Header Ads

Header ADS

পবিত্র আল্ মি’রাজ : তাৎপর্য ও শিক্ষা



মহানবী হযরত মুহাম্মদ (.)-এর জীবনের সবচেয়ে বিস্ময়কর অলৌকিক ঘটনাবলীর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে পবিত্র শবে মিরাজ। মিরাজের মাধ্যমেই তিনি মহান আল্লাহর সত্তার সাথে পরিচিত হন এবং নভোমন্ডল ভ্রমণ শেষে আল্লাহর সাথে সাক্ষাকরে তাঁর উম্মতের জন্যে নিয়ে আসেন রহমত শান্তির বার্তা।  মিরাজআরবী শব্দ। এর অর্থ হলো সিড়ি, উর্ধ্বগমন, আরোহন। ইসসলামী পরিভাষায় বিশ্ব নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর মক্কা হতে বায়তুল মুকাদ্দেসে (জেরুজালেম) উপনীত হওয়া এবং সেখান হতে সপ্তাকাশ ভ্রমণ করে মহান রাববুল আলামিনের সান্নিধ্য উপস্থিত হওয়ার ঘটনাকে মিরাজ বলে নবুয়তের দ্বাদশ বর্ষ অর্থাহযরত রাসুল (সা.) এর (বয়ান্ন ৫২) বছর বয়ঃ ক্রমকালে আরবী রজব মাসের সাতাইশ (২৭) তারিখ রাতে মিরাজ নামক মহা ঘটনাটি সংগঠিত হয়।
মিরাজ পূর্ব সময়টি ছিলো হযরত রাসুলে পাক (সা.) এর জন্যে দুঃখ বেদনাময়। মক্কার ইসলাম বিরোধীদের দ্বারা দীর্ঘ প্রায় বছর নওমুসলিমসহ অন্তরীণ থাকার পর মুক্তি পেলেন এর দিন পরই  প্রধান পৃষ্ঠপোষক কুরাইশ দলপতি চাচা আবু তালিবের ৮০ বছর বয়সে বার্ধক্য জর্জরিত অবস্থায় মৃত্যুতে যেন তার জীবনের একটি বড় অংশ শূন্য হয়ে গেল। পিতৃব্যের মৃত্যুর শোক ভুলতে না ভুলতেই হযরত রাসুল (সা.) এর জীবনসঙ্গিনী জগতের প্রথম মুসলিম মহিয়সী মহিলা বিবি খাদিজা (রা.) চিরতরে চক্ষু মুদ্রিত করলেন।

দুজন পৃষ্ঠপোষকের বিদায়ে হযরত রাসুলে পাক (সা.) বাহ্যিকভাবে কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়লেন। মক্কার কাফেরদের অত্যাচার নিষ্ঠুরতা এতই বৃদ্ধি পেল, যার দরুন তিনি দেশ ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। মককা হতে ৭০ মাইল দূরে তায়েফ নগরীতে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটে গেলেন। তার সাথে ছিলো পালিত পুত্র হযরত জায়েদ (রা) তায়েফ গমনের পর তথাকার লোকজন হযরত রাসুল (সা.) এর সাথে যে নিষ্ঠুর আচরণ করেছিলো তা আমাদের অনেকের জানা  আছে। তায়েফ বাসীর নিষ্ঠুর অত্যাচারে হযরত রাসুল (সা.) অচেতন হয়ে পড়েন। পালিত পুত্র জায়েদ (রা.) নিজের জীবন বাজি রেখে হযরত রাসুল (সা.) কে নিয়ে তায়েফ নগরী হতে বেরিয়ে আসে। পালিত পুত্রের সেবায় হযরত রাসুল (সা.) কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠলেন। রাহমাতুল্লিল আলামীনকে নির্বোধ তায়েফবাসী না চিনে যে কষ্ট দিয়েছিলো সে কথা স্মরণ করলে আজো লক্ষ কোটি আশেকে রাসুলু কান্নায় বুক ভেজায়। জন্মভূমি ছেড়ে তিনি তায়েফ এসেছিলো ধর্ম প্রচারের জন্যে। কিন্তু সেইখানেও তাঁর স্থান হলো না। এখন যাবেন কোথায়? চিন্তায় হযরত রাসুল (সা.) ভেঙ্গে পড়লেন।  অবশেষে ভেবে চিন্তে ঠিক করলেন। তিনি তাঁর জন্মভূমিতেই ফিরে যাবেন। যে মক্কাবাসি তাঁকে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য করেছিলো তাদের মাঝে আবারো ফিরে আসা যে কত কষ্টের তা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। জন্মভূমিতে ফিরে এসে হযরত রাসুল (সা.) উন্মেহানী (রা.) এর গৃহে অবস্থান নিলেন।

