মকামে ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু
মুহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মাসুম
ইস দোগানা পর ফিদা সারি নামাযেঁ জিস মে,
ধারে হুলকুম পে সর খম হো ইবাদত কে লিয়ে।
নবী বংশের অনন্য উজ্জ্বল নক্ষত্র এবং বিলায়তের এক নির্যাসের নাম ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু। যিনি ছিলেন বহু সদগুণের আধার। একাধারে সাহাবীয়ে রাসূল, মুহাদ্দিছে যমান, আহলে বায়তে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অন্যতম সদস্য। এছাড়াও খোদাভীতি, ইবাদত-বন্দেগী, দানশীলতা, পরোপকারীতা ও উত্তম চরিত্রে তিনি ছিলেন কিংবদন্তি মহামানব।
জন্ম কাল: চতুর্থ হিজরির শা'বান মাসের ৪র্থ দিবস মঙ্গলবার শুভক্ষণে (৮ জানুয়ারি ৬২৬খ্রি:) কুরাইশ রাজবংশের বনু হাশেম গোত্রে মাওলা আলী শেরে খোদা ও ফাতেমা বিনতে রাসূল রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমার ঔরশে ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু জন্মগ্রহণ করেন। তিনি জন্ম গ্রহণের পর তাঁর পিতা মহব্বত করে তাঁর নাম রাখেন হারব। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর জন্মের শুভ সংবাদে শুনে খুবই আনন্দিত হয়ে তাঁকে দেখতে এসে জিজ্ঞেস করলেন নাম কী? হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, তাঁর নাম হারব। তখন নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তাঁর নাম হারব নয় ; বরং হুসাইন। উপনাম হলো আবু আব্দুল্লাহ। তাঁর একাধিক উপাধি রয়েছে। যেমন ১.সিবতুর রাসূল ২. শহীদ ৩.যকি ৪.সৈয়্যিদুশ শোহাদা ৫. রাশিদ ৬.তাইয়িব ৭.অসি ৮. তক্বি ৯. মুজাহিদ ইত্যাদি। রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর তাহনিক করালেন ও তাঁর কানে আযান দিয়েছেন এবং জন্মের সপ্তম দিনে স্বয়ং নিজে একটি মতান্তরে দু’টি মেষ জবেহ করে তাঁর আকীকা দিয়েছেন। এরপর তিনি হযরত ইমাম হাসান রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর বেলায় যেমন নির্দেশ দিয়েছিলেন তেমনি হযরত ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর মাথার চুল কামিয়ে তাঁর ওজনের সমপরিমাণ রৌপ্য গরীবদের মধ্যে বিতরণ করে দেয়ার জন্য নির্দেশ দেন।
অবয়ব: হযরত ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর এর চেহারা ছিল খুবই আকর্ষণীয় ও সুন্দর। তিনি যখন কোন অন্ধকারে বসতেন তখন সেখানকার অন্ধকার আলোকিত হয়ে যেতো। তাঁর বক্ষ থেকে পা পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে মিল ছিলো। এ প্রসঙ্গে হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন-
الحُسَيْنُ أَشبَهُ بِرَسُوْلِ اللهِ –صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مِنْ صَدْرِهِ إِلَى قَدَمَيْهِ
অর্থাৎ তাঁর বক্ষ থেকে পা পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ আলাহিস সালামের সাথে মিল ছিলো।
