জুমার খুতবা-১২: প্রিয়নবীর অনুপম চরিত্র

মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মাসুম রাসূলে আরবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন অনুপম চরিত্র ও মহানুভবতার একমাত্র আধার। পিতা-মাতা, স্বামী-স্ত্রী, প্রতিবেশী সবার অকৃত্রিম শিক্ষণীয় আদর্শ ও প্রাণপ্রিয় ব্যক্তিত্ব নবী করিম (সা.) একাধারে সমাজসংস্কারক, ন্যায়বিচারক, সাহসী যোদ্ধা, দক্ষ প্রশাসক, যোগ্য রাষ্ট্রনায়ক এবং সফল ধর্মপ্রচারক। কল্যাণকর প্রতিটি কাজেই তিনি সর্বোত্তম আদর্শ। তাঁর অসাধারণ চারিত্রিক মাধুর্য ও অনুপম ব্যক্তিত্বের স্বীকৃতি দিতে গিয়ে কুরআনুল কারিমে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, اِنَّكَ لَعَلي خُلُقٍ عَظِيْمٍ ‘নিশ্চয় আপনি মহান চরিত্রের অধিকারী’। (সুরা ক্বালাম : আয়াত ৪) অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে, لقد کان لکم فی رسول اللہ اسوۃ حسنۃ ‘তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসুলের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ।’ (সূরা আল-আহজাব, আয়াত: ২১) আল্লাহ তাআলা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চরিত্রের সার্টিফিকেট বিশ্বনবী নিজেই তাঁর চরিত্রের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, اِنَّمَا بُعِثْتُ لِاُتَمِّمَ مَكَارِمَ الْاَخْلَاقِ ‘আমি তো প্রেরিত হয়েছি উত্তম চরিত্রের পরিপূর্ণতা বিধানের জন্য।’ (কানযুল উম্মাল) রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চরিত্র সম্পর্কে উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি সংক্ষিপ্ত অথচ অত্যন্ত ব্যাপক অর্থবহ শব্দে বলেন, كَانَ خُلُقُهُ الْقُرْأَنَ – ‘তাঁর চরিত্র ছিল আল-কুরআন।’ অর্থাৎ কুরআন মাজিদে যে সকল উত্তম চরিত্র ও মহান নৈতিকতার উল্লেখ রয়েছে সে সবই তাঁর মাঝে বিদ্যমান ছিল। কুরআনের বর্ণিত চরিত্র অপেক্ষা উত্তম চরিত্র আর কী হতে পারে? তিনি ছিলেন পবিত্র কুরআনি চরিত্রমালার জীবন্ত প্রতীক।ঘ. সর্বযুগের ইসলামিক স্কলারগণ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চারিত্রিকগুণের গবেষণায় এ কথা বলতে বাধ্য হয়েছিলেন যে, তাঁর সততা ও নবুয়্যতের জন্য কোনো মু’যিযা যদি নাও দেয়া হতো, শুধুমাত্র তাঁর সুমহান চরিত্রই নবুয়্যতের সত্যতা প্রমাণের জন্য যথেষ্ট ছিল। এমনকি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রহমতি বরকতি আকার-আকৃতিতেও এ কথার প্রমাণ হয়ে যেত যে, তিনি একজন সত্যবাদী নবি ও রাসুল। রাসুলুল্লাহ (ﷺ)-এর দানশীলতা: عَنِ ابْنِ الْمُنْكَدِرِ، سَمِعَ جَابِرَ بْنَ عَبْدِ اللَّهِ، قَالَ مَا سُئِلَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم شَيْئًا قَطُّ فَقَالَ لاَ ইবনুল মুনকাদির সূত্রে, তিনি জাবির ইবনু আবদুল্লাহ (রাঃ)কে বলতে শুনেছেন, তিনি বলেন- “রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে কেউ কিছু চাইলে কোনো দিন তিনি ‘না’ বলেন নি।” (সহীহ বুখারী: ৫৬৮৭ কিতাবুল আদাব, সহীহ মুসলিম:২৩১১ কিতাবুল ফাযাইল, মু’জামুল আওসাত: ১৩৬১, সুনানে দারেমী:৭০, মুছান্নাফে ইবনে আবি শাইবাহ:৪৭০৫) عَنْ أَنَسٍ، أَنَّ رَجُلاً، سَأَلَ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم غَنَمًا بَيْنَ جَبَلَيْنِ فَأَعْطَاهُ إِيَّاهُ فَأَتَى قَوْمَهُ فَقَالَ أَىْ قَوْمِ أَسْلِمُوا فَوَاللَّهِ إِنَّ مُحَمَّدًا لَيُعْطِي عَطَاءً مَا يَخَافُ الْفَقْرَ ‏.