দ্যা ইনোসেন্স অব মুসলিমস : প্রাসঙ্গিক দু'টি কথা
রাসুলুল্লাহ (দ:) মানুষকে যখন প্রকাশ্যে ইসলামের দাওয়াত দিতে লাগল, তখন কাফেররা কোন আগন্তুক তাঁর ডাকে সাড়া না দেয়ার লক্ষ্যে এক মন্ত্র ছাড়ল- ‘‘এখানে মুহাম্মদ নামে এক পাগল কবি আছে- যে মানুষকে বিভ্রান্ত করছে, নিজেদের দ্বীন থেকে বের করে ফেলছে। তোমরা সবাই সাবধান থেকো।’’ এ মন্ত্রে যখন তারা ব্যর্থ হল তখন তাদের সেরা কবির দলকে মাঠে প্রেরণ করল। তারা কেউ কুরআনকে কটাক্ষ করে, আবার কেউ রাসুল (দ:) কে ব্যঙ্গ করে কবিতা লিখতে লাগল। আর কেউ নবীজীর শানে ভয়ংকর সব অশ্লীল সাহিত্য ও কবিতা প্রচার করতে লাগল। পক্ষান্তরে রাববুল আলামীন তাঁর হাবীবের মান-মর্যাদা সমুন্নত করেছেন। ফলে কাফেররা আবারো ব্যর্থ হলো এবং ইসলাম হয়ে দাঁড়াল বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শক্তি। আর ইসলাম বিদ্বেষীরা ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলো। শুরু হল ইসলাম ও নবীজীর বিরুদ্ধে অপপ্রচার। যুগে যুগে তারা মুসলমানদের অনুভূতিতে আঘাত হেনেছে। কালের পরিক্রমায় কেউ ইসলামকে ভ্রান্ত ধর্ম বলেছে, কেউ রাসূল (দ:) কে সন্ত্রাস আখ্যা দিয়েছে। প্রসঙ্গত, উল্লেখ করা যায় সালমান রুশদীর স্যাটানিক ভার্সেস, তসলিমা নাসরিনের মানহীন অনেক সাহিত্যে আল্লাহ ও রাসুলের বিরোধিতা, নবী করিম (দ:)কে নিয়ে কার্টুন আঁকার প্রতিযোগিতা, শামসুর রাহমান-শওকত ওসমান - হুমায়ুন আযাদ - আহমদ শরীফের মতো ইসলাম ও রাসূলের সুকৌশলী কুৎসাকারীর নাম। চরম অনাকাক্মিখত এসব অপতৎপরতা বিশ্ববাসীকে বিস্মিত, দুঃখিত ও ক্ষুব্ধ করছে। মূলত এসবই এক বৃহৎ গ্লোবাল প্লানিংয়ের অংশ। এর সর্বশেষ সংস্করণ হচ্ছে- রাহমাতুল্লিল আলামীন (দ:) এর দাম্পত্য জীবন নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্র ‘‘ইনোসেন্স অব মুসলিমস’’। আমেরিকা অভিবাসী ইসারাইলী ইহুদি স্যাম বাসিল/নাকুলা বাসিল সিনেমাটি নির্মাণ করে। তার সহযোগী ছিল তথাকথিত ধর্মযাজক টেরিজোন্সের। এ চলচ্চিত্র প্রিয় নবী (দ:) এর চরিত্র হননের অপচেষ্টা এবং ইসলাম ধর্ম অবমাননার মাধ্যমে ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে ইহুদী ক্রুসেড। ১১ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে স্যাম বাসিল জানায়, ‘‘চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করতে ১০০ জন ইহুদী মোট পাঁচ মিলিয়ন ডলার অর্থ দিয়েছেন। চলচ্চিত্রে কাজ করেছেন ৬০ জন অভিনেতা ও ৪৫ জন কলাকুশলী।’’ ওবামা সরকারের চলচ্চিত্র সেন্সরবোর্ড চলচ্চিত্রটি বাজারে ছাড়ার অনুমতি দেয়। ছবিটি ২৩ জুন মুক্তি পায়। বলা বাহুল্য যে, তথ্য প্রযুক্তি কলার উন্নয়ন ও প্রসারের ফলে যে কোন তথ্য চিত্র দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে অতি সহজে। আর এই সুযোগটি গ্রহণ করেছে ইসলাম বিদ্বেষী ইহুদি-খ্রিস্টান লবি। চলচ্চিত্রটি ইউটিউবে আপলোড করার ফলে ইন্টারনেটের মাধ্যমে তা ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে।