শিক্ষা জীবন: তিনি দরবারে রিসালত ও বেলায়তের কেন্দ্রস্থলে লালিত পালিত হয়ে একজন যুগশ্রেষ্ঠ আলেমে দ্বীন এবং মুহাদ্দিসে রূপান্তরিত হন। তাঁর যুগের লোেেকরা তাঁর নিকট থেকে ফতোয়া গ্রহণ করতেন। তিনি অত্যন্ত সাবলিল ভাষায় নজির বিহিন বক্তব্য রাখতেন। তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে ১২৯ টি হাদিস বর্ণনা করেছেন। তিনি স্বীয় পিতা হযরত আলী,স্বীয় মাতা হযরত ফাতিমা,হযরত উমর ,হযরত হিন্দা রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম প্রমুখের নিকট থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন। তাঁর থেকেও অসংখ্য বর্ণনাকারী হাদিস বর্ণনা করেছেন। যেমন- হযরত বিশর বিন গালিব আসদি, হযরত ছুয়াইর বিন আবি ফাখতাহ,স্বীয় ভাই হযরত হাসান,স্বীয় ভাইপো হযরত যায়েদ বিন হাসান,সাঈদ বিন খালিদ, সিনান বিন আবি সিনান, ত্বালহা বিন উবাইদুল্লাহ, হযরত আমির আশ-শাবি, হযরত আব্দুল্লাহ বিন আমর, হযরত উবাইদ বিন হুনাইন, হযরত ইশরামাহ, স্বীয় সন্তান ইমাম যয়নুল আবেদিন, পৌত্র ইমাম বাক্বির, হযরত হুমাম বিন গালিব ফারাযদাক্ব, হযরত ইউসূফ বিন মাইমূন,স্বীয় কন্যা হযরত সকিনা ও ফাতিমা রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
গুণাবলী : ইমামে আলী মকাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বহুগুণে গুণান্বিত ছিলেন। যেমন-১.আল্লাহর রাস্তায় দান ও সদকা : ইবনে আছাকির বর্ণনা করেছেন, তিনি অত্যন্ত দানশীল ছিলেন। যখনই তাঁর নিকট কোন ফকির আসত, তখন তাঁর নিকট যা থাকত, তা দিয়ে দিতেন। যেমন একদা এক ফকির তাঁর দরবারে এসে আরজ করলেন,হুযূর! আমি অত্যন্ত গরিব আর আমার পরিবার অনেক বড়। আমার কিছু টাকার প্রয়োজন। ইমামে আলী মকাম এ কথা শুনে তাকে বললেন, তুমি বস। কিছুক্ষণ পর জনৈক ব্যক্তি পাঁচ থলে দিনার নিয়ে তাঁর দরবারে উপস্থিত হলো। ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু পাঁচ থলে দিনার ঐ ফকিরকে দিয়ে দিলেন এবং নিজের জন্য কিছুই রাখেননি।
২.গরীব ও মিসকীনদের প্রতি ভালবাসা: ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর নিকট তাঁর সহধর্মিনী আরজ করলেন, “আমি আপনার জন্য সুস্বাদু খাবার এবং সুগন্ধি প্রস্তুত করেছি, আপনি আপনার সমপর্যায়ের কাউকে দেখুন এবং তাদেরকে সাথে নিয়ে আমার নিকট তাশরীফ নিয়ে আসুন।” ইমামে হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু মসজিদে তাশরীফ গমন করলেন এবং সেখানে যত মিসকিন ছিলো তাদেরকে নিয়ে ঘরে চলে এলেন। প্রতিবেশি মহিলারা তাঁর স্ত্রীর নিকট এসে বলতে লাগলো, আল্লাহর শপথ! আপনার ঘরে তো মিসকিন জমা হয়ে গেছে। অতঃপর ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু নিজের স্ত্রীর নিকট গেলেন এবং বললেন: আমি তোমাকে আমার ঐ হকের শপথ দিচ্ছি, যা আমার প্রতি তোমার রয়েছে যে, তুমি খাবার ও সুগন্ধি বাঁচিয়ে রাখবে না। অতঃপর তিনি এমনই করলেন। তিনি মিসকিনদের খাবার খাওয়ালেন, তাদেরকে পোশাক পরিধান করালেন এবং সুগন্ধি লাগালেন।
ইবাদত ও রিয়াজত: ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বেশি ইবাদত-বন্দেগী করতেন। তিনি সারা দিন এবং সারারাত ইবাদতে লিপ্ত থাকতেন। তিনি সর্বদা তাহাজ্জুদ নামায আদায় করতেন এবং কুরআন তেলাওয়াত করতেন আর আল্লাহর স্মরণে সদা মশগুল থাকতেন। এমনকি তিনি শাহাদাত বরণের আগ মুহুর্ত পর্যন্ত কোন নফল নামাযও ত্যাগ করেননি। তিনি অন্তিম মুহুর্তেও দুই রাকাত নামায আদায় করেছেন। এ প্রসঙ্গে আল্লামা ইবনুল আছির বলেন-
