নন্দিত কিংবদন্তি ইমাম ও ঘৃণিত স্বৈরাচারী শাসক

নবী বংশের অনন্য উজ্জ্বল নক্ষত্র এবং বিলায়তের এক নির্যাসের নাম ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু। যিনি ছিলেন বহু সদগুণের আধার। একাধারে সাহাবীয়ে রাসূল,আহলে বায়তে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অন্যতম সদস্য,জান্নাতী যুবকদের সরদার। এছাড়াও খোদাভীতি, ইবাদত—বন্দেগী, দানশীলতা, পরোপকারীতা ও উত্তম চরিত্রে তিনি ছিলেন কিংবদন্তি মহামানব। চতুর্থ হিজরির শা'বান মাসের ৪র্থ দিবস মঙ্গলবার শুভক্ষণে (৮ জানুয়ারি ৬২৬খ্রি:) কুরাইশ রাজবংশের বনু হাশেম গোত্রে মাওলা আলী শেরে খোদা ও ফাতেমা বিনতে রাসূল রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমার ঔরশে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি দরবারে রিসালত ও বেলায়তের কেন্দ্রস্থলে লালিত পালিত হয়ে একজন যুগশ্রেষ্ঠ আলেমে দ্বীন এবং মুহাদ্দিসে রূপান্তরিত হন। তিনি দিন—রাত ইবাদতে লিপ্ত থাকতেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত সাহসী, দৃঢ় মনোবলের অধিকারী, অকুতোভয় সৈনিক। জিহাদের ডাকে প্রয়োজনের মুহূর্তে সাড়া দিতে কখনো পিছপা হতেন না তিনি। ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ইয়াজিদকে কেন সমর্থন করেননি: সাহাবীয়ে রাসূল হযরত আমীরে মুয়াবিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ওফাতকালে তাঁর পুত্র ইয়াজিদকে আহলে বায়তসহ বনি হাশেমের সকলের সাথে সদাচারণের ওসিয়ত করেন। কিন্তু ৬০ হিজরীতে ইয়াজিদ ক্ষমতাসীন হওয়ার পর সেই ওসিয়ত বাস্তবায়ন করার পরিবর্তে চতুর্দিকে চিঠি লিখে বায়আত গ্রহণের বার্তা পাঠায়। ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তার হাতে বায়াত গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানান। কারণ ইয়াজিদ ছিল দুশ্চরিত্রের, বেনামাজি ও মদ্যপায়ী। এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যোবাইর রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমা বলেন, ইয়াজিদ এক প্রতারক, মাতাল ও সত্য পথ পরিত্যাগকারী এবং এমন এক ব্যক্তি যে গায়িকা নারীদের সঙ্গে থাকে। ইমাম যাহাবী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, ইয়াজিদ ছিল ঘৃণ্য নাসিবি তথা আহলে বাইত—বিদ্বেষী। সে মদ পান করত ও পাপাচারে লিপ্ত ছিল। ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে শহীদ করার মাধ্যমে সে তার রাজত্ব শুরু করে এবং মক্কা ও মদীনায় মহাবিপর্যয় ঘটায়। তাই লোকেরা তাকে ঘৃণা করত। ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর শাহাদতের ঘটনার পর মদীনার অনেকেই আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্যই ইয়াজিদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে তুলে নেয়। এমনকি ইয়াজিদের দোসর ইবনে জিয়াদও মক্কায় হামলা চালানোর ব্যাপারে ইয়াজিদের হঠকারী নির্দেশে ক্ষুব্ধ হয়ে বলেছিল, আল্লাহর শপথ! এক ফাসিকের জন্য আমি দু’টি বিষয় সমন্বিত করব না। আমি এরিমধ্যে নবীর কন্যার সন্তানকে হত্যা করেছি। আর এখন সে (ইয়াজিদ) আমাকে বায়তুল হারামে যুদ্ধ বাধাতে