বিতর্কিত এ চলচ্চিত্রের প্রতিবাদে উত্তাল মুসলিম বিশ্ব। এই ছবির প্রতিবাদে গত ১৩ সেপ্টেম্বর মিসর, ইয়েমেন, ইরান, ইরাক ও তিউনিসিয়ায় মার্কিন দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ হয়। এক সপ্তাহের ব্যবধানে মুসলিম বিশ্বের অন্তত ২০টি দেশে চলচ্চিত্রটির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে বন্ধ করা দেয়া হয়েছে জনপ্রিয় ওয়েব সাইট ইউটিউব। লিবিয়ার বিক্ষোভকারীরা দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর বেনগাজিতে মার্কিন উপদূতাবাস ভবনে রাষ্ট্রদূত ক্রিস্টোফার স্টিভেনসের গাড়িতে রকেট হামলা চালালে রাস্ট্রদূতসহ চারজন নিহত হয়। এ লেখা লিখা পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী এ ঘটনায় ত্রিশজন নিহত হয়েছে। ব্যক্তি কর্তৃক অবমাননার দায়ে বিভিন্ন দেশের দূতাবাসে হামলা করে রাষ্ট্রদূতদের হত্যা করা প্রিয় নবীর আদর্শ নয়। প্রতিবাদের ভাষা এরূপ হতে পারে না। ইন্টারনেট জগতে ইসলামকে কটাক্ষ করে বানানো হাজার হাজার ভিডিও চিত্র রয়েছে, তাই বলে কি ইন্টারনেট ব্যবহারের উপর হামলা চালানোই এর সমাধান? অবশ্যই নয়। এর প্রতিবাদে বর্তমানে ইন্টারনেটে অনেক ইসলামী ভিডিও রয়েছে। প্রসঙ্গত, মহানবী (দ:) কে নিয়ে মূলধারায় সবচেয়ে অথেনটিক সিনেমা হচ্ছে দ্যা ম্যাজেস। সিরিয়ান গুণী পরিচালক মুস্তাফা আল আকাড এর তৈরি করা এই সিনেমাতে Anthony Quin এর মত সাড়া জাগানো অভিনেতা অভিনয় করেছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক প্রোপাগান্ডার সময়ে অস্কার নমিনেটেভ এই সিনেমাটির প্রচার আরো বেশি করে হওয়া প্রয়োজন।
এখন চলছে স্নায়ু যুদ্ধ ও মিডিয়া যুদ্ধ। যারা এক্ষেত্রে অগ্রগামী, তারাই জিতবে। মুসলমানদের এই যুদ্ধে জিততে হলে তাদেরও এ ক্ষেত্রে অগ্রসর হতে হবে জোড় কদমে। এক্ষেত্রে তরুণ মিডিয়া অভিজ্ঞতা সম্পন্ন মুসলিম স্কলারদের এগিয়ে আসতে হবে। যারা তৈরি করবেন - বিশ্বমানবতার মুক্তির দূত হযরত মুহাম্মদ
(দ:) এর উত্তম জীবনাদর্শ নিয়ে ইতিবাচক ছবি। বিশ্ববাসীকে দেখাবেন-মরুর দুলাল সরকারে দুআলম (দ:) এর অমরকীর্তি। যে চলচ্চিত্রে রূপায়িত হবে রাষ্ট্রনায়ক হিসাবে তাঁর সফলতা, দেশ পরিচালনায় দক্ষতা, ঐতিহাসিক সমরনীতি, যোদ্ধা হিসাবে তাঁর বীরত্ব। প্রতিবেশী হিসাবে তাঁর সহাবস্থানের মনোভাব, বাবা হিসাবে কন্যার সাথে সদ্ব্যবহার, স্বামী হিসাবে কেমন দায়িত্বপরায়ণ ছিলেন। রূপায়িত হবে তাঁর বহু বিবাহের তাৎপর্য ও গুরুত্ব, সামাজিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক / কূটনৈতিক কারণসমূহ। তবেই মূর্খ বিশ্ব জানতে পারবে, শিখতে পারবে প্রিয়নবীর অনুপম আদর্শ। যা মহান আল্লাহর ভাষায় ‘‘খুলকে আজীম’’ উত্তম চরিত্র। এক্ষেত্রে জায়েয না জায়েয প্রসঙ্গ অবান্তর, বরং এর মাধ্যমে ইসলামের সুমহান আদর্শ আরো ছড়িয়ে পড়বে।
