ইসলামী সমাজে মজুরের অধিকার
* মালিকানা সমস্যা ও ইসলাম : মালিকানা সম্পর্কে দুইটি মত
* অস্বাভাবিক মালিকানা নীতির পরিণাম
* সম্পত্তির জাতীয়করণ
* মালিকানা স্বত্ব ওইসলাম
* পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক সমাজে মজুরদের অবস্থা
* ইসলামে মজুরদেরঅধিকার
* ইসলামী সমাজে মজুরদের মর্যাদা ও অধিকার
* নবতর শ্রমিক আন্দোলনেরপ্রয়োজনীয়তা ও ভিত্তি
* বাংলাদেশে শ্রমিক আন্দোলন
* শ্রমের উদ্বোধক
* স্বল্প মেয়াদী পরিকল্পনা
পূর্বকথা
শ্রমিক-মালিক মানব সমাজের এক সুপ্রাচীন সমস্যা। যুগ যুগ ধরিয়া এই সমস্যাটি মানবসমাজকে নানাভাবে আলোড়িত
করিয়াছে, অনাকাক্ষিতভাবে মেহনতী মানুষের রক্ত ঝরাইয়াছে।এমনকি,
শ্রমিক-মালিক সম্পর্কে
ভারসাম্য রক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (ILO) নামে একটি বিশ্বসংস্থা পর্যন্ত গঠন করা হইয়াছে। কিন্তু তৎসত্ত্বেও শ্রমিক-মালিকসমস্যার সুষ্ঠু সমাধান
নিশ্চিত হইয়াছে, একথা কোনক্রমেই দাবি করা চলেনা। বরং
এখনওদেশে দেশে শ্রমিক-মালিক সমস্যা একটি প্রকট সমস্যা রূপে বিরাজ করিতেছে,
শ্রমজীবিমানুষের রক্তে
অহরহ রাজপথ রঞ্জিত হইতেছে। বলাবাহুল্য যে, বাংলাদেশেও কম-বেশি একইপরিস্থিতি বিরাজ
করিতেছে।
মূলত শ্রমিক-মালিক সমস্যাটিকে অধূনা বিবেচনা করা হইতেছে
নেহায়েত একটি শ্রেণীগতসমস্যা হিসাবে। এখানে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিকে মোটেই গুরুত্ব
দেওয়া হইতেছে না। ফলেশ্রমিক-মালিক উভয় পক্ষই বিষয়টিকে বিবেচনা করিতেছে
নেহায়েত শ্রেণীস্বার্থেরদৃষ্টিতে। কিন্তু আল্লাহর মনোনীত জীবন-বিধান ইসলাম সমগ্র
বিষয়টিকে বিবেচনা করিয়াছেমানবিক ও ন্যায়নুগ দৃষ্টিতে। শ্রমিক
ও মালিক কোন পক্ষকেই সে বড় কিংবা ছোট করিয়াদেখে নাই; বরং উভয় পক্ষের স্বার্থকেই সে রক্ষা করিয়াছে
পরিপূর্ণ ন্যায়পরতারদৃষ্টিতে। প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ, আলেম ও দার্শনিক
মুহাম্মদ আবদুর রহীম (রহ) এই বিষয়টিকেই অত্যন্ত চমৎকার রূপে তুলিয়া ধরিয়াছেন
ইসলামী সমাজে মজুরের অধিকারনামক বর্তমান পুস্তিকায়।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, এই পুস্তিকাটি রচিত হইয়াছে দীর্ঘ প্রায় পঞ্চাশ
বৎসরপূর্বে। তৎকালীন দুনিয়ার সামাজিক রাজনৈতিক ও অথনৈতিক পরিস্থিতির
আলোকে। তারপর দুনিয়ার উপর দিয়া অনেক পানি গড়াইয়া গিয়াছে;
কমিউনিস্ট বিশ্বের
মানচিত্রে অনেকপরিবর্তন ঘটিয়াছে। উপমহাদেশে পাকিস্তান ভাঙিয়া বাংলাদেশ হইয়াছে। ইহার ফলে দুনিয়ারশ্রমিক আন্দোলনেও কিছু কিছু পরিবর্তনের ছাপ
পড়িয়াছে। কিন্তু তৎসত্ত্বেও বর্তমানশ্রমিক-মালিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে
তেমন কোন পরিবর্তন সূচিত হয় নাই। এই কারণেইবর্তমান পুস্তিকার সংশ্লিষ্ট অংশে
আমরা কোন মৌলিক পরিবর্তন সাধনের প্রয়োজন বোধ করিনাই।
পুস্তিকার নিবন্ধসমূহ প্রথম প্রকাশিত হইয়াছিল পঞ্চাশের
দশকের প্রথম ভাগে তৎকালীনদৈনিক আজাদসহ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় এবং প্রায় একই সময়ে তাহা
পুস্তকাকারেওআত্মপ্রকাশ করে। বিগত বৎসরগুলিতে ইহার অনেকগুলি সংস্করণ
প্রকাশিত হয় এবং পাঠকসমাজেও তাহা ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। পুস্তকটির
বর্তমান সংস্করণও পাঠকদের নিকটব্যাপকভাবে সমাদৃত হইবে বলিয়া আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস
করি।
মালিকানা
সমস্যা ও ইসলাম : মালিকানা সম্পর্কে দুইটি মত
অর্থ ও সম্পত্তির মালিকানা সম্পর্কে দুইটি ভিন্ন ভিন্ন মত
প্রচলিত আছে। একটিব্যক্তিগত মালিকানা এবং অপরটি সম্পত্তির জাতীয়করণ। ব্যক্তিগত মালিকানার অধিকারব্যক্তিকে পূর্ণ স্বাতন্ত্র্য ও
স্বাধীনতা দান করিয়াছে। যে কোন উপায়ে হউক না কেন,
সে যত সম্পদ এবং যত
সম্পত্তিই উপার্জন করিবে, তাহাকে সে একান্তভাবে নিজেরমালিকানাধীন মনে করিতে পারিবে। উপার্জনের এই নিরংকুশ স্বাধীনতা ব্যয়ের ব্যাপারেওতাহাকে
পূর্ণ নিরংকুশ ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী করিয়া তোলে। কাজেই
তাহার উপার্জিত অর্থ ওসম্পত্তি যেভাবে যে পথে এবং যত পরিমাণেই সে ইচ্ছা করিবে,
অনায়াসেই তাহা খরচ করিতেপারিবে;
কিংবা এক বিন্দু খরচ না
করিয়া তিল-তিল করিয়া তাহা সঞ্চিত করিয়া রাখিলেওতাহাতে কাহারো আপত্তি করা চলিবে না। এক কথায়, ব্যয় করা বা সঞ্চয় করিবার ব্যাপারে এইমত ব্যক্তিকে পূর্ণ
আজাদী দান করিয়াছে। বস্তুত ইহাকেই বলে ব্যক্তিগত মালিকানারঅধিকার। বর্তমান যুগের পুঁজিবাদী গণতন্ত্রের নিশানবর্দারগণ এই মত
সমর্থন করিয়াথাকে। আর সত্য বলিতে কি, অর্থনীতির ক্ষেত্রে এই দৃষ্টিভঙ্গির মারাত্মক
পরিণতিদীর্ঘকাল ধরিয়া সমগ্র দুনিয়াকে শোষিত নিষ্পোষিত এবং দু:খ ও দারিদ্রের দু:সহ জ্বালায়জর্জরিত
করিয়া রাখিয়াছে। ইহা মানুষকে অমানুষিক স্বার্থপরতা ও নির্মম অর্থপূজাশিক্ষা
দিয়াছে। এই ব্যবস্থা পুঁজিপতি ও সম্পদশালীদের স্বাতন্ত্র্যবাদ ও
শ্রেষ্ঠত্ববোধে দীক্ষিত করিয়া বিশাল বিশ্ব-মানবতার ঊর্ধ্বে তুলিয়া ধরিয়াছে। দু:খিতের আহাজারীআর ব্যথিতের মর্মবিদারী ফরিয়াদ তাহাদের
কর্ণকুহরে মাত্রই পৌঁছায় না। বিপন্ন ওব্যথিত মানুষ যখন তাহাদের সম্মুখে এক
বিন্দু করুণা লাভের আশায় হস্ত প্রসারিত করিয়াসাহায্য ও সহানুভূতি পাইবার জন্য করুণ
নেত্রে তাহাদের প্রতি তাকায়, তখন তাহারাইহাদের সকল আশা-আকাঙ্ক্ষাকে পদদলিত করিতে
বিন্দুমাত্র কুন্ঠাবোধ করে না। এই সবদরিদ্র, সর্বহারা ও মজলুম মানুষকে তাহারা হীন,
নীচ ও মানবতার কুলাংগার
বলিয়া মনেকরে। অন্য কথায়, দরিদ্র আর সর্বহারা হইয়া যেন তাহারা মস্তবড় অপরাধ করিয়া
বসিয়াছে।এই ধরনের লোক যখন কোন কারখানার মালিক হইয়া বসে,
তখন মজুর-শ্রমিকদিগকে
তাহাদের শোষণও নিষ্পেষণের অগ্নিজ্বালায় ভষ্ম করিতে থাকে। আবার
ইহারা যখন জমিদার ও জোতদার হইয়াবসে, তখন প্রজা-কৃষকগণ তাহাদের নিকট নিরন্তর
লাঞ্চিত ও নিপীড়িত হইতে থাকে। আররাষ্ট্রের সর্বময় কর্তৃত্ব যখন ইহারা লাভ
করে, তখন নিন্মশ্রেণীর সরকারী কর্মচারীহইতে শুরু করিয়া দেশের
কোটি কোটি বাসিন্দা খাদ্য-বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ওস্বাস্থ্য প্রভৃতি মানুষের বুনিয়াদী প্রয়োজন হইতে
সম্পূর্ণ বঞ্চিত হইয়া যায় এবংতাহাদের বঞ্চিত রেখে বিপুল জাতীয় সম্পদকে ইহারা ইহারা
নিজেদের বিলাস-ব্যাসন, লোভ ওলালসা এবং নিরবচ্ছিন্ন সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্যের অগ্নি
শিখায় আহুতি দেয়।
অস্বাভাবিক
মালিকানা নীতির পরিণাম
বস্তুত ব্যক্তিগত মালিকানার এই অস্বাভাবিক নীতির এটাই
মারাত্মক পরিণতি। এই নীতিআজ দুনিয়ার সকল পুঁজিবাদী দেশে প্রচন্ড রূপ ধারণ
করিয়াছে। কারণ মানুষ যখন নিজেকেকোন জিনিসের নিরুংকুশ,
প্রকৃত একক মালিক এবং
সর্বময় স্বত্বাধিকারী বলিয়া মনে করিতেথাকে, তখন তাহার সংকীর্ণ দৃষ্টি ও স্বাভাবগত মূর্খতা
তাহাকে কৃপণ, লোভী ওঅর্থভোগী করিয়া তোলে। বর্তমানে
দুনিয়ার সাম্রাজ্যবাদী ধর্মহীন গণতন্ত্রের ইহারবাস্তব নিদর্শন সুস্পষ্টরূপে দেখিতে
পাওয়া যায়। রাজতন্ত্র, একনায়কত্ববাদ আরসাম্রাজ্যবাদী দুনিয়ার বুকে পাশ্চাত্য
গণতন্ত্র অপেক্ষাও মারাত্মক ধ্বংসলীলারসৃষ্টি করিয়াছে। ইহার
একমাত্র কারণ এই যে, রাজা বা সম্রাট নিজেকে তাহার বিশাল রাজ্যবা সাম্রাজ্যের এবং
সমগ্র উপায়-উপাদানের একমাত্র ও প্রকৃত মালিক বলিয়া মনে করিয়াছে।ফলে
দেশে যাবতীয় ধন-সম্পদ ও উপায়-উপাদানকে কেবলমাত্র নিজের ব্যক্তিস্বার্থের কাজেব্যয়
করিয়াছে। আর কোটি কোটি জনগণের স্বার্থ, প্রয়োজন এবং কল্যাণসাধনকে সে একেবারেইউপেক্ষা
করিয়াছে। পক্ষান্তরে পাশ্চাত্য ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রে যারা
রাষ্ট্রীয়কর্তৃত্ব লাভ করে, তাহারা মনে করে যে, রাষ্ট্রের সার্বভৌম কর্তত্ব প্রকৃতপক্ষেতাহাদের
নিজস্ব নয়, বরং দেশের জনগণই প্রকৃত কর্তৃত্বের মালিক-তাহাদের নিকট
এইকর্তৃত্ব আমানত স্বরূপ অর্পণ করা হইয়াছে মাত্র। এই
মনোভাবের কারণই গণতন্ত্রের অধীনমানুষ রাজতন্ত্র, একনায়কত্ববাদ বা সামাজ্রবাদ অপেক্ষা অধিকতর
শান্তি ও সমৃদ্ধি লাভকরিয়া থাকে। কিন্তু জনগণের রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের একচ্ছত্র
মালিক হওয়ার ধারণাটাওমূলত ভুল এবং অচিরে তাও মারাত্মক আকার ধারণ করিয়া বসে। রাজতন্ত্র, একনায়কত্ববাদ ওসাম্রাজ্যবাদ এক ব্যক্তির মধ্যে যে সংকীর্ণ
দৃষ্টি ও স্বার্থপরতার সৃষ্টি করে, পাশ্চাত্য গণতন্ত্র ঠিক তা-ই জাগিয়ে তোলে সমগ্র
জাতির মধ্যে এবং ইহার পরিণামঅন্তহীন যুদ্ধ ও সংঘাত ব্যতীত আর কিছুই হয় না।
মোটকথা, ইহা অনস্বীকার্য যে, ব্যক্তিগত মালিকানা-অন্যকথায় ব্যক্তির
স্ব-উপার্জিতধন-সম্পত্তির উপর তাহার নিরংকুশ মালিক হওয়া এক ভয়ানক মারাত্মক
ব্যবস্থা, তাহাতেবিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নাই। ধন-সম্পত্তি
সম্পর্কে এহেন বুনিয়াদী ধারণাইবর্তমান ধন-তন্ত্র, পুঁজিপতির ও জমিদারীর মারাত্মক ও ধ্বংসাত্মক
রূপ ধারণ করিবারমূলীভূত কারণ।
সম্পত্তির
জাতীয়করণ
ব্যক্তিগত মালিকানার পরে দ্বিতীয় মত হচ্ছে জাতীয় মালিকানা। ইহার অর্থ এই যে, দেশের কোন জিনিসের মালিক হইবে না;
বরং দেশের ও জাতির
যাবতীয় ধন-সম্পত্তির মালিকহইবে নির্বিশেষে ও সম্মিলিতভাবে দেশের সমগ্র জাতি। সাধারণভাবে কমিউনিজম ওমার্কসবাদের ধ্বজাধারিগণই এ মত পোষণ ও
প্রচার করিয়া থাকে। এই মতের দৃষ্টিতেসমাজক্ষেত্রে ব্যক্তির স্বতন্ত্র সত্তার
কোনই গুরুত্ব নাই, সকল গুরুত্ব এবং সর্বময়কর্তৃত্ব একান্তভাবে সমাজের হাতে
ন্যস্ত করা হয়। ব্যক্তি সেখানে খাটে, মেহনত করিয়াউপার্জন করে,
কিন্তু উপার্জিত সম্পদের
মালিক সে ইইতে পারে না, সমাজ তাহাকে তাহাহইতে বঞ্চিত রাখিয়া নিজেই একচ্ছত্র মালিক
হইয়া বসে। ব্যক্তি তাহার মেহনত, যোগ্যতা ওমননশক্তি ব্যয় করিয়া তাহার বিনিময়ে
সমাজের নিকট হইতে পেটভরা খাবার, পরিধানের বস্ত্রআর সম্ভব হইলে বাসস্থান লাভ করে। ফলত সে সমাজের চাকর, এই চাকরী হইতে সে মৃত্যুপর্যন্ত কখনও মুক্তি
পাইতে পারে না। উপরোন্ত তাহার এই নিরংকুশ ও একচ্ছত্র মনিব ওপ্রভূ তাহাকে
এতটুকু সুযোগ দেয় না যে, সে নিজের দাবি অনুযায়ী নিজের পরিশ্রমের সঠিকমূল্য আদায়
করিতে চেষ্টা করিবে।
ব্যক্তিগত মালিকানা ব্যবস্থার অধীন প্রতিটি শ্রমিক মজুর
নিজের শ্রম-মেহনত বিক্রয়করিয়া পুঁজিদারের নিকট উপযুক্ত মূল্য সে অনায়াসেই দাবি
করিতে পারে, সে সুযোগ তাহাতেপূর্ণরূপে লাভ করা যায়। এমনকি
একজন পুঁজিদার তাহার দাবি অনুসারে মূল্য দিতেপ্রস্তুত না হইলে সে অন্যত্র তাহার
ভাগ্য পরীক্ষা করিয়া দেখিতে পারে। কিন্তুশ্রেণীহীন সমাজ তথা এই জাতীয় মালিকানা
ব্যবস্থায় সমাজ মজুর শ্রেণীর শ্রম-মেহনতেরমূল্য যা-ইচ্ছা তা-ই নির্দিষ্ট করিয়া
দিতে পারে, সে সম্পর্কে মজুরের কোন কিছুবলিবার অধিকার মাত্রই নাই। এবং সমাজ কর্তৃক কোন মূল্যবান নির্দিষ্ট হইয়া গেলে
তাহারপ্রতিবাদ করিবার বা তাহার বিরুদ্ধে একক কিংবা সংঘবদ্ধ আওয়াজ বুলন্দ করিবার
কোনসুযোগই সে পাইতে পারে না। এমনকি এই অত্যাচারী ও শোষক মনিবের দাসত্ব হইতে
মুক্তিপাইবার জন্য অন্য কোথায়াও ভাগ্য পরীক্ষা করিয়া দেখতেও সে সক্ষম হয় না। কেননা এখানেসে জন্মগত মজুর, সমাজ তাহার স্বাভাবিক প্রভূ। পরিশ্রমের মূল্য সে যা ইচ্ছা বাঁধিয়াদিতে পারে,
কিংবা একেবারে না দিবার
সিদ্ধান্ত করিলেও তাহার প্রতিরোধ করা সম্ভবনয়-মজুর তাহার গোলামী হইতে কিছুতেই
নিষ্কৃতি লাভ করিতে পারে না।
সমাজবাদে যত গালভরা দাবিই করা হউক না কেন,
ব্যক্তির রক্ত পানি
করিয়া উপার্জন করাসম্পদকে তাহার নিকট হইতে তাহার মর্জির বিরুদ্ধে কাড়িয়া লওয়ার
সমাজের কি অধিকারথাকিতে পারে, সমাজবাদের এই ধ্বজাধারিগণ তাহার কোন যুক্তিই আজও পর্যন্ত
উপস্থাপিতকরিতে পারে নাই। শ্রমিক-মজুর বা কৃষকের শ্রম-লব্ধ সম্পদ ভোগ
করিবার অধিকার যদিপুঁজিদার বা জমিদারের না থাকে তবে সেই মজুরের হাড়াভাংগা
পরিশ্রমের ফল হরণ করিবারঅধিকার সমাজ কি করিয়া লাভ করিতে পারে?
