চট্টগ্রাম আদালত ঔপনিবেশিক স্থাপত্যেের অনন্য কীর্তি
মুহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মাসুম
চট্টগ্রাম বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে পরিচিত হলেও পাহাড়, সমুদ্রে এবং উপত্যকায় ঘেরা চট্টগ্রাম শহর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্যে প্রাচ্যের রাণী হিসেবে বিখ্যাত। ১৩৫২-১৩৫৩ সালে বাংলার প্রথম স্বাধীন সুলতান শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহ সময়ে চট্টগ্রাম বাংলার প্রধান বন্দর হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।এটি এশিয়ায় ৭ম এবং বিশ্বের ১০ম দ্রুততম ক্রমবর্ধমান শহর।
চট্টগ্রামের প্রাণকেন্দ্রে পরীর পাহাড় নামে খ্যাত কোর্ট বিল্ডিং একটি ঔপনিবেশিক স্থাপত্যকীর্তি। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৭৩ সালে চট্টগ্রামকে পৃথক প্রশাসনিক অঞ্চল ঘোষণা করে। ফলে প্রশাসনিক কাজের জন্য এই দ্বিতল ভবনটি নির্মাণ করা হয়। এর আয়তন ১,৫৩,০০০ বর্গফুট ও কক্ষ সংখ্যা শতাধিক। বিল্ডিং-এর নির্মাণ কাজ শুরু হয় ১৮৯২ সালে ও সমাপ্ত হয় ১৮৯৮ সালে। এই ভবনটি বাংলায় নির্মিত ইন্দো-ব্রিটিশ স্থাপত্য শৈলীর একটি উদাহরণ। পুরাকীর্তি আইনের আওতায় আনা হয় নি এই প্রত্নসম্পদ।
অগ্নিপুরুষ, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম বিপস্নবী, মাস্টার দা সূর্যসেনের ফাঁসির রায় ঘোষিত হয় এই আদালত ভবন থেকে। শুধু তা নয়, ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, স্বাধীনতার মহান নায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দালদীঘির পাড়ে ৬ দফা ভাষণ শেষে তিনি এই ভবনের স্থাপত্যের নিদর্শন দেখতে এসেছিলেন।
কোর্ট বিল্ডিং-এ ইউরোপীয় ও মুঘল ঐতিহ্যের সম্মিলিত ধারায় লোকজ নানা অলঙ্করণ আরোপ করা হয়। দালানটির ভূমি নকশায় মুঘল মসজিদ স্থাপত্যের গভীর প্রভাব পড়েছে । নির্মাণ-স্থলের সাংস্থানিক বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করেছে পরিকল্পনার অন্যান্য প্রায়োগিক দিক। অসাধারণ কারুকাজ, ফ্রন্ট ভিউ, ব্যাক ভিউ, পরিমান মতো দরজা-জানালা, বিশাল করিডোর সত্যি সবাইকে এক চমকে মুগ্ধ করে। মূল দালানটি আয়তাকার এবং পূর্ব-পশ্চিম বিন্যস্ত। এর পূর্ব প্রান্তে আড়াআড়ি যুক্ত আছে উত্তর-দক্ষিণ বিন্যস্ত একটি সংযোজিত অংশ। পাহাড়ি ভূমির উচ্চতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে দ্বিতল এই ভবনের পূর্ব অংশের উত্তর প্রান্ত রূপ নিয়েছে ত্রিতলে। ভবনের এই অংশেই পূর্ব দিক থেকে প্রবেশের জন্য সুঅলঙ্কৃত মূল তোরণটি রয়েছে। পূর্ব অংশের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মূল দালানের পশ্চিম অংশকে কিছুটা দক্ষিণ দিকে টানা হয়েছে। নির্মাতার সতর্ক মনোযোগ ছিল ভবনটির প্রতি তলের মেঝের সমতা রক্ষায়। প্রাচীরগুলি ইট ও চুন-মর্টারে তৈরি এবং প্রতিটি প্রাচীর তিন ফুট প্রশস্ত। উত্তর-পূর্ব এবং উত্তর-পশ্চিম কোণে দুটি মিনার রয়েছে। মিনারের অভ্যন্তরে রয়েছে চক্রাকার সিঁড়ি। উভয় পাশের মিনারের মাথায় বসানো আছে মুঘল শৈলীর গম্বুজ এবং কোণায় ছোট ছোট চারটি কিউপোলা।
দালানটির সম্মুখভাগ মূলত মনোহর সজ্জায় অনেকভাবে বিন্যস্ত নানা আকৃতির তোরণের সারি। তোরণের কীলক আকার অনেক ভার বহনে সক্ষম। দালানের নিচ তলার বারান্দায় প্রত্যেকটি প্রকৃত তোরণ ধারণ করছে উপর তলার এক একটি জোড়া তোরণ, মাঝে তিনটি করবেল্ড তোরণসহ। ছাদ থেকে বৃষ্টির জল নিষ্কাশনের চৌকো নল কার্নিসের ভেতর দিয়ে দু’প্রস্থ তোরণের মাঝে বসানো আছে। দালানটির দক্ষিণ ভাগে দু’পাশের কেন্দ্রে আরও দু’টি তোরণ-সজ্জিত প্রবেশপথ রয়েছে। স্থাপত্যিক অলংকরণে পোড়া ইটের বিন্যাসও মনোহারী। ভবনটিতে দেওয়ানি আদালত, ফৌজদারি আদালত এবং বিভাগীয় কমিশনার, ডেপুটি কমিশনার, জেলা ও দায়রা জজের কার্যালয় রয়েছে। ভ্রমণ পিপাসুদের জন্য এই ভবন এবং এর সন্নিহিত এলাকা অন্যতম পর্যটন আকর্ষণ স্থান। বর্তমানে পুরাতন ভবনে কার্যক্রমের স্থান সংকুলান না হওয়ায় পুরাতন ভবনের পাশে নতুন নির্মিত হয়েছে।
বলা বাহুল্য, চট্টগ্রাম বিভাগের মাঠ পর্যায়ে সর্বোচচ গুরম্নত্বপূর্ণ এবং উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন অফিস হল বিভাগীয় কমিশনার অফিস। এ অফিসকে মাঠ প্রশাসনের সচিবালয়ও বলা হয়ে থাকে। হাত-দুহাত দূরত্বে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের কার্যালয়। পেছনে নতুন আদালত ভবনে জেলা ও দায়রা জজ, মহানগর দায়রা জজ, চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটসহ আরো অন্যান্য অফিস রয়েছে। লালচে এই পুরাতান আদালত ভবনের স্থাপত্তের অনন্য নিদর্শন পাওয়া যায়। এ পাহাড়ের শীর্ষদেশ হতে নিচে শহরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অবলোকন করা যায়। যে কেউ মোহনা পর্যন্ত কর্ণফুলি নদী এবং এর তীর ধরে বন্দর এলাকা, দক্ষিণ দিকে দিয়াঙ ও বাঁশখালী পর্বতশ্রেণী এবং পূর্ব দিকে পার্বত্য অঞ্চল দেখতে পারে। পাহাড়ের পাদদেশ ধরে জেনারেল পোষ্টঅফিস, মিউনিসিপ্যাল হাইস্কুল, নিউমার্কেট এবং চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ভবন অবস্থিত।
লিখকঃ আরবি প্রভাষক, রাণীরহাট আল-আমিন হামেদিয়া ফাযিল মাদরাসা; খতিব, রাজানগর রাণীরহাট ডিগ্রি কলেজ জামে মসজিদ।
কোন মন্তব্য নেই