‏ فَقَالَ أَنَسٌ إِنْ كَانَ الرَّجُلُ لَيُسْلِمُ مَا يُرِيدُ إِلاَّ الدُّنْيَا فَمَا يُسْلِمُ حَتَّى يَكُونَ الإِسْلاَمُ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِنَ الدُّنْيَا وَمَا عَلَيْهَا আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে এসে দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী ছাগলগুলো চাইলে তিনি তাকে তা দিয়ে দিলেন। তারপর সে ব্যক্তি তার সম্প্রদায়ের কাছে ফিরে গিয়ে বললো, হে আমার জাতি (ভাইয়েরা)! তোমরা ইসলাম গ্রহণ কর। আল্লাহর কসম! মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এত বেশি দান করেন যে, তিনি অভাবের ভয় করেন না। আনাস (রাঃ) বলেন, এমন হত যে, মানুষ দুনিয়ার উদ্দেশ্যে মুসলমান হত। সে কিন্তু ইসলাম গ্রহনের পরেই (তার অবস্থা এমন হত) তার কাছে দুনিয়া ও দুনিয়ার সমস্ত সম্পদের চেয়ে ইসলামই অধিক প্রিয় হয়ে যেত। (সহীহ মুসলিম:২৩১২, সুনানুল কুবরা: ১২৮১৯, মুসনাদে ইমাম আহমাদ: ১৩৩১৯) নবী (ﷺ) এর দয়া ও বিনয়: عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، أَنَّ الأَقْرَعَ بْنَ حَابِسٍ، أَبْصَرَ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم يُقَبِّلُ الْحَسَنَ فَقَالَ إِنَّ لِي عَشَرَةً مِنَ الْوَلَدِ مَا قَبَّلْتُ وَاحِدًا مِنْهُمْ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ‏ “‏ إِنَّهُ مَنْ لاَ يَرْحَمْ لاَ يُرْحَمْ ‏ আবূ হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আকরা ইবনু হাবিস (রাঃ) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে দেখলেন যে, তিনি (ইমাম) হাসান (রাঃ) কে চুম্বন করছেন। তখন আকরা ইবনু হাবিস (রাঃ) বলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমার দশটি সন্তান রয়েছে। আমি তাদের কাউকে চুম্বন করি নি। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ যারা দয়া করে না তাদের প্রতি (আল্লাহ কর্তৃক) দয়া করা হয় না। (মুসলিম:২৩১৮, বুখারী:৫৬৫১, আবু দাউদ:৫২১৮, সুনানুল কুবরা, তিরমিযী:১৯১১, মুসনাদে আহমাদ, মুছান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক:২০৫৮৯) যারবী (রহঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আনাস ইবনু মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু-কে বলতে শুনেছি যে, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে আসার উদ্দেশ্যে এক বৃদ্ধ এল। কিন্তু উপস্থিত লোকজন তাকে পথ করে দিতে দেরী করে। তখন নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যে ব্যক্তি আমাদের ছোটদের দয়া করে না আর বড়দের শ্রদ্ধা করে না সে আমাদের নয়। (তিরমিযী: ১৯১৯) আবদুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন যে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, রহমশীলদের প্রতি রহমানও রহম করেন। তোমরা পৃথিবীবাসীদের প্রতি রহম করবে তাহলে আকাশবাসী তোমাদের উপর রহম করবেন। রেহেম হল রাহমান শব্দ থেকে উদগত। যে ব্যাক্তি রেহেমের বন্ধন মিলাবে আল্লাহ্‌ তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক রাখবেন আর যে ব্যাক্তি রেহেমের বন্ধন ছিন্ন করবে আল্লাহও তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করবেন। (তিরমিযী:১৯২৪) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের কাজ নিজেই সম্পন্ন করতেন: عَنِ الأَسْوَدِ، قَالَ سَأَلْتُ عَائِشَةَ مَا كَانَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم يَصْنَعُ فِي بَيْتِهِ قَالَتْ كَانَ يَكُونُ فِي مِهْنَةِ أَهْلِهِ ـ تَعْنِي خِدْمَةَ أَهْلِهِ ـ فَإِذَا حَضَرَتِ الصَّلاَةُ خَرَجَ إِلَى الصَّلاَةِ‏.‏ আসওয়াদ (রাযি.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি ‘আয়িশাহ্ (রাযি.)-কে জিজ্ঞেস করলাম, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘরে থাকা অবস্থায় কী করতেন? তিনি বললেন, ঘরের কাজ-কর্মে ব্যস্ত থাকতেন। অর্থাৎ পরিবারবর্গের সহায়তা করতেন। আর সালাতের সময় হলে সালাতের জন্য চলে যেতেন। (বুখারী: ৬৪৪, ৫৬৯২, সুনানুল কুবরা:৩০৭৯, তিরমিযী: ২৪৮৯, মুসনাদে আহমাদ:২৩৭০৬, ২৪৪২৭) অপর হাদীসে এসেছে- ‘আয়িশা (রাযি.)-কে একব্যক্তি জিজ্ঞেস করলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘরে থাকা অবস্থায় কি কোনো কাজ করতেন? তিনি বলেন: হা। তিনি জুতা ও কাপড় সেলাই করতেন, আর তিনি ঘরের কাজ-কর্ম করতেন যেমন তোমাদের মধ্য থেকে কেউ তার ঘরে কাজ করে। (মুসনাদে আহমাদ: ২৪৮১৩, মুছান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক: ২০৪৯২) আমরাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আয়েশা (রাঃ) কে জিজ্ঞেস করা হলো, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘরে অবস্থানকালে কি করতেন? জবাবে তিনি বললেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন একজন মানুষ। তিনি তাঁর কাপড় সেলাই করতেন, ছাগল দোহন করতেন এবং নিজের কাজ নিজেই সম্পন্ন করতেন।( শামায়েলে তিরমিযী, মুসনাদে আহমাদ: ২৫৬৬২) সেবকের সাথে অনন্য আচরণ : আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি ১০ বছর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর খেদমত করেছি; কিন্তু এ সময়ের মধ্যে তিনি কখনো আমার কোন কাজে ’উহ’ শব্দটি পর্যন্ত করেননি। আমি করেছি এমন কোন কাজের ব্যাপারে তিনি কখনো জিজ্ঞেস করেননি যে, কেন করেছি? আর না করার ব্যাপারেও তিনি কখনো জিজ্ঞেস করেননি যে, কেন করোনি? চরিত্র মাধুর্যে তিনি ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ। কোন রেশমী কাপড় বা কোন বিশুদ্ধ রেশম বা অন্য কোন এমন নরম জিনিস স্পর্শ করিনি, যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হাতের তালুর চেয়ে নরম। আমি এমন কোন মিশক বা আতরের সুবাস