সম্পত্তির মালিকানা সম্পর্কে এই দুইটি মতসাধারণভাবে বর্তমান দুনিয়ার প্রচলিত আছে। ব্যক্তি মালিকানা অধিকার যদি অবাঞ্চিত ওশোষণমূলক হয়, তবে সমাজের নিরুংকুশ মালিকানাও ঠিক তদ্রুপ অস্বাভাবিক, অত্যাচারমূলকএবং মানবতা-বিরোধী, তাহাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকিতে পারে না। উল্লিখিত মতদ্বয়েরপ্রথমটি শোষণ পীড়নের চরম ব্যবস্থা আর দ্বিতীয়টি বর্বরতা ও জুলুমেরশেষ সীমা। এক্ষণেস্বাভাবত:ই প্রশ্ন জাগিবে যে, ব্যক্তিগত মালিকানা যদি বাতিল ও ধ্বংসাত্মক হয় আরজাতীয় মালিকানার ধারণাও যদি অস্বাভাবিক জালিম ও মানবতা বিরোধী হয়, তাহা হইলেমানুষের উপায় কি? পৃথিবীর এই বিপুল ধন-সম্পদ ও মানুষের পরিশ্রম লব্ধ এই অপর্যাপ্তধন ঐশ্বর্যের মালিক কাকে স্বীকার করিতে হইবে?আর কাকে এ সবের মালিক বলিয়া সমর্থনকরিলে এই দুনিয়া ও গোটা মানুষ সর্বপ্রকার জুলুম, শোষণ, নিষ্পেষণ ও বর্বরতারঅবাঞ্চিত পরিণতি হইতে চিরতরে মুক্তি লাভ করিতে পারিবে?
সম্পত্তির মালিকানা সম্পর্কে এই দুইটি মতসাধারণভাবে বর্তমান দুনিয়ার প্রচলিত আছে। ব্যক্তি মালিকানা অধিকার যদি অবাঞ্চিত ওশোষণমূলক হয়, তবে সমাজের নিরুংকুশ মালিকানাও ঠিক তদ্রুপ অস্বাভাবিক, অত্যাচারমূলকএবং মানবতা-বিরোধী, তাহাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকিতে পারে না। উল্লিখিত মতদ্বয়েরপ্রথমটি শোষণ পীড়নের চরম ব্যবস্থা আর দ্বিতীয়টি বর্বরতা ও জুলুমেরশেষ সীমা। এক্ষণেস্বাভাবত:ই প্রশ্ন জাগিবে যে, ব্যক্তিগত মালিকানা যদি বাতিল ও ধ্বংসাত্মক হয় আরজাতীয় মালিকানার ধারণাও যদি অস্বাভাবিক জালিম ও মানবতা বিরোধী হয়, তাহা হইলেমানুষের উপায় কি? পৃথিবীর এই বিপুল ধন-সম্পদ ও মানুষের পরিশ্রম লব্ধ এই অপর্যাপ্তধন ঐশ্বর্যের মালিক কাকে স্বীকার করিতে হইবে?আর কাকে এ সবের মালিক বলিয়া সমর্থনকরিলে এই দুনিয়া ও গোটা মানুষ সর্বপ্রকার জুলুম, শোষণ, নিষ্পেষণ ও বর্বরতারঅবাঞ্চিত পরিণতি হইতে চিরতরে মুক্তি লাভ করিতে পারিবে?
মালিকানা
স্বত্ব ও ইসলাম
ইসলাম এই প্রশ্নের জওয়াব দিয়াছে এবং সে জওয়াব অতীব সুষ্ঠ ও
বিজ্ঞাসম্মত।ইসলামবলে, পুঁজি বা সম্পত্তির প্রকৃত মালিক ব্যক্তিও নয় সমাজও নয়। ইহার কারণ এই যে, পুঁজি বা সম্পত্তির প্রকৃত মালিক ও সর্বময়
কর্তৃত্বের অধিকারী সে-ই হইতে পারে, যেতাহা নিজ শক্তির বলে সৃষ্টি করিয়াছে অথবা
উৎপাদন করিয়াছে সেই সব শক্তি যোগ্যতা ওসামর্থের যাহা পুঁজি সৃষ্টি করিয়াছে। আর ইহা সর্বজনবিদিত যে, কোন মানুষই দুনিয়ারকোন বস্তু বা শক্তি বা
যোগ্যতার সৃষ্টি করে নাই কোন ব্যক্তি তাহা সৃষ্টি করিয়াছে আরনা কোন মানবগোষ্ঠি বা
কোন সমাজ। অতীব সুস্পষ্ট কথা-ইহা প্রমাণ করিবার জন্য কোনবৈজ্ঞানিক
যুক্তি আবশ্যক করে না।
এই বিশাল দুনিয়ার যাহা কিছু পাওয়া যায় তাহার সৃষ্টিকর্তা
ব্যক্তি বা সমাজেরঊর্ধ্বের কোন সত্তা যাহাকে আমাদের জড়চক্ষু যদিও দেখতে পায়
না-কিন্তু মন তাঁহাকেঅনুভব করে।মানব-বুদ্ধি তাঁহাকে বিশ্বস্রষ্টা বলিয়া
স্বীকার করিতে আমাদেরকে বাধ্যকরে। কারণ সৃষ্টিকর্তা যখন ব্যক্তিও নয়,
সমাজও নয়,
তখন একজন সাধারণ মানুষও
এই কথাস্বীকার করিতে বাধ্য যে, প্রকৃত সৃষ্টিকর্তা এই মানুষ ও জড়ের অতীত কোন সত্তা। ইসলামএই সত্তার নাম রাখিয়াছে আল্লাহ। ইসলামের
দৃষ্টিতে এই আল্লাহ তা’আলাই সকল বস্তু এবংজীব ও জন্তুকে সৃষ্টি করিয়াছেন। সৃষ্টি করিয়াছেন সকল শক্তি ও যোগ্যতা। কাজেই তিনিইসকল বস্তু
এবং জন্তু, সকল সম্পদ এবং সম্পত্তি তথা সকল ব্যক্তি এবং
সমাজেরসৃষ্টিকর্তা ও একচ্ছত্র মালিক। মানুষের হাতে ধন-সম্পত্তি যাহা কিছু আছে তাহা
কোনব্যক্তি বা সমাজেরই উপার্জিত হউক না কেন, তাহার সব কিছুরই প্রকৃত মালিক আল্লাহ।তিনি
দুনিয়ার সুষ্ঠু পরিচালনা ও শৃংখলা বিধানের জন্য মানুষের জন্য নয়;
বরং একটিসুনির্দিষ্ট
কালের জন্য মাত্র। এই আমানত রাখার মূলে আল্লাহর আর একটি বিরাট উদ্দেশ্যনিহিত
রহিয়াছে, তাহা হচ্ছে মানুষের পরীক্ষা। আল্লাহ
তা’আলা এই সম্পদ এবং সম্পত্তিমানুষের ভোগ ব্যবহারের জন্য
দিয়াছেন আর সেই সঙ্গে দিয়াছেন সেই সব ভোগ-ব্যবহারকরিবার-তথা ব্যক্তি-মানুষ ও
সমাজ-মানুষের সুনিয়ন্ত্রিত জীবন যাপনের জন্য একটি পূর্ণও সার্বজনীন জীবন বিধান। আল্লাহ তা’আলা ইহার সাহায্যে মানুষকে এই দিক দিয়া
পরীক্ষাকরিতে চান যে, মানুষ কি এইগুলি নিয়ে ইচ্ছামত ভোগ ব্যবহার করে,
না আল্লাহর দেওয়াবিধান
অনুযায়ী করে। আর এগুলিকে আল্লাহর দেওয়া বিধান মুতাবিক কোটি কোটি
মানুষেরমধ্যে বন্টন করে, না তিল তিল করিয়া সঞ্চিত ও নিজস্ব ভোগের সামগ্রী করিয়া রাখে।সম্পদ
সম্পত্তির মালিকানা সম্পর্কে ইসলামের এ-ই গোড়ার কথা।
এই খানের সমগ্র ব্যাপারটি শেষ হইয়া যায় নাই;
বরং আল্লাহ তা’আলা
পরিস্কার করিয়াবলিয়া দিয়াছেন যে, আল্লাহর দেওয়া বিধান অনুসারে যার নিকট যত পরিমাণ সম্পদ
যাসম্পত্তি থাকুক না কেন তাহাক যে সুষ্ঠুভাবে আল্লাহর বিধান মতো ব্যয় করিবে,
তাহাকেতিল তিল করিয়া জমা
করিয়া রাখিবে না-এহেন পরীক্ষায় সেই ব্যক্তি সাফল্য লাভ করিতেপারিবে। আর যে এরূপ করিবে না তাহার জীবন এই পরীক্ষায় ব্যর্থ
প্রমাণিত হইবে। মালিকানাসম্পর্কে এই নীতি উপস্থাপিত করিয়া ইসলাম মানবীয় মালিকানার
মূলে চিরতরে কুঠারাঘাতেকরিয়াছে। এবং ব্যক্তি মালিকানা আর জাতীয় মালিকানা এই
উভয় প্রকার ধ্বংসাত্মক মত হইতেসম্পূর্ণ ভিন্ন ও স্বতন্ত্র এক নতূন মত-আল্লাহর
মালিকানা-পেশ করিয়াছে। এই দৃষ্টিতেমানুষ ধন-সম্পত্তির মালিক নহে,
আমানতদার মাত্র। এই মতের ভিত্তিতে ইসলাম তাহারপরিপূর্ণ সমাজ-ব্যবস্থার
কাঠামো রচনা করিয়াছে। এহেন সমাজ ও অর্থব্যবস্থা যে
বাস্তবপ্রয়োগযোগ্য, এবেং তা যে মানবতার সকল দু:খ-দারিদ্র,
শোষণ-নিষ্পেষণ এবং
লাঞ্চনা ওঅবমাননার একমাত্র একমাত্র প্রতিষেধক তাহার প্রমাণ বিশ্ব-ইতিহাসের এক
সোনালী অধ্যায়তাহার বাস্তব পরীক্ষা হইয়া গিয়াছে। সেই
অধ্যায়ের বিশিষ্টতা, সৌন্দর্য এবং সার্বজনীনকল্যাণকারিতা স্মরণ করিয়া আজও মানুষ
শ্রদ্ধায় মস্তক অবনমিত করে।
বর্তমান দুনিয়া যে অস্বাভাবিক,
অসমান ও ভুল ত্রুটিপূর্ণ
সমাজ-ব্যবস্থার তলেপড়িয়া নিষ্পেষিত হইতেছে এবং অসংখ্য ও বিরাট সমস্যা মাথাচাড়া
দিয়া উঠিয়া দুনিয়াকেধ্বংসের সুখে নিক্ষেপ করিয়াছে, তাহার সমাধান এবং নিখুঁত কল্যাণ ব্যবস্থার
প্রতিষ্ঠাএকমাত্র এই আল্লাহর মালিকানার ভিত্তিতে গড়া ইসলামী সমাজ-ব্যবস্থায়ই হউক,
কিংবাসামাজিক মালিকানার
সমাজতন্ত্রই হউক-উভয় ব্যবস্থাই অবৈজ্ঞানিক, ধ্বংসকরী এবং মানবপ্রকৃতির সম্পূর্ণ বিরোধী। তাহা কোনদিনই নির্বিশেষে সমগ্র মানুষের কল্যাণ
ব্যবস্থাপ্রতিষ্ঠিত করিতে পারিবে না।
১. ১৯৫১ সালে ১২ই মে দৈনিক ‘আজাদ’পত্রিকার ‘সাহিত্য মজলিস’প্রকাশিত।
পুঁজিবাদী
ও সমাজতান্ত্রিক সমাজে মজুরদের অবস্থা
বর্তমান পৃথিবী যে সব জটিল সমস্যার সম্মুখীন,
মজুর-শ্রমিকদের মজুরি
সমস্যাতন্মধ্যে অন্যতম। মেহনতী জনতার সঠিক ও সুবিচারপূর্ণ মজুরি ও
পারিশ্রমিক কি হইতেপরে-যাহাতে একদিকে শ্রমিকগণ নিশ্চিন্ত ও সচ্ছল জীবন যাপন করিতে
পারে-বর্তমানে এইপ্রশ্নই মানুষের মনকে অত্যন্ত তীব্রভাবে বিব্রত করিয়া তুলিয়াছে।
মজুরি সমস্যা চিরকালই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হিসাবে
পরিগণিত হইয়া আসিলেওশিল্প-বিপ্লবের পরই এই সমস্যা আইন ও নৈতিকতা উভয় দিক দিয়াই
দুনিয়ার রাষ্ট্রসমূহেরপক্ষে অত্যন্ত জটিল হইয়া দেখা দিয়াছে। যন্ত্রের
সাধারণ প্রচলন হওয়ার পূর্বে এক একটিকাজ যেখানে এক হাজার মজুর সম্পন্ন করিত ও তাহা
হইতে নিজেদের জীবিকা অর্জনকরিত-যন্ত্র আবিষ্কৃত ও সাধারণভাবে ব্যবহৃত হইতে শুরু
হওয়ার পর উহা একটি মাত্রযন্ত্র ও কয়েকজন মানুষের দ্বারাই সম্পন্ন হইতে লাগিল,
ফলে ব্যাপকভাবে দেখা
দিলবেকার সমস্যা। আর প্রত্যেক দেশে যেহেতু মেহনতী জনতার সংখ্যাই সর্বাধিক ও
বিপুল হইয়াথাকে, এই জন্য এই সমস্যার জটিলতা কেবল মজুরদের পর্যন্তই সীমাবদ্ধ
হইয়া থাকে না; বরংশেষ পর্যন্ত তাহা জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় সমস্যায় পরিণত হয়। ১৯৫৬ সনের মার্চ মাসেআন্তর্জাতিক শ্রমিক-সংস্থার পক্ষ হইতে
যে রিপোর্ট প্রকাশিত হইয়াছে, তাহাতে দুনিয়ারআড়াইশত কোটি জনতার মধ্যে একশত কোটিই শ্রমজীবি
বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে আর তৎকালীনপূর্ব পাকিস্তানে ইহার সংখ্য হচ্ছে সাত লক্ষ।
বর্তমান বিশ্ব সমাজের যতগুলো আদর্শ ও সমাজ ব্যবস্থা কার্যকর
রহিয়াছে, তন্মধ্যেকোন একটিও এখন পর্যন্ত শ্রমিকদের মজুরী সমস্যার
সুষ্ঠু সমাধান করিতে পারে নাই। যেসব দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত ও সেই সঙ্গে
অবাধ অর্থ শোষণের অবারিত সুযোগ-সুবিধাবিদ্যমান সেইখানে মজুর-শ্রমিকদের ওপর
রাষ্ট্র-সরকারের নিরুংকুশ প্রাধান্য ওএকচ্ছত্র আধিপত্য স্থাপিত হইয়াছে সেখানে
তাহারা বাধ্যতামূলক দাসশ্রম ও সীমাবদ্ধমজুরীর অভিশাপে জর্জরিত হইতেছে। পার্থক্য এই যে, পুঁজিবাদী দেশে মজুর-শ্রমিকগণমজুরী সম্পর্কে
দর কষাকষি করিতে পারে, দাবি-দাওয়া পেশ করিতে, দাবি আদায়ের জন্যবিক্ষোভ প্রদর্শন করিতে পারে,
ধর্মঘটের হুমকী দিতে
পারে এবং শেষ পর্যন্ত ধর্মঘটেরসাহায্যে কর্তৃপক্ষেকে বাধ্য করিয়া নিজেদের দাবি
অনুযায়ী মজুরি ও অন্যান্যসুযোগ-সুবিধা আদায় করিতে পারে। কিন্তু
সেখানে মজুরদের ওপর একমাত্র সরকারের নিরংকুশকর্তৃত্ব কায়েম হইয়া আছে সেখানে
মজুর-শ্রমিকগণ নিজেদের কোন অভাব-অভিযোগ, মজুরীসম্পর্কে আপত্তি কিংবা অতিরিক্তি কোন
দাবি পেশ করিতে পারে না। অন্যথায় নিষ্পেষণ ওশুদ্ধির আঘাতে নিশ্চিহ্ন
হইয়া যাওয়া অবধারিত। কিন্তু উভয় প্রকারের সমাজেই যেব্যাপকভাবে
শ্রমিক অসন্তোষ বিদ্যমান রহিয়াছে এবং কোনমতেই তাহার কোন প্রতিকারব্যবস্থা করা
হইতেছে না, তা সর্বজনবিদিত।
বিগত ১৯৫৪ সনের জানুয়ারী হইতে আগষ্ট পর্যন্ত আমেরিকা,
বৃটেন,
ফ্রান্স,
জাপান ওভারতে যেসব
ধর্মঘট সঙ্ঘটিত হইয়াছে তাহা হইতে বর্তমান ব্যাপক শ্রমিক অসন্তোষসম্পর্কে সুস্পষ্ট
অনুমান করা যাইতে পারে। ১৯৫৪ সনের নভেম্বর মাসে বৃটেনের ডকশ্রমিকগণ যে
