Header Ads

Header ADS

তিনশত বছরের ঐতিহ্য ও দক্ষিণ চট্টগ্রামের আলোকবর্তিকা ফয়জুল বারী ফাযিল মাদরাসা



মুহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মাসুম    

দক্ষিণ চট্টগ্রামের  ঐতিহ্যবাহী  প্রাচীন দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ফয়জুল বারী ফাযিল মাদরাসা। কর্ণফুলী থানাধীন শাহমীরপুর গ্রামের প্রসিদ্ধ জমিদার মুন্সী মৌলভী ফয়েজ আলী চৌধুরী ১৮৩১ সালে এ মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। মুন্সী ফয়েজ আলী ছিলেন ব্রিটিশ শাসনামলে ফার্সি ভাষায় পারদর্শী বিজ্ঞ মুসলমান। তাঁর পূর্বপুরুষ সপ্তদেশ শতকে সুদূর আরবদেশ থেকে আগত  সূফীসাধক হযরত আতাউদ্দীন খন্দকার রহমাতুল্লাহি আলাইহি। তিনি তৎসময়ে খন্দকার হিসেবে স্থানীয় মুসলমানদের মাঝে দ্বীনি শিক্ষার তালিম দিতেন।ফলশ্রুতিতে তাঁর সুখ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর পৌত্র মুন্সী মৌলভী ফয়েজ আলী চৌধুরী। তিনি একদা জমিদার গৃহ নির্মাণের জন্য মনস্থির  করেন এবং এ বিষয়ে তার সমবয়সী কর্ণফুলীর  বড়উঠান গ্রামের প্রখ্যাত জমিদার শের আলী খাঁর পিতা আনোয়ার আলী খাঁর সাথে পরামর্শ করলে, তিনি ” তুমি যদি উপযুক্ত ছেলে না রেখে যেতে পার তাহলে জমিদার গৃহে বটবৃক্ষের চারা গজিয়ে উঠতে পারে ” বলে সতর্ক করেন। পরবর্তীতে তিনি  জমিদার গৃহ নির্মাণের সংকল্প পরিত্যাগ করে শহরে থেকে নিজ গৃহে ফেরার পথে শিকলবাহানিবাসী স্বীয় বন্ধু মাওলানা আবদুল বারী রহমাতুল্লাহি আলাইহির সাথে সাক্ষাত করে মাদরাসা প্রতিষ্ঠার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত করেন এবং  তাঁকে মাদরাসা পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণের জন্য আবেদন জানান। মাওলানা আবদুল বারী রহমাতুল্লাহি আলাইহি তাঁকে আশ্বস্ত করেন, “আপনার ত্যাগ আর আমার মেধার সমন্বয়ে মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হবে ইনশাআল্লাহ। ” আর মাদরাসার নামকরণ করেন শিকলবাহার প্রখ্যাত আলেমেদ্বীন সূফী আহসান উল্লাহ রহমাতুল্লাহি আলাইহি। তিনি  ফয়েজ আলীর নাম থেকে ‘ফয়েজ ‘ এবং আবদুল বারীর নাম থেকে ‘বারী’ শব্দযুগলের  সমন্বয়ে  ফয়জুল বারী মাদরাসা নামকরণ করেন। পরবর্তীতে ফয়েজ আলীর সুযোগ্য পুত্র জমিদার মিঞা হাজী আশরাফ আলী চৌধুরী ( বড় মিঞা) এবং মুন্সী মিঞা আসাদ আলী চৌধুরী ( মেঝ মিঞা) মাদরাসার নামে আরো ভূমি দান করেন। সেথায় আজও স্বমহিমায় মাদরাসাটি প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে মাদরাসাটি সম্পূর্ণ আবাসিক ছিল। শিক্ষক – শিক্ষার্থী উভয়ে প্রতিষ্ঠাতার মুসাফির খানায় আহার শেষে দেওড়ী ঘরে রাত্রিযাপন করত। ব্রিটিশ ভারতে এই মাদরাসাই দক্ষিণ চট্টগ্রামে কুরআন-সুন্নাহ ভিত্তিক দ্বীনি তালিম লাভের একমাত্র প্রাচীন  প্রতিষ্ঠান । দূরদূরান্ত থেকে অসংখ্য জ্ঞানপিপাসু শিক্ষানবিশ  ইলম অর্জনের অভিপ্রায়ে  এ প্রতিষ্ঠানে ছুটে আসত। দক্ষিণ চট্টগ্রামের কর্ণফুলী, আনোয়ারা, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া  এমনকি সুদূর কক্সবাজার জেলা থেকেও অসংখ্য শিক্ষার্থী মাদরাসায় এসে জ্ঞান পিপাসা মিটিয়ে স্বীয় অন্তরাত্নাকে  পরিপূর্ণ করে দ্বীনের খেদমতে চাঁটগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে  ছড়িয়ে পড়েন। বর্তমানেও মাদরাসাটি সমগ্র চট্টগ্রামে দ্বীনি শিক্ষার মশাল জ্বালিয়ে চলেছে। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই মাদরাসা হক্কানী আলেমগণের পদচারণায় মুখর ছিল। অজস্র সুন্নী মতাদর্শে বিশ্বাসী  ওলামা মাশায়েখের দ্বীনি তালিমের ফলে মাদরাসার  সুখ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। মাদরাসার অসংখ্য ছাত্র বুজুর্গানে দ্বীন ও আলেমে দ্বীন হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। তন্মধ্যে কুতুবদিয়ার সূফীসাধক হযরত আবদুল মালেক আল কুতুবী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এবং সাতকানিয়ার বুজুর্গ আলেম বাহরুল উলূম হযরত আমিন উল্লাহ রহমাতুল্লাহি আলাইহির নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য।