وكان الحسين رضي اللَّه عنه فاضلًا كثير الصوم، والصلاة، والحج، والصدقة، وأفعال الخير جميعها
অর্থাৎ হযরত ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ছিলেন একাধারে মর্যাদাবান,অত্যাধিক রোযাদার,নামায আদায়কারী, হজ্জ্ব পালনকারী, সদকা প্রদানকারী এবং সকল সৎকর্মকারী। তিনি পদব্র্রজে পঁচিশ বার হজ্জ্ব করেছেন। এ প্রসঙ্গে হযরত আব্দুল্লাহ বিন উবাইদ বলেন-
حجّ الحسين بن علي رضي الله عنه خمساً وعشرين حجَّةً ماشيا
অর্থাৎ তিনি পদব্রজে পঁচিশবার হজ্জ্ব পালন করেছেন।
শাহজাদায়ে ইমামে আলী মকাম ইমাম যয়নুল আবেদীন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন: আমার আব্বাজান ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু দিনে ও রাতে এক হাজার রাকাত নফল নামায আদায় করতেন।
এমনকি আশুরার রাতে (নয় মুহাররমের দিবাগত রাতে) ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তাঁর প্রিয় ভাই হযরত সৈয়্যিদুনা আব্বাস আলমদারকে বললেন: যেকোন ভাবে এই লড়াই আগামীকাল পর্যন্ত বিলম্বিত করুন এবং যেনো আজ রাতটি আমরা আল্লাহ পাকের ইবাদতের জন্য পেয়ে যাই, আল্লাহ তায়ালা ভালভাবেই জানেন যে, আমি নামায, কুরআন তিলাওয়াত এবং অধিকহারে দোয়া করা ও ইস্তিগফার করা অনেক পছন্দ করি।
দাম্পত্য জীবন: তাঁর দাম্পত্য জীবন খুবই সুন্দর ছিলো। তাঁর কতিপয় স্ত্রী ছিলো। তাঁরা হলেন-শহরবানু, রুবাব বিনতে ইমরুল কায়েস,লায়লা বিনতে আবী মুররাহ আল-সাকাফী, উম্মে ইসহাক বিনতে তালহা ইবনে উবায়দুল্লাহ। তাঁর চার মতান্তরে ছয় ছেলে ও পাঁচ মেয়ে ছিলো। ছেলে সন্তানরা হলেন-১.ইমাম জয়নুল আবেদিন ২.হযরত আলী আকবর ৩.হযরত আলী আসগর ৪. হযরত মুহাম্মদ ৫. হযরত জাফর এবং ৬. আবদুল্লাহ রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম। মেয়ে সন্তানরা হলেন-১. হযরত সকিনা বিনতে রুবাব ২.ফাতেমা ৩. যয়নব ৪. হযরত রুকাইয়া ৫. হযরত খাওলা রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুন্না।
সাহসিকতা ও সংগ্রাম: হযরত ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ছিলেন অত্যন্ত সাহসী, দৃঢ় মনোবলের অধিকারী, অকুতোভয় সৈনিক। জিহাদের ডাকে প্রয়োজনের মুহূর্তে সাড়া দিতে কখনো পিছপা হতেন না তিনি। তাঁকে একবার হযরত মুয়াবিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর নিকট দূত হিসেবে পাঠানো হয়েছিল। তিনি সামরিক বাহিনীর সাথে কনস্টান্টিনোপলে (ইস্তাম্বুল অভিযানের) যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এতে হযরত হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর মহত্ত¡ই প্রকাশ পায়। যখনই আল্লাহর পথে যুদ্ধের আহবান এসেছে তখনই তিনি তাতে সাড়া দিয়েছেন, শুধুমাত্র আল্লাহর ধর্মের মর্যাদা রক্ষার জন্যই তিনি তা করেছিলেন।
