জুমার খুতবা -১৬৩: মাযহাব মানা আবশ্যক কিনা

ইমাম গায্যালি বলেন- التقليد هو قبول قول بلا حجة তাক্বলীদ হলো কোন দলিল-প্রমাণের প্রতি দৃষ্টিপাত না করে, কোন গবেষকের উক্তি বা কৃত কর্ম শুনে তাঁর অনুসরণ করা।’ আর কুরআন-হাদিস থেকে নির্গত মাসাইলের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট ইমাম কর্তৃক প্রদত্ত নীতিমালায় চলার পথ হল ‘মাযহাব’। শরিয়তের মাসাইল হচ্ছে তিন রকমের। যথা- প্রথমত, আক্বাইদ সংক্রান্ত মাসাইল। এ সকল মাসআলায় তাক্বলিদ বা অনুসরণ জায়িয নেই। দ্বিতীয়ত, ঐ সমস্ত বিধি-বিধান যেগুলো কোন গবেষণা ছাড়াই কুরআন-হাদিস থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত। যেমন, ৫ ওয়াক্ত নামায ফরয। এসকল বিধি-বিধানের ক্ষেত্রেও তাক্বলিদ নিষেধ। এ দুই প্রকারের মাসআলায় কোন ইমামের বক্তব্যকে দলিল হিসেবে পেশ করাই যথেষ্ঠ নয়। বরং কুরআন-হাদিস থেকে সরাসরি দলিল উপস্থাপন করতে হবে। তৃতীয়ত, ঐ সমস্ত আহকাম- যেগুলো কুরআন-হাদিস থেকে গবেষণা করে বের করা হয়েছে। যেমন, ইমামের পেছনে ক্বিরাত পড়ার বিধান। কেননা এ বিষয়ে কয়েক রকমের বর্ণনা-ই হাদিস শরিফে পাওয়া যায়। এ সকল মাসআলার ক্ষেত্রে মাযহাব মানা তথা তাক্বলিদ করা ওয়াজিব। অন্যথায় ধর্মে ফিতনা এত ব্যাপক হবে যে, প্রত্যেকেই নিজ নিজ মতানুযায়ী একেক রকম ব্যাখ্যা উপস্থাপন করতে শুরু করে দিবে। শরীয়তের বিধি-বিধান বর্তায় এমন দিক থেকে মুসলমান ২ প্রকার। (ক) মুজতাহিদ, (খ) গাইরে মুজতাহিদ। মুজতাহিদ বলা হয় ঐ ব্যক্তিকে যিনি, কোরআন-হাদিসের ইশারা বুঝতে পারেন, নাসেখ-মানসুখ সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞাত, যিনি নাহু-সরফ সহ আরবি কাওয়ায়েদে দক্ষ। গাইরে মুজতাহিদ যিনি উপরোক্ত বিষয়ে পূর্ণ জ্ঞান রাখেন না। সকল গাইরে মুজতাহিদের উপর মাযহাব মান্য করা ওয়াজিব। (তাফসীরাতে আহমাদীয়া)। মূলত ইজতিহাদ করা সকলের পক্ষে সম্ভব নয়,তাই আল্লাহ সকলের উপর ইজতিহদের মত কষ্টের কাজ আরোপ করবেন না। ইরশাদ হচ্ছে لَا يُكَلِّفُ اللَّهُ نَفْسًا إِلَّا وُسْعَهَا- অর্থাৎ “আল্লাহ কোন আত্মার উপর বোঝা অর্পণ করেন না; কিন্তু তার সাধ্য পরিমাণ।”(সূরা বাকারা, আয়াত: ২৮৬) তাই যাদের ইজতিহাদ করার সামর্থ্য নেই তারা তাকলীদ করবে। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, يَوْمَ نَدْعُو كُلَّ أُنَاسٍ بِإِمَامِهِمْ- অর্থাৎ “যে দিন আল্লাহ প্রত্যেক মানব দলকে তাদের তার ইমামের সাথে ডাকবো।”( সূরা বনী ইসরাইল,আয়াত:৭১)। উপর্যুক্ত আয়াতের তাফসীরে বলা হয়েছে, ইমাম হচ্ছেন দ্বীনি পেশোয়া। সুতরাং কেয়ামতের দিন বলা হবে, হে হানাফী, হে শাফেয়ী… এর অনুসারীরা (তাফসীরে রুহুল বয়ান,সূরা বনী ইসরাইল,আয়াত:৭১) এ প্রসঙ্গে হযরত হুযায়ফা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বলে, রাসূলুল্লাহ ইরশাদ করেন, জানি না আর কত দিন আমি তোমাদের মাঝে বেচে থাকবো, তোমরা আমার পরে হযরত আবু বকর, ও হযরত ওমর এ দু’জনকে অনুসরণ করবে। ( জামে তিরমিজী, সুনানে ইবনে মাজাহ)অন্যত্র তিনি ইরশাদ করেন, তোমরা (আমার কর্মপদ্ধতি প্রত্যক্ষ করার মাধ্যমে) আমাকে অনুসরণ করে যাও আর তোমাদের পরবর্তীরা তোমাদেরকে