একদিকে নিকটাত্মীয় চাচা আবু তালেব সহধর্মিনী হযরত খাদিজা (রা.)কে হারিয়ে শোকে দুঃখে ভেঙ্গে পড়া, অপরদিকে মককার কাফেরদের দ্বারা অত্যাচারিত হয়ে তায়েফ নগরীতে আশ্রয় নেয়া এবং তথাকার পাষান হৃদয়ীদের  দ্বারা বিতাড়িত হয়ে আর কোথাও আশ্রয় না পেয়ে আবারো মককায় ফিরে আসা এটা যে কত বেশি দুঃখের তা সহজেই অনুমেয়। এই সবকিছুই হয়েছে আল্লাহ পাকের একত্ব প্রকাশের জন্য।
হযরত রাসুল (সা.) এর এই দুঃখময় অসহায়ত্বের মুহূর্তে মহান আল্লাহ পাকের প্রেমের বাঁধও দুঃখ কষ্টে ব্যাথিত হয়ে তাঁকে কাছে ডেকে সান্ত্বনা দেয়া, আদর সোহাগ করা প্রয়োজনীয় কথা বলার জন্য মহান আল্লাহ তাঁর বন্ধুকে একান্ত কাছে পাওয়ার বাসনায় উদগ্রীব হয়ে পড়লেন।  তাই গুণবান ফেরেস্তা জিব্রাঈল (.) মারফত হযরত রাসুল (সা.) কে মহান আল্লাহ পাক তাঁর কাছে ডেকে নিয়ে উভয়েই একান্তে মিলিত হলেন। মহান আল্লাহ তায়ালা হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর একান্তে মিলিত হওয়ার ঘটনাটিই ইসলামের ইতিহাসে মিরাজ নামে পরিচিত।
মিশকাত শরীফের বর্ণনানুযায়ী পবিত্র মিরাজের ঘটনা এরূপ : রজনী দ্বিপ্রহর নিস্তব্ধ নির্জন চারিধার। হযরত রাসুল (সা.) উম্মেহানী (রা.) এর ঘরে ঘুমিয়ে আছেন। এমন সময় জিব্রাঈল (.) সহ তিনজন ফেরেস্তা হযরত রাসুল (সা.) এর নিকট আগমন করলেন। তিনি চোখ খুলে দেখলেন তাঁর শিয়রে ফেরেশতা জিব্রাইল (আঃ) দন্ডায়মান। দন্ডায়মান। জিব্রাইল (আঃ) হযরত (সাঃ) কে যমযম কুয়ার পাশে নিয়ে গেলেন। সেখানে তাঁর বক্ষ বিদীর্ণ করে যমযমের পানি দিয়ে ভেতরের অঙ্গগুলো ধূয়ে সেগুলো পুনঃস্থাপন করলেন। এরপর ডানা বিশিষ্ট অশ্বের মত বাহন বোরাক আরোহণ পূর্ব যাত্রা শুরু করলেন।মক্কা থেকে এলেন বায়তুল মুকাদ্দাসে। পথিমধ্যে মদিনা, তুর পাহাড় বায়তে লাহামে (হযরত ঈসা (আঃ) এর জন্মস্থান) এই তিন স্থানে হযরত জিব্রাইল (আঃ) এর পরামর্শে হযরত (সা.) নামাজ আদায় করলেন।