৬০ হিজরীতে ইয়াজিদ ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তার হাতে বায়াত গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানান। কারণ ইয়াজিদ ছিল দুশ্চরিত্রের, বেনামাজি ও মদ্যপায়ী। বস্তুত হযরত ইমাম হাসান ও হজরত মুয়াবিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমার ইন্তেকালের পর খিলাফতের ন্যায়সংগত দাবিদার ছিলেন হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু। নীতিজ্ঞানহীন ইন্দ্রিয়পরায়ণ ইয়াজিদের কাছে জীবনের বিনিময়েও তাঁর মস্তক অবনত করতে রাজি ছিলেন না। তিনি বিশ্বাস করতেন পাপীষ্ট ইয়াজিদের বায়াত গ্রহণ করলে ইসলামের গুরুত্ব ক্ষুন্ন হবে। তাঁর দেখাদেখি অন্যান্য অনুসারীও ইয়াজিদের কাছ থেকে বায়াত নেবেন। তাই তিনি অবৈধভাবে ক্ষমতায় আসীন ইয়াজিদের বায়াত না নিয়ে বাতিলের সামনে মাথানত না করার অসীম সাহসিকতা দেখিয়েছেন। ঘটনা প্রবাহের সে সময় কুফাবাসী ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে চিঠির মাধ্যমে সেখানে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানায়। ইয়াজিদ শাসনের মোকাবিলায় তার হাতে বায়াতের অঙ্গীকার করে ১৫০ মতান্তরে ১২০০ চিঠি ইমাম আলী মকামের কাছে প্রেরণ করা হয়। তারা তাঁকে খিলাফতের অধিক যোগ্য, তাঁর জন্য জানমাল কোরবানির জন্য প্রস্তুত এবং আহলে বায়াতের অনুরক্ত এমন পয়গাম পাঠায়। তাদের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য তিনি আপন চাচাতো ভাই মুসলিম বিন আকিলকে কুফায় পাঠান। কুফার গভর্নর নুমান বিন বশিরসহ ৪০ হাজার মানুষ ইমাম মুসলিমের হাতে হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর নামে বায়াত গ্রহণ করেন। পরিস্থিতি তাঁর অনুকূলে এমন বর্ণনা দিয়ে একজন পত্রবাহককে চিঠি দিয়ে তাঁকে কুফায় আসতে অনুরোধ করা হয়। কুফাবাসীর অস্থির চিত্তের জন্য আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু সহ অনেকের বাধা সত্তে¦ও ৬০ হিজরির ৮ জিলহজ পরিবার-পরিজন, বন্ধু-বান্ধব ও প্রিয়জনদের সঙ্গে নিয়ে তিনি মক্কা মুকার্রমা থেকে কুফার উদ্দেশে রওনা দেন। পথিমধ্যে তাঁর চাচাতো ভাই আবদুল্লাহ বিন জাফর রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু সাক্ষাৎ করে মদিনার গভর্নর কর্তৃক প্রদত্ত নিরাপত্তা সনদের ভিত্তিতে মদিনায় ফিরে যাওয়ার অনুরোধ করলে তিনি বলেন, আমি স্বপ্নে নানাজির সাক্ষাৎ পেয়েছি। তিনি আমাকে একটি কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন। ফলাফল যাই হোক না কেন, আমি অবশ্যই তা করব আর কাজটি কী, সে সম্পর্কে মৃত্যুর আগে আমি কাউকে কিছু বলতে পারি না। ‘যি জাশাম’ নামক স্থানে উবায়দুল্লাহ ইবনে যিয়াদের পক্ষ থেকে হুর ইবনে ইয়াজিদ ইমামের পথ রোধ করে এবং ইমাম কাফেলার সামনে ছাউনি ফেলে। হুর ইবনে ইয়াজিদ তাঁকে তাদের সঙ্গে যেতে বাধ্য করে। তিনি তাদের সঙ্গে চললেন। ৬১ হিজরির ৯ মহররম বৃহস্পতিবার দিন ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তাঁর সঙ্গী-সাথীসহ কারবালা প্রান্তরে শিবির স্থাপন করেন। কারবালায় অবস্থানরত দ্বিতীয় দিনে আমর ইবনে সা’দ চার হাজার সৈন্য নিয়ে ইবনে যিয়াদের পক্ষ থেকে কারবালায় পৌঁছে। ইয়াজিদ বাহনীর পক্ষ থেকে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে পড়ে। ১০ মহররম তিনি পরিবার-পরিজন ও সাথীবর্গ নিয়ে জালিমদের বিরুদ্ধে জিহাদে অবতীর্ণ হন এবং একে একে তিনি সহ ৭২ জনের সবাই বীরত্বের সাথে শাহাদাতের সুধা পান করেন। পরিবারের নারী ও শিশুসহ বাকি ১২৮ জন সদস্য বন্দী হন। ১০ মহররম কারবালার ময়দানে তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথানত না করে যে অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন যা ইমানদারদের জন্য অনুসরণীয়।
ইমামের প্রতি মহব্বত : হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বর্ণনা করেন, রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
هَذَانِ ابْنَايَ، فَمَنْ أَحَبَّهُمَا فَقَدْ أَحَبَّنِي، وَمَنْ أَبْغَضَهُمَا فَقَدْ أَبْغَضَنِي
অর্থাৎ এরা দুজন আামার সন্তান। যে ব্যক্তি এ দুজনকে ভালবাসল সে যেন আমাকে ভালবাসল আর যে ব্যক্তি এ দুজনের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করল সে যেন আমার প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করল”।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো ইরশাদ করেছেন-
حسين مني وأنا من حسين أحب الله من أحب حسينًا
অর্থাৎ ইমাম হুসাইন আমার থেকে আর আমি ইমাম হুসাইন থেকে। আল্লাহ তাকে ভালোবাসেন যে ইমাম হুসাইনকে ভালোবাসে।”
হযরত বুরাইদা রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন-
كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَخْطُبُنَا إِذْ جَاءَ الْحَسَنُ وَالْحُسَيْنُ عَلَيْهِمَا قَمِيصَانِ أَحْمَرَانِ يَمْشِيَانِ وَيَعْثُرَانِ فَنَزَلَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَنْ الْمِنْبَرِ فَحَمَلَهُمَا وَوَضَعَهُمَا بَيْنَ يَدَيْهِ ثُمَّ قَالَ: ্রصَدَقَ اللَّهُ [إِنَّمَا أَمْوَالُكُمْ وَأَوْلَادُكُمْ فِتْنَةٌ] نَظَرْتُ إِلَى هَذَيْنِ الصَّبِيَّيْنِ يَمْشِيَانِ وَيَعْثُرَانِ فَلَمْ أَصْبِرْ حَتَّى قَطَعْتُ حَدِيثِي وَرَفَعْتُهُمَا
অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে খুতবা দিচ্ছিলেন। ইতিমধ্যে ইমাম হাসান ও হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমা লাল জামা পরিধান করে হেঁটে মসজিদের দিকে আসছিলেন এবং তাঁরা দুজন পরে যাবার উপক্রম হলো। তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিম্বর থেকে নেমে তাঁদেরকে বহন করে নিয়ে এসে তাঁর সামনে বসালেন। অতঃপর ইরশাদ করেছেন- আল্লাহ তায়ালা সত্য বলেছেন যে, তোমাদের সন্তান ও সম্পদ পরীক্ষা সরূপ। এরপর তিনি ইরশাদ করেছেন-আমি এ দুই শিশুকে হেঁটে আসতে দেখলাম যে,তারা মাটিতে পরে যাচ্ছিল। এ অবস্থা দেখে আমি আর ধৈর্য ধরতে পারিনি এমনকি আমি আমার খুতবা ত্যাগ করে তাদেরকে তুলে নিয়ে আসলাম।” এ হাদিস থেকে বোঝা যায় যে,রাসূলুল্লাহর নিকট ইমাম হাসান ও হুসাইন কত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি তাঁরা মাটিতে পরে যাবার সম্ভাবনা দেখে খুতবা বন্ধ করে তাঁদেরকে তুলে নিয়ে আসলেন।
