১২ই রবিউল আউয়াল কি মিলাদুন্নবী, না ওফাতুন্নবী- মাওঃ মুহাম্মদ আবদুল মান্নান (১ম পর্ব)
ණ বারই রবিউল আউয়াল শরীফে বিশ্বের সমস্ত মুসলিম তাঁদের ত্রানকর্তা ও দয়ালু আক্বা হযরত আহমদ মুজতাবা মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর বেলাদত শরীফে খুশি উদযাপন করে আসছেন । আর এ জন্যই আপন প্রতিপালকের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন, তিনি এ ঐতিহাসিক দিনে তাঁর সর্বাপেক্ষা বৃহত্ নিমাতরুপে বিশ্বকুল সরদার সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রেরণ করেছেন । কিন্তু মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর খুশী উদযাপনকে বিদআত মনে করে এবং ওই মহান দিনে ও মাসে 'সিরাতুন্নবী' ইত্যাদি বিকল্প নাম আবিষ্কার করে মিলাদুন্নবীর গুরুত্বকে খাটো করে দেখানোর অপচেষ্টা চালায় এমন কিছু লোক গত করেক বছর ধরে আরেকটা বিভ্রান্তির জন্ম দিয়েছে । তারা ১২ই রবিউল আউয়ালকে বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ওফাত দিবস (ওফাতুন্নবী) হিসেবে চিহ্নিত করে মিলাদুন্নবীর খুশী উদযাপনের দিক থেকে মুসলিম সমাজের ধর্মীয় অনুভুতিকে অন্যদিকে ফেরানোর অপচেষ্টা চালাচ্ছে । দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, এ কয়েক বছর থেকে আমাদের দেশের প্রচার মাধ্যমগুলোতেও ১২ই রবিউল আউয়ালের ওই দিবসের তাত্পর্য উল্লেখ করতে গিয়ে 'মিলাদুন্নবী' এর সাথে 'ওফাতুন্নবী' (ওফাত দিবস) শব্দটার সংযোজন করতে দেখা ও শুনা যাচ্ছে । অথচ ওফাতুন্নবী সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বসম্মতভাবে সোমবার হলেও ১২ই রবিউল তারিখে কিনা তা নিয়ে যতেষ্ট বিতর্ক রয়েছে । এ নিবন্ধে আমি একথাই প্রমাণিত করা প্রয়াস পাচ্ছি, ১২ই রবিউল আউয়াল শরীফ হচ্ছে বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পবিত্র বেলাদতেরই দিন (মিলাদুন্নবী); ওফাতের তারিখ নয় । তাই ওই তারিখে আহলে সুন্নাত তথা বিশ্ব মুসলিম নবী করীম সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পবিত্র বেলাদত বা জন্মের খুশীই উদযাপন করে আসছেন । বস্তুত এটাই তাঁদের যথাযোগ্য পদক্ষেপ এবং পবিত্র ক্বোরআন, সুন্নাহ, ইজমা এবং গ্রহনযোগ্য কিয়াস অতীব বরকতময় কাজ ।
।। এক ।।
*১২ই রবিউল আউয়াল হচ্ছে 'পবিত্র মিলাদ' এর দিন
ණ সত্যর মাফকাঠি সাহাবা কেরাম থেকে বিশুদ্ধরুপে বর্ণিত হয়েছে, ১২ই রবিউল আউয়াল শরীফ বিশ্বনবী হুযূর আকরাম সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পবিত্র বেলাদতেরই দিন । যেমন হাফেয আবু বকর ইবনে আবী শায়বাহ (ওফাত ২৩৫ হিজরি) সহীহ সনদ সহকারে বর্ণনা করেছেন-
অর্থাত্ হযরত আফফান থেকে বর্ণিত, তিনি হযরত সাঈদ ইবনে মীনা থেকে বর্ণনা করেছেন, হযরত জাবের ও হযরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমা থেকে বলেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বেলাদত শরীফ ঐতিহাসিক 'হস্তি বাহিনী বর্ষের' (যে বছর আবরাহা তার হস্তিবাহিনী নিয়ে কাবা শরীফ ধ্বংস করতে এসে নিজে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিলো) ১২ই রবিউল আউয়াল সোমবার হয়েছিলো ।
[সূত্রঃ বুলূগুল আমানী ফী শরহিল ফাততিহর রব্বানী' ২য় খণ্ড, ১৮৯ পৃঃ বৈরুতে মুদ্রিত এবং আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ' ২য় খণ্ড, ২৬০ পৃঃ বৈরুতে মুদ্রিত]
উক্ত বর্ণনার 'সনদ'- এর মধ্যে প্রথম বর্ণনাকারী হযরত আফফান সম্পর্কে মুহাদ্দিসগণ বলেছেন, "আফফান একজন উচ্চ পর্যায়ের নির্ভরযোগ্য ইমাম, প্রবল স্মরণশক্তি ও দৃঢ় প্রত্যয়সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব"
[সূত্রঃ খোলাসাতুত তাহযীব ২৬৮ পৃঃ বৈরুতে মুদ্রিত]
"২য় বর্ণনাকারী সাঈদ ইবনে মীনা । তিনিও অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য ।"
[সূত্রঃ খোলাসাহ ১৪৩ পৃঃ এবং তাক্বরীব ১২৬ পৃঃ]
এ দুজন উচ্চ পর্যায়ের ফক্বীহ সাহাবীর বিশুদ্ধ সনদসহকারে বর্ণনা থেকে প্রমাণিত হলো, ১২ই রবিউল আউয়াল হচ্ছে হুযূর সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পবিত্র মিলাদ দিবস । সুতরাং পরবর্তী যুগগোলোর কোন ইতিহাস লেখকের ভিন্নকথা এবং ধারণা বা অনুমান উক্ত বিশুদ্ধ বর্ণনার মোকাবেলায় দৃষ্টিপাতযোগ্য ও গ্রহনযোগ্য হতে পারে না ।
অতএব, হযরত যোবায়ের ইবনে বাক্কার, ইমাম ইবনুল আসাকির, ইমাম জামাল উদ্দিন ইবনে জূযী এবং ইবনুল জাযযার প্রমুখ ১২ই রবিউল আউয়াল 'বিশ্বনবীর মিলাদ দিবস' হওয়াই নির্ভরযোগ্য ও সেটার উপর গবেষক ইমামদের 'ইজমা' (ঐকমত্য) প্রতিষ্ঠিত হবার কথা ঘোষনা করেছেন ।
[সূত্রঃ সীরাত ই হালবিয়াহ ১ম খণ্ডঃ ৯৩ পৃঃ, যারক্বানী আলাল মাওয়াহিব ১ম খণ্ডঃ ১৩২ পৃঃ, মা-সাবাতা মিনাস সুন্নাহ কৃত শায়খ আল-মুহাক্বক্বিক্ব দেহলভী ৯৮ পৃঃ, শামামাহ-ই আম্বিয়াহ কৃত নাওয়াব সিদ্দীক্ব হাসান খান ভূপালী আহলে হাদীস ০৭ পৃঃ]
ණ "আর এটাই হচ্ছে প্রায় সব ওলামা ও মুসলমানের অনুসৃত পথ ও মত । এটাই তাঁদের মধ্যে প্রসিদ্ধ ।"
[সূত্রঃ আল-বিদায়া ২য় খণ্ডঃ ২৬০ পৃঃ, আল-ফতহুর রাব্বানী ২য় খণ্ডঃ ১৮৯ পৃঃ, আল-মাওরেদ আর- রাভী কৃত মোল্লা আল-ক্বারী ৯৬ পৃঃ, মক্কা মুকাররামায় মুদ্রিত, হাজ্জাতুল্লাহি আলাল আলামীন কৃত আল্লামা নাবহানী ১ম খণ্ড ৭৩১ পৃঃ, আল- মাওয়াহিব- আল-লাদুন্নিয়াহ কৃত ইমাম ক্বাস্তলানী এবং এর ব্যাখ্যাগ্রন্থ 'যারক্বানী' ১ম খণ্ডঃ ১৩২ পৃঃ, মাদারিজুন্নবূয়ত ২য় খণ্ডঃ ১৪ পৃঃ]