অনুসরণ করে যাবে। (সহিহ বুখারী, সহিহ মুসলিম) সাহাবী ও তাবেয়ীগণের যুগে ‘‘মুক্ত তাকলীদ’’ ও ‘‘ব্যক্তি তাকলীদ’’ উভয়েরই প্রচলন ছিল। তবে পরবর্তীতে পরিবর্তিত পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে উম্মাতের শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞ আলেম ও ফকীহগণ সর্বসম্মতভাবে মুক্ত তাকলীদের পরিবর্তে ব্যক্তি তাকলীদের পক্ষে রায় দিয়েছেন। কেননা, তাঁরা ‘প্রবৃত্তির দাসত্ব’’ নামে এক ভয়ংকর ব্যাধি সর্বসাধারণদের মাঝে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। যে প্রবৃত্তির দাসত্বকে চরিতার্থ করার জন্য শরীয়তকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে তারা সামান্যতম কুণ্ঠিত হলো না, সুবিধাভোগী ব্যক্তিরা নিজেদের ঘৃণ্য চাহিদা পূরণে মুক্ত তাকলীদের নামে হালালকে হারাম এবং হারামকে হালাল প্রমাণ করার অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। এ দিকে ইঙ্গিত করে মহান আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, , اَفَرَاَيْتَ مَنِ اتَّخَذَ اِلـهَه هَوَاهُ- অর্থাৎ “তোমরা কি তাকে দেখেছো? যে তার নাফসকে তার মাবুদ হিসেবে গ্রহণ করেছে”। (সূরা ফুরক্বান,আয়াত:৪৩) সুতরাং ব্যক্তি তাকলীদের অপরিহার্যতার ধারাবাহিকতায় আজ পৃথিবী জুড়ে সমাদৃত হানাফী, শাফেয়ী, মালেকী, হাম্বলী এই চারটি বরহক্ব মাযহাব বিদ্যমান আছে। মাযহাবগুলোর রূপকার হলেন যথাক্রমে ইমাম আযম আবু হানীফা নু’মান বিন ছাবিত (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) ইমাম দারুল হিজরাহ্ হযরত মালেক বিন আনাস (রাহমাতুল্লহি আলাইহি) ইমাম মুহাম্মদ বিন ইদ্রিছ আশ্শাফেয়ী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) ও ইমাম আহমদ বিন হাম্বল (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)। ইমামুল হারামাইন, আল্লামা শামী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) সহ বিজ্ঞজনদের অভিমত হলো বর্তমানে সাহাবা, তাবেয়ীগণসহ এমন কোন ইমাম বা মুজতাহিদের তাকলীদ বৈধ নয় যাদের মাযহাব ও ফতোয়া পূর্ণাঙ্গ ও সুবিন্যস্তাকারে আমাদের কাছে নেই। বিশ্লেষণের নিরিখে আমরা বলতে পারি একমাত্র চার ইমামের মাযহাব ও ফতোয়া সুবিন্যস্ত গ্রন্থাবদ্ধ। সুতরাং অনিবার্য কারণবশতঃ উক্ত চার ইমাম ছাড়া অন্য কারো তাক্বলীদ সম্ভব নয়। এ প্রসঙ্গে আল্লামা ইমাম ইবনে হাজার মক্কী বলেন, আমাদের যুগের বিশেষজ্ঞদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আবু হানীফা, শাফেয়ী, মালেক, আহমদ বিন হাম্বল- এ চার ইমাম ব্যতিত অন্য কারও তাকলীদ জায়েয হবে না। (ফাত্হুম মুবীন, পৃ: ১৯৬)। হযরত শাহ্ ওয়ালীউল্লাহ মোহাদ্দেছ দেহলভী বলেন, আমি হারামাইন শরীফাইনে অবস্থান কালে ৩টি জিনিস নবীজী থেকে এলহামের মাধ্যমে জানতে পারলাম। এর মধ্যে ২য় টি হলো আমি যেন মুসলমানদের ওসীহত করে যাই যে, তোমরা ৪ মাযহাবের মধ্য থেকে যেকোন একটিতে অন্তর্ভুক্ত হয়। কেউ এর থেকে খালি হয়ো না(ফুয়ুজুল হারামাঈন, পৃষ্ঠা: ৬৫)। আর তাই যুগ যুগ ধরে মুসলিম উম্মাহ্ মাযহাবের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে মাযহাব মেনে