ধর্মঘট করিয়াছিল তাহা কয়েক মাস পর্যন্ত স্থায়ী হইয়াছিল। এই
ধর্মঘট শেষহওয়ার পূর্বে ২০ হাজার ডাক শ্রমিকের সঙ্গে ৭০ হাজার রেল শ্রমিকও ধর্মঘটে
অংশগ্রহণকরে। ইহার ফলে বৃটিশ সরকারকে কয়েক কোটি টাকার ক্ষতি স্বীকার
করিতে হয় ও কয়েক মাসপর্যন্ত আভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে
নষ্ট হইয়া যায়।আমেরিকায়ও অনুরূপ ধর্মঘটের কোন সীমা সংখ্যা নাই। ১৯৫৫ সনের মার্কিন দূতাবাস হইতেপ্রকাশিত এক সংবাদে জানা
গিয়াছে যে, কয়েক বৎসর পূর্বে আমেরিকায় ১৪ বৎসর কিংবাতদুর্ধ বয়সের
বেকারদের সংখ্যা হচ্ছে ২৮:৩২:২০৬। আর তাহারা যে মজুর-শ্রমিক ছাড়াঅন্য কোন লোক নয়
তাহা বুঝিতে কোন কষ্ট হওয়ার কথা নয়। ভারতের অবস্থা আরও মারাত্মক।সেখানে
সম্ভবত একটি মাস এমন যায় না যখন সেখানে কোন-না কোন ক্ষেত্রে ধর্মঘট বা দাবিআদায়ের
জন্য বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হয় না। ১৯৫৫ সনে কানপুরে সমস্ত বস্ত্রমিলেরমজুরগণ Rationalisation
এর বিরুদ্ধে কয়েক মাস
পর্যন্ত ধর্মঘট করিয়াছিল, যার ফলেভারতের বস্ত্র-শিল্প কয়েক কোটি টাকার লোকসান স্বীকার
করিতে বাধ্য হয়। এই বিরাটলোকসান দেখিয়া তথাকার সরকার সম্পূর্ণ নীরব ও
নিরপেক্ষ ভূমিকা অবলম্বন করিয়াছিল।অর্থাৎ মজুর-শ্রমিকদের দুরাবস্থা দূরীকরণ এবং
তাহা দূর করিবার জন্য মজুরদেরদাবি-দাওয়া সম্পর্কে ভারত সরকার কোনই দায়িত্ব বোধ করে
নাই। বরং অসহায় ওঅভুক্ত-অর্ধভুক্ত মজুর শ্রমিকদেরকে মুষ্টিমেয়
পুঁজিপতির বজ্র মুষ্ঠিতে সোপর্দ করিয়াদিয়া জাতীয় সরকার সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত ভূমিকা
অবলম্বন করে। একটি ধর্মহীন পুজিবাদীগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মজুরদের যে কি
দুরাবস্থা ভারত সরকারের নিষ্ক্রীয় ভূমিকা ওভারতের মজুরদের অবস্থা হইতেই
সুস্পষ্টরূপে বুঝতে পারা যায়।
১৯৬৪ সনেঅক্টোবরে-নভেম্বর মাসে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান চটকল শ্রমিক ফেডারেশনের উদ্যোগেচটকল সমূহে যে ব্যাপক ও একটানা দেড় মাসাধিকালের ধর্মঘট চলে এবং এ ব্যাপারে তৎকালীনসরকার যে নিরপেক্ষ ভূমিকা অবলম্বন করে, তাহাও এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য।
১৯৬৪ সনেঅক্টোবরে-নভেম্বর মাসে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান চটকল শ্রমিক ফেডারেশনের উদ্যোগেচটকল সমূহে যে ব্যাপক ও একটানা দেড় মাসাধিকালের ধর্মঘট চলে এবং এ ব্যাপারে তৎকালীনসরকার যে নিরপেক্ষ ভূমিকা অবলম্বন করে, তাহাও এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য।
রাশিয়া, চীন ও পূর্ব ইউরোপের যে সব দেশের মজুরদের রাজত্ব কায়েম
রয়েছে, রাষ্ট্রেরনির্মম ও নিরংকুশ নিয়ন্ত্রণের দরুন সে সব দেশের
মজুরদের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কেআমরা খুব বেশি কিছু জানিতে পারি না। কিন্তু তা সত্ত্বেও শাসকদের অনুবীক্ষণ হইতেবাঁচিয়ে যেসব
তথ্য প্রকাশিত হয় কিংবা বৈদেশিক পর্যটকদের মারফতে বহির্বিশ্ব যাহাকিছু জানিতে পারে
তাহা হইতে এতটুকু অনুমান করা কিছুমাত্র কঠিন নয় যে, এই সবমজুর-রাষ্ট্রে শ্রমিক মজুরদের অবস্থা
পুজিবাদী দেশ বিশেষত: আমেরিকা, বৃটেন ওফ্রান্স প্রভৃতি দেশের মজুরদের অপেক্ষা কিছুমাত্র
উন্নত নহে। মেহনতী জনতাকে শ্রান্তও দমন করিবার জন্য সেখানে কর্মীদের নির্মম
হস্তে ধোলাই করা হয়, অপরদিকে কঠোরবাধ্যতামূলক শ্রম ও সীমাবদ্ধ মজুরির নিপীড়নে
তাহাদিগকে জর্জরিত হইয়া থাকিতে হয়।
যেসব দেশে বাক-স্বাধীনতা রহিয়াছে এবং যেসব দেশের সরকার বার্ষিক
রিপোর্ট ইত্যাদিপ্রকাশ করিয়া থাকেন, সে সব দেশের মজুর-শ্রমিকদের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে
সঠিক তথ্যজানিতে কোন অসুবিধা হয় না। কিন্তু যেখানে কেবল মুখ ও লেখনীর উপরই নহে
মানুষেরচিন্তা ও কল্পনা শক্তির উপর পর্যন্ত কঠোর পাহারা বসানো হইয়াছে,
সেখানকার মজুরদেরঅবস্থা
সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য তথ্য সংগ্রহ করা বড়ই কঠিন ব্যাপার। কিন্তু
তবুও যতটুকুবিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে তা-ই এখানে পেশ করা যাইতেছে।
রাশিয়ার সরকারী সংবাদসরবরাহ প্রতিষ্ঠান তাস-এর পাক্ষিক মুখপত্র ‘সোভিয়েত দেশ’এ সোভিয়েট রাশিয়ায় কি সাম্যপ্রতিষ্ঠিত হইয়াছে’ শীর্ষক প্রবন্ধে মজুরদের অবস্থা লিখিতে গিয়া বলা হইয়াছে: তাহাদেরবাস্তব প্রয়োজন পূরণ করিবার ব্যাপারে এখানো পুরোপুরি সাম্য কায়েম করা হয় নাই। কেননাতাহারা সমাজ হইতে নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী নহে; বরং শ্রম মেহনত অনুযায়ী অংশ পাইয়াথাকে। ইহা শ্রমিকদের প্রয়োজন পূরণের ব্যর্থতা সম্পর্কে এমন একটি রাষ্ট্রের স্পস্টস্বীকৃতি যা বিগত ৩৮ বৎসর পর্যন্ত দুনিয়ার অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠার শ্লোগান দিয়াআসিতেছে।
রাশিয়ার সরকারী সংবাদসরবরাহ প্রতিষ্ঠান তাস-এর পাক্ষিক মুখপত্র ‘সোভিয়েত দেশ’এ সোভিয়েট রাশিয়ায় কি সাম্যপ্রতিষ্ঠিত হইয়াছে’ শীর্ষক প্রবন্ধে মজুরদের অবস্থা লিখিতে গিয়া বলা হইয়াছে: তাহাদেরবাস্তব প্রয়োজন পূরণ করিবার ব্যাপারে এখানো পুরোপুরি সাম্য কায়েম করা হয় নাই। কেননাতাহারা সমাজ হইতে নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী নহে; বরং শ্রম মেহনত অনুযায়ী অংশ পাইয়াথাকে। ইহা শ্রমিকদের প্রয়োজন পূরণের ব্যর্থতা সম্পর্কে এমন একটি রাষ্ট্রের স্পস্টস্বীকৃতি যা বিগত ৩৮ বৎসর পর্যন্ত দুনিয়ার অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠার শ্লোগান দিয়াআসিতেছে।
মজুরগণ তাহাদের প্রয়োজন অনুযায়ী কবে ও কোন দিন উৎপাদনের অংশ
পাবে, কিংবা আদৌকোনদিনই পাবে কিনা তাহা নিশ্চিত করিয়া বলা মুশকিল। কিন্তু পরিশ্রম অনুযায়ী তাহারাকত এবং কিভাবে মজুরি পাইয়া
থাকে এবং তাহাদের শ্রমের সঠিক মূল্য নির্ধারণ কারা করিয়াথাকে,
তাহা অবশ্যই আলোচিত হইবে। উপরোন্ত সরকারী সাধারণ কর্মচারী ও মজুর-শ্রমিকদেরমজুরির
ক্ষেত্রে যে পার্থক্য রহিয়াছে তাহাও বিশেষভাবে লক্ষণীয়। ভারতের
প্রখ্যাতসমাজতান্ত্রিক নেতা মিসেস সূচেতা কৃপালনী ১৯৫৪ সনের মধ্যভাগে রাশিয়া
সফরান্তে যেবিবৃতি দিয়াছিলেন তাহার একাংশ এখানে উদ্ধৃত করা যাইতেছে;
তিনি
বিবৃতিতেবলিয়াছিলেন:
শ্রমিকদের সঠিক মজুরি কত, তাহা জানিতে পারা আমাদের পক্ষে কঠিন ছিল। যখনই আমরাবিশেষ কোন শিল্পক্ষেত্রে সেখানকার মজুরদের উচ্চ ও
নিম্ন বেতনের পরিমাণ জানিতেচাহিয়াছি তখনই আমাদিগকে মাঝামাঝি পরিমাণই বলা হইয়াছে। তাহারা পরও খুটিয়া খুটিয়াজিজ্ঞাসা করিলে পরে জানা গেল যে,
নিম্নতম মজুরি হইতেছে
পাঁচশত রুবেল, অথচ কারখানারডাইরেক্টর পাঁচ হাজার হইতে সাত হাজার রুবেল
পর্যন্ত বেতন পাইয়া থাকেন। অর্ধ সপ্তাহিক‘দাওয়াত’২৫ জুলাই ১৯৫৪।
লক্ষ্যণীয় বিষয় এই যে, খুটিয়া খুটিয়া জিজ্ঞাসা করিবার পরই এই নিম্নতম
মজুরিজানিতে পারা সম্ভব হইয়াছে। দ্বিতীয়ত: ইহাও অসম্ভব নয় যে,
ইহা সেই কারখানার
অবস্থাওহইতে পারে, যাহা কমিউনিষ্ট রাষ্ট্রের মধ্যে সর্বোত্তম ও যা বিদেশী
পর্যটকদেরদেখাইবার জন্য ও বহির্বিশ্বে সুনাম অর্জন করিবার উদ্দেশ্যে বিশেষভাবে
নির্দিষ্টকরিয়া রাখা হইয়াছে।
তদুপরি পাক-ভারতের লোকদের নিকট পাঁচ শত রুবেল খুব বিরাট
কিছু মনে হইবে এবং তাহারামনে করিবে যে, সেখানকার নিম্ন বেতনভোগী সাধারণ মজুরদেরও জীবন
মান বুঝি কতই নাউন্নত! কিন্তু রাশিয়ার দ্রব্যমূল্যের উচ্চতা ও বেতনের মধ্যে যে
৫০-১ পার্থক্য রয়েছেসেই দৃষ্টিতে যাচাই করিলে পাঁচ শত রুবেলের কোন ধোকাই টিকিয়া
থাকিবে না। মজুরি কমকিংবা বেশি তাহা নির্ধারণের জন্য দ্রব্যমূল্যই
হইতেছে সঠিক মাপকাঠি।এই জন্য এইখানেতাহার একটি চার্ট দেওয়া যাইতেছে।
১৯৫৪ সনের আগস্ট মাসে ভারতীয় পার্লামেন্টের প্রভাবশালী
সদস্য জ্ঞানী গৌরমুখ সিংহরাশিয়া সফর করিয়া যে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়াছেন,
এখানে তাহার
কিছুটাউল্লেখ করা যাইতেছে। তিনি বলিয়াছেন:
“রাশিয়ার সাধারণ প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্য
দেখিলে পাঁচশত রুবেল মজুরির রহস্যবুঝিতে পারা যায়। মনে
রাখা দরকার যে, একটি রুবলের মূল্য আমাদের দেশী টাকা অনুসারে১,০৯ টাকা মাত্র; কিন্তু সেখানে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদীর
মূল্য নিম্নরূপ:
একটিডিমের মূল্য ৩ রুবেল, একটি মোরগের মূল্য ২৫ রুবেল, টমেটোর প্রতি কেজি মূল্য ২ রুবেল, দুগ্ধ প্রতি কেজি মূল্য ২০ রুবেল, আলুর প্রতি সের মূল ৬ রুবেল, মূলার প্রতি কেজিমূল্য ৫ রুবেল, গাজর প্রতি কেজি মূল্য ৮ রুবেল শালগমের প্রতি কেজি মূল্য ৭ রুবেল, ডবলরুটির প্রত্যেকটির মূল্য ২ রুবেল, বকরীর গোশত প্রতি সের মূল্য ১৮ রুবেল, ৬ সিট কাগজেরমূল্য ৪ রুবেল, একটি শীতল কোর্তার মূল্য ৪ রুবেল, গমের এক মণ মূল্য ৮৫ রুবেল, মেয়েদের ছোট ব্যাগ প্রতিটি ৯০ রুবেল।এইখানে শুধুমাত্রকয়েকটি জিনিসের মূল্যের উল্লেখ করা হইল। ইহা হইতে সহজেই বুঝিতে পারা যায় যে, সেখানেএকজন মজুর পাঁচশত রুবেল বেতন পাইলেও তাহার জীবন মাত্রা মোটেই সচ্ছল হইতে পারে না। আরকেবল রাশিয়ায়ই নহে, প্রতিটি কমিউনিস্ট দেশেরই এই অবস্থা। আন্তর্জাতিকশ্রমিক-প্রতিষ্ঠানের তরফ হইতে সাম্প্রতিক প্রকাশিত এক ইশতেহার হইতে এইসব দেশেরশ্রমিকদের মর্মান্তিক অবস্থা সম্পর্কে অনুমান করা যায়। তাহাতে স্পষ্ট স্বীকার করাহইয়াছে যে, “চেকোস্নোভাকিয়ার মজদুরদের দ্বারা ক্রীতদাসেদের ন্যায় কাজ সম্পন্ন করাঅত্যন্ত ভয়ানক পদ্ধতি। রাশিয়ার আইনে রাজনৈতিক সন্দেহসূত্রে শ্রমিকদিগকে বাধ্যতামূলকদাস শ্রমিকদের ক্যাম্পে বন্দী করিয়া রাখার সুযোগ রহিয়াছে।
