জুমার খুতবা -১৩: আল্লাহর ওলি কারা, কি তাদের বৈশিষ্ট্য

মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মাসুম অলী শব্দ আরবি, এটি একবচন, বহুবচন আউলিয়া, এর কয়েকটি অর্থ রয়েছে ১. বন্ধু, ২. নৈকট্য ধন্য, ৩.সাহায্যকারী, ৪. অনুগত ইত্যাদি। পরিভাষায় শরিয়ত ও তরিকত উভয়ই পালন করে যিনি মারিফত ও হকিকত লাভ করেন, তিনিই হচ্ছেন যথার্থ অলি। যিনি আল্লাহভীরু এবং আল্লাহর উপদেশ-নির্দেশ যথাযথভাবে মেনে চলেন, তিনিই অলি। কোনো কোনো সময় আল্লাহর কৃপায় তাঁর কেরামত প্রকাশ পায়, যদিও তিনি তা গোপন রাখতেই সচেষ্ট থাকেন। হযরত শাহ আবদুল আযীয মুহাদ্দেস দেহলভী রহমাতুল্লাহি আলাইহির বর্ণনা মতে প্রকৃত শায়খ বা মুরশিদগন মুরাকাবা মুশাহাদার মাধ্যমে মহান আল্লাহর পবিত্র সত্তার নূর বা জ্যোতি প্রাপ্ত হন। তাঁদের সান্নিধ্যে এলে আল্লাহর স্মরণ অন্তরে জাগ্রত হয়। আত্না পরিশুদ্ধ হয়। পবিত্র কুরআনে তাঁদের মর্যাদা ও পরিচয় সম্পর্কে আলোকপাত হয়েছে, মহান আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেছেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহর অলীদের অতীত ও ভবিষ্যতের কোন চিন্তা নেই। যারা ঈমান এনেছে এবং তাকাওয়া অবলম্বন করেছে ইহকাল ও পরকালে তাদের জন্য রয়েছে সুসংবাদ। (আল কুরআন, সূরা: ইউনুস, আয়াত: ৬২-৬৪) বর্ণিত আয়াতে অলীদের দুটি বিশেষ গুণ বর্ণিত হয়েছে, প্রথমত: তাঁরা হবেন পূর্ণাঙ্গ মুমিন, তাঁদের জীবনাদর্শ হবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক মনোনীত শরীয়তের পরিপূর্ণ অনুসরণের প্রতিচ্ছবি। দ্বিতীয়ত: তাঁরা হবেন তাকওয়ার গুণে গুণান্বিত। খোদাভীতি অর্জন ও আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে সকল প্রকার মন্দ ও শরীয়া বিবর্জিত কর্ম থেকে নিজেদেরকে মুক্ত রাখা অলীদের অন্যতম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। হযরত আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আল্লাহর অলী সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে নবীজি ইরশাদ করেন, যাঁদের দর্শনে আল্লাহর স্মরণ হয়। (নাসাঈ শরীফ, হাদীস ১১২৩৫) হযরত আসমা বিনতে ইয়াযিদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, আমি কি তোমাদেরকে তোমাদের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদের সংবাদ দিব না? তাঁরা বললেন হ্যাঁ, ইয়া রাসূলাল্লাহ! নবীজি ইরশাদ করেন, তোমাদের মধ্যে শ্রেষ্ট হলেন তাঁরা যাঁদের দেখলে মহান আল্লাহর স্মরণ হয়। (ইবনে মাযাহ, হাদীস নং: ৪১১৯, মুসনাদে আহমদ: হাদীস : ২৭৬৪০)বর্ণিত হাদীস শরীফ দ্বয়ে প্রকৃত আল্লাহর অলীদের পরিচয় ব্যক্ত হয়েছে। সুতরাং আল্লাহর অলী তাঁরাই যাঁদের সুহবতে বসলে যাদের প্রদশির্ত পথে চললে, মানুষ আল্লাহর দ্বীনের পথিক হয়ে যায়। বদকার মানুষ নেককার হয়ে যায়, বেনামাযী নামাযী হয়ে যায়। অসৎ মানুষ সৎ ও আদর্শ মানুষে পরিণত হয়। আউলিয়ায়ে কেরামের সাথে সম্পর্ক স্থাপনকারী সহীহ বিশুদ্ধ আক্বিদার অনুসারী তরীক্বতের