বন্দর নগরীর ঐতিহাসিক স্থাপত্য চন্দনপুরা জামে মসজিদ
মুহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মাসুম
চন্দনপুরা হামিদিয়া জামে মসজিদ ঐতিহাসিক মোগল স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত বন্দর নগরী চট্টগ্রামের অতি প্রাচীনতম মসজিদ। চোখ ধাঁধানো কারুকাজে নির্মিত সুসজ্জিত এ মসজিদটি আকর্ষণ কেড়ে নেয় সবার। নগরীর চকবাজার ওয়ার্ডের সিরাজ-উদ-দৌলা সড়কে এটি অবস্থিত। মসজিদের চারদিকে যেন রঙের মেলা। হরেক রঙ ব্যবহার করা হয়েছে স্থাপনার প্রতিটি অংশে। লতা-পাতার নকশা আর নানান কারুকাজে সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে সুনিপুণ হাতে। অনেক দূর থেকে দেখা যায় মসজিদটির বাহ্যিক সৌন্দর্য। শুধু নগরবাসীই এই মসজিদে আসেন এমন নয়, এই মসজিদটি এক নজর দেখতে ছুটে আসেন দেশি-বিদেশি পর্যটকরাও।
ইতিহাসবিদদের মতে, ১৬৬৬ সালে নবাব শায়েস্তা খানের সেনাদল আরাকান মগ রাজাদের কবল থেকে চট্টগ্রামকে স্বাধীন করার পর সেখানে মোগল শাসন কায়েম করেন। আর শাহী ফরমানে নগরীর বিভিন্ন অঞ্চলে অনেকগুলো মসজিদ নির্মাণ করা হয়। তারই ধারাবাহিকতায় এই দৃষ্টিনন্দন মসজিদটির ভিত্তিপ্রস্তর করা হয়েছে বলে ধারণা করা হয়, তবে মূলত বিট্রিশ শাসনামলে মোগল স্থাপনা শিল্পের আদলে ১৮৭০ সালে মাটি ও চুন সুরকির দেয়াল আর টিনের ছাদের মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী আবদুল হামিদ মাস্টার। তখনও মাটির দেয়ালে কারুকাজে ভরপুর ছিল। তাই এই মসজিদের নামকরণ হয় হামিদিয়া তাজ মসজিদ। তবে লোক মুখে এই মসজিদ চন্দনপুরা জামে মসজিদ কিংবা তারা মসজিদ হিসেবে পরিচিত। মসজিদে ঢুকতে কার্নিশে খোদাই করে লিখা আছে প্রতিষ্ঠাতার নামটি। পরবর্তিতে তারই বংশধর ব্রিটিশ সরকারের ঠিকাদার আবু সৈয়দ দোভাষ ১৯৪৬ সালে এই মসজিদের পূর্ণ সংস্কার কাজে হাত দেন। ভারতের লখনৌ এবং মুম্বাই থেকে নির্মাণ সামগ্রী এবং আর্কিটেক্ট এনে প্রায় ১৩ শতক জায়গার ওপর গড়ে তোলা হয় দোতলা মসজিদ। মসজিদটির নান্দনিকতা বাড়াতে নির্মাণ করা হয় ছোট-বড় ১৫টি গম্বুজ। প্রতিটি গম্বুজে যাওয়ার জন্য আছে সিঁড়ি। গম্বুজ ও সিঁড়িতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে মোগল স্থাপত্য নিদর্শনের প্রতিচ্ছবি। ১৫ মণ রুপা ও পিতল ব্যবহার করা হয় সবচেয়ে বড় গম্বুজটি নির্মাণে। এতে সেই সময়ে প্রায় পাঁচ লাখ টাকারও অধিক খরচ হয়। এক সময় পিতলে নির্মিত সুউচ্চ প্রকাণ্ড গম্বুজটি সূর্যালোকে ঝলমল করত। তবে এখন সেই