একটিডিমের মূল্য ৩ রুবেল, একটি মোরগের মূল্য ২৫ রুবেল, টমেটোর প্রতি কেজি মূল্য ২ রুবেল, দুগ্ধ প্রতি কেজি মূল্য ২০ রুবেল, আলুর প্রতি সের মূল ৬ রুবেল, মূলার প্রতি কেজিমূল্য ৫ রুবেল, গাজর প্রতি কেজি মূল্য ৮ রুবেল শালগমের প্রতি কেজি মূল্য ৭ রুবেল, ডবলরুটির প্রত্যেকটির মূল্য ২ রুবেল, বকরীর গোশত প্রতি সের মূল্য ১৮ রুবেল, ৬ সিট কাগজেরমূল্য ৪ রুবেল, একটি শীতল কোর্তার মূল্য ৪ রুবেল, গমের এক মণ মূল্য ৮৫ রুবেল, মেয়েদের ছোট ব্যাগ প্রতিটি ৯০ রুবেল।এইখানে শুধুমাত্রকয়েকটি জিনিসের মূল্যের উল্লেখ করা হইল। ইহা হইতে সহজেই বুঝিতে পারা যায় যে, সেখানেএকজন মজুর পাঁচশত রুবেল বেতন পাইলেও তাহার জীবন মাত্রা মোটেই সচ্ছল হইতে পারে না। আরকেবল রাশিয়ায়ই নহে, প্রতিটি কমিউনিস্ট দেশেরই এই অবস্থা। আন্তর্জাতিকশ্রমিক-প্রতিষ্ঠানের তরফ হইতে সাম্প্রতিক প্রকাশিত এক ইশতেহার হইতে এইসব দেশেরশ্রমিকদের মর্মান্তিক অবস্থা সম্পর্কে অনুমান করা যায়। তাহাতে স্পষ্ট স্বীকার করাহইয়াছে যে, “চেকোস্নোভাকিয়ার মজদুরদের দ্বারা ক্রীতদাসেদের ন্যায় কাজ সম্পন্ন করাঅত্যন্ত ভয়ানক পদ্ধতি। রাশিয়ার আইনে রাজনৈতিক সন্দেহসূত্রে শ্রমিকদিগকে বাধ্যতামূলকদাস শ্রমিকদের ক্যাম্পে বন্দী করিয়া রাখার সুযোগ রহিয়াছে।
অত:পর চীনের মজুর শ্রমিদের অবস্থা সম্পর্কেও খানিকটা আলোচনা
করিতে চেষ্টা করিব।কেননাআমাদের দেশের এক শ্রেণীর কমিউনিস্ট প্রচারক আজকাল কথায়
কথায় চীন দেশের দোহাইদিয়া থাকেন।
১৯৫৩ সনে এপ্রিল মাসে ‘ইন্ডিয়ান ওযার্কার্স ডেলিগেশন’এর
সদস্য হিসাবে ব্রজকিশোরশাস্ত্র সরকারী আমন্ত্রণক্রমে চীন গমন করে। সেখানে তিনি মজুর-শ্রমিকদের অবস্থাজানিবার জন্য বিশেষ
কৌতুহল প্রকাশ করেন। প্রায় ছয় সপ্তাহ কাল পর্যন্ত চীন ভ্রমণকরিয়া
তিনি সেখানকার মজুর-শ্রমিকদের সম্পর্কে যে অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করিয়াছেন,
তাহা নিম্নরূপ:
“এখানে আমরা হালের সঙ্গে বলদের পরিবর্তে
মেয়েলোককে বাঁধা দেখিয়াছি। সে কতমর্মান্তিক ও অমানুষিক দৃশ্য। মেয়েলোক-তাহাকে হালের সঙ্গে বাঁধিয়া দেওয়াহইয়াছে।
চীনের ইংয়াংস্টেরি ভারপ্রোজেক্ট-এ সব মজুর শ্রমিককে তিনি
কাজ করিতে দেখিয়াছেন, তাহাদের সম্পর্কে তিনি বলেন:
“এই প্রোজেক্ট-এর নিকটে অফিসারদের থাকিবার
বাংলা নির্মাণ করা হইয়াছে। প্রায় পাঁচহাজার মজুর এখানে কাজ করে। সকল প্রকার পাথর ভাঙ্গা হইতে শুরু করিয়া সুড়ঙ্গ খোদাইকরা
কিংবা পাথরে চটান স্থানান্তরিত করা,প্রভৃতি যাবতীয় কাজই অনাবৃত হাতে করা হইয়াছে।মজুরগণ
যে সব হাতিয়ার ব্যবহার করিতেছিল, তাহা ছিল খুবই দুর্বল ও প্রায় অকেজো এবংনিকৃষ্ট ধরণের। মনে হইতেছিল যে, তাহা কোন যাদুঘর হইতে আনা হইয়াছে।
তিনি বলেন, “আমি
এই দৃশ্য দেখিয়া মুহূর্তের জন্য হতচেতন হইয়া পড়িলাম। চীন
দেশেরমেহনতী লোকদের দ্বারা যেভাবে কাজ করানো হইতেছে তাহা দেখিয়া তাহার অনুকরণ করা
যাতাহা হইতে কোন প্রকার প্রেরণা লাভ তো দূরের কথা; বরং বড়ই দু:খ ও বেদনা পাইলাম। আমিভীত বিহ্বল হইয়া পড়িলাম। মানুষ
আর যাহাই হউক জন্তু নয়। কোন দেশের উন্নয়নের ব্যাপারেজন্তুদের স্থানে
মানুষকে ব্যবহার করা মানবতার উপর নির্মম জুলুম ও চরম অমানুষিকতাভিন্ন আর কি হইতে
পারে?
ইহার প্রতিবাদ করারও ভাষা নাই। মজুরদের
বেশির ভাগ বহু দূর-দুরাঞ্চল হইতে আনাহইয়াছে। বর্তমান
চাকুরী ছাড়িয়া অন্যত্র যাওয়ার তাহাদের কোন পথ নাই। মূলত
চীনাকমিউনিষ্ট পার্টি ও প্রেসিডেন্ট মাও সেতুং এখানে বাধ্যতামূলক অমানুষিক
শ্রমেররাশিয়া-পরীক্ষিত ‘কার্যপদ্ধতি’প্রয়োগ করিয়াছেন।
প্রত্যক্ষদর্শী ও সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী শাস্ত্রী মহাদয়ের এই
বিবরণের পর চীনামজুরদের অবস্থা সম্পর্কে আর বেশি কিছু বলিবার প্রয়োজন নাই। অবশ্য উল্লেখযোগ্য এইযে, এইরূপ বাধ্যতামূলক অমানুষিক প্ররিশ্রমের পর
তাহারা মজুরী বাবদ যাহা কিছু পায়তাহা পাক-ভারতের সরকারী অফিস ও কারখানার মজুরদের
বেতন অপেক্ষা অনেক কম।
একজন চীনা শ্রমিক এক হাজার পনেরো শত ‘ইয়ান’কিংবা
পঞ্চাশ ইউনিট পারিশ্রমিক পাইয়াথাকে। (এক ‘ইয়ান’তৎকালীন পাকিস্তানের এক পয়সার একটু বেশি ও এক
ইউনিট আট আনা কিংবাতাহার একটু বেশির সমান’আর পঞ্চাশ ইউনিটে আমাদের ২৫/২৬ টাকার সমান হয়)। এই সামান্যও সংক্ষিপ্ত পারিশ্রমিক নিয়ে একজন শ্রমিক যখন
বাজারে যায় তখন চেতনা হরণকারীদ্রব্যমূল্যের সম্মুখীন হইতে হয়। এই
প্রসঙ্গে শাস্ত্রী মহোদয় বলেন:
“নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্য ভারত
অপেক্ষা চীনদেশে অনেক বেশি। চাউল, কাপড়, তৈল, লবণের মূল্য অপেক্ষা পঞ্চাশ ভাগ বেশি। এতদ্ব্যতীত অন্যান্য জিনিসের মূল্যসম্পর্কে ধারণা করাও কঠিন।”
প্রত্যক্ষদর্শীর এই বর্ণনার ভিত্তিতে অনায়াসেই এই প্রশ্ন
করা যাইতে পারে যে, বৃটেন ফ্রান্স আর স্বয়ং আমাদের দেশে অন্তত: সরকারী মজুর ও
কারখানার কুশলীরাও কি এইঅপেক্ষা অনেক বেশি বেতন বা মজুরি পায় না?
আর চীন অপেক্ষা এই সব
দেশের দ্রব্যমূল্যওকি অনেক কম নয়? এতৎসত্ত্বেও আজ এদেশের এক শ্রেণীর কমিউনিস্ট চীন ও রাশিয়াকে‘স্বর্গরাজ্য’ বলিয়া মনে করে এবং অবুঝ যুবক-যুবতীদের সাহায্যে বিভ্রান্ত
করিতেচেষ্টা করে। বাস্তব অভিজ্ঞতা ও সঠিক জ্ঞানের আলোকে এই সব অজ্ঞতা ও
বিভ্রান্তিরঅন্ধকার যতশীঘ্র দূর হইয়া যায় মানবতার পক্ষে ততই মংগল-তাহাতে কোন
সন্দেহ নাই।
সাপ্তাহিক ‘জাহানেও নও’পত্রিকার শ্রমিক উন্নয়ন সংখ্যায় প্রকাশিত।
ইসলামে
মজুরদের অধিকার
বর্তমান দুনিয়ার পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থা এবং জমিদারী ও
সামন্ততান্ত্রিকভূমি-ব্যবস্থা মারাত্মকরূপ ধারণ করিয়াছে। একদিকে
আজ পুঁজিদার কারখানা মালিকদের হাতেমজুর-শ্রমিকগণ, অপরদিকে বড় বড় জমিদার সামন্তদের কবলে গরীব
কৃষকগণ নির্মমভাবে শোষিতও নিষ্পেষিত হইতে। অভাব
ও দারিদ্র, অনশন ও অর্ধাশসনের উপর হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম
তাহাদেরস্বাস্থ্যের মেরুদন্ড ভাঙিয়া দিয়াছে। শ্রেণী
বৈষম্যমূলক আচার-আচারণ তাহাদের নৈতিক ওমানসিক শক্তিকে ক্ষুন্ন করিয়াছে।
কৃষক-মজুরদের এই চরম দুরবস্থাকে একদল মানুষ নিজেদের
স্বার্থ-সিদ্ধির হাতিয়ারহিসাবে ব্যবহার করিতেছে। তাহারা
মার্কস-লেলিনের প্রেতাত্মা স্ট্যালিন-ক্রশ্চেভেরগুপ্তচর হইয়া পৃথিবীর সর্বত্র
ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। সমগ্র পৃথিবীকে কমিউনিস্ট সমাজব্যবস্থার লৌহ-নিগড়ে বন্দী
করিবার উদ্দেশ্যে কুটিল ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হইয়া আছে।বর্তমান
দু:খী ও বঞ্চিত মানবতাকে চীন রাশিয়ার সুখী (?) সমাজের উন্নত (?) জীবনধারারবিচিত্র কাহিনী শুনাইয়া প্রলুব্ধ
করিতেছে এবং দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের কারখানা আরজমির মালিকদের বিরুদ্ধে তাহাদিগকে
বিক্ষুব্ধ করিয়া তুলিতেছে। “তোমাদের
সকল প্রকারদু:খ এবং দুর্গতির অবসান (?) ঘটাইতে পারে একমাত্র কমিউনিজন এবং কমিউনিস্ট
সমাজ ওরাষ্ট্রব্যবস্থা ভিন্ন অন্য কোন আর্দশের তোমাদের দুরবস্থা দূর করিতে পারে
না-প্রচ্ছন্ন অপ্রচ্ছন্ন সকল প্রকার কমিউনিস্টদের মুখে এই প্রচারণা বনাম প্ররোচনা
খুবজোরালো হইয়া উঠিয়াছে। দুনিয়ার অন্যান্য দেশের ন্যায় এই দেশেও চীন ও
রাশিয়ার অসংখ্যগুপ্তচর বিভিন্ন বেশে কাজ করিয়া যাইতেছে। চাষী
মজুরদের প্রতি সহনুভূতি প্রদর্শনকরিয়া অন্ন বস্ত্রের আওয়াজ তুলিয়া আন্দোলন আর
সংগঠনের কাজ অবিশ্রান্তভাবে-আর কতকটাঅবাধে-চালাইয়া যাইতেছে।
অপরদিকে কমিউনিজমের এই প্রচারণার গতিরোধ করিবার উদ্দেশ্যে
যেসব উপায় অবলম্বন করাহইতেছে তাহা এতই হাস্যকর যে, সমাজ-বিজ্ঞান সম্পর্কে সামান্য ধারণা থাকিলেই
ইহারবাতুলতা স্পষ্ট বুঝিতে পারা যায়। কমিউনিজম আর কমিউনিস্টদের দোষ-ত্রুটি,
অন্যায়-অনাচার,
নির্যাতন আর
অসচ্ছরিত্রের কথা বর্ণনা করা, প্রচার করা আরবক্তৃতা-বিবৃতি দেওয়াই উহার সয়লাব-স্রোত রোধ
করিবার জন্য কিছুমাত্র যথেষ্ট নয়।সেইজন্য দরকার বর্তমান সমাজের এই অশান্ত ও অসম
অবস্থার পরিবর্তন সাধন করা, একউন্নতকর সুষ্ট অর্থ ব্যবস্থার সাহায্য মজুর-শ্রমিক-তথা
কোটি কোটি মানুষের অর্থনৈতিকদুর্গতির চির অবসান ঘটান। বস্তুত
কমিউনিজমের সয়লাব স্রোতের এ-ই একমাত্র প্রতিরোধব্যবস্থা,
অন্য কিছু নয়। ভুল আদর্শই হউক আর বিজ্ঞানসম্মত সত্য আদর্শই হউক,
কেবলফাঁকা বুলি দ্বারা
কমিউনিজমের পতিরোধ করা বা উহার প্রচার বন্ধ করা কিছুতেই সম্ভবনয়। যতদিন পর্যন্ত বর্তমান সমাজে এই মৌলিক ত্রুটিগুলি এবং
সামাজিক শোষণ-পীড়ণ ওঅবিচারের ভিত্তিমূল চূর্ণ করা না হইবে,
যতদিন এ অবস্বাভাবিক
অর্থনৈতিক অসামাঞ্জস্যদূর করিয়া এক সুস্থ, সুন্দর, সুমৃদ্ধ, সুসমঞ্জস সমাজের সৃষ্টি করা না যাইবে,
ততদিনকমিউনিজমের
সংক্রামক ব্যাধি কিছুতেই দুর করা যাইবে না।
কাজেই আজ বিশেষভাবে কমিউনিজমের মৌলিক দোষত্রুটি এবং
ভিত্তিগত ধ্বংসকারিতারবৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ করিবার সঙ্গে সঙ্গে মজুর-কৃষক তথা গোটা
সমাজের সম্মুখে অপর একটিপূর্ণাঙ্গ অর্থ-ব্যবস্থা সুষ্ঠুরূপে পেশ করিতে হইবে। এই কাজ শুধু মুখে করিলেইচলিবেনা,
বাস্তব কর্মাদর্শ ও
কার্যকর প্রোগ্রাম লইয়াই এক দিকে অগ্রসর হইতে হইবে এবংবাস্তব ক্ষেত্রে উহার
পুন:প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করিতে হইবে। বলা বাহুল্য, এই ধরনেরঅর্থব্যবস্থা-যাহা সর্বপ্রকার
সৌন্দর্য ও সার্বজনীনতাপূর্ণ এবং ইহকাল ও পরকালের সকলরকম কল্যাণ ব্যবস্থার মূল উৎস
হইতে পারে, তাহা ইসলাম ছাড়া আর কিছুই নহে। বর্তমানপ্রবন্ধে
ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় মজুর-শ্রমিক আর কৃষকদের অধিকার সম্পর্কে বিস্তারিতআলোচনা
করিতে চাই।এই আলোচনার সুযোগে আমি এদেশের জমি-মালিক,
পুঁজিদার ও
কারখানামালিকদিগকে অবিলম্বে ইসলাম নির্দিষ্ট অধিকার সংরক্ষণমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ
করিবারজন্য অনুরোধ করিব। কারণ, তাহাতেই সকল শ্রেণীর মানুষ-তথা গোটা দেশের
কল্যাণএকান্তভাবে নিহিত রহিয়াছে; আর তাই সকল প্রকার অমঙ্গল ও ভাঙ্গন-বিপর্যয়ের নির্মমআঘাত
হইতে গোটা সমাজকে রক্ষা করিতে পারে।
সর্বপ্রথম একথা সুস্পষ্টরূপে জানিয়া লওয়া দরকার যে,
মজুরি খাটা অর্থাৎ
নির্দিষ্টপারিশ্রমিকের বিনিময়ে পরের কাজ করা, অন্য কথায় শ্রমের মূল্য আদায় করা বা
