হযরত সৈয়্যদ মুহাম্মদ খলিলুর রহমান আল মাইজভান্ডারী বি.এ.বি.টি কুদ্দিসা সিররুহুল আজিজ এর জীবন ও কর্ম
নবী—রাসুল, সাহাবী ও আউলিয়ায়ে কামেলিনের মহান জীবন আগত উম্মত ও ধর্মানুরাগীদের জন্য উত্তম আদর্শ। তাঁদের আখলাক ও চাল—চলনের প্রতিটি স্তর বা ধারায় রয়েছে সত্য ও সুন্দরের অমোঘ স্বরূপ। সারাজীবন স্মরণ সাধনায় যারা আল্লাহর অবারিত নেয়ামত পেয়ে অসংখ্য মানুষের কল্যাণ করেছেন তেমন এক মহান ব্যক্তিত্ব খলিফায়ে গাউসুল আজম, যুগশ্রেষ্ঠ কলন্দর হযরত শাহসুফী সৈয়্যদ মুহাম্মদ খলিলুর রহমান আল মাইজভান্ডারী কুদ্দিসা সিররুহুল আজিজ ।
শুভ জন্মক্ষণ: বার আউলিয়ার শহর চট্টগ্রাম। ক্ষনজন্মা মহাপুরুষদের লীলাভূমি চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী থানার অন্তর্গত ১২ নং চিকনদন্ডী ইউনিয়নের খন্দকিয়া গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে ১৮৭৩ সালের এক শুভক্ষণে জন্ম গ্রহন করেন যুগশ্রেষ্ঠ মহান তাপস হযরত শাহসুফী সৈয়দ মুহাম্মদ খলিলুর রহমান কুদ্দিসা সিররুহুল আজিজ। মুন্সি সৈয়দ মুহাম্মদ ওয়াজিউল্লাহ তাঁর সম্মানিত পিতা এবং তাঁর মাতার নাম ছিল তাজুন্নেসা।
শিক্ষা জীবন: খলিল শাহ কেবলা কাবা বাল্য বয়সে নিজ গ্রামে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে তৎকালীন "নিউ স্কিম মাদরাসায় ভর্তি হন এবং জমাতে হাফতমে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন। অতঃপর উচ্চ শিক্ষা অর্জনের জন্য তিনি তাঁর নানা জনাব কলিমুল্লাহ দারোগার সাথে কলকাতায় গমন করেন এবং সেখান থেকে কৃতিত্বের সাথে বিএ পাশ করেন।
কর্ম জীবন: শিক্ষা জীবন সমাপ্ত করে হযরত খলিলুর রহমান শাহ কুদ্দিসা সিররুহুল আজিজ কর্ম জীবনে আত্মনিয়োগ করার মানসে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র মায়ানমারে গমন করেন এবং মেগলাল মেকেঞ্জী কোম্পানীর হেড ক্লার্ক পদে যোগদানের মাধ্যমে কর্ম জীবনের শুভ সুচনা করেন। বেশ কিছু দিন চাকরী করার পর নিজ মাতৃভূমিতে বেড়াতে আসেন। এ সময় তিনি ম্যানেজার পদে পদোন্নতির জন্য দোয়া লাভের উদ্দেশ্যে হযরত গাউসুল আজম, রুহুল আশেকীন, সুলতানুল মাশুকীন, সিরাজুস সালেকীন, বাবাজান কেবলা মাওলানা সৈয়্যদ গোলামুর রহমান আল হাসানী আল মাইজভান্ডারী কুদ্দিসা সিররুহুল আজিজ এর দরবারে গমন করেন এবং তাঁর মনোবাসনা বাবাজান কেবলাকে খুলে বলেন। বিস্তারিত শুনে বাবাজান কেবলা বলেন— "তুমি ম্যানেজার পদ পাবার যোগ্য। তোমাকে যদি ম্যানেজার পদ দেয়া