বলছে। কুসতুনতুনিয়া—বিষয়ক হাদীসের অপব্যাখ্যার অপনোদন: হযরত উম্মে হারাম রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছেন,‘নৌযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী আমার সাহাবীদের প্রথম দলটি বেহেশতী হবে। এ প্রসঙ্গে ইমাম তাবারী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, আবদুর রহমান বিন খালেদ বিন ওয়ালিদের সেনাপতিত্বে ৪৪ হিজরী সালে প্রথম মুসলিম বাহিনী রোমে (কনস্টানটিনোপোল) প্রবেশ করেন এবং সেখানে গযওয়া সংঘটিত হয়। ৪২ থেকে ৪৯ হিজরিতে সেখানে ছয়টি অভিযান চালায় মুসলিম মুজাহিদ বাহিনী। আর ইয়াজিদকে কথিত অভিযানে প্রেরণ করা হয় ৫০ হিজরিতে এবং তা ছিল সপ্তম অভিযান। বস্তুত ইয়াজিদ মুসলিম বাহিনীকে ব্যঙ্গ—বিদ্রুপ করেছিল বলে শাস্তি হিসেবে মুয়াবিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তাকে যুদ্ধে পাঠিয়েছিল। অর্থাৎ যুদ্ধ করার জন্য তাকে পাঠানো হয়নি বরং শাস্তি হিসেবে সাময়িক নির্বাসনের মধ্যে সময় কাটানোর জন্য। সুতরাং নির্ভরযোগ্য ইতিহাস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, ইয়াজিদ ক্ষমা প্রাপ্তির শুভ সংবাদ সক্রান্ত হাদীসে অন্তর্ভুক্ত নয়। কেননা, ইয়াজিদ কসতুনতুনিয়ার যে যুদ্ধে শরীক ছিল তার পূর্বেও কসতুনতুনিয়ায় মুসলিম সেনাবাহিনী বেশ কয়েকবার হামলা করেছিলেন। পরিশেষে বলা যায়, ইয়াযীদ যেমন অভিশপ্ত তেমনি ইয়াযীদীরাও অভিশপ্ত,নির্লজ্জ ও অবিবেচক। আর যারা ইয়াযীদের পক্ষে সাফাই গায় তারা ইসলামের দুশমন। ইয়াযীদ কোন মতেই কুসতুনতুনিয়া—বিষয়ক হাদীসের সুসংবাদের আওতায় আসবে না। সে ক্ষমা পাবার উপযোগীও নয়। পক্ষান্তরে হযরত ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু সত্যের উপর ছিলেন। তিনি ইয়াযীদ ও ইয়াযীদের বাতিল খিলাফতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে শহীদ হয়ে ইসলামের গৌরবকেই অক্ষুন্ন রেখেছেন। সুপ্রিয় ঈমানদার ভাইয়েরা! ইমামে আলী মকাম, ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর প্রতি আমাদের ভালবাসা কেমন? আমরাও একটু ভাবি— মুহাররামুল হারামের দশম রজনী ইমাম আলী মকামের জীবনের শেষ রাত ছিলো, কিন্তু আল্লাহ পাকের ইবাদতের প্রতি তাঁর আগ্রহ দেখুন! আর একেবারে শাহাদতের মুহুর্তেও তিনি আল্লাহ তায়ালার দরবারে সিজদা অবস্থায় ছিলেন। সুতরাং আমরা ইমাম হুসাইনের গোলামরাও যেনো আমাদের মাহবুবের পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলে ইবাদত ও রিয়াযত করে নিজের জীবনের দিন রাত অতিবাহিত করে চলি। মনে রাখবেন! হাদীসে পাকে বর্ণিত রয়েছে: বান্দা তারই সাথে হবে, যাকে সে ভালবাসবে, যদি আমরা মুখে ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে ভালবাসার দাবী করে থাকি কিন্তু ইমামে আলী মকামের চরিত্র অনুসরন না করি তবে আমাদের সেই ভালবাসা অর্থহীন। রব্বে করিম আমাদের ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর পদাংক অনুসরণ করার তাওফিক দান করুন। লিখক: আরবি প্রভাষক, তাজুশ শরী'আহ দরসে নিযামী মাদরাসা,ষোলশহর, চট্টগ্রাম; খতিব,রাজানগর রাণীরহাট ডিগ্রি কলেজ জামে মসজিদ, রাঙ্গুনিয়া, চট্টগ্রাম।