গ্রহণকরা-ইসলামের দৃষ্টিতে কিছুমাত্র হীন বা ঘৃণার্হ কিংবা বর্জনীয় নয়। বিশ্ব নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এর
নিকট জিজ্ঞাসা করা হইয়াছিল: اَيُّ
الْكَسِبَ اَطْيَبُ“কোনপ্রকারের উপার্জন
উত্তম ও পবিত্রতর।”উত্তরে
তিনি ইরশাদ করিয়াছেন: “ব্যক্তির নিজশ্রমের উপার্জন এবং সৎ ব্যবসায় লব্ধ মুনাফা।”
পরিশ্রম
করিয়া উপার্জন করিবার প্রতি উৎসাহদান করিবার জন্য তিনি বলিয়াছেন:اَلْكَاسِبُ حَبِيْبُ اللهِ
হালাল উপায়ে উপার্জনকারী ব্যক্তি আল্লাহর বন্ধু।
অপরএক হাদীসে বলা হইয়াছে:
اِنَّ اللهَ يُحِبُّ الْعَبْدِ الْمُخْتَرِفِـ
উপার্জনের কোন পেশা গ্রহণকারী বান্দাহকে আল্লাহ তা’আলা ভালবাসেন।
তিনি আরোবলিয়াছেন:
اِنَّ اللهَ يُحِبُ الصّا نِعَ الْحَاذِقَ ـ
চতুর ও দক্ষশিল্পীকে আল্লাহ তা’আলা ভালবাসেন।
অপরএক হাদীসে বলা হইয়াছে:
اِنَّ اللهَ يُحِبُّ الْعَبْدِ الْمُخْتَرِفِـ
উপার্জনের কোন পেশা গ্রহণকারী বান্দাহকে আল্লাহ তা’আলা ভালবাসেন।
তিনি আরোবলিয়াছেন:
اِنَّ اللهَ يُحِبُ الصّا نِعَ الْحَاذِقَ ـ
চতুর ও দক্ষশিল্পীকে আল্লাহ তা’আলা ভালবাসেন।
সদুপায় অর্থ উপার্জনের প্রতি মানুষকে পথনির্দেশ করিবার কাজ
তিনি কেবল মুখেমুখেবলিয়াই সমাধা করেন নাই। তিনি
নিজে কার্যত পরিশ্রম করিয়া উপার্জনও করিয়াছেন, অন্যেরমূলধনে নিজের শ্রম যোগ করিয়া ব্যবসা
করিয়াছেন। আলী রা. কুপ হইতে
পানি তুলিয়াখেজুরের বাগান সিক্ত করিয়াছেন এবং এই পরিশ্রমের বিনিময়ে তিনি কিছু
পরিমাণ খেজুরমজুরী স্বরূপ গ্রহণ করিয়াছেন। এইভাবে
যাহারাই একনিষ্টভাবেইসলামী আদর্শ অনুসরণকরিয়া চলিয়াছেন,
তাহারা শ্রম ও মজুরির
সাহায্য উপার্জন করিয়া দুনিয়ার সম্মুখেসুস্পষ্ট নিদর্শন সংস্থাপন করিয়া গিয়াছেন। ইমামগণ, প্রায় সকল শ্রেষ্ঠ আলিম ও ফিকাহশাস্ত্রবিদগণ পর্যন্ত মজুরি
ও সাধারণ পেশার কাজ করিয়া রোজগার করিয়াছেন। এই
সম্মানিতব্যক্তিদের আদর্শ ও জীবন-কাহিনী দুনিয়ার ইতিহাসে উজ্জল অক্ষরে লিখা থাকিবে।
উমর ফারুক (রা) বলিয়াছেন, “তোমাদের
মধ্যে কোন ব্যক্তি যেন শ্রম-মেহনত করিয়াঅর্থোপার্জনের কাজ বন্ধ করিয়া না দেয় এবং
এই বলিয়া যেন বেকার হইয়া বসিয়া না থাকেযে, “হে
খোদা তুমি আমাকে খাবার দাও”। কারণ
তোমরা ভাল করিয়া জান যে, আকাশ হইতে সোনাচান্দি ঝরিয়া পড়ে না।”
এক কথায় জীবিকা উপার্জনের জন্য কোন পেশা অবলম্বন করা,
সৎ চাকরী বা মজুরি
খাটিয়াজীবন যাপন করা ইসলামের দৃষ্টিতে মূলত অন্যায় বা নিন্দনীয় নয় এবং উপার্জনের
সঙ্গতকোন উপায় অবলম্বন করিবার দরূন কাহারো মনে কোনরূপ হীনতাবোধ জাগ্রত হওয়াও উচিৎ
নয়।মজুর নিজে নিজেকে কখনো ছোট ও নীচ মনে করিবে না,
আর কারখানার মালিককেও
কোনদিকে দিয়াইশ্রেষ্ঠ বলিয়া বোধ করিবে না। পক্ষান্তরে
কারখানা মালিক নিজেও নিজেকে মজুর অপেক্ষাশ্রেষ্ঠতর এবং মজুরকে নিজ অপেক্ষা হীনতর
বলিয়া মনে করিবে না। বস্তুত পণ্যৎপাদনেরব্যাপারে শ্রম ও মূলধনের
সমন্বয় অপরিহার্য।কারণ তাহা ব্যতীত পণ্যৎপাদনের ব্যাপারেশ্রম ও মূলধনের
সমন্বয় অপরিহার্য। কারণ তাহা ব্যতীত পণ্যৎপাদন মাত্রই সম্ভব নয়।তাই
এই উদ্দেশ্যে পুঁজিদার ও শ্রমিকের সমন্বয় সাধন একান্ত আবশ্যক। অতএব
পরস্পরপরস্পরকে পাণ্যৎপাদনের ক্ষেত্রে সহকারী ও সহযোগী বলিয়া মনে করিবে।
ইসলামী
সমাজে মজুরদের মর্যাদা ও অধিকার
বুখারী শরীফের একটি হাদীসে মজুর ও চাকরদের অধিকার সম্পর্কে
যথেষ্ট আলোকপাতকরা হইয়াছে। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
আবূ বকর (রা) কে সম্বোধন করিয়া একদা মজুরদাসদের সম্পর্কে বলিয়াছেন:
هُمْ اَخْوَ اَنُكُمْ جَعَلَهُمُ اللهُ
تَحْتَ اَيْدِيْكُمْ ـ فَمَنْ جَعَلَ اللهُ اَخَاهُ تَحْتَ يَدِه فَلْيُعْمَهُ
مِمَّا يَأكُلُيُلْبِسْهُ مِمَّا يَلْبِسُ وَلاَ يُكَلّفُهُ مِنَ الْعَمَلِ
مَانُغْلِبُهُ فَاِنْكَلِّفُهُ مَا يُغْلِيُعِنْهُ عَلَيْهِ ـ (رواه البخاري)
যাহারা তোমাদের কাজ করিয়াজীবিকা উপার্জন করে সেই মজুর ও দাস তোমাদের ভাই-আল্লাহ তাহাদিগকে তোমাদের অধীনকরিয়া দিয়াছেন। কাজেই যাহার কাছে এইরূপ লোক রহিয়াছে, তাহাকে যেন সে তাহাই খাইতে দেয়যাহা সে নিজে আহার করে; আর তাহাকে যেন তাহাই পরিতে দেয়, যাহা সে নিজে পরিধান করে।তাহার সাধ্যশক্তির অতীতে কোন কাজের চাপ যেন তাহাকে না দেয়। দিলে সে কাজ সমাধাকরিবার ব্যাপারে যেন তাহাকে উপযুক্ত সাহায্য ও সহযোগিতা দান করে।
যাহারা তোমাদের কাজ করিয়াজীবিকা উপার্জন করে সেই মজুর ও দাস তোমাদের ভাই-আল্লাহ তাহাদিগকে তোমাদের অধীনকরিয়া দিয়াছেন। কাজেই যাহার কাছে এইরূপ লোক রহিয়াছে, তাহাকে যেন সে তাহাই খাইতে দেয়যাহা সে নিজে আহার করে; আর তাহাকে যেন তাহাই পরিতে দেয়, যাহা সে নিজে পরিধান করে।তাহার সাধ্যশক্তির অতীতে কোন কাজের চাপ যেন তাহাকে না দেয়। দিলে সে কাজ সমাধাকরিবার ব্যাপারে যেন তাহাকে উপযুক্ত সাহায্য ও সহযোগিতা দান করে।
আমাদের কারখানার মালিকগণ যদি খাঁটি খাঁটি মুসলিম হইয়া
বিশ্বনবীর এই আদেশ অনুসারেকাজ করিতে শুরু করিয়া, পক্ষান্তরে মজুর কৃষকগণ যদি মার্কস-লেলিনের
ফাঁকা বুলির মোহত্যাগ করিয়া ইসলাম প্রদত্ত অধিকার আদায়-করিবার জন্য সঠিক ইসলামী
পন্থায় আন্দোলনকরে, তাহা হইলে শ্রেণী-বিদ্বেষ ও শ্রেণী-সংগ্রাম এবং
অমানুষিকভাবে স্বার্থেরটানা-হেঁচড়া শোষণ ও পীড়ন নিমেষে বন্ধ হইয়া যাইতে পারে এবং
রক্তপাত ও বিদ্রোহ বিপ্লবব্যতিরেকেই সমস্যার সমাধান হইতে পারে। উল্লিখিত হাদীস হইতে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কথাপ্রমাণিত হয়। পণ্যোৎপাদনের ব্যাপারে মজুর ও মূলধনীদের জন্য ইহা ইসলামী
অর্থব্যবস্থার একটি মূলনীতি বিশেষ:
১. মজুর ও পুঁজিদার যে কাজ করে এবং মজুরদের দ্বারা যে কাজ
করায়-ইহারা উভয়ই ভাইবলিয়া মনে করিবে। দুই সহোদর ভাইয়ের মধ্যে যে সম্পর্কে ইহাদের
মধ্যেও ঠিক তাহাইহইবে। বিশ্বনবীর ইহাই আন্তরিক বাসনা এবং ইসলামের
দৃষ্টিতে ইহাই সুষ্ঠ মানবিকআদর্শ।
এই ব্যাপারে মূলনীতি হিসাবে যদি এইটুকু কথাই বলা হইত এবং
সকলে মিলিয়া এই অনুসারেকাজকরিত তাহা হইলেও সকল প্রকার সমস্যার উৎসমুখ বন্ধ হইতে
পারিত। কারখানা মালিককারখানা শ্রমিককে যদি নিজের ভাই বলিয়া মনে করে,
তাহা হইলে আর কোন
সমস্যাই থাকিতেপারে না। শ্রমিক ও মজুরের যাবতীয় দু:খকষ্ট দূর করা এবং
সর্বোতভাবে তাহারসুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করাই তখন কারখানা মালিকের কর্তব্য হইবে। কিন্তু বিশ্বনবীরএই কথা এই অস্পষ্টতার মধ্যে শেষ হইয়া যায়
নাই, তিনি আরো স্পষ্ট করিয়া বলিয়াদিয়াছেন।
২. অন্তত খাওয়া-পরা-থাকা প্রভৃতি বুনিয়াদী প্রয়োজন পূর্ণ
করা পর্যন্ত মজুর ওমালিকদের আর্থিক অবস্থা একেবারে সমান-স্তরের হইতে হইবে। মালিক নিজ যা খাইবে, তাহাইমজুর ও শ্রমিককে খাইতে দিবে,
যাহা নিজে পরিধান করিবে
মজুরকেও তাহাই পরিধান করিবারব্যবস্থা করিয়া দিবে। কেবল
গার্হস্থ্য পর্যায়ের শ্রমিক-মজুরদের সম্পর্কেও ইসলামেরইহা বিধান। এই আদেশ হইতে মজুরে পারিশ্রমিক নির্ধারণের ব্যাপারে ইসলামের
লক্ষ্য ওদৃষ্টিভঙ্গিও নি:সন্দেহে জানিতে পারা যায়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর এই আদেশকে মালিকের ইচ্ছা-অনিচ্ছারউপর ছাড়িয়া
দেওয়া কোনক্রমেই ঠিক হইবে না; বরং ইসলামী হুকুমত আইনের সাহায্যে এইরূপআচরণকে প্রত্যেক
মালিক ও মূলধনীর পক্ষে অবশ্য করণীয় ও বাধ্যতামূলক করিয়া দিবে।রাসূলে
করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলিয়াছেন: لِلْمُلُوْكِ طَعَامُهُ وَكَسْوَتُهُ بِالْمَعْرُوْفِ ـমজুর-শ্রমিক
ও ভৃত্যদের যথারীতি খাদ্য ও পোষাক দিতে হইবে।
উল্লিখিত হাদীস হইতেরাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নির্দেশ ও ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি সুস্পষ্টরূপে বুঝিতে পারা যায় যে, ইসলামীহুকুমতের অধীন প্রত্যেক মজুর ও শ্রমিককে মালিকের সমান স্তরের খাওয়া-পরা-থাকাপ্রভৃতি বুনিয়াদী প্রয়োজন পূরণ করিবার পরিমাণ অনুপাতে পারিশ্রমিক অবশ্যই দিতে হইবে।বর্তমান সময় মজুরির হার যদি এতটুকু পরিমাণও বৃদ্ধি করিয়া দেওয়া হয় এবং মালিক ওমূলধনী মালিকদের মানের খাওয়া-পরা-থাকা ইত্যাদি শ্রমিক ও শ্রমিকের সন্তানরাও লাভকরিতে থাকে, তাহা হইলে তথায় শোষণ বলিতে কিছুরই অস্তিত্ব থাকিতে পারেনা, থাকিতেপারেনা কোন শ্রেণী বিদ্বেষ। শ্রেণী-বৈষম্যের তৈল খনিতে আগুন লাগাইয়া মারত্মকধ্বংসযজ্ঞের সৃষ্টি করাও কাহারো পক্ষে সম্ভব হয় না।
উল্লিখিত হাদীস হইতেরাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নির্দেশ ও ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি সুস্পষ্টরূপে বুঝিতে পারা যায় যে, ইসলামীহুকুমতের অধীন প্রত্যেক মজুর ও শ্রমিককে মালিকের সমান স্তরের খাওয়া-পরা-থাকাপ্রভৃতি বুনিয়াদী প্রয়োজন পূরণ করিবার পরিমাণ অনুপাতে পারিশ্রমিক অবশ্যই দিতে হইবে।বর্তমান সময় মজুরির হার যদি এতটুকু পরিমাণও বৃদ্ধি করিয়া দেওয়া হয় এবং মালিক ওমূলধনী মালিকদের মানের খাওয়া-পরা-থাকা ইত্যাদি শ্রমিক ও শ্রমিকের সন্তানরাও লাভকরিতে থাকে, তাহা হইলে তথায় শোষণ বলিতে কিছুরই অস্তিত্ব থাকিতে পারেনা, থাকিতেপারেনা কোন শ্রেণী বিদ্বেষ। শ্রেণী-বৈষম্যের তৈল খনিতে আগুন লাগাইয়া মারত্মকধ্বংসযজ্ঞের সৃষ্টি করাও কাহারো পক্ষে সম্ভব হয় না।
৩. সময় ও কাজের কঠোরতা-উভয় দিক দিয়াই মজুরকে সক্ষম ও সামর্থ
করিয়া রাখিতে হইবে।এমন দীর্ঘ সময় পর্যন্ত কাজে নিযুক্ত রাখা বা এমন কোন কাজের
বোঝা মজুরের মাথায়চাপাইয়া দেওয়া যাইবে না, যাহা করিতে সে একেবারেই অসমর্থ কিংবা যাহা
করিলে সেক্লান্ত হইয়া পড়িবে বা তাহার স্বাস্থ্য নষ্ট হইয়া যাইতে পারে:
وَلاَيُكَلِّفُ مِنَ الْعَمَلِ اِلاًّ
مَايُطْيِقُ ـ মজুরদের সাধ্যের অতীত কোনকাজকরিতে
তাহাদিগকে বাধ্য করিবে না।
বিশ্বনবীর এই ছোট কথাটি মজুর-শ্রমিকদের জন্য চিরন্তন
রক্ষাকবচ। বর্তমান যুগেমজুরদের কাজের সময়ের পরিমাণ এবং কাজের স্বরূপ