শায়খ পীর মুর্শিদের প্রদর্শিত পথে জীবন পরিচালনাকারী ব্যক্তিবর্গ অন্যায় ও অনৈতিক শরীয়ত পরিপন্থি কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত থাকতে পারেনা। এ প্রসঙ্গে মুসলিম শরীফে বর্ণিত হাদীসে এসেছে, অলীগণ এমন শ্রেণিভূক্ত সম্প্রদায় যাঁদের সুহবত অর্জনকারী তাদের মজলিসে অবস্থানকারী ব্যক্তিগন পাপী থাকেনা আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হয় না। [(মুসলিম শরীফ, খ.৭, পৃ: ১৯৯ ইফা) আল কাউলুল জামীল কৃত: শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী (র.), পৃ: ৬০] যে ব্যক্তি আল্লাহর বন্ধুতে পরিণত হয়। তার কোনো চিন্তা নেই বলে ঘোষণা দিয়েছেন আল্লাহ তাআলা। আবার তাদের পুরস্কারও ঘোষণা করেছেন তিনি। আল্লাহ তাআলা বলেন-لَهُمُ الْبُشْرَى فِي الْحَياةِ الدُّنْيَا وَفِي الآخِرَةِ لاَ تَبْدِيلَ لِكَلِمَاتِ اللّهِ ذَلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُতাদের জন্য দুনিয়ার জীবন ও পরকালীন জীবনে রয়েছে সুসংবাদ। আল্লাহর কথার কখনো রদবদল হয় না। এটাই হল মহা সফলতা।’ (সুরা ইউনুস : আয়াত ৬৪) ওলি হওয়ার পন্থা : এ বিষয়ে মুজাদ্দিদ- ই- আলফি সানী বলেন: আল্লাহ তা’আলার নৈকট্য প্রদানকারী আমলসমূহ দুই প্রকার। প্রথম প্রকার ফরয কার্যসমূহ, দ্বিতীয় প্রকার নফল কার্যাবলী। নফল আমলসমূহের ফরযের সহিত কোনোই তুলনা হয় না। নামায, রোযা, যাকাত, যিকর, মোরাকাবা ইত্যাদি যে কোনো নফল ইবাদত হউক না কেন এবং তাহা খালেছ বা বিশুদ্ধভাবে প্রতিপালিত হউক না কেন, একটি ফরয ইবাদত তাহার সময় মতো যদি সম্পাদিত হয়, তবে সহস্র বৎসরের উক্তরূপ নফল ইবাদত হইতে তাহা শ্রেষ্ঠতর। বরং ফরয ইবাদতের মধ্যে যে সুন্নাত, নফল ইত্যাদি আছে, অন্য নফলাদির তুলনায় উহারাও উক্ত প্রকার শ্রেষ্ঠতব রাখে। ... অতএব, মুস্তাহাবের প্রতি লক্ষ্য রাখা এবং মাকরূহ যদিও উহা ‘তানজিহী’ হয় তাহা হইতে বিরত থাকা যিকর মোরাকাবা ইত্যাদি হইতে বহুগুণে শ্রেষ্ঠ, মাকরূহে তাহরীমির কথা কী আর বলিব ! অবশ্য উক্ত কার্যসমূহ (যিকর মোরাকাবা) যদি উক্ত আমলসমূহের (ফরয, মুস্তাহাব পালন ও সকল মাকরূহ বর্জনের) সহিত একত্রিত করা যায়, তবে তাহার উচ্চ-মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হইবে, অন্যথায় মেহনত বরবাদ।”(মাকতুবাত শরীফ ১/১ মাকতুব ২৯, পৃষ্ঠা ৫৭–৫৮) তাই একজন মুমিনের কাজকে প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুই ভাগে বিভক্ত করেছেন। তাহলো-- প্রথমত : বান্দা আল্লাহর ফরজ বিধানগুলো যথাযথ পালন করবে।- দ্বিতীয়ত : ফরজ বিধান পালনের পাশাপাশি নফল ইবাদত-বন্দেগিতে আত্মনিয়োগের মাধ্যমে বেলায়েত তথা আল্লাহর বন্ধুত্ব অর্জন করবে। হাদীসে কুদসীতে ইরশাদ হচ্ছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আল্লাহ বলেছেনঃ مَنْ عَادَى لِي وَلِيًّا فَقَدْ آذَنْتُهُ بِالْحَرْبِ وَمَا تَقَرَّبَ إِلَيَّ عَبْدِي بِشَيْءٍ أَحَبَّ إِلَيَّ مِمَّا افْتَرَضْتُ عَلَيْهِ وَمَا يَزَالُ عَبْدِي يَتَقَرَّبُ إِلَيَّ بِالنَّوَافِلِ حَتَّى أُحِبَّهُ فَإِذَا أَحْبَبْتُهُ كُنْتُ سَمْعَهُ الَّذِي يَسْمَعُ بِهِ وَبَصَرَهُ الَّذِي يُبْصِرُ بِهِ وَيَدَهُ الَّتِي يَبْطِشُ بِهَا وَرِجْلَهُ الَّتِي يَمْشِي بِهَا وَإِنْ سَأَلَنِي لَأُعْطِيَنَّهُ وَلَئِنْ اسْتَعَاذَنِي لَأُعِيذَنَّهُ “যে ব্যক্তি আমার কোনো ওলীর সাথে শত্রুতা করে আমি তার সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করি। আমার নৈকট্য অর্জন বা ওলী হওয়ার জন্য বান্দা যত কাজ করে তন্মধ্যে সবচেয়ে আমি বেশি ভালবাসি যে কাজ আমি ফরয করেছি। (ফরয কাজ পালন করাই আমার নৈকট্যে অর্জনের জন্য সর্বপ্রথম ও সবচেয়ে প্রিয় কাজ)। এরপর বান্দা যখন সর্বদা নফল ইবাদত পালনের মাধ্যমে আমার বেলায়তের পথে অগ্রসর হতে থাকে তখন আমি তাকে ভালবাসি। আর যখন আমি তাকে ভালবাসি তখন আমি তার শ্রবণযন্ত্রে পরিণত হই, যা দিয়ে সে শুনতে পায়, আমি তার দর্শনেন্দ্রিয় হয়ে যাই, যা দিয়ে সে দেখতে পায়, আমি তার হাত হয়ে যাই, যদ্দ্বারা সে ধরে বা আঘাত করে এবং আমি তার পা হয়ে যাই, যদ্দ্বারা সে হাঁটে। সে যদি আমার কাছে কিছু প্রার্থনা করে তাহলে আমি অবশ্যই তাকে তা প্রদান করি। সে যদি আমার কাছে আশ্রয় চায় তাহলে আমি অবশ্যই তাকে আশ্রয় প্রদান করি।” (মুয়াত্তা মালেক;সহীহ বুখারী, কিতাবুর রিকাক, হাদীস: ৬৫০২) ওলির বৈশিষ্ট্য : এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ তায়ালা সূরা মায়েদায় ইরশাদ করেন, তোমাদের বন্ধু কেবল আল্লাহ ও তাঁর রাসূল আর মুমিনগণ, যারা সালাত কায়েম করে, যাকাত প্রদান করে এবং আল্লাহর নিকট অবনত হয়। আর আল্লাহ ও তাঁর রাসূল আর মুমিনদেরকে বন্ধু রূপে গ্রহন করে, নিশ্চয়ই সেটি আল্লাহর দল, আর তারাই বিজয়ী হবে। (সূরা মায়েদাহ, ৫৫-৫৬) এ প্রসঙ্গে আয়াতসমুহের আলোকে নিম্নোক্ত বৈশিষ্ট্যাবলী নির্ধারণ করা যায়। যথা- ১. যে আল্লাহর আদেশ নিষেধগুলো মনে রাখে ২. যে সব ভালো কাজের প্রতিদান আল্লাহর কাছে আশা করে ৩. যে আল্লাহর পথে দান করে, সালাত, যাকাত আদায় করে, বিপদে বা অভাবের সময় সবর করে। ৪. যে সিয়াম পালন করে ৫. যে আল্লাহর ভয়ে হজ্জ করে ৬. যে ন্যায়নীতির সাথে সম্পত্তি বন্টন করে ৭. যে ওয়াদা রক্ষা করে এবং অসৎকাজ থেকে দূরে থাকে ৮. অসৎকাজে বাধা দেয় এবং সৎ কাজে লিপ্ত থাকে ৯. নিজের অনেক সমস্যার পরও জিহাদে সাড়া দেয় ১০. শালীন ও সুন্নাহসম্মত পোশাক পড়ে ১১. যারা ভুল/পাপ কাজ করলেও আত্মসমালোচনা ও তাওবাহ করে ১২. যারা কাফেরদের সাথে করা চুক্তি পূরন করে ১৩. আল্লাহর পথে যারা জিহাদ করে ১৪. যারা জিহাদ থেকে সরে আসার বাহানা খুজেনা ১৫. যারা ইসলামের শত্রুদের প্রতি কঠোর ১৬. যারা সবর করে ১৭. যারা আল্লাহকে ভয় করে ১৮. যারা পরিবারকে সালাতের হুকুম দেয় ১৯. যারা পশু কুরবানী দেয় ২০. যারা নিজেদেরকে অন্যদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ বলে ঘোষণা দেয়না ২১. যারা নিচু কন্ঠোস্বরে কথা বলে ২২. যারা অশ্লীলতা ও কবিরা গুনাহ থেকে বেচে থাকে