আসছেন। মুফাসসির, মুহাদ্দিস, ফক্বিহ ও আল্লাহর ওলিগণের মধ্যে এমন কেউ নেই, যিনি মাযহাবেরর অমান্যকারী। যেমন- ইমাম কাসতালানি ও ইমাম তাজুদ্দিন সুবকি সুস্পষ্টভাবে এবং ইমাম নববি ইঙ্গিতে বলেছেন যে- ইমাম বুখারি, তিরমিযি, আবু দাউদ, নাসাই, দারু কুতনি প্রমুখ মুহাদ্দিস কিরামগণ শাফেয়ি ছিলেন। ইমাম তাহাবি, যায়লায়ি, বুখারি শরিফের ব্যাখ্যাকার আল্লামা আইনি, তিব্বি, মোল্লা আলি ক্বারি, আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভি প্রমুখ মুহাদ্দিসগণ হানাফি ছিলেন। তাফসিরে কাবির, তাফসিরে খাযিন, বায়হাক্বি, জালালাইন, তানভিরুল মিক্ববাস ইত্যাদি গ্রন্থকার মুফাস্সিরগণ শাফেয়ি ছিলেন। তাফসিরে মাদারিক, তাফসিরে সাভির প্রণেতা ও অন্যান্য মুফাস্সিরগণ হানাফি ছিলেন। এমনিভাবে ফুকাহা ও আওলিয়া কিরাম সকলেই কোন-না-কোন মাযহাবের অনুসারী ছিলেন এবং আওলিয়া কিরামের অধিকাংশই হানাফি মাযহাবের অনুসারী ছিলেন। মাযহাব কোন নতুন বিষয় নয়, বরং মাযহাবকে অস্বীকার করাই নতুন বিষয় এবং মাযহাব অস্বীকারকারীরাই নব আবিস্কৃত। একটি হাদিস শরিফের উদ্ধৃতি না দিয়ে পারছি না। ইমাম মুসলিম তার ‘আস্-সহিহ্’ গ্রন্থে রিওয়াআত করেছেন, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন-‘শেষ যমানায় ধোঁকাবাজ ও মিথ্যাবাদীদের এমন একটি দল হবে, যারা এমন-এমন কথা তোমাদেরকে উপস্থাপনা করবে, যা না তোমরা শুনেছ, আর না তোমাদের পিতৃপুরুষদের কেউ। তাদের থেকে তোমরা দূরে থাক এবং তাদেরকে তোমাদের থেকে দূরে রাখ। যেন তারা তোমাদেরকে পথভ্রষ্ট করতে না পারে এবং তোমাদেরকে ফিতনায় ফেলতে না পারে।’ (সহিহ মুসলিম) এ হাদিস শরিফ খানাকে মানদন্ড করে বর্তমান মাযহাব অস্বীকারকারীদেরকে একটু সামনে আনুন, আর দেখুন অদৃশ্যের সংবাদদাতা নবীপাকের ভবিষ্যদ্বাণীর বাস্তবতা। এখন যদি কোন লা-মাযহাবি বা সালাফি বলে যে, আমাদের ইজতিহাদ প্রয়োগের ক্ষমতা আছে, সেহেতু আমরা মাযহাব মানি না। তাদের এ উক্তির জন্য দীর্ঘ আলোচনার প্রয়োজন নেই। ইজতিহাদের জন্য কতটুকু জ্ঞান দরকার, আর তারা কতটুকু জ্ঞানের অধিকারী সে প্রসঙ্গে আলোচনা হলো- ‘হযরত ইমাম রাযি, ইমাম গায্যালি, ইমাম তিরমিযি, ইমাম আবু দাউদ, গাউছে পাক, বায়যিদ বুস্তামি, শাহ্ বাহাউল হক্ব নক্বশবন্দি প্রমুখ ইসলামে এত উন্নত মর্যাদার অধিকারী ও মাশায়িখ ছিলেন যে, তাঁদের নিয়ে মুসলমানগণ যতই গর্ববোধ করুন-না-কেন তা তাঁদের জ্ঞান গরিমা ও প্রজ্ঞার তুলনায় নেয়াহত কিঞ্চিতকর রূপেই প্রতিভাত হবে। অথচ উনাদের মধ্যে কেউ মুজতাহিদরূপে স্বীকৃতি পান নি। বরং তাঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন মুক্বাল্লিদ তথা কোন-না-কোন মাযহাবের অনুসারী। বর্তমান জমানায় তাঁদের সমপরিমাণ মর্যাদা ও যোগ্যতার অধিকারী কেউ কি আছেন? যখন তাঁদের জ্ঞান মুজতাহিদ এর স্তরে উপনীত হওয়ার জন্য যথেষ্ঠ নয়, তখন যারা বিভিন্ন হাদিস গ্রন্থের নামগুলো পর্যন্ত ঠিকমত বলতে পারে না, তারা কোন পর্যায়ে পড়বেন!!’  উপর্যুক্ত আলোচনা হতে মাযহাব গ্রহণের আবশ্যকতা স্পষ্ট হয়ে গেছে। আল্লাহ তাআলা সকলকে আমল করার তাওফিক দান করুন,আমিন বিজাহিন নবিয়িল আমিন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।