জেরুজালেমের বায়তুল মোকাদ্দাসে উপনীত হয়ে ইব্রাহিম (.) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এই পবিত্র মসজিদটি সকলেরই কেবলা ছিলো। বোরাক বাইরে রেখে যহরত রাসুল (সা.) প্রবেশ করলেন এবং বিগত সকল নবী রাসুলগণকে সাথে নিয়ে ইমামতি করে দুরাকাত সালাত আদায় করলেন। এরপর বোরাক আরোহন করে উর্ধ্বাকাশে রওনা হলেন হযরত মুহম্মদ (দঃ)সাথে জিব্রাইল (আঃ)  মুহূর্তের মধ্যে প্রথম আকাশের প্রবেশদ্বারে আসমানে দ্বার রক্ষকের সাথে জিব্রাঈল (.) কথনের পর দুয়ার খুলে দেয়া। তারা প্রথম সেখানে অবস্থান করলেন। সেখানে আদি পিতা হযরত আদম (.) হযরত রাসুল (সা.) এর সাক্ষা হয় এবং তাদের  সালাম বিনিময় হয়। হযরত আদম (.) তাঁকে সবকিছু জ্ঞাপন করেন। এরপর একে একে দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ সপ্তম আসমানে এসে যথাক্রমে রাসুল (সাঃ) এর সাথে সাক্ষা সালাম বিনিময় হলো হযরত ঈসা (আঃ), হযরত ইউসুফ (আঃ), হযরত ইদ্রিস (আঃ), হযরত হারুন (আঃ), হযরত মূসা (আঃ) হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর।এরপর হযরত মুহম্মদ (সাঃ) আরো উর্ধ্বে এসে ‘‘সেদরাতু-লমনতাহায়’’ উপনীত হলেন। এখানে পৌঁছে জিব্রাইল (আঃ) আর অগ্রসর হতে পারলেন না। রাসুল (সাঃ) বোরাকে করে একাই এসে উপনীত হলেনবায়তুল মামুর বায়তুল মামুর আসার পর বাহক বোরাকের গতি থেমে গেল।
উল্লেখ্য, মক্কার কাবা হলো বায়তুল মামুরের প্রতিচ্ছবি। বর্তমানে মক্কার কাবা গৃহ যেকানে দন্ডায়মান ঠিক তারই উর্ধ্ব দেশে সপ্তম আসমানে ‘‘বায়তুল মামুর’’ অবস্থিত। প্রতিনিয়ত অসংখ্য ফেরেশতা বায়তুল মামুর তাওয়াফ করে চলেছেন। সেইখানে হাজার হাজার ফেরেস্তা আল্লাহর এবাদতের জন্য এখানে একবার আসেন। কিয়ামত পর্যন্ত আর দ্বিতীয়বার সেই সুযোগ হবে না।