না হয়, তবে আমার নিকট একটি পদ খালি আছে, তা তোমাকে প্রদান করবো।" অতঃপর বাবাজান কেবলা থেকে বিদায় নিয়ে তিনি পুনরায় মায়ানমার গমন করেন। বাবাজান কেবলার দোয়ার বদৌলতে সত্যিই তিনি ম্যানেজার পদ লাভ করেন। তিনি দক্ষতার সাথে সুচারুরূপে দায়িত্ব পালন করেন। বেশ কিছুদিন অতিবাহিত হওয়ার পর তিনি স্বদেশে পুনরায় বেড়াতে আসেন। ইত্যবসরে মেগলাল মেকেঞ্জী কোম্পানীর বৃটিশ পরিচালক মায়ানমারস্থ অফিস পরিদর্শনে আসেন। ম্যানেজার শাহ মুহাম্মদ খলিলুর রহমান কুদ্দিসা সিররুহুল আজিজ এর অনুপস্থিতিতেও অফিসের সৃষ্ট ব্যবস্থাপনা দেখে তাঁর যোগ্যতার উপর আস্থাবান হন এবং বৃটিশ পরিচালক সাহের লন্ডনে ফিরে যাওয়ার সময় তাঁর সার্টিফিকেটগুলোও সাথে করে নিয়ে যান। এর কিছুদিন পরই কোম্পানী তাঁকে পদোন্নতি দিয়ে লন্ডনে নিয়ে যেতে আগ্রহ প্রকাশ করে। এরই প্রেক্ষিতে তিনি মায়ানমারস্থ অফিসের যাবতীয় হিসাব বুঝিয়ে দিয়ে লন্ডনে যাওয়ার জন্য বাবাজান কেবলা গোলামুর রহমান শাহ কুদ্দিসা সিররুহুল আজিজ এর অনুমতি লাভের আশায় স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন এবং মাইজভান্ডার দরবার শরীফস্থ বাবা ভান্ডারীর দরবারে উপস্থিত হন।
আধ্যাত্মিক জীবন: দ্বিতীয় বার বাবা ভান্ডারী কুদ্দিসা সিররুহুল আজিজ এর দরবারে গমন করলে তিনি তাঁকে জিজ্ঞেস করেন—ইতিপূর্বে ম্যানেজার পদ অর্জন হয়েছে কি? শাহ খলিলুর রহমান কুদ্দিসা সিররুহুল আজিজ হ্যাঁ সুচক জবাব দিয়ে কোম্পানীর কাজে লন্ডনে গমন করার অনুমতি প্রার্থনা করলেন। বাবা ভান্ডারী এ আরজির কোন উত্তর দিলেন না বরং তাঁর হাতে একটি চাঁপা কলা তুলে দিয়ে বললেন—ছিলকাসহ খেয়ে ফেলো। তিনি আদব সহকারে তা খেয়ে ফেললেন। হুযূরের দোয়া নিয়ে হযরত খলিল শাহ কুদ্দিসা সিররুহুল আজিজ বাড়ী ফিরে আসেন। আল্লাহর হিকমত বুঝা বড়ই কঠিন ব্যাপার। বাড়ী ফিরে আসার পর থেকে তাঁর জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু হয়। ক্রমশঃ তিনি মযজুব হয়ে উঠেন। শুরু হয় রিয়াজত। কঠিন সাধনা করে বেলায়তের উচু মকাম ‘ফানা ফিল্লাহ’ এ স্তরে উন্নিত হন।
বিবাহ: উপরোক্ত ঘটনার মাত্র ছয়মাস পূর্বে তিনি বিয়ে করেছিলেন। দাম্পত্য জীবনে লোকের মন সচরাচর সংসারের দিকে আকৃষ্ট হয়। কিন্তু দুনিয়াদারী ও সংসারের প্রতি তাঁর কোন আগ্রহ ছিল না। তাঁর ঔরশজাত কোন সন্তান নেই।
