবনে মাসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু চুপ হয়ে গেলেন। তৃতীয়ত: ব্যাখ্যার ভিন্নতার কারণেও হতে পারে। একই আয়াত বা হাদিসের ব্যাখ্যা একেক জন একেকটি করেছেন। যেমন পবিত্র কুরআনুল করিমে ইরশাদ হচ্ছে, ‘আর যদি তোমরা অসুস্থ হও, অথবা সফরে থাকো, অথবা তোমাদের মধ্যে কেউ পায়খানা থেকে আসে, অথবা তোমরা স্ত্রী স্পর্শ করো এবং পানি না পাও, তাহলে পবিত্র মাটি অন্বেষণ করো।’ উপর্যুক্ত আয়াতে ‘স্ত্রী স্পর্শ’ কথাটির ব্যাখ্যায় বিজ্ঞ ওলামায়ে কেরামের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ স্পর্শ বলতে সাধারণ স্পর্শ বুঝেছেন। কেউ বুঝেছেন, যৌন উত্তেজনাসহ স্পর্শ। কেউ বুঝেছেন, স্পর্শ বলতে এখানে স্ত্রী সহবাস বুঝানো হয়েছে। এই মতটি ছিল হযরত ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর। বেশির ভাগ ওলামায়ে কেরাম এক্ষেত্রে আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমার মতই গ্রহণ করেছেন এবং এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে স্ত্রীকে যৌন উত্তেজনা নিয়ে স্পর্শ করলে অজু ভেঙে যায়, আর সঙ্গম করলে গোসল ফরয হয়। চতুর্থত: ইমামের কাছে যে হাদিসটি পৌঁছেছে পরবর্তী সময়ে তার হুকুম রহিত হয়ে গেছে। আর রহিতকারী হাদিসটি তিনি জানেন না। এ প্রসঙ্গে হযরত সাদ ইবনে আবু ওয়াক্কাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, আমরা প্রথমে রুকুতে দুই হাত একসঙ্গে মিলিয়ে দুই রানের মাঝখানে রাখতাম। কিন্তু পরে আমাদের এমনটি করতে নিষেধ করা হয়েছে এবং রুকুর সময় হাঁটুর ওপর হাত রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু অনেক দিন পর্যন্ত এই হাদিসটি না জানার কারণে তিনি রুকু করার সময় হাঁটুর মাঝখানেই হাত রাখতেন। তাই ওলামায়ে কেরামের মধ্যে কোনো বিষয়ে মতভেদ দেখলে তাতে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। বরং মতভেদপূর্ণ বিষয়ে সমস্যা হলে তা বুঝার জন্য সেসব বিষয়ে বিজ্ঞ আলেমদের সঙ্গে পরামর্শ করা আবশ্যক। ইরশাদ হচ্ছে— فَاسْأَلُوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِنْ كُنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ অর্থাৎ যদি কোন বিষয়ে তোমাদের জানা না থাকে, তবে জ্ঞানীদেরকে জিজ্ঞেস করে নাও। তবে মতানৈক্য হওয়াটা যে সর্বদা রহমত, তা নয়। হক জানার পর সে বিষয়ে মতভেদ করা নিন্দনীয়। এমতাবস্থায় সত্য বিষয়টি জানার পর তা গ্রহণ করে নেওয়াই জ্ঞানীর পরিচায়ক। আর নিজ মানহানী মনে করে তা গ্রহণ না করা কিংবা ইনডোর—আউটডোরে সমালোচনা করার মাধ্যমে বিভেদ সৃষ্টি করা পাপীষ্ঠ অভিশপ্ত