নির্ধারণ শ্রমিকদের এই দুইটি প্রধান ওবুনিয়াদী সমস্যার সমাধান এই ছোট বাণীটির
ভিত্তিতেই অতি সুন্দরভাবে করা যাইতে পারে।সহজ
কথায় বলিতে গেলে চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে কাজের গুরুত্ব অনুপাতে সাধারণভাবে যে কয়ঘন্টা
শ্রম করা সম্ভব ঠিক তত ঘন্টাই মজুরদের নিকট হইতে কাজ লওয়া যাইবে এবং ততটুকুসময়ের
কাজের বিনিময়ে তাহাকে পূর্ণ একটি দিনের বুনিয়াদী প্রয়োজন পূরণ করিবার সমানমজুরি
দিতে হইবে।
৪. এমন কোন কঠিন কাজ যদি এসে পড়ে বা সমাধা করা মজুরের পক্ষে
নানা কারণেদু:সাধ্য, যথা-কারখানার বর্তমান মজুর সমাধার জন্য যথেষ্ট শারীরিক
শক্তি মজুরের নাই, এমতাবস্থায় সে কাজটি অসম্পূর্ণ রাখা হইবে এবং সামগ্রিক প্রয়োজনীয়
পণ্যদ্রব্যেরউৎপাদন এইভাবে বন্ধ করিয়া দিয়া কারখানাঅচল করে দেওয়া হইবে-তাহা মোটেই
সমীচীন নহে।পক্ষান্তরে মজুরদের শক্তি থাকুক তাহাদের দ্বারা সে কাজ অবশ্যই জোর
করিয়া করান হইবেবা তা করিতে তাহাদিগকে বাধ্য করা হইবে-ইহাও হইতে পারেনা। এহেন অবস্থায় ইসলামেরনির্দেশ এই যে, বর্তমান মজুরদিগকে সেই
কাজে নিযুক্ত করিয়া দিয়া, সেইকাজ সমাধার জন্যযথেষ্ট জনশক্তি ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির
শক্তি অথবা সময়-সুযোগের শক্তি দিয়েতাহাদিগকে সাহায্য করিতে হইবে। হাদীসে উল্লিখিত فَاَعْيِنُوْهُمْ শব্দটির অর্থ এইনয় যে,
এহেন অবস্থায় মালিক বা
মূলধন নিজেই মজুরদের সঙ্গে কাজে নামিয়া পড়িবে। কারণতা
সব সময় সম্ভব ও সহজ হয় না এবং একজন বা দুইজনের শারীরিক সাহায্য সেই কাজ সমাধারজন্য
যথেষ্ট না-ও হইতে পারে। আর তাহার প্রয়োজনও কিছু নেই।বরং
বর্তমান মজুরদেরসংখ্যা বৃদ্ধি করিয়া কাজের ক্ষেত্রে সহযোগিতা করিলেই যথেষ্ট হয়। মজুরদের শক্তি বৃদ্ধিকরিবার একাধিক উপায় হইতে পারে;আর তাহা প্রয়োজন অনুপাতেই করিতে হইবে। প্রয়োজন হইলেমজুরের সংখ্যা বাড়াইয়া দিতে হইবে। সেই জন্য আবশ্যক হইলে মজুরির হারও বৃদ্ধি করিতেহইবে। এক কথায় উপস্থিত কাজ সম্পন্ন করিতে যথাসম্ভব সুযোগ-সুবিধার
ব্যবস্থা করিতেহইবে। যেমন দেশ ও জাতির প্রয়োজনীয় পণ্যের উৎপাদন
বন্ধ বা ব্যবহৃত না হয়, কারখানা-মালিকের কাজেরও যেন সমাধা হয়,
মজুরদের উপর সাধ্যাতীত
কোন কাজেরও যেন চাপ নাপড়ে। ইসলামে শ্রমিকদের যাবতীয় সমস্যার সমাধানের
জন্য ইহাই প্রধানতম মূলনীতি।
বর্তমান যুগে কারখানা-মালিক ও মজুর-শ্রমিক এবং পুঁজি ও
শ্রমের পারস্পরিকদ্বন্দ্ব-বৈষম্যের যে আকাশ ছোঁয়া তুফান জাগিয়া উঠিয়াছে,
এই হাদীসের ভিত্তিতে
তাহারসুন্দর ও সামঞ্জস্যপূর্ণ অবসান সাধন করা অতীব সহজ।
ইসলামী অর্থ ব্যবস্থায় ইহা মোটেই মন ভোলানো প্রস্তাব কিংবা ‘খেয়ালী
স্বর্গ’বিশেষ নয়। ইহা একটি বাস্তব কর্মাদর্শ। ইহার ভিত্তিতে মানবেতিহাসে এক সোনালী অধ্যায়েসমাজের যাবতীয়
আর্থিক সমস্যার সমাধান করা হইয়াছিল।বাস্তবক্ষেত্রে তদনুযায়ী কাজকরিয়া একটি যুগের
মানুষের জীবনকে সুখ-শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধশালী করিয়া তোলা হইয়াছিল।ফলে
তৎকালে শ্রম-মজুরি এবং শ্রমিক মূলধনীদের পরস্পরের মধ্যে কোনরূপ বৈষম্য,
শ্রেণী-সংগ্রাম ও
শ্রেণী-বিদ্বেষ সৃষ্টি হইতে পারে নাই। উপরোল্লিখিত হাদীসটি বর্ণনাকরিয়াছেন আবুযার
গিফারী (রা)। তিনি বলিয়াছেন, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম এর মুখে এই পবিত্রবাণীটি ঠিক সেই সময় শুনিয়াছেন,
যখন তিনি ও তাঁহার ভৃত্য
ঠিক একইরূপ পোশাক পরিহিতছিলেন। তাঁহাকে ইহার কারণ জিজ্ঞাসা করা হইলে উত্তরে
তিনি এই হাদীসটি ইরশাদ করেন।নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা
শুনিয়া বলিয়াছিলেন; তোমরা মধ্যে এখনও কি জাহিলী যুগেরবদ-অভ্যাস বর্তমান আছে?
অর্থাৎ ভৃত্যকে ভর্ৎসনা
করা জাহিলী স্বভাব-বিশেষ, ইসলাম তাবরদাশত করেনা। অত:পর
প্রতিটি ব্যাপারে পূর্ণ সমতা রক্ষা করাই আবুযারের আজীবনেরকার্যসূচীতে পরিণত
হইয়াছিল। ওমর ফারুক (রা) এর বায়তুল মাকদাস সফরকালে উষ্ট্রচালনার কাজে
ভৃত্যের সাথে আধাআধি ভাগ করিয়া লওয়ার ঘটনা এক ঐতিহাসিক ব্যাপার। তিনিমদীনার চতুর্দিকে রাত নিশিথে ঘুরিয়া বেড়াইতেন এবং
যেখানে কোন মজুর-দাসকে কোন কঠিনকাজে নিযুক্ত দেখিতে পাইতেন তাহাকে তাহা হইতে
মুক্তি দিতেন এবং কাহাকেও তাহারন্যায়সংগত মজুরি কম পাইতে দেখিলে তাহার মজুরি
বৃদ্ধি করিয়া প্রয়োজন পরিমাণ দেওয়ারব্যবস্থা করিয়া দিতেন।
শ্রমিক-মজুরদের প্রতি বর্তমান যুগেরপুঁজিদার ও
কারখানা-মালিকদের আচরণ শোষণ ও উৎপীড়নমূলক সন্দেহ নাই। তাহারামজুর-শ্রমিককে
খাটাইয়া নির্দিষ্ট কাজ তিল তিল করিয়া সম্পূর্ণ করিয়া লয়,
অথচশ্রমিকদেরকে যথেষ্ট
পরিমাণ মজুরি আদৌ দেয় না। আর দিলেও নানা কৌশলে ও ফাঁদ-প্রতারণায়জড়াইয়া
উহার অধিকাংশ কাটিয়া-ছাটিয়া রাখিয়া দেয়। তাহার
পরও যে সামান্য পরিমাণ বেতনবা মজুরি প্রাপ্য হয় তাহাও যথাসময় আদায় করিতে কুন্ঠিত
হয় এবং অফিসেরনিয়মতান্ত্রিকতা অভাব-পীড়নে তাহাদিগকে অতিষ্ট করিয়া তোলা হয়। একদিকে গরীব ও মজুরদেরশিশু-সন্তান ক্ষুধা-তৃষ্ণায়,
দু:সহ-জ্বালায়,
শীত-গ্রীষ্মের,
রোগ-দু:খের দু:সহ
চাপেজর্জরিত হইয়া ওষ্ঠাগত প্রাণ। অপরদিকে আকাশচুম্বি বিরাট প্রাসাদের উপর
তলায়বিদ্যুত-পাখার হিমশীতল মলয়-হিল্লোল মজুর-দেহের শোণিত বর্ণের লাল-পানি
পানেররুদ্রদর্পিত হুঙ্কার-এখন দিতে পারিব না। এক
সপ্তাহ পরে বেতন পাইবে ইত্যাদি।
পুঁজিদার আর মালিকদের এবম্বিধ আচরণ ইসলামের দৃষ্টিতে
সম্পূর্ণ অন্যায়-অনাচারমূলকএবং ইহা মজুরদের প্রতি তাহাদের অমানুষিক জুলুম,
সন্দেহ নাই। ইসলামের শেষ ও শ্রেষ্ঠনবী মানবতার এই দু:খ মর্মে মর্মে
অনুভব করিতে পারিয়াছিলেন। দু:খী মানবতার আহাজারীতাঁহার হৃদয়-মনকে
বিষায়িত করিয়া তুলিয়াছিল। ব্যথিতের প্রতি সহানুভূতিই ছিল তাঁহারজীবনের
অন্যতম ব্রত। তাই তিনি জলদ-গম্ভীর স্বরে ইরশাদ করিয়াছিলেন:
আল্লাহ পাক ইরশাদ করিয়াছেন যে,
কিয়ামতের দিন তিন
ব্যক্তির বিরুদ্ধে আমি কঠিনঅভিযোগ উপস্থাপিত করিব-যে ব্যক্তি আমার জন্য কাহাকেও
কিছু দান করিবার ওয়াদা করিয়াপ্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করিল, কোন মুক্ত স্বাধীন ব্যক্তিকে বিক্রয় করিয়া
পুরাপুরি কাজআদায় করিয়া লইল, কিন্তু তাহার মজুরি দিল না-ইহারাই সেই তিন জন।
অন্য
হাদীসে বলা হইয়াছে: “ধনীর সামর্থ থাকা সত্ত্বেও পরের ‘হক’আদায় করিতে অকারণবিলম্ব করা জুলুম”।
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্পষ্ট ভাষায় আদেশ করিয়াছেন:
اُعْطُوْاالاَجِيْرَ اجْرَهُ قَبْلَ اَنْ يُّجِفً رِيْقُهُ ـ
মজুরকে তাহার ঘাম শুল্কহওয়ার পূর্বেই মজুরি শোধ করিয়া দাও।
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্পষ্ট ভাষায় আদেশ করিয়াছেন:
اُعْطُوْاالاَجِيْرَ اجْرَهُ قَبْلَ اَنْ يُّجِفً رِيْقُهُ ـ
মজুরকে তাহার ঘাম শুল্কহওয়ার পূর্বেই মজুরি শোধ করিয়া দাও।
অর্থাৎ মজুরি শোধ করিতে অকারণ কিছুমাত্র বিলম্ব করা সঙ্গত
নয়। এই ব্যাপারেকোনরূপ টাল-বাহানা করা এবং কোনরূপ ধোঁকা বা
প্রতারণার আশ্রয় নেওয়া পরিষ্কার জুলুমএবং সকল প্রকার জুলুম শোষণের উৎস চিরতরে বন্ধ
করিয়া দেওয়াই ইসলামী হুকুমতেরকর্তব্য। এই জন্য রাষ্ট্র যথাযোগ্য আইন রচনা করিয়া
পুঁজিদার ও কারখানা মালিককেনির্দিষ্ট সময়ে এবং পুরোপুরিভাবে শ্রমিকের বেতন আদায়
করিতে বাধ্য করিতে পারিবে।বর্তমান কালের শ্রমিক-মজুরদের জীবনে
দু:খ-দারিদ্রের যে অমানিশা নামিয়াছে, ইসলামীহুকুমতে তাহার চির অবসান হইবে,
তাহাতে কোনরূপ সন্দেহ
থাকিতে পারে না।
একটি
হাদীসে বর্ণিত হইয়াছে:
اِنَّ رَسُوْلٌ اللهِ نَهى عَنِاسْتَجَارَةِ اِلاجِيْرِ حَتّى يُبَيِنُ لَهُ اَجرُهُ ـ
اِنَّ رَسُوْلٌ اللهِ نَهى عَنِاسْتَجَارَةِ اِلاجِيْرِ حَتّى يُبَيِنُ لَهُ اَجرُهُ ـ
মজুরের বেতন নির্দিষ্ট না করিয়া তাহাকে কাজে নিযুক্ত করিতে
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামপরিষ্কার ভাষায় নিষেধ করিয়াছেন।
এযুগের পুঁজিদার ও কারখানা-মালিকগণ গরীব দুস্থ ওদারিদ্র নিপীড়িত মজুরদের প্রতি যে ধোঁকা ও প্রতারণামূলক আচরণ করিয়া থাকে, তাহাদিগকেশোষণ করিবার জন্য নিত্য নূতন উপায় উদ্ভাবন করিয়া থাকে, মজুরি নির্ধারিত না করিয়াতাহাদিগকে কাজ করিতে বাধ্য করিয়া এবং কাজ আদায় করিবার পর সামান্য কিছু দিয়েতাহাদিগকে বিদায় করিয়া দেয়-বর্তমান বিপর্যস্ত সমাজে এই ধরণের দুর্নীতি এবংজুলুম-পীড়নের কোনই অন্ত নাই। কিন্ত ইসলামী সমাজে ইহার বিন্দুমাত্র অবকাশ থাকিতেপারিবে না। সেখানে মজুরির পরিমাণ অজ্ঞাত ও অনির্দিষ্ট রাখিয়া কাজ করা কিংবা করানমাত্রই জায়েয নয় বরং কাজ-কাজের স্বরূপ এবং উহার মজুরি-পূর্বেই সুনির্দিষ্ট হওয়াআবশ্যক। মুজরি নির্ধারিত না করিয়া কাজ করিলে সেই ধরনের কাজে যাহা মজুরি সাধারণতদেওয়া হয়, তাহাই আদায় করিতে হইবে। মালিক নিজের ইচ্ছামত মজুরির কোন পরিমাণনির্ধারিত করিতে পারিবে না-করিলে মজুর বা শ্রমিক তা কবুল করিতে বাধ্য হইবে না।কাজের স্বরূপ অনুসারে মজুরি নির্ধারণের ব্যাপারে প্রয়োজন হইলে ইসলামী হুকুমত সরাসরিহস্তক্ষেপ করিতে পারিবে এবং এক সুসমঞ্জস্য ও সুবিচারপূর্ণ হার নির্দিষ্ট করিয়াদেওয়ার পূর্ণ অধিকার তাহার রহিয়াছে।
এযুগের পুঁজিদার ও কারখানা-মালিকগণ গরীব দুস্থ ওদারিদ্র নিপীড়িত মজুরদের প্রতি যে ধোঁকা ও প্রতারণামূলক আচরণ করিয়া থাকে, তাহাদিগকেশোষণ করিবার জন্য নিত্য নূতন উপায় উদ্ভাবন করিয়া থাকে, মজুরি নির্ধারিত না করিয়াতাহাদিগকে কাজ করিতে বাধ্য করিয়া এবং কাজ আদায় করিবার পর সামান্য কিছু দিয়েতাহাদিগকে বিদায় করিয়া দেয়-বর্তমান বিপর্যস্ত সমাজে এই ধরণের দুর্নীতি এবংজুলুম-পীড়নের কোনই অন্ত নাই। কিন্ত ইসলামী সমাজে ইহার বিন্দুমাত্র অবকাশ থাকিতেপারিবে না। সেখানে মজুরির পরিমাণ অজ্ঞাত ও অনির্দিষ্ট রাখিয়া কাজ করা কিংবা করানমাত্রই জায়েয নয় বরং কাজ-কাজের স্বরূপ এবং উহার মজুরি-পূর্বেই সুনির্দিষ্ট হওয়াআবশ্যক। মুজরি নির্ধারিত না করিয়া কাজ করিলে সেই ধরনের কাজে যাহা মজুরি সাধারণতদেওয়া হয়, তাহাই আদায় করিতে হইবে। মালিক নিজের ইচ্ছামত মজুরির কোন পরিমাণনির্ধারিত করিতে পারিবে না-করিলে মজুর বা শ্রমিক তা কবুল করিতে বাধ্য হইবে না।কাজের স্বরূপ অনুসারে মজুরি নির্ধারণের ব্যাপারে প্রয়োজন হইলে ইসলামী হুকুমত সরাসরিহস্তক্ষেপ করিতে পারিবে এবং এক সুসমঞ্জস্য ও সুবিচারপূর্ণ হার নির্দিষ্ট করিয়াদেওয়ার পূর্ণ অধিকার তাহার রহিয়াছে।