সিদরাতুল মোনতাহা থেকে রফরফের মাধ্যমে তার ওপরে ৩৬ হাজার সরের পথ পাড়ি দিয়ে আরশে গমন এবং সেখান থেকে ৭০ হাজার নুরের পর্দা অতিক্রম করে (এক পর্দা হতে অপর পর্দার দুরত্ব শত সরের রাস্তা)রসুল (সাঃ) এমন এক জগতে এলেন যা অপূর্ব জ্যোতির্ময়, চিরস্নিগ্ধ চিরমনোরম।  একেবারে নির্জনে দিদারে এলাহীতে পৌঁছে সেখানে আল্লাহ তায়ালার সাথে  অনেক অজানা কথা বাক্য বিনিময় করে পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ নামাজের বিধান নিয়ে হযরত (সাঃ) মুহূর্তের মধ্যে পুনরায় মক্কায় উপস্থিত হয়েছিলেন
মহান সৃষ্টি কর্তার দিদারে সর্বশেষ নবী হযরত মুহম্মদ (সাঃ)-এর উর্ধ্ব আকাশে গমন এক অলৌকিক ঘটনা। এমন ঘটনা কোন নবী রাসুলের বেলায় ঘটেনি।প্রিয় নবী নুরুন্নবী (সা.) এর মেরাজ ছিল বাস্তব, শারীরিক আধ্যাত্মিক ঘটনা, মেরাজের বাস্তবতার সাক্ষী হচ্ছেন মহান আল্লাহর তায়ালা তার পবিত্র কোরআন (সুরা বনী ইসরাইলের ১ম আয়াত সুরা নজমের ১ম থেকে ১৭ নং আয়াত) সাক্ষী হচ্ছে স্বয়ং রাসূল (সা.)-এর হাদীস শরিফ এছাড়া ৩০ জন সাহাবী মোতাওয়াতির বর্ণনা দ্বারাও মেরাজের বাস্তবতা প্রমাণিত, তাফসির গ্রন্থ কানযুল ঈমান এছাড়া সাক্ষী হচ্ছেন স্বয়ং জিব্রাইল (:সা:) সকল ফেরেশতা (তাফসীরে জালালাইন শরীফের ২২৯ পৃষ্ঠা) আরো সাক্ষী হলেন হযরত আবু বক্কর ছিদ্দিক (রা..) হযরত মা উম্মেহানী (রা. .) আরো সাক্ষী হচ্ছেন বিজ্ঞান
ইসলামের ইতিহাসে এই বিস্ময়কর যুগান্তকারী ঘটনাটি পবিত্র শবে মিরাজ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে এই শবে মিরাজ মুসলমানদের বিজ্ঞান চর্চায় বিশেষ করে মহাকাশ গবেষণা সৃষ্টি রহস্য উন্মোচনে নতুন পথের দিশা সাহ যুগিয়েছে সংগত কারণে মুসলিম বিশ্ব পবিত্র মিরাজের রাতটিকে জ্ঞানচর্চা জীবনের লক্ষ্যে সন্ধানের এক অনুপম স্মারক হিসেবে পালন করে থাকে  মিরাজের রাতের তাপর্য এবং ফজিলত অপরিসীম। হযরত আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, যে ব্যক্তি ২৭ রজব ইবাদত করিবে তাহার আমলনামায় একশত বছরের ইবাদতের সওয়াব লিখা হইবে। হযরত আবু হোরায়রা বলেছেন, যে ব্যক্তি ২৭ রজব রোজা রাখিবে সে যেন ষাট মাসের রোজা রাখিল।
 রাসুলে পাক (সা.) এর কর্তৃক পবিত্র মিরাজ রজনীতে প্রভুর নিকট থেকে তাঁর উম্মতদের জন্য পাওয়া শ্রেষ্ঠ নিয়ামত বা উপহার হচ্ছে সালাত। এই সালাতের মাধ্যমেই উম্মতে মোহাম্মদীগণ প্রভুর দিদার লাভের সুযোগ পায়-আল্লাহ প্রদত্ত নিয়ামত সালাত কায়েমের মাধ্যমে মহান আল্লাহ পাকের ভালোবাসা লাভের সুযোগ লাভকারীগণ হচ্ছেন মুমিনগণ। তাই মিরাজের উপহার সালাত কায়েম করে প্রভুর দিদার লাভ আমাদের প্রকৃত মুমেন হওয়ার চেষ্টা করা একান্ত প্রয়োজন। কি করে মুমিন হওয়া যায় সে সম্পর্কে হযরত রাসুল (সা.) বলেছেন ‘‘যতক্ষণ পর্যন্ত কেউ আমাকে তার স্ত্রী-পুত্র এমনকি নিজের  জীবনের চেয়েও অধিক ভালোবাসতে না পারবে ততক্ষণ পর্যন্ত সে মুমিন হতে পারবেনা। অর্থামুমিন হতে হলে আমাদেরকে হযরত রাসুল (সা.) এর প্রেম হৃদয়ে ধারণ করতে হবে। আর সে প্রেম হতে হবে জাগতিক জীবনের কিছুর উর্ধ্বে।  হযরত রাসুল (সা.) মিরাজ হতে তাঁর  প্রভুর নিকট হতে আমাদের জন্য যে মহামূল্যবান নিয়ামত সালাত নিয়ে এসেছেন, মুমিন হয়ে সেই সালাত কায়েম করার পর আমরা যেন প্রভুর দিদার লাভের যে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি এবং এটাই হোক আমাদের মিরাজের প্রতিজ্ঞা।

কোন মন্তব্য নেই

ইলমে দ্বীনের ফজিলত

﴿يَرْفَعِ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنْكُمْ وَالَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ دَرَجَاتٍ ﴾ (المجادلة: ١١)

Blogger দ্বারা পরিচালিত.