বিভিন্ন দেশের মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে হত্যা করে মুসলমানদেরকে একটি আগ্রাসী জাতি হিসাবে পরিচিত করা ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর জন্য কখনো কলা্যণ বয়ে আনবে না। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন বলেছেন, ‘‘ইসলামবিরোধী যে প্রামাণ্য চিত্রটির কারণে মুসলিম প্রধান দেশগুলোতে হামলা-বিক্ষোভ হচ্ছে, সেই ছবিটি জঘণ্য, নিন্দনীয় এবং একটি মহান ধর্মের প্রতি অবমাননা। নির্মাতা নিজ দায়িত্বেই এটি নির্মাণ ও প্রচার করেছেন। তার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে দোষারোপ কিংবা মার্কিন দূতাবাসের ওপর হামলা কোন কান্ডজ্ঞানসম্পন্ন মানুষ সমর্থন করতে পারে বলে ওয়াশিংটন মনে করে না।’’ মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এ ঘটনার তদন্তের কথা বলার পর পর লিবীয় উপকূলে মার্কিন রণতরী ও মেরিন সেনাদল প্রেরণ করেন। যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা জানান, ওই হামলায় আল কায়েদা সম্পৃক্ত ছিল বলে তারা ধারণা করছে। তারা আল কায়েদা বা তাদের সহযোগীরা হামলায় জড়িত কি না, তা তদন্ত করে দেখছে।
যুক্তরাষ্ট্রে মহানবী (দঃ) কে কটাক্ষ করে চলচ্চিত্র নির্মাণের জেরে যখন বিশ্ব জুড়ে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে, তখন ১৯শে সেপ্টেম্বর বুধবার ফ্রান্সের হাস্যরসাত্মক সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন ‘চার্লি হেবদো'য় রাসুল (দঃ) কে ব্যঙ্গ করে বেশ কিছু কার্টুন ছাপা হলো। ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী লরে ফেবিয়াস এ সব ব্যঙ্গ চিত্র ছাপার ঘটনা প্ররোচনামূলক কাজ বলে তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। প্রসঙ্গত, ফরাসি ম্যাগাজিনটির এ ঘৃণ্য প্রচেষ্টা নতুন নয়। এর আগেও গত নভেম্বরে ম্যাগাজিনটি প্রিয় নবী (দঃ) এর আরেকটি ব্যঙ্গ চিত্র ছাপায় যা বিশ্বজুড়ে তীব্র আলোড়ন তৈরি করে।
আজ মুসলমানদের ভগ্নদশা। তারা আজ কাফেরদের দিকে চাতক পাখির মতো তাকিয়ে থাকে অনুদান আর অনুকম্পার জন্য। সারা পৃথিবীতে যতো পশু-পাখি গুলী করে মারা হয়, তার চেয়ে হাজার গুণ বেশি মুসলিম মারা হয় গুলী করে আর বোমা / ক্ষেপণাস্ত্র / ড্রোন হামলা করে। পাখি কিংবা বন্য প্রাণী শিকারের বিরুদ্ধে আইন রয়েছে, কিন্তু মুসলিম মারার কোন বিচার নেই। বিশ্ব মিডিয়া আর পাপেট শাসকদল আজ কাফেরদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। ইরশাদ হচ্ছে, ‘‘হে মুমিনগণ, তোমরা ইহুদী ও খ্রিস্টানদেরকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করোনা। তারা একে অপরের বন্ধু, তোমাদের মধ্যে যে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ জালেমদের পথ প্রদর্শন করেন না।’’ - আল মায়েদা: ৫১।
শিক্ষার্থী: আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম। ই-মেইল: almasum18@yahoo.com
কোন মন্তব্য নেই