শয়তানের বৈশিষ্ট্য। যারা আরবী ভাষায় বিশেষ ব্যুৎপত্তি রাখেন; কুরআন ও সুন্নাহ্ সম্পর্কিত যাবতীয় স্ত্রে দক্ষতা রাখেন যেমন ইমাম আযম আবূ হানীফা, ইমাম শাফেয়ী, ইমাম মালিক, ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল, আওযায়ী, ফকীহ আবুল্লাইস রহমাতুল্লাহি আলাইহিম প্রমুখ, আল্লাহ্ তা’আলা তাদেরকে নবুয়ত যুগের নৈকট্য এবং সাহাবী ও তাবেয়ীগণের সংসর্গের বরকতে শরীয়তের মূলনীতি ও উদ্দেশ্য বুঝার বিশেষ রুচি এবং বর্ণিত বিধানের ওপর অবর্ণিত বিধানকে অনুমান করে শরীয়তসম্মত নির্দেশ বের করার অসাধারণ দক্ষতা দান করেছিলেন। আর এ জাতীয় ইজতিহাদী মাস’আলায় সাধারণ আলিমদের পক্ষেও কোন না কোন একজন মুজতাহিদ ইমামের তকলীদ করা অপরিহার্য। মুজতাহিদ ইমামদের মতের বিরুদ্ধে কোন নতুন মত অবলম্বন করা মারাত্মক ভুল। এ কারণেই যুগ যুগ ধরে আলিম, মুহাদ্দিস ও ফিকাহবিদগণ যেমন ইমাম গাযযালী, রাযী, তিরমিযী, তাহাভী, মুযানী, ইবনে হুসাম, ইবনে কুদামা এবং এই শ্রেণীর পূর্ববর্তী ও পরবর্তী আলিমগণ আরবী ভাষা ও শরীয়ত সম্পর্কে গভীর পাণ্ডিত্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও ইজতিহাদী মাস’আলাসমূহে সর্বদা মুজতাহিদ ইমামদের তকলীদ করে গেছেন। তাঁরা উপর্যুক্ত ইমামের বিপরীতে নিজমতে কোন ফতোয়া দেওয়াকে বৈধ মনে করেননি। ইমামগণের মত ও পথের বাইরে, তাঁদের সবার বিরুদ্ধে কোন মত আবিষ্কার করাকে তাঁরা কখনও বৈধ মনে করতেন না। অতঃপর ক্রমান্বয়ে জ্ঞানের মাপকাঠি সংকুচিত হতে থাকে এবং তাকওয়া ও আল্লাহভীতির পরিবর্তে মানবিক স্বার্থপরতা প্রাধান্য বিস্তার করতে থাকে। এমন পরিস্থিতিতে যদি কোন মাস’আলায় যে—কোন ইমামের উক্তি গ্রহণ করার এবং অন্য মাস’আলায় অন্য ইমামের উক্তি গ্রহণ করার স্বাধীনতা দেওয়া হয়, তবে এর অবশ্যম্ভাবী পরিণতিতে মানুষ শরীয়ত অনুসরণের নামে প্রবৃত্তির অনুসারী হয়ে যাবে। যে ইমামের উক্তিতে সে নিজ প্রবৃত্তির স্বার্থ পূর্ণ হতে দেখবে সেই ইমামের উক্তিকেই গ্রহণ করবে। বলা বাহুল্য; এরূপ করার মধ্যে ধর্ম ও শরীয়তের অনুসরণ হবে কম এবং স্বার্থ ও প্রবৃত্তির অনুসরণ হবে বেশি। অথচ দ্বীন ও শরীয়তের অনুসরণ না করে স্বার্থ ও প্রবৃত্তির অনুসরণ করা উম্মতের ইজমা দ্বারা হারাম সাব্যস্ত। এ কারণে পরবর্তী ফিকাহবিদগণ এটা জরুরী মনে করেছেন যে, আমলকারীদের ওপর কোন একজন ইমামেরই তকলীদ করা বাধ্যতামূলক করে দেওয়া উচিত। এখান থেকেই ব্যক্তিভিত্তিক তকলীদের সূচনা হয়। এটা প্রকৃতপক্ষে একটি শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা। এর উদ্দেশ্য দ্বীনি ক্ষেত্রে শৃঙ্খলাকে প্রতিষ্ঠিত রাখা এবং মানুষকে দ্বীনের আড়ালে