প্রতিবছর মাদরাসার সালানা জলসায় দেশবরেণ্য ওলামা মাশায়েখের শুভ আগমনে শিকলবাহা এলাকা জুড়ে বসে মিলনমেলা। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত মাদরাসা প্রতিষ্ঠাতার পরিবারের পৃষ্ঠপোষকতা অব্যাহত ছিল। পরবর্তী সময়ে এক দশককাল  মাদরাসার কার্যক্রমে স্থবিরতা নেমে আসে এবং মাদরাসা শ্লথ গতিতে পরিচালিত হতে থাকে। অতঃপর ১৯৫৬ সালে মাদরাসার কার্যক্রমে প্রাণশক্তি ফিরে আসে। সূত্রপাত ঘটে মাদরাসার আধুনিক যাত্রা  এবং নির্জীবতার খোলস ছেড়ে এগিয়ে যেতে থাকে। তৎকালীন অহিদিয়া ফাযিল মাদরাসার পরিচালক হযরত মাওলানা মুজিবুল হক নক্সবন্দী মোজাদ্দেদী রহমাতুল্লাহি আলাইহি তাঁর এক সহকর্মীর সাথে ব্যক্তিগত মনোমালিন্যের জের ধরে স্বপদে ইস্তফা প্রদানপূর্বক  কতিপয় শিক্ষার্থী সহ  ফয়জুলবারী মাদরাসায় যোগদান করেন এবং পরিচালকের পদ অলঙ্কৃত করেন। বস্তুত তাঁর হাত ধরেই মাদরাসার ক্রমোন্নতির দ্বার উন্মোচিত হয়। তিনি ১৯৫৬ সাল হতে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত মাদরাসার পরিচালকের পদে আসীন ছিলেন। তাঁর সুদক্ষ পরিচালনায় মাদরাসার প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়।সূফী ব্যক্তিত্ব হিসেবে হযরত মুজিবুল হক নকশবন্দী রহমাতুল্লাহি আলাইহির জনপ্রিয়তা ছিল আকাশচুম্বী। এলাকার সর্বস্তরের ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণের নিকট তিনি ছিলেন অতীব শ্রদ্ধার পাত্র। তাঁর পিতার ওফাতের পর  তিনি তরিক্বতের দায়িত্ব গ্রহণের লক্ষ্যে ১৯৭৬ সনে ফয়জুল বারী মাদরাসার পরিচালক পদ থেকে ইস্তফা প্রদান করে চাঁদপুরের ধনিয়া দরবার শরীফে গমন করেন। তাঁর প্রস্থান সত্ত্বেও মাদরাসা তাঁর নামে ১৯৮০সন পর্যন্ত পরিচালিত হয়। এসময় মাদরাসা পরিচালনা করেন তাঁর সুযোগ্য ছাত্র এবং পরবর্তী  অধ্যক্ষ হযরত মাওলানা আবুল হাশেম। তিনিও  একজন মোহাক্বিক আলেমে দ্বীন এবং প্রসিদ্ধ ব্যক্তিত্ব। তাঁর সুদক্ষ পরিচালনায় মাদরাসার প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়। তিনি দীর্ঘ ৩১বছর অধ্যক্ষ হিসেবে খেদমত আঞ্জাম দিয়েছেন। তিনি অধ্যক্ষ থাকাকালীন সময়েই মাদরাসার চূড়ান্ত অবকাঠামোগত উন্নয়ন সাধিত হয়। অতঃপর সফল অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন কাযী আনোয়ারুল ইসলাম খাঁন রহমাতুল্লাহি আলাইহি। বর্তমান ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন  করছেন মাওলানা ড. খলিলুর রহমান। 