কারামত: মহান এ মযজুব অলীর জীবনে ঘটেছে অসংখ্য অলৌকিক ঘটনা। যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে এর অনেক গুলোই আজ স্মৃতি বিস্মৃত। বিশদভাবে জানতে প্রকাশিতব্য ‘গুলশান—ই খলিল’ গ্রন্থটি সংগ্রহে রাখুন। তন্মধ্যে কয়েকটি নিম্নে তুলে ধরা হল।
মৃত্যু দন্ডে দন্ডিত ব্যক্তির মুক্তি লাভ
অক্সিজেনের পূর্বে শহীদ নগরের কালু নামক এক ব্যক্তি মিলিটারীকে হত্যা করে। আদালতের রায়ে তাকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করা হয়। দীর্ঘদিন যাবৎ কালু পালিয়ে বেড়ায়। শেষ পর্যন্ত সে হযরত খলিল বাবার নিকট দোয়া কামনায় এসে কান্নাকাটি করতে থাকে। অবশেষে তাঁর দোয়ার বরকতে এবং তৎকালীন চেয়ারম্যান বজল দফাদারের সহায়তায় কালু মৃত্যুদন্ড থেকে নিস্কৃতি লাভ করে।
মন্দ লোকের উচিত শাস্তি
একদা খলিল শাহ কুদ্দিসা সিররুহুল আজিজ নাজিরহাট সড়কে বসে পত্রিকা পড়ছিলেন। এমন সময় শহর অভিমুখী একটি প্রাইভেট কার আসছিল। তখন ড্রাইভার মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, আজকে এ পাগলকে গাড়ীর নিচে চাপা দিয়ে মেরে ফেলব। তাই সে গাড়ীর গতিবেগ বাড়িয়ে দিল। গাড়ী যখন খলিল বাবার খুব কাছে আসল তখন হঠাৎ গাড়ীর ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায়। আর বাবাজান রাস্তা থেকে উঠে গ্রামের দিকে ছুটলেন। গাড়ীর ড্রাইভার আপ্রাণ চেষ্টা করেও গাড়ী চালু করতে ব্যর্থ হলে চার আরোহী যাত্রীসহ খলিল শাহকে খুঁজতে বের হল। বহু অনুসন্ধানের পর তাঁকে একটি বাড়ীতে পেয়ে অনুনয় বিনয় করে নিজেদের বেয়াদবীর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করল এবং তাঁকে প্রচুর হাদিয়া প্রদান করল। খলিল বাবা তাদেরকে রাগান্বিত অবস্থায় উত্তম—মধ্যম দিয়ে এই বলে বিদায় করলেন "যাও—গিয়ে গাড়ী চালাও। অতঃপর তারা গাড়ী চালিয়ে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে যাত্রা করল।
দূর্ভিক্ষ সম্পর্কে ভবিষ্যবাণী
বৃটিশ যুগে এদেশে দুর্ভিক্ষ হওয়ার আগে একদা তিনি ভিক্ষারীবেশে একটি পাত্র হাতে নিয়ে পাঁচলাইশ ইয়ার আলীর খাঁর হাটে গিয়ে লোকজনের কাছে সাহায্য চেয়ে বললেন, অনাহারে লোক মারা যাচ্ছে, সাহায্য কর। কিছুদিন পর দেখা গেল (১৯৪৩ ইং সনে) সত্যিই অনাহারে হাজার হাজার মানুষ মারা গেল।
অলীর ক্ষমতার কাছে বিষধর সর্প পরাজিত