"১২ই রবিউল আউয়াল 'মিলাদ দিবস' হবার প্রাচীন ও আধুনিক উভয় যুগের মক্কাবাসী ঐক্যমত পোষণ করে আসছেন । এ তারিখই হুযূরের পবিত্র বেলাদতে হাযির হয়ে মিলাদ শরীফ উদযাপনের নিয়ম প্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছে ।"
[আল- মাওয়াহিব- আল-লাদুন্নিয়াহ ও 'যারক্বানী' ১ম খণ্ডঃ ১৩২ পৃঃ, সীরাত ই হালবিয়াহ ১ম খণ্ডঃ ৯৩ পৃঃ, আল-মাওরেদ আর-রাভী কৃত মোল্লা আল-ক্বারী ৯৫ পৃঃ, মা- সাবাতা মিনাস সুন্নাহ ৯৮ পৃঃ, তাওয়ারীখ-ই হাবীব-ই ইলাহ, যা মৌলভী আশরাফ আলী থানভী সাহেবের নিকটও প্রশংসিত । মাদারিজুন্নুবূয়ত ২য় খণ্ড ১৪ পৃঃ ইত্যাদি]
১২ই রবিউল আউয়াল শরীফ 'মীলাদুন্নবী' উদযাপনের রীতি মদীনাবাসীদের মদ্যেও চলে এসেছে ।
[সূত্রঃ তাওয়ারীখ-ই হাবীব-ই ইলাহ]
"এ তারিখেই সমস্ত শহরে মুসলমানদের 'জশনে মিলাদ' উদযাপনের নিয়ম রয়েছে ।"
[সূত্রঃ সীরাতে হালবিয়্যাহ ১ম খণ্ডঃ ৯৩ পৃঃ, যুরক্বানী আলাল মাওয়াহিব ১ম খণ্ডঃ ১৩২ পৃঃ]
প্রাচীন যুগের মক্কাবাসীদের মধ্যে প্রচলিত নিয়মের সংক্ষিপ্ত বিবরণঃ
মুহাদ্দিস ইবনুল জূযী (ওফাতঃ ৫৯৭হি.) বলেছেন- "হেরমাঈন শরীফাঈন (মক্কা শরীফ ও মদীনা শরীফ), মিশর, সিরিয়া, সমস্ত আরব দেশ এবং প্রাচ্য পাশ্চাত্যের মুসলমানদের মধ্যে পুরানা যুগ থেকে এ নিয়মই চলে এসেছে যে রবিউল আউয়ালের চাঁদ দেখতেই তাঁরা মিলাদ শরীফের মাহফিলসমূহ আয়োজন করতেন, খুশী উদযাপন করতেন, গোসল করতেন, উন্নত মানের পোশাক পরিধান করতেন, বিভিন্ন ধরনের সাজসাজ্জা করতেন, খুশবু লাগাতেন, এ দিনগুলোতে (রবিউল আউয়াল) খুব খুশি ও আনন্দ প্রকাশ করতেন, সামর্থ্যনুসারে লোকজনের জন্য টাকা-পয়সা ও জিনিসপত্র খরচ করতেন এবং মিলাদ শরীফ পাঠ ও শ্রবণের প্রতি পূর্ণাঙ্গ গুরুত্ব দিতেন । এরই মাধ্যমে আল্লাহর পক্ষ থেকে মহান প্রতিদান ও মহা সাফল্যাদি অর্জন করতেন । মিলাদ শরীফের খুশী উদযাপনের পরীক্ষিত বিষয়াদির উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- গোটা বছর অধিক পরিমাণে কল্যাণ ও বরকত, সুখ ও শান্তি, জীবিকা, মাল-দৌলত এবং আওলাদে আধিক্য লাভ হয় । আর শহরগুলোতে নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধি এবং ঘর-বাড়িতে অনাবিল শান্তি জশনে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরই বরকতে বিরাজমান থাকে ।"
[সূত্রঃ বয়ানুল মিলাদিন্নভী কৃত ইবনে জূযী ৫৭-৫৮ পৃঃ]
(চলবে)
কোন মন্তব্য নেই