নান্দনিকতা নেই। গম্বুজের চারপাশে লেখা রয়েছে শিলালিপিতে আহলে বায়তে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং দুনিয়ায় বেহেশতের সুসংবাদ প্রাপ্ত দশজন বিশিষ্ট সাহাবির নাম। মসজিদটির সুউচ্চ মিনার থেকে শুরু করে দেয়াল, উঁচু পিলার, দরজা ও জানালা সব কিছুতেই দারুণ কারুকাজ দৃশ্যমান। যখন মাইকের ব্যবহার ছিল না, তখন চারতলা সমান উঁচু মিনারে উঠে উচ্চ স্বরে আজান দেয়া হতো। এ রকম ২টি মিনার এখনও আছে। চারপাশের দেয়ালগুলো ভেন্টিলেশন সিস্টেমের। দেয়ালের ফাঁক গলে ঢুকছে আলো। আলোর ঝরণাধারায় ভেতরটা করছে ঝলমল, আছে বাতাসের কোমল পরশ। মসজিদের চারদিকে যেন রঙের মেলা।
ষাটোর্ধ্ব এক মুসল্লি বর্তমান কথাকে জানান, দোতলা মসজিদটিতে একত্রে নামাজ আদায় করতে পারেন অন্তত ৩ হাজার মুসল্লি। মসজিদে নিয়মিত ইমামতি করছেন ২ জন ইমাম, ১ জন খতিব ও ৩ জন মুয়াজ্জিন। এছাড়াও ঐতিহাসিক সংরক্ষিত বিভিন্ন দুর্লভ জিনিসের পাহারায় নিয়োজিত থাকেন পর্যাপ্ত পরিমাণ নৈশপ্রহরী।
মসজিদ কমিটির সদস্য মুহাম্মদ জহুরুল হক বলেন, তার দাদা আবু সৈয়দ দোভাষ ১৯৫০ সালে এ মসজিদ পুনর্নির্মাণ কাজ শেষ করেন। এখন প্রতি ৫ বছর পর একবার রং করা হয়। একবার রং করার কাজ শেষ করতে প্রায় ৩ থেকে ৪ মাস সময় লাগে। এ সুক্ষ কাজের কারিগরের অভাবে সংস্কার কাজও সঠিকভাবে করা যায় না বলেও তিনি জানান। বৈরি আবহাওয়ায় এসব জিনিস যেমন নষ্ট হয়েছে তেমনি সংস্কারের সময়ও অনেক কিছু হারিয়ে গেছে। এখন বড় গম্বুজে সবুজ, গোলাপি ও হলুদ রং লাগানো হয়।
মসজিদের মুয়াজ্জিন মুহাম্মদ যাকারিয়া বলেন, দীর্ঘদিন ধরে মসজিদের খেদমত করছি। প্রতিদিনই নতুন নতুন মানুষ এ মসজিদ দেখতে আসেন। আশপাশেও অনেক নতুন মসজিদ গড়ে উঠেছে। এরপরও এ মসজিদে মুসল্লির সংখ্যা বাড়ছে। তিনি আরও বলেন, সাধারণত দিনে গড়ে ৮ থেকে ৯শ’ লোক নামাজ পড়েন এ মসজিদে। শুক্রবারে হাজার তিনেক ছাড়িয়ে যায়। তখন মসজিদে জায়গা সংকুলন না হলে রাস্তা বন্ধ করে সেখানেই নামাজ আদায় করেন মুসল্লিরা।
মসজিদটির পরিচিতি বৃদ্ধি পেতে সহায়তা করেছে ‘এশিয়া ট্রাভেল ট্যুরস’ নামের জার্মানের জনপ্রিয় একটি ম্যাগাজিন। তারা তাদের প্রচ্ছদে এই মসজিদের ছবি ব্যবহার করলে বিশ্ববাসী ঐতিহাসিক এই মসজিদ সম্পর্কে জানতে পারে। চট্টগ্রামের আইকনিক চিত্র কিংবা ডকুমেন্টোরিগুলোতে এই মসজিদটির স্থান শীর্ষে।
লিখক: আরবি প্রভাষক, রাণীরহাট আল-আমিন হামেদিয়া ফাযিল মাদরাসা; খতিব,রাজানগর রাণীরহাট ডিগ্রি কলেজ জামে মসজিদ।
কোন মন্তব্য নেই