পাইনি, যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ঘামের ঘ্রাণ হতে অধিক সুগন্ধিময়।) শারহুস সুন্নাহ, হা/৩৬৬৪; দারেমী, হা/৬২; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৩০৫৭; সহীহ ইবনে হিব্বান, হা/২৮৯৪) নবী (ﷺ) ছিলেন অধিক লজ্জাশীল: عَنْ قَتَادَةَ، قَالَ سَمِعْتُ عَبْدَ اللَّهِ بْنَ أَبِي عُتْبَةَ، يَقُولُ سَمِعْتُ أَبَا سَعِيدٍ الْخُدْرِيَّ، يَقُولُ كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم أَشَدَّ حَيَاءً مِنَ الْعَذْرَاءِ فِي خِدْرِهَا وَكَانَ إِذَا كَرِهَ شَيْئًا عَرَفْنَاهُ فِي وَجْهِهِ ‏.‏ কাতাদা রহ. বলেন, আব্দুল্লাহ ইবনে আবি উতবা বলতেন, তিনি আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ)কে বলতে শুনেছেন। তিনি বলেন: রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্দানশীন কুমারীর চেয়েও বেশি লজ্জাশীল ছিলেন। আর যখন তিনি কোন বস্তুকে অপছন্দ করতেন, আমরা তাঁর চেহারা মুবারক থেকে তা অনুভব করতে পারতাম। (বুখারী: ৩৩৬৯, মুসলিম: ২৩২০, সুনানুল কুবরা:২০১৭৮, ইবনে মাজাহ:৪১৮০, মুসনাদে আহমাদ: ১১৩৩৯, মুছান্নাফে ইবনে আবি শাইবাহ: ৩৪৮৮) عن عبد الله بن عمرو رضي الله عنهما قال لم يكن النبي صلى الله عليه وسلم فاحشا ولا متفحشا وكان يقول إن من خياركم أحسنكم أخلاقا আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রা. বলেন- নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অশ্লীল ছিলেন না এবং অশ্লীল কথা বলতেন না। আর তিনি (নবী স.) বলতেন: “তোমাদের মধ্যে উত্তম সেই ব্যক্তি, যার চরিত্র ভাল।” (বুখারী:৩৩৬৬) সহীহ মুসলিমে এসেছে- মাসরুক (রহঃ) থেকে বর্নিত। তিনি বলেন, আমরা আবদুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) এর নিকট গিয়েছিলাম যখন মুআবিয়া (রাঃ) কুফায় এসেছিলেন। মুআবিয়া (রাঃ) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্বন্ধে বর্ণনা দিয়ে বললেন, তিনি অশ্লীল ছিলেন না এবং অশ্লীল কথা বলতেন না। মুআবিয়া (রাঃ) আরো বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমাদের মধ্যে উত্তম সে ব্যক্তি, যার চরিত্র ভাল। (মুসলিম:২৩১৯) আবূ আবদুল্লাহ আল-জাদালী (রাহঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চরিত্র-মাধুর্য সম্বন্ধে আইশা (রাঃ)-কে প্রশ্ন করলাম। তিনি বললেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো অশ্লীল ও কটুভাষী ছিলেন না, অশ্লীল ব্যবহারও করেননি। তিনি কখনো বাজারে গিয়ে হউগোল করতেন না এবং অন্যায়ের দ্বারা অন্যায়ের প্রতিশোধ নেননি। বরং তিনি উদার মন নিয়ে ক্ষমা করে দিতেন। (তিরমিযী: ২০১৬) স্বাবলম্বী রাসূল : তিনি ছিলেন বহুলাংশেই স্বাবলম্বী। নিজের প্রয়োজনে কারও ওপর নির্ভরশীল হতেন না। নিজ হাতে জুতা মেরামত করতেন, কাপড় সেলাই করতেন, দুধ দোহন করতেন। সেবকদের কাজে সহায়তা করে আটা পিষতেন। নিজ হাতে রুটি তৈরি করে পরিবার-পরিজনকে নিয়ে খেতেন। নিজে হাটবাজার থেকে সওদা করে নিয়ে আসতেন। পরিবারের কেউ কোনো কাজের সহায়তা কামনা করলে তখনই সাহায্যের জন্য সাড়া দিতেন। তাঁর পারিবারিক কার্যকলাপ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) বাড়িতে অবস্থানকালে পরিবারের কল্যাণমূলক কাজে নিয়োজিত থাকতেন। যখন নামাজের সময় হতো তখন তিনি নামাজের জন্য উঠে যেতেন।’ হজরত আনাস (রা.) বলেছেন, ‘পরিবারের প্রতি অধিক স্নেহপ্রবণ হিসেবে নবী করিম (সা.) থেকে বেশি অগ্রগামী আমি আর কাউকে দেখিনি। তিনি দিবারাত্রির সময়টুকু তিন ভাগে ভাগ করে নিতেন। এক ভাগ ইবাদত-বন্দেগি করতেন। অন্য ভাগ পরিবার-পরিজনের গৃহকর্মের যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করতেন। আর এক ভাগ সময় তিনি নিঃস্ব-দুস্থজনদের জনসেবায় ব্যয় করতেন। কোনো জরুরি অবস্থা দেখা না দিলে সাধারণত এ নিয়মের ব্যত্যয় ঘটত না। কোরআন হাদিসে উত্তম চরিত্র অর্জন ও নৈতিক জীবনযাপনের বহু পুরস্কারের বিবরণ রয়েছে। এর কয়েকটি হলো— ১. উত্তম চরিত্র মানুষকে জান্নাতে পৌঁছে দেবে আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করা হলো, কোন আমল জান্নাতে প্রবেশের জন্য বেশি সহায়ক হবে? মহানবী (সা.) বলেন, ‘আল্লাহর ভয় ও উত্তম চরিত্র।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ২০০৪) ২. নেকের পাল্লায় সবচেয়ে ভারী হবে উত্তম চরিত্র আবু দারদা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘কিয়ামতের দিনে উত্তম চরিত্রের চেয়ে অন্য কিছু পাল্লায় বেশি ভারী হবে না।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ২০০৩) ৩.ঈমানের পূর্ণতা আসে সচ্চরিত্রের মাধ্যমে আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘ঈমানের হিসাবে সর্বোত্তম মুমিন সেই যে চরিত্রের দিক দিয়ে সর্বোত্তম।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ৭৪০২) ৪. উত্তম চরিত্র নবী (আ.)-এর অন্যতম মিশন চারিত্রিক পূর্ণতা দানকে রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর অন্যতম নববী মিশন হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয়ই আমি চারিত্রিক গুণাবলি পরিপূর্ণ করার জন্য প্রেরিত হয়েছি।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ৮৯৩৯) ৫. উত্তম চরিত্র উত্তম ইবাদতের সমতুল্য উত্তম চরিত্রের দ্বারা মুমিন নিয়মিত রোজা রাখা ও তাহাজ্জুদ আদায় করার মর‌্যাদা অর্জন করবে। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয়ই মুমিন উত্তম চরিত্রের দ্বারা স্থায়ী রোজাদার ও তাহাজ্জুদ আদায়কারীর মর‌্যাদা অর্জন করে।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ৪৮০০)  ৬. সর্বোত্তম জান্নাতে ঘর লাভ আবু উমামা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সুসংবাদ হলো—যে তার চরিত্র সুন্দর করবে আমি সর্বোত্তম জান্নাতে তার জন্য ঘরের জামিনদার হব।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ৪৮০২) ৭. মহানবী (সা.)-এর নৈকট্য লাভ জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয় কিয়ামতের দিনে তোমাদের মধ্যে আমার বেশি প্রিয় এবং আমার মজলিসের বেশি নিকটবর্তী তারাই থাকবে যারা তোমাদের ভেতর সর্বোত্তম চরিত্রবান।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ২০১৮)