একদা বায়েজিন বোস্তামী কুদ্দিসা সিররুহুল আজিজ’র দরগাহর পশ্চিম পার্শ্বে মাষ্টার পাহাড়ে তিনি ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এমন সময় এক বিষাক্ত সর্প তাঁর কপালে দংশন করল। বিষে পুরো শরীর নীলবর্ণ হয়ে গেল। সবাই ভেবেছিল— 'খলিল ফকির' মারা যাবে। এমনকি কোথাও কোথাও গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল যে, “খলিল ফকির মারা গেছেন”। দলে দলে মানুষ খলিল শাহের জানাযা পড়তে এসে যে দৃশ্য দেখল তাতে সবাই অবাক হয়ে গেল। খলিল ফকির সুস্থ হয়ে উঠেছেন, কিন্তু একটি বিষধর সর্প তাঁর সম্মুখে মরে পড়ে আছে। এ ধরনের আরেকটি ঘটনা কুলগাঁও বাজারের পার্শ্ববর্তী জামশেদ শাহ সড়কেও ঘটেছিল।
ইন্তেকাল: হযরত খলিল শাহ কুদ্দিসা সিররুহুল আজিজ আল্লাহ প্রদত্ত করুণা বিতরণের পর সুদীর্ঘ ১০৫ বৎসর বয়সে দেশবাসীর অতুলনীয় আশার প্রদীপ পাপী—তাপী, দুঃখী—দুস্থের সহায় ও আশ্রয়স্থল, খলিফায়ে গাউসুল আজম হযরত শাহ সুফী সৈয়্যদ মুহাম্মদ খলিলুর রহমান বি.এ আল মাইজভান্ডারী কুদ্দিসা সিররুহুল আজিজ লক্ষ লক্ষ ভক্ত—অনুরক্তকে শোক সাগরে ভাসিয়ে ১৯৭৮ সালের ২২ অক্টোবর মোতাবেক ১৯ জিলক্বদ ১৩৯৮ হিজরি, ১৩৮৫ বাংলার ৪ কার্তিক রবিবার পরম প্রিয়তম মাহবুব মহান আল্লাহর সান্নিধ্যে গমন করেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন। অল্প সময়ের মধ্যে এ মহান অলীর ইন্তেকালের খরর চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল এবং খলিল ভান্ডার দরবার শরীফ হাজার হাজার ভক্ত, অনুরক্ত, লোকে লোকারণ্য হয়ে গেল। তাঁর নামাযে জানাযায় অনিয়ন্ত্রিত জন—সমুদ্রের সমাগমে ইমামতি করেন ইমামে আহলে সুন্নাত, রাহনুমায়ে শরীয়ত ও তরীকত হযরতুলহাজ্ব আল্লামা কাজী মুহাম্মদ নুরুল ইসলাম হাশেমী কুদ্দিসা সিররুহুল আজিজ। নামাযে জানাযার পর তাঁর সাধনা ও রিয়াজতের প্রাণ কেন্দ্র আউলিয়ায়ে কেরামের পূণ্যভূমি— কুলগাঁও ফকিরপাড়ায় তাঁকে দাফন করা হয়। প্রতি বৎসর মহান ৭ মাঘ তাঁর খোশরোজ শরীফ এবং ৪ কার্তিক তাঁর বার্ষিক ওরশ শরীফ খলিল ভান্ডার দরবার শরীফে শরীয়ত সম্মত পদ্ধতিতে উদযাপিত হয়। দরবারের সার্বিক পরিচালনায় রয়েছেন—সৈয়দ মুহাম্মদ মনছুর আহমদ, সৈয়দ মুহাম্মদ দিদারুল আলম, সৈয়দ নুরুল ইসলাম ফরহাদ, সৈয়দ শহিদুল ইসলাম ফয়সাল, সৈয়দ আমিনুল ইসলাম আরাফাত। বর্তমানে তাঁর আলিশান গম্বুজ বিশিষ্ট মাযার শরীফ সর্বসাধারণের অন্তরকে আকর্ষণ করে, যেখানে অহরহ চলছে ফাতেহাখানি ও দরুদ সালাম। আল্লাহ পাক এ মহান অলীর নেক নজর ও রুহানী ফুজাত আমাদের দান করুন। আমিন বিহুরমাতি সৈয়্যদিল মুরসালিন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
--
اَلسَّلامُ عَلَیۡکُمْ وَرَحۡمَۃُ وَبَرَکَاتُہٗ
Abdullah Al M@sum
কোন মন্তব্য নেই