জুমার খুতবা -১৩: ইসলামের পূর্ণ অনুশীলন

জুমার খুতবা : ইসলামের পূর্ণ অনুশীলন আলোচনায় : মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মাসুম আরবি প্রভাষক ও ইসলামী গবেষক মানুষের চিন্তা-ভাবনা, আদর্শ, মতবাদ, জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিক্ষা, আচরণ, ব্যবহারিক জীবন, লেনদেনসহ মানুষের জীবনের সব প্রচেষ্টা ও কর্মের পরিসরকে পুরোপুরি ইসলামের কর্তৃত্বাধীন করা আবশ্যক। জীবনের কিছু অংশে ইসলামি অনুশাসন মেনে চলা আর কিছু অংশে ইসলামি অনুশাসনের বাইরে না থাকা। আর এ কারণেই আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে পরিপূর্ণভাবে ইসলামে প্রবেশ করার কথা বলেছেন। ইরশাদ হচ্ছে, يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ ادْخُلُواْ فِي السِّلْمِ كَآفَّةً وَلاَ تَتَّبِعُواْ خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِ إِنَّهُ لَكُمْ عَدُوٌّ مُّبِينٌ‘ অর্থাৎ হে ঈমানদার গন! তোমরা পরিপূর্ণভাবে ইসলামের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও এবং শয়তানের পদাংক অনুসরণ কর না। নিশ্চিত রূপে সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ২০৮) কেননা, শুধু কতগুলো আক্বিদা-মতাদর্শ অথবা গুটি কয়েক বিধি-বিধান পালনের নাম ইসলাম নয়; বরং ইসলাম হচ্ছে একটি সার্বজনীন স্বীকৃত জীবন ব্যবস্থা। যা মানব জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে তার শাখা-প্রশাকা বিস্তৃত।সুতরাং ইসলামে কিছু বিধি-বিধান পালন করা আর কিছু ছেড়ে দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। উপরোক্ত আয়াতে ওইসব লোকদেরকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে, যারা ইসলাম গ্রহণ করা সত্ত্বেও ভুলবশতঃ ইসলামের পাশাপাশি অন্য ধর্মের কিছু কিছু বিধান মেনে চলতো।হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুসহ অধিকাংশের মতে, এ আয়াতটি হজরত আবদুল্লাহ ইবনে সালাম, আসাদ ইবনে ওবায়েদ সা’লাবা প্রমুখ ব্যক্তিদের সম্পর্কে নাজিল হয়েছে।তাঁরা ইসলাম গ্রহণের পরও পূর্ববর্তী ইয়াহুদি ধর্মের ন্যায় শনিবারের পবিত্রতায় বিশ্বাস করতো। ইয়াহুদিদের জন্য হারাম করা উটের গোশতকে ইসলাম গ্রহণের পরও নিজেদের জন্য উটের গোশতকে হারাম মনে করতো।তাঁদের ধারণা ছিল, ইসলামে উটের গোশত খাওয়া আবশ্যক বা ফরজ নয়। অতএব আমরা যদি শনিবারের প্রতি সম্মান প্রদশন করি এবং উটের গোশত হালাল মনে করে তা বর্জন করি, তাহলে উভয় দিকই রক্ষা পায়।অর্থাৎ দ্বীন ইসলামও ঠিক থাকবে আবার হজরত মুসা আলাইহিস সালামের শরিয়তের প্রতিও শ্রদ্ধাবোধ থাকবে। তখনই আল্লাহ তাআলা উপরোক্ত আয়াত নাজিল করেন। আয়াতের হুকুম হলো-কোনো ধরনের ব্যতিক্রম ও সংরক্ষণ ছাড়াই, কিছু অংশকে বাদ না দিয়ে এবং কিছু অংশকে সংরক্ষিত না রেখে জীবনের সমগ্র পরিসরটাকে ইসলামে আওতাধীন করা। প্রত্যেককে ইসলামে পরিপূর্ণভাবে প্রবেশ করতে হবে। শয়তানের পদাংক অনুসরণ করা থেকে বিরত থাকতে হবে।  আধুনিক মনস্ক’ কিছু ভাইয়ের মুখে এ প্রশ্নটি প্রায়ই শোনা যায় যে ‘সব জায়গায় ইসলাম টেনে আনেন কেন?’ কয়েক ধরনের মানুষ এ ধরনের প্রশ্ন তোলে। এক. অমুসলিম (ইসলাম ছাড়া অন্য ধর্মে বিশ্বাসী)। দুই. নাস্তিক। তিন. বংশগতভাবে মুসলিম (ধর্ম-কর্মের ধার ধারে না)। চার. ছদ্মবেশী মুসলিম (সুবিধা বুঝে ইসলাম পালন, নয়তো গোপনে বিরোধিতা)। পাঁচ. ইসলাম বিদ্বেষী। সব জায়গায় ইসলাম টেনে আনেন কেন—এ প্রশ্নের সহজ-সরল জবাব হলো, প্রথমে ‘সব জায়গা’ কথাটির পরিধি নির্ধারণ করতে হবে। আপনি কি ‘সব জায়গা’র ভেতরে আছেন? যদি না থাকেন, তাহলে এ প্রশ্ন করার অধিকার আপনার নেই। আর হ্যাঁ, একজন মুসলমান, যিনি আমৃত্যু আল্লাহর আনুগত্য পালনে অঙ্গীকারবদ্ধ, তার ‘সব জায়গা’য় ইসলাম থাকবে—এটিই স্বাভাবিক। ইসলামের বিধান কোনো অমুসলিমের জন্য নয়। ইসলামের বিধান কোনো নাস্তিকের জন্য নয়। ইসলামের বিধান কোনো নামধারী মুসলিমের জন্য নয়। ইসলামের বিধান কোনো ছদ্মবেশী কিংবা ইসলামবিদ্বেষীর জন্য নয়। যে ইসলাম মানে না, তার জন্য ইসলাম নয়। ইসলামের বিধান শুধু ওই ব্যক্তির জন্য, যে আল্লাহকে রব হিসেবে মেনে নিয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামাকে নবী ও রাসল হিসেবে মেনে নিয়েছে। আমৃত্যু আল্লাহর ইবাদত করার অঙ্গীকার করেছে। শয়নে-স্বপনে, গোপনে- প্রকাশ্যে, আলোকে-আঁধারে, ছোট থেকে বৃহত্—সব কাজে যে আল্লাহকে স্মরণ করে, ইসলাম তার জন্য। যে নিজেকে আল্লাহর কাছে সঁপে দিয়েছে, ইসলাম তার জন্য। যে দুনিয়ার জীবন থেকে পরকালের জীবনকে প্রাধান্য দেয়, ইসলাম তার জন্য। ইরশাদ হচ্ছে, বলে দাও, আমার নামাজ, আমার কোরবানি, আমার জীবন ও মরণ বিশ্বজাহানের রব আল্লাহর জন্য। ’ (সুরা: আনআম, আয়াত: ১৬২) ইসলামকে খন্ডিতভাবে অনুসরণ করার কারণে কোরআনে মুসলমানের যেই পরিণতির কথা বলা হয়েছে, মুসলমান সেই পরিণতি ভোগ করতেছে। সুতরাং ইহকালে পরকালে শান্তি ও সফলতা অর্জন করতে চাইলে ইসলাম ও রাসুলে পাক (সা.) কে পরিপূর্ণভাবে অনুসরণ করতে হবে। মুমিন মুসলমান এক আল্লাহর ওপর বিশ্বাস করে। তার সন্তুষ্টি অর্জনে দিনরাত ইবাদত-বন্দেগি তথা দিনের সিয়ম (রোজা) রাতের কিয়াম তথা তারাবিহ-তাহাজ্জুদে মগ্ন থাকে। পারস্পরিক লেনদেন, আচার-ব্যবহার, স্বভাব-আচরণ প্রকাশেও থাকে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের প্রচেষ্টা। জীবন পরিচালনায় হাদিসের আমল হবে এমন-রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, হে আনাস! তোমার পক্ষে যদি সম্ভব হয়, তুমি সকাল-সন্ধ্যা এমনভাবে অতিবাহিত করবে, তোমার অন্তরে কারও প্রতি কোনোরূপ বিদ্বেষ থাকবে না। তাহলে তুমি তাই কর। (এটাই তোমার জন্য কল্যাণকর)। কারণ এমন ধারণা পোষণ করা আমার সুন্নত। যে আমার সুন্নতকে জিন্দা করে সে যেন আমাকেই ভালোবাসে। আর যে আমাকে ভালোবাসে সে পরকালে আমার সঙ্গে জান্নাতে থাকবে।’ (জামে তিরমিযি) বলা হয়েছে, ইসলামের কল্যাণময়ী বিধানের প্রতি অবহেলার কারণে প্রতিটি ক্ষেত্রে মানুষের অশান্তি আর অস্থিরতা সীমাহীনভাবে বাড়বে। মানুষ পৃথিবী নামক গ্রহকে বসবাসের অনুপযোগী মনে করতে শুরু করছে। কারণ শ্রেষ্ঠজীব মানুষের বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থানের বিকল্প নেই। কিন্তু নিত্য প্রয়োজনীয় এসব জিনিসপত্রের মূল্য ঊর্ধ্বগতির পরিপ্রেক্ষিতে জনজীবন অতিষ্ঠ। দ্রব্যমূল্যের পাগলাঘোড়া ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে তো ছুটছেই। দৈনন্দিন পারিবারিক চাহিদা মেটাতে পরিবার প্রধানরা হিমশিম খাচ্ছেন। মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত এবং অস্বচ্ছল জনসাধারণ কষ্টের গ্লানি সহ্য করতে না পেরে কেউ অসৎ পন্থা অবলম্বন করছে আবার কেউ আত্মহত্যা করছে। অনেকেই নিজের দুগ্ধপোষ্য সন্তান বিক্রি করে পাগল হয়ে পথে পথে ঘুরছে বলেও গণমাধ্যমে খবর বিরেয়েছে। এমন অবস্থা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এমন অবস্থা পরিবর্তনে দরকার রাসুলের আদর্শের অনুসরণ ও ইসলামকে মেনে চলা। আল্লাহতায়ালা আমাদের তাওফিক দান করুন। আমিন বিজাহিন নবিয়্যিল আমিন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।