জনৈক গ্রাম্য ব্যক্তি মানত করল যে,একটি হরিণের বাচ্চা রাসূলুল্লাহর দরবারে নিয়ে আসবে। সে তার মানত অনুযায়ী একটি হরিণের বাচ্চা হুযূরের দরবারে নিয়ে আসলেন। রাসূলুল্লাহ এ বাচ্চাটিকে ইমাম হাসান রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে দিয়ে দিলেন। এটা দেখে ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হরিণের বাচ্চা নেয়ার জন্যে নানার নিকট দৌঁড়ে আসলেন। নানার নিকট এসে হরিণের বাচ্চা চাইতে লাগলেন। রাসূলুল্লাহ তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করলে তিনি কোন রকম বোঝতে নারাজ বরং হরিণের বাচ্চা চাই। ইতিমধ্যে একটি হরিণ তার বাচ্চা নিয়ে এসে রাসূলের দরবারে উপস্থিত। হরিণটি আরজ করল, হুযূর! আমার একটি বাচ্চা জনৈক গ্রাম্য ব্যক্তি ধরে এনে আপনার দরবারে উপস্থিত করেছে। এ বাচ্চাকেও আমি আল্লাহর হুকুমে ইমাম হুসাইনের জন্যে দিয়ে দিচ্ছি। এ ঘটনা থেকে বোঝা যায় যে, বনের প্রাণীও ইমাম হোসাইনের সন্তুটি চায়।
মর্যাদা: আহলে বায়তের মর্যাদা পবিত্র কুরআন-হাদিস দ্বারা স্বীকৃত। ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু আহলে বায়তের অন্যতম একজন। তাঁরা পবিত্রতার গুণে গুনান্বিত। তাঁদের পবিত্রতার ঘোষণা স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনুল করিমে দিয়েছেন। ইরশাদ হচ্ছে-
إِنَّمَا يُرِيدُ اللَّهُ لِيُذْهِبَ عَنْكُمُ الرِّجْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ وَيُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيرًا
অর্থাৎ ‘হে নবি-পরিবার! আল্লাহ তো চান তোমাদের অপবিত্রতা দূর করতে আর তোমাদেরকে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করতে।’ হযরত আবূ সাঈদ খুদরি রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-‘এ আয়াতে মুবারকা পাঁচজন ব্যক্তি সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে। তাঁরা হলেন-আমি, হযরত আলী, হযরত ফাতিমা, ইমাম হাসান এবং ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম।
হযরত উম্মে সালমাহ্ রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা বলেন, হুযূর পুরনূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর শয়নের স্থানে খায়বারি চাদর গায়ে দিয়ে আরাম করছেন। অত:পর হযরত ফাতিমা রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্যে বিশেষ খাবার-ভর্তি একটি পাত্র নিয়ে আসলেন। এটি দেখে রাসূলে আরবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করলেন, হে ফাতিমা! তুমি তোমার স্বামী এবং সন্তানদ্বয় হাসান- হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমকে ডেকে নিয়ে আসো। তিনি তাঁদেরকে ডেকে আনলেন আর তাঁরা খাবার গ্রহণ করছেন। এমতাবস্থায় আল্লাহ তায়ালা উপরোক্ত আয়াত শরিফ অবতীর্ণ করেন। এ বরকতময় আয়াত অবতীর্ণ হবার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আলী, হযরত ফাতিমা, ইমাম হাসান এবং ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমকে তাঁর চাদর দ্বারা আবৃত করে ফেললেন । তারপর তিনি চাদরের ভিতর থেকে হাত মুবারক বের করে আল্লাহর দরবারে হাত তুলে ফরিয়াদ করলেন,‘হে আল্লাহ্! এরাই হলেন আমার আহলে বায়ত এবং আপন-জন । আপনি তাঁদের অপবিত্রতা (প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য পাপ) দূর করুন আর তাঁদেরকে পবিত্র করুন।’ এ দুয়া তিনি তিনবার করেছেন। এ প্রসঙ্গে ইরশাদ হচ্ছে-