প্রবৃত্তির অনুসরণ থেকে বাঁচিয়ে রাখা। যেমন রোগী হাকীম ও ডাক্তারদের মধ্য থেকে কোন একজনকেই চিকিৎসার জন্য নির্দিষ্ট করাকে জরুরী মনে করে। কারণ, সে যদি নিজ মতে এক সময় এক ডাক্তারের কাছে জিজ্ঞেস করে ওষুধ পান করে এবং অন্য সময় অন্য ডাক্তারের পরামর্শে ঔষধ সেবন করে, তবে এটা তার স্বাস্থেও জন্য ক্ষতিকর এবং ধ্বংসের কারণ হয়। অতএব সে যখন একজন ডাক্তারকে চিকিৎসার জন্য মনোনীত করে, তখন এর অর্থ কখনও এরূপ হয় না যে, অন্য ডাক্তার পারদর্শী নয় কিংবা চিকিৎসা করার যোগ্যতা রাখে না। প্রতিষ্ঠিত চার মাজহাব (হানাফী, শাফেয়ী, মালেকী ও হাম্বলী) এর অনুসরণের বিষয়টিও ঠিক তেমনি। পক্ষান্তরে একে দলাদলির রঙ দেওয়া এবং পারস্পরিক কলহ ও মতানৈক্য সৃষ্টিতে মেতে ওঠা দ্বীনের কাজ নয় এবং অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন আলিমগণ কোন সময় একে সুনজরে দেখেননি। কোন কোন আলিমের আলোচনা পারস্পরিক বিতর্কের রূপ ধারণ করে, যা পরে তিরস্কার ও ভর্ৎসনার সীমা পর্যন্ত পৌঁছে যায়। সুপ্রিয় পাঠক! যদি ওলামায়ে কেরামের মাঝে কোন আমলগত বিষয়ে মতানৈক্য পরিলক্ষিত হয়, সেক্ষেত্রে বিজ্ঞ আলেমগণের পক্ষ থেকে পরামর্শ হল, যে সত্যিকার আলেমেদ্বীনকে আপনার ভাল লাগে, যার প্রতি আস্থা হয় তাঁকে অনুসরণ করুন। তাঁর সান্নিধ্যে থাকুন। তাই বলে আপনার আস্থাবাজন নয় এমন আলেম কিংবা প্রতিপক্ষের কোন সমালোচনা করা যাবেনা। প্রতিপক্ষকে অপমান— অপদস্থ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। এমন কোন কাজ করা যাবেনা, যার ফলশ্রম্নতিতে ওলামায়ে কেরামের উপর তোহমত চলে আসে, বা তাঁদের গীবত —শেকায়েতের দ্বার উম্মোচিত হয়। পক্ষান্তরে কোন জ্ঞানপাপী যদি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আকায়েদ ও মতাদর্শের বিপরীত কোন কার্যকলাপে লিপ্ত হয়, এমতবস্থায় সে পিএইচডি ডিগ্রিধারি হলেও তার অনুসরণ ও অনুকরণ করা যাবে না। এ প্রসঙ্গে হুযূর পুরনূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, পাপ কাজের আদেশ না করা পর্যন্ত ইমামের কথা শোনা ও তাঁর আদেশ মান্য করা অপরিহার্য। তবে পাপ কাজের আদেশ করা হলে তা শোনা ও আনুগত্য করা যাবে না। আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত আমাদেরকে আইম্মায়ে সালফে সালেহীনের পদাংক অনুসরণ করার তাওফিক দান করুক। আমীন, বিহুরমাতি সৈয়্যিদিল মুরসালিন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। লিখক: আরবী প্রভাষক, তাজুশ শরী’আহ দরসে নিযামী মাদরাসা,ষোলশহর,চট্টগ্রাম; খতিব, রাজানগর রাণীরহাট ডিগ্রি কলেজ মসজিদ, রাঙ্গুনিয়া,চট্টগ্রাম। মোবাইল:০১৯৩৭৩০৫৪৫৫