মাদরাসার দাখিল ও আলিম বিভাগ সরকারী মঞ্জুরী লাভ করে ১৯৮০ সনে। এ সরকারী স্বীকৃতি আদায়ে একজন ব্যক্তিত্বের নাম মাদরাসার ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়ে আছে। তিনি রায়হান উদ্দীন কেরাণী।মরহুম রায়হান উদ্দীন কেরাণী(প্রতিষ্ঠাতার দৌহিত্রী জামাতা )। তিনি ছিলেন  তৎকালীন চট্টগ্রাম শিক্ষা অফিসের মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের বিভাগীয় প্রধানের অফিস সহকারী। তাঁর আন্তরিক সহযোগিতায় মাদরাসার সরকারী স্বীকৃতি আদায় সম্ভব হয়। এ মাদরাসার ক্রমোন্নয়নে রয়েছে কর্ণফুলীর বড়উঠান, শিকলবাহা, জুলধা, চরলক্ষ্যা  ইউনিয়নের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের অবদান। মাদরাসার সম্প্রসারণে প্রতিষ্ঠাতার দৌহিত্র মরহুম মিঞা জাকের হোসেন চৌধুরীর দানকৃত ভূমির উপর বহুতল  একাডেমিক ভবন গড়ে উঠেছে।  এতে করে মাদরাসার কার্যক্রমে আরো গতিশীলতা আসে। পাকিস্তান শাসনামলে বিভিন্ন প্রথিতযশা ব্যক্তিবর্গের নাম মাদরাসার ক্রমোন্নয়নের সাথে জড়িয়ে রয়েছে। তন্মধ্যে  জুলধা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মরহুম  এ কে এম মনছুর উদ্দীন, প্রতিষ্ঠাতার পৌত্র মুন্সী মৌলভী আহমদুল হক চৌধুরী এবং বড় উঠান ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মরহুম মৌলভী আবদুল আউয়াল চৌধুরীর নাম উল্লেখযোগ্য। প্রাথমিক বিদ্যালয়,  জামে মসজিদ ও মাদরাসা নিয়ে সম্পূর্ণ একটি শিক্ষা কমপ্লেক্সের মনোরম সুনিবিড় শান্ত, শ্যামল পরিবেশে তিনটি দৃষ্টিনন্দ ভবন নিয়ে এই প্রতিষ্ঠানটি তার অগ্রযাত্রার পথে এগিয়ে চলছে। জ্ঞান-গরিমা, প্রজ্ঞা, ত্যাগ-তিতিক্ষা, সৃজনশীল কর্মকান্ড, শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ, গুণগত মান অর্জন, শ্রেণিকক্ষে পাঠদান প্রক্রিয়া, পরীক্ষা পদ্ধতি আজ অনেকের কাছে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত, শিক্ষা প্রদানের পাশাপাশি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড, জাতীয় দিবস উদযাপন, প্রকাশনা সংকলন, প্রভৃতি কার্যক্রমের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল প্রতিভার বিকাশ ও বাঙ্গালি ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতির চর্চায় এ প্রতিষ্ঠান অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে।
 লিখক: আরবি প্রভাষক, রাণীরহাট আল-আমিন হামেদিয়া ফাযিল মাদরাসা; খতিব, রাজানগর রাণীরহাট ডিগ্রি কলেজ জামে মসজিদ            

কোন মন্তব্য নেই

 

Blogger দ্বারা পরিচালিত.