শ্রকিকদের অজ্ঞতা ও অসহায়তায় সুযোগ লইয়া শিল্পপতি ও
পুঁজিদারগণ তাহাদের উপর যাতেকোনরূপ অত্যাচার করিতে না পারে কোনরূপ শোষণ পীড়ন করিতে
না পারে, ইসলামী রাষ্ট্রতাহার নিখুঁত ব্যবস্থা করিবে।
ইসলামী শিল্প-ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে মজুরের অধিকার সম্পর্কে
একটি হাদীস সুস্পষ্টইঙ্গিত দিতেছে। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
ইরশাদ করিয়াছেন:
মজুরকে তাহার কাজ হইতে অংশ দান কর। কারণ
আল্লাহর মজুরকে বঞ্চিত করা যাইতে পারেনা।
এই হাদীসের দৃষ্টিতে প্রমাণিত হইতেছে যে,
মজুরের নির্ধারিত বেতন
যা মজুরি আদায়েরপরও মূল কারখানায় যাহা মুনাফা হইবে তাহা হইতেও মজুরকে অংশ দিতে
হইবে। এই সম্পর্কেইসলামী অর্থনীতিতে যদিও সুস্পষ্ট কোন নির্দেশ
পাওয়া যায় না, কিন্তু তবুও নিম্মলিখিতহাদীসটি এই ব্যাপারে নির্দেশনা
প্রদান করে। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলিয়াছেন:
إذاصنع لأحدكم خادمه طعامه ثم جاءه به ، وفقد ولى
حره ودخانه ، فلقعده معه . فليأكل . فإن كان الطعام مشفوها قليلا ، فليضع في يده
منه أكلة أو أكلتين
তোমরা ভৃত্য যদি তোমার অন্ন প্রস্তুত করে এবং তাহা লইয়া
তোমার নিকট আসে- যাহারান্না করিবার সময় আগুনের তাপ এবং ধুম্র তাহাকে অনেক কষ্ট
দিয়াছে-তখন তাহাকে তোমারসাথে বসাইয়া খাওয়াইবে। খানা
যদি শুষ্ক রান্না হইয়া থাকে, তবে তাহা হইতে তাহার হাতেএক মুঠি বা দুই মুঠি অবশ্যই তুলিয়া
দিবে। (মুসলিম)
এই হাদীস হইতে প্রমাণিত হয় যে,
শ্রমিক শ্রমের সাহায্যে
মালিকের কাঁচামাল বামূলধন খাটাইয়া যাহা উৎপন্ন করিবে,
তাহা হইতে তাহাকে
নির্দিষ্ট হারে বেতন দেওয়ার পরওআসল মুনাফা হইতে তাহাকে কিছু না কিছু অংশ দিতে হইবে। হাদীসে উল্লিখিত ঘরের বাবুর্চিআর কারখানার শ্রমিকের মধ্যে
মূলত কোন পার্থক্য নাই। একজন বাবুর্চি খাদ্য পাকাইবারকাজে যেভাবে
মনোযোগ দিতে হয়, দেহ ও চিন্তা শক্তিকে যেভাবে নির্দিষ্ট এক কাজের
জন্যনিয়োজিত করিতে হয়, কম-বেশি প্রায় তদ্রুপই কারখানার একজন মজুরকেও খাটিতে হয়। কাজেইএক হাদীস অনুসারে নির্বিশেষে সকল শ্রমিকই কারখানায়
উৎপন্ন দ্রব্য হইতে অংশ পাইতেপারিবে। যে মিলে কাপড় তৈরী হয়,
প্রত্যেক শ্রমিককে তাহার
পরিবারবর্গের জন্য বৎসরে একবা একাধিকবার কাপড় দেওয়া যাইতে পারে। ইহা নির্দিষ্ট বেতনের মধ্যে গণ্য হইবে না।কারণ
প্রায়ই দেখা যায়, কোন মিলে শ্রমিক সকাল-সন্ধ্যা হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করিয়া
থানকেথান কাপড় বুনে অথচ তাহার নিজের বা তাহার পরিবারের লোকদের পরিধানে
হয়তছিন্নবস্ত্রটুকুরও অস্তিত্ব নাই। এই হাদীস অনুসারে ইসলামী সামাজে যে শ্রমনীতি
কায়েমকরা হইবে তাহাতে এই অবাঞ্চিত পরিস্থিতির অবকাশ থাকিতে পারিবে না। খাদ্যপ্রস্তুতকারী পাচকের অভুক্ত থাকা যে ইসলাম বরদাশত
করিতে পারে না, কারণ খাদ্যপ্রস্তুত করিবার ব্যাপারে মালিক শুধু
দ্রব্যসামগ্রী দিয়াই রেহাই পাইয়া যায়, কিন্তুউহা প্রস্তুত করিতে গিয়া আগুনের উত্তাপ
ও ধোঁয়ার জ্বালা পাচককেই ভুগিতে হয়। তাহাহইলে যে কারখানায় মজুর শ্রমিকগণ
প্রাণান্তকর পরিশ্রম করিয়া হাজার হাজার থান কাপড়বুনল,
সে বা তাহার পরিবারবর্গ
কাপড়ের অভাবে উলঙ্গ থাকিবে, আর ওদিকে কারখানা-মালিকতাহার কুকুরকে পর্যন্ত মখমলে
মূল্যবান বস্ত্রে আচ্ছাদিত করিয়া রাখিবে, এমন অবিচার ওঅসাম্য ব্যবস্থা ইসলাম কিছুতেই
সমর্থন করিতে পারে না। একথা প্রমাণ করিতে খুব বেশিযুক্তির আবশ্যক করে
না।
ইসলাম মজুর-শ্রমিকদের এই সব অধিকারের কথা স্পষ্ট ভাষায়
উল্লেখ করা হইয়াছে। এসম্পর্কে আরও কয়েকটি হাদীস পাওয়া যায়,
যেসবের উপর ভিত্তি করিয়া
আধুনিক সমস্যা ওপ্রয়োজন অনুপাতে এই সম্পর্কীয় একটি পরিপূর্ণ ও বিস্তারিত বিধান
রচনা করা যাইতেপারে। সম্প্রতি আমাদের বক্তব্য শুধু এতটুকু যে,
বর্তমান সময়
মজুর-শ্রমিকদের এই আকাশছোঁয়া জটিল সমস্যাসমূহের সুষ্ঠু ও সুবিচারপূর্ণ সমাধান
করিতে পারে একমাত্র ইসলাম।মালিক-মজুরের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ও শ্রেণী
সংগ্রাম অতি সহজেই বন্ধ হইতে পারে? তিক্ততার পরিবর্তে তথায় মধুর সহযোগিতা ও
সহানুভূতিমূলক সম্পর্কের সৃষ্টি হইতেপারে।
অতএব অনতিবিলম্বে ইসলামী সমাজ-ব্যবস্থা বাস্তবায়িত করা এবং ইসলামের আদর্শঅনুযায়ী মালিক ও মজুরের যাবতীয় সমস্যা সমাধান করা একান্তই কর্তব্য। আর সেই জন্যসরকার ও কারখানা মালিকগণের তথা সমগ্র দেশবাসীরই প্রাণপণ চেষ্টা করা বাঞ্চনীয়।
অতএব অনতিবিলম্বে ইসলামী সমাজ-ব্যবস্থা বাস্তবায়িত করা এবং ইসলামের আদর্শঅনুযায়ী মালিক ও মজুরের যাবতীয় সমস্যা সমাধান করা একান্তই কর্তব্য। আর সেই জন্যসরকার ও কারখানা মালিকগণের তথা সমগ্র দেশবাসীরই প্রাণপণ চেষ্টা করা বাঞ্চনীয়।
(প্রবন্ধটি ১৯৫১ সালের ৫ই জুলাই ঈদ সংখ্যা দৈনিক ‘আজাদে’প্রকাশিত
হয়)
নবতর
শ্রমিক আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা ও ভিত্তি
এই সব কারণেই বাংলাদেশে এমন এক মজুর আন্দোলন গড়িয়া তোলা
আবশ্যক যাহা একদিকেদীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা হিসাবে দেশে পূর্ণাঙ্গ ইসলামী সমাজ
গঠনের প্রচেষ্টা চালাইয়াযাইবে। অপর দিকে এবং সঙ্গে সঙ্গে মজুর শ্রমিকদের
উপস্থিত সমস্যার সুষ্ঠু সমাধানকরিবে- তাহাদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার ও স্বার্থ আদায়ের
জন্য ঐকান্তিক নিষ্ঠা ওবিশ্বস্ততা সহকারে আন্দোলন চালাইবে। এইরূপ
এক পূর্ণাঙ্গ মজুর আন্দোলন গড়িয়া তোলারজন্য নিম্নোক্ত পাঁচটি ভিত্তি একান্তই জরুরী।
১.
সমাজ ও রাষ্ট্র সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা ও পরিকল্পনা
২. সমাজ-সংস্কারশ্রমজীবীদের সম্মানজনক স্থান নির্ধারণের ব্যাপারে পূর্ণ দৃষ্টি ও সচেতনতা
৩.শ্রম ও পুঁজির পারস্পরিক সম্পর্ক, অধিকার ও কর্তব্য
৪. শিল্পগত সম্পর্ক ওসম্বন্ধের রীতিনীতি
৫. শ্রমের কারণ ও উদ্বোধক
২. সমাজ-সংস্কারশ্রমজীবীদের সম্মানজনক স্থান নির্ধারণের ব্যাপারে পূর্ণ দৃষ্টি ও সচেতনতা
৩.শ্রম ও পুঁজির পারস্পরিক সম্পর্ক, অধিকার ও কর্তব্য
৪. শিল্পগত সম্পর্ক ওসম্বন্ধের রীতিনীতি
৫. শ্রমের কারণ ও উদ্বোধক
পূর্ববর্তী প্রবন্ধ হইতে একথা সুস্পষ্ট হইয়া উঠিয়াছে,
যে উপরোক্ত পাঁচটি
বিষয়েইসলাম এক অত্যন্ত ব্যাপক এবং কল্যাণকর মতবাদ ও দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপিত করিয়াছে।ইসলামের
একটি নিজস্ব সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা রহিয়াছে। রাষ্ট্র
সম্পর্কে উহার একবিশেষ দৃষ্টিকোণ ও পরিকল্পনা রহিয়াছে।
ইসলামী আদর্শে গঠিত সমাজের শ্রমিকদের মর্যাদা ও অধিকার কোন
দিক দিয়াই হীন নহে, হেয় ও ঘৃণার্হ নহে। বরং
হালাল রিযিক লাভের জন্য যে কোন প্রকারের শ্রম-দৈনিক কিংবামানসিক-সবই ইবাদত এবং আল্লাহ
ও রাসূলের সন্তুষ্টি লাভের অন্যতম উপায়।
এই কারণে ইসলামী সমাজে শিল্পগত সম্পর্কে ঠিক মানবীয় ধারায়
স্থাপিত হইতে বাধ্য।শ্রমজীবিরাও মানুষ,
অতএব ‘হক্কুল
ইবাদ’এর ইসলামী ধারণার ভিত্তিতেই মালিকদের হক এরমুকাবিলায়
শ্রমজীবীদের ‘হক’ও নির্ধারিত হইবে-ইহাতে সংঘর্ষের অবকাশ নেই বললেওচলে।
বর্তমান শ্রমিক অশান্তির কারণ অনেক ক্ষেত্রে নিতান্ত
মনস্তাত্বিক। এইমনস্তাত্বিক কারণ যতদিন বর্তমান থাকিবে শ্রমিক অশান্তি
প্রশমনের সকল চেষ্টাই ব্যর্থহইতে বাধ্য। আধুনিক
শিল্প-নীতিতে পুঁজির মুকাবিলায় শ্রমের মূল্য কম, মর্যাদা আরোহীন। ইহার
দরুন শ্রমিক অশান্তি যে অনেকাংশে বৃদ্ধি পাইয়াছে, তাহা অস্বীকার করিবারউপায় নাই। কমিউনিজম শ্রেণীহীন সমাজ গঠন করিয়া এই সমস্যার সমাধান করিতে
চেষ্টাকরিয়াছে, কিন্তু উহা কিতাবের পৃষ্ঠা হইতে নামিয়া বাস্তবক্ষেত্রে যখনই
কার্যকর হইতেশুরু করিয়াছে, তখনই দুনিয়ার মানুষ দেখিতে পাইয়াছে যে,
‘মজদুর রাজ’এর নামে সেখানেএক বিশেষ কর্তা-শ্রেণীর নিরংকুশ
ও সর্বাত্মক ডিকটেটরী শাসন কায়েম হইয়া শ্রমিকদেরআষ্ঠেপৃষ্ঠে শক্ত করিয়া বাঁধিয়া
ফেলিয়াছে। অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে সেখানে শ্রমিকঅসন্তোষ তুষের আগুনের
মতো জ্বলিয়া সমাজ সংস্থাকে তিলে তিলে দগ্ধ করিয়াছে।
বাংলাদেশে
শ্রমিক আন্দোলন
ইসলামের শ্রমিক-মজুরদের জন্য যে সব অধিকার নির্ধারিত হইয়াছে,
তদৃষ্টে এইকথা জোরকরিয়াই
বলা যাইতে পারে যে, ইসলামী সমাজে মজুরদের কোন প্রকৃত সমস্যাই অসমাপ্ত
থাকিয়াযাইতে পারে না। শুধু সমাধান তাহাই নয়,
শ্রমিক-মজুরদের যাবতীয়
মৌলিক সমস্যার সুষ্ঠুসমাধান কেবলমাত্র ইসলামী আদর্শে গঠিত সমাজেই সম্ভব।
ইসলাম আদর্শ মজুর-শ্রমিকদের যাবতীয় সমস্যার যেভাবে সামাধান
করে, তাহা কোনবিছিন্ন ও স্বতন্ত্র জিনিস নহে। এমন জিনিস নহে যে, উহার সাহায্য নিরপেক্ষভাবেকেবলমাত্র মজুরদের
সমস্যারই সমাধানকরা সম্ভব হইতে পারে। বরং তাহা ইসলামের পূর্ণাঙ্গসমাজ ব্যবস্থার এক
অপরিহার্য অংশ, পূর্ণমাত্রায় গঠিত ইসলামী সমাজেই-যেখানেই ইসলামীআদর্শের
ভিত্তিতে মানুষের সামগ্রিক সমস্যার সমাধান করা হইয়াছে,
কেবলমাত্রসেখানেই-এই
সমস্যার সমাধান পূর্ণমাত্রায় কার্যকরী করা সম্ভব নয়। ইসলামী
আদর্শে গঠিতনয় এমন সমাজে মজুর সমস্যার ইসলামী সমাধান কার্যকর হওয়ার কোনই সম্ভবনা
থাকিতে পারেনা। এই কারণে যাহারাই ইসলামী আদর্শে মজুর সমস্যার সমাধান করিতে
ইচ্ছুক, তাহাদিগকেসোজা-সুজি ও কেবলমাত্র মজুর সমস্যার সমাধানের জন্য
নহে; বরং ইসলামী আদর্শে একপূর্ণাঙ্গ সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের
উদ্যোগী হইতে হইবে। ইসলামী আদর্শ বিরোধী সমাজেমজুরদের সমস্যার ইসলামী সমাধান
লাভ করিতে চাওয়া মরুভূমির বুকে ঝর্ণা প্রবাহের কামনাকরিবার সমতুল্য।
শ্রমিক ও সমাজ
বস্তুত মজুর শ্রমিক একটি গোটা সমাজের অঙ্গ বিধায়
সামগ্রিকভাবে গোটা সমাজের যাহাআদর্শ মজুর সমস্যার সমাধানেরও সেই আদর্শই কার্যকরী
হইতে পারে। আর সমাজ যদিপুঁজিবাদী হয়, মজুর শ্রমিকরাও পুঁজিবাদী আদর্শেই নিজেদের
সমস্যাবলীর সমাধান পাইতেপারে; আর সমাজ যেখানে সমাজতন্ত্রী, মজুর শ্রমিকগণও সেখানে গোটা সমাজের
ন্যায়সামগ্রিকতাবাদের (Totalitarianism) শৃংখলে বন্দী হইয়া থাকিতে বাধ্য। অনুরূপভাবেমজুর-শ্রমিকদের
ইসলাম প্রদত্ত অধিকার ও মর্যাদা কেবলমাত্র ইসলামী সমাজেই বাস্তবায়িতহইতে পারে। কাজেই শ্রমিক-মজুরদের সমস্যার ইসলামী সামাধানকে কার্যকরী
করিবার জন্যইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে গোটা সমাজকে গঠন করাই প্রাথমিক কাজ। সমাজবিজ্ঞান সম্পর্কেএকবিন্দু ধারণাও যাহাদের আছে,
তাহারা এই কথার যথার্থতা
সহজেই বুঝিতে পারিবেন। অতএবইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন মজুর
সমস্যার ইসলামী সমাধান কার্যকরী করা সম্পর্কেনিরপেক্ষতা বা নিরবতা ও ঔদাসিন্যতা
অবলম্বন করিতে পারেনা। পক্ষান্তরে মজুর সমস্যারইসলামী সমাধান
কার্যকরী করণের জন্য যে আন্দোলন তাও মূলগতভাবে ইসলামী সমাজ গঠনেরআন্দোলন তাহাকে
মৌলিক নীতি প্রকৃতির দিক দিয়া অবশ্যই ইসলামী আন্দোলন হইতে হইবে এবংগোটা ইসলামী
আন্দোলনকে ও শ্রমিক-মজুরদের সমস্যাবলীকে ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতেসমাধান করিবার
জন্য পূর্ণমাত্রায় দায়িত্বশীল হইতে হইবে
শ্রমিক আন্দোলন
বাংলাদেশে যদিও ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত হইতে যাইতেছে এবং
সেখানে পূর্ণমাত্রায়ইসলামী সমাজ গঠনের জন্য প্রবল ও বিজ্ঞানসম্মত পন্থায় আন্দোলন
চলিতেছে; কিন্তু এখানেমজুর সমস্যার সমাধানের উদ্দেশ্য যে আন্দোলন
চালিতেছে তাহা ইসলামী আদর্শ ভিত্তিক নহেএবং তাহা ইসলামের নির্ধারিত পথে পরিচালিত
হইতেছে বলিয়াও দাবি করা চলে না। ইহার কারণপ্রধানত এই যে,
বাংলাদেশের শ্রমিক
আন্দোলন বৃটিশ ভারতের শ্রমিক আন্দোলনেরই উত্তরাধিকার মাত্র।
পাক ভারতের শ্রমিক আন্দোলন প্রথম মহাযুদ্ধের পর এক
স্বতন্ত্র শক্তি হিসাবেআত্মপ্রকাশ করে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর ভারত বিভাগ পর্যন্ত ইহা
এক নিজস্ব ওনির্ধারিত রূপ পরিগ্রহ করে। ভারত বিভাগের পর অতি স্বাভাবিকভাবেই মজুর
আন্দোলনওবিভক্ত হইয়া এদেশে অনুপ্রবেশ করে। পূর্বেই
এই আন্দোলন যে ধরনের নেতৃত্বে এবং যেধারা-প্রকৃতিতে পরিচালিত হইত এদেশেও ঠিক
অনুরূপ নেতৃত্বেও ধারা-প্রকৃতিতে পরিচালিতহইতে শুরু করে। তাই
বলা যায়, বিভাগ পূর্ব মজুর আন্দোলন ও বিভাগোত্তর শ্রমিকআন্দোলনের
মধ্যে রীতি-নীতি ও ধারা-প্রকৃতির দিক দিয়া কোনোই পার্থক্য নাই। আর এইকারণেই এদেশে জনগণের আদর্শিক ভিত্তির সহিত এখানকার
শ্রমিক আন্দোলনের কোন সামঞ্জস্যবা ঐক্য খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। অতএব
এইখানে ইসলামী ধারা-প্রকৃতির অনুরূপ এক শ্রমিকআন্দোলন গড়িয়া তোলা একান্তই আবশ্যক।
দেশের বর্তমান শ্রমিক-নেতৃত্ব বৃটিশ ভারতের উত্তরাধিকারী
হওয়া এবং এখানকার সমাজও রাষ্ট্র কাঠামো ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে গঠিত না হওয়ার
কারণে এদেশের জনগণেরআদর্শিক চেতনার পরিপ্রেক্ষিতে এখানকার শ্রমিক আন্দোলনের
ধারা-প্রকৃতিতে কোনরূপপরিবর্তন সূচিত করিবার প্রয়োজন বোধ হয় নাই। পূর্বে এ আন্দোলন যেমন চলিত সম্পূর্ণসেকিউলারিস্ট ধারায় ও
দৃষ্টিভঙ্গিতে এবং উহার পরিণামে সৃষ্টি হইত মালিক ও শ্রমিকস্বার্থের দ্বন্দ্ব ও
সংঘর্ষ; ঠিক তেমনি বর্তমান শ্রমিক আন্দোলনেও এই শ্রমিক-মালিকসংঘর্ষ
ছাড়া অন্য কিছুই দেখিতে পাওয়া যায় না। উপরোন্তু এখানকার নেতৃত্বে মজুরদেরন্যায়সঙ্গত
অধিকার স্বার্থোদ্ধারের ব্যাপারেও পূর্ণ নিষ্ঠাবান বলিয়া প্রমাণিত হইতেপারে নাই। এদেশে এইরূপ নেতৃত্ব বিরল নহে,
যাহারা মজুর-শ্রমিকদের
নির্দিষ্ট দাবিরভিত্তিতে ধর্মঘট করিতে বাধ্য নিজেদের মালিক পক্ষের সহিত গোপন
ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়এবং কিছু দিনের মধ্যেই মালিকদের নিকট হইতে বিপুল পরিমাণ অর্থ
গ্রহণের বিনিময়েধর্মঘট প্রত্যাহারের ঘোষণা প্রচার করে। ফলে
মজুরদের স্বার্থ বিনষ্ট হয়, আর মাঝখানদিয়া তাহাদের নেতৃত্ব বিপুল অর্থ লুটিয়া লয়। মজুরদের ন্যায়সঙ্গত স্বার্থ বলি দিয়াঅন্যায় স্বার্থ উদ্ধার
করিয়া লয়। এইরূপ মজুর-নেতা এদেশে যথেষ্ট সংখ্যক বিরাজকরিতেছে বলিয়া
মজুরদের কোন সমস্যারই একবিন্দু সমাধান লাভ আজও সম্ভব হইল না।
তাই এই কথায় কোনই সন্দেহ থাকেনা যে,
দেশের বর্তমান শ্রমিক
আন্দোলন আদর্শিকতারদিক দিয়া যেমন এখানকার জনগণের চিন্তা-বিশ্বাসের সহিত
সামঞ্জস্যপূর্ণ নহে, তেমনইতাহা মজুর-শ্রমিকদের অধিকার ও ন্যায়সঙ্গত স্বার্থ
আদায়েরও অনুকূল নহে। মজুরদেরবর্তমান নেতৃত্ব কোন দিনই প্রকৃত
সমস্যার সমাধান করিতে চেষ্টিত হইবেনা, বরং উহাকেযথাযথভাবে জিয়ায়ে রাখিতেই সযত্নে
চেষ্টা চালাইতে থাকিবে। কেননা সমস্যার সমাধানই যদিহইয়া যায় তাহা হইলে
শ্রমিক আন্দোলনেরও প্রয়োজন থাকিবে না, আর তাহাদের নেতৃত্বেরআবশ্যকতাও ফুরাইয়া যাইবে।
শ্রমের
উদ্বোধক
ইসলামী সমাজে শ্রমের উদ্বোধক স্বার্থ,
লোভ বা বিলাস উপকরণ
সঞ্চয় প্রবণতা নয়; বরংতা হচ্ছে জীবনের চূড়ান্ত উদ্দেশ্য লাভ,
আল্লাহ ও রাসূলের সন্তোষ
বিধান এবং ইহকাল ওপরকালের সর্বোচ্চ কল্যাণের অধিকারী হওয়ার উদ্দীপনা।
কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান শ্রমিক আন্দোলনে উপরোক্ত পঞ্চ ভিত্তিকে
উপেক্ষা করাহইয়াছে। ফলে এখানকার শ্রমিক আন্দোলন যেমন দুর্বল হইয়া পড়িয়াছে তেমনি
ইহার নেতৃত্বওচরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়াছে। আন্দোলনের
দুর্বলতা ও নেতৃত্বের ব্যর্থতার অন্য সবকারণের মধ্যে শিল্পপতি ও মালিক পক্ষের ভুল
আচরণ ও সরকারী লেবার ডিপার্টমেন্টেরমজুরধ্বংসী নীতিকে প্রধানত দায়ী করা হয়। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে স্বয়ং মজুর নেতৃত্বেরবন্ধ্যাত্ব যে
অন্যতম কারণ তাহা স্বীকার করিতে দ্বিধা-সংকোচ করা হইতেছে। কিন্তুপ্রকৃত
ব্যাপার এই যে, উপরোক্ত পঞ্চ ভিত্তিকে স্থায়ী বুনিয়াদ হিসাবে গ্রহণ
করিয়াশ্রমিক আন্দোলন গঠন করা না হইলে-না আন্দোলন জোরদার হইতে পারে আর না পারে
উহারনেতৃত্ব কিছুমাত্র বলিষ্ঠ হইতে। এই কথা যতশীঘ্র স্বীকার করা হইবে শ্রমিক
আন্দোলনেরস্বার্থকতা ততই নিশ্চিত ও আসন্ন হইবে।
ইসলামী আদর্শে মজুর আন্দোলন গড়িয়া তুলিতে হইলে প্রথমত
সাধারণভাবে সমগ্র শ্রমজীবিএবং বিশেষভাবে তাহাদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত শিক্ষিত শ্রেণীর
মধ্যে এই চেতনা জাগ্রতকরিতে হইবে যে, দেশে সামগ্রিকভাবে ইসলামী সমাজ গঠনই হইতেছে
তাহাদের যাবতীয় সমস্যারসুষ্ঠু সমাধানের সঠিক ব্যবস্থা। অতপর
এই প্রেক্ষিতেই শ্রমিক আন্দোলন গড়িয়া তুলিতেহইবে। বস্তুত
সমগ্র দেশে যদি ইসলামী শিক্ষা, নৈতিকতা, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ওতামাদ্দুনিক বিধি-বিধান প্রতিষ্ঠিত হইতে পারে
তাহা হইলে সাধারণ লোকদের ন্যায়মজুর-শ্রমিকরাও মনস্তাত্বিক অশান্তি এবং নৈতিক ও
অর্থনৈতিক দূর্নীতি ও শোষণ-অপমানহইতেও স্থায়ীভাবে মুক্তি লাভ করিতে পারিবে। এই কারণে শ্রমিক আন্দোলনের দীর্ঘ মেয়াদীপরিকল্পনা ইহাই হইতে
হইবে।
ইহারই পরিপ্রেক্ষিতে এক আদর্শিক শিক্ষা ব্যবস্থা রচনা করাও
আবশ্যক। কেননা নিজস্বশিক্ষা পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করা ব্যতীত কোন
আদর্শ ভিত্তিক আন্দোলনই সফল লাভ করিতেপারেনা। ইহা
এক গুরুত্বপূর্ণ কাজ, যাহার সাহায্যে শ্রমজীবীরা ধীরে ধীরে ও অত্যন্তকার্যকর ভাবে
ইসলামী সমাজ ব্যবস্থার অনুকূলে এক জীবন্ত সার্থক শক্তি হিসাবে গড়িয়াউঠিবে। শ্রমিক আন্দোলনের সাধারণ টেকনিকও এই উদ্দেশ্যের অনুকূলে
গ্রহণ করা হইবে।
এই দীর্ঘমেয়াদী কর্মসূচীর একটি বিশেষ অংশ হিসাবে সাধারণ
মজুর-শ্রমিকদের মধ্যেইসলামী জীবন ও সমাজ ব্যবস্থা সম্পর্কে ব্যাপক চেতনা ও জ্ঞান
এবং সেইজন্য এক উদগ্রপিপাসা জাগাইয়া তুলিতে হইবে। তাহাদের
এমনভাবে ট্রেনিং দিতে হইবে যেন তাহারা ইসলামীসমাজ গঠন ও রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠায় ব্রতী
ব্যক্তি বা দলের সাথে পূর্ণ সহযোগিতা করে।
স্বল্প
মেয়াদী পরিকল্পনা
স্বল্প মেয়াদী পরিকল্পনা হিসাবে মজুরগণ যাহাতে দেশের
উন্নয়নমূলক কাজে পূর্ণ অংশগ্রহণ করিতে পারে, মজুর আন্দোলনকে সেইজন্য যত্নবান হইতে হইবে। এই উদ্দেশ্যে বর্তমানশ্রমিক আইন এর পরিবর্তন ও সংশোধন সূচিত
করা, শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি, কাজের সময়ের পরিমাণ হ্রাস,
সাধারণ জীবন যাপনের মান
উন্নয়ন, শ্রমিকদের শিশু সন্তানেরশিক্ষা,
স্বাস্থ্য ও সংরক্ষণের
পুর্ণ ব্যবস্থা করণ এবং সেই সঙ্গে মজুর সংগঠনের এবংসভা-সম্মেলন অনুষ্ঠানের অবাধ
স্বাধীনতা অর্জনের জন্য নিয়মতান্ত্রিক চেষ্টা চালাতেহইবে। মজলুমের
সাহায্য ও জুলুম প্রতিরোধের জন্য বীর দর্পে আগাইয়া আসিতে হইবে।সেইজন্য
প্রাণপণে চেষ্টা করিতে হইবে। প্রত্যেক শ্রমজীবী যাহাতে মানুষের মর্যাদা
ওঅধিকার পাইয়া জীবন যাপন করিতে পারে, সেইদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখিতে হইবে। আর গোটাআন্দোলনকে এমন প্রকৃতিতে গড়িয়া তুলিতে ও চালাইতে
হইবে যে, উহাতে যাবতীয় দাবিদাওয়াকে সংঘর্ষের পরিবর্তে একই সমাজের
দুইটি শ্রেণীর পারস্পরিক বিরোধ নিষ্পোত্তিরপর্যায়ে রাখিয়া সকল দাবি-দাওয়া আদায় ও
সকল সমস্যার সমাধানের সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণপথ উন্মুক্ত হইবে।
এক্ষণেই এইরূপ এক নবতর আদর্শবাদী শ্রমিক আন্দোলনের
প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভবকরা যাইতেছে। বর্তমান
শ্রমিক ইউনিয়নসমূহের নেতৃবৃন্দ ও সাধারণ শ্রমজীবিগণের আশুদৃষ্টি এইদিকে আকৃষ্ট
হওয়া আবশ্যক।
কোন মন্তব্য নেই