إِنَّ رَبَّكَ فَعَّالٌ لِمَا يُرِيدُ
অর্থাৎ নিশ্চয় আপনার প্রতিপালক যা ইচ্ছা করেন,তা-ই করেন।’ এতে প্রমাণিত হয় যে, আহলে বায়তে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হলেন পবিত্র। আর আহলে বায়তের প্রতি ভালোবাসা উম্মতে মুহাম্মদির উপর ফরজ। মহান রাব্বুল আলামিন পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন-
قُلْ لَا أَسْأَلُكُمْ عَلَيْهِ أَجْرًا إِلَّا الْمَوَدَّةَ فِي الْقُرْبَى
অর্থাৎ হে প্রিয় হাবিব! আপনি বলে দিন, আমি দ্বীন প্রচারের বিনিময়ে তোমাদের নিকট থেকে আত্মীয়তার সৌহার্দ্য ব্যতীত অন্য কোন প্রতিদান চাই না।’ ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু আহলে বায়তের একজন উল্লেখযোগ্য সদস্য ছিলেন। সুতরাং তাঁকেও ভালোবাসা ফরজ। তাঁর মর্যাদা সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
إِنَّ الْحَسَنَ وَالْحُسَيْنَ هُمَا رَيْحَانَتَايَ مِنْ الدُّنْيَا
অর্থাৎ ‘নিশ্চয় ইমাম হাসান এবং হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা উভয়ে দুনিয়ায় আমার দুটি ফুল।’ অন্যত্র ইরশাদ করেন-
الحسن والحسين سيدا شباب أهل الجنة
অর্থাৎ ইমাম হাসান ও হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমা জান্নাতের যুবকদের সরদার।’ রাসূলে আকরম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো ইরশাদ করেন-
الْحَسَنُ وَالْحُسَيْنُ ابْنَايَ، مَنْ أَحَبَّهُمَا أَحَبَّنِي، وَمَنْ أَحَبَّنِي أَحَبَّهُ اللَّهُ، وَمَنْ أَحَبَّهُ اللَّهُ أَدْخَلَهُ الْجَنَّةَ، وَمَنْ أَبْغَضَهُمَا أَبْغَضَنِي، وَمَنْ أَبْغَضَنِي أَبْغَضَهُ اللَّهُ، وَمَنْ أَبْغَضَهُ اللَّهُ أَدْخَلَهُ النَّارَ
অর্থাৎ হযরত ইমাম হাসান ও হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমা আমার সন্তান। যে ব্যক্তি তাঁদেরকে ভালোবাসলো সে যেন আমাকে ভালোবাসলো আর যে ব্যক্তি আমাকে ভালোবাসলো সে যেন আল্লাহ তায়ালাকে ভালোবাসলো। যে আল্লাহকে ভালোবাসলো আল্লাহ তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি তাঁরা দুজনের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করল সে যেন আমার সাথে বিদ্বেষ পোষণ করলো। আর যে ব্যক্তি আমার সাথে বিদ্বেষ পোষণ করল সে যেন আল্লাহর সাথে বিদ্বেষ পোষণ করল। যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে বিদ্বেষ পোষণ করল আল্লাহ তাকে জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন।
জান্নাতি পোশাক: .ঈদের আগের দিন রাতে ইমাম হাসান ও হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমা স্বীয় মাতা হযরত ফাতেমা রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহার নিকট গিয়ে আরজ করলেন, আম্মাজান! কাল ঈদের দিন সবাই নতুন জামা পরিধান করবে। আমরা কি নতুন কাপড় পরিধান করবো না? তিনি উত্তর দিলেন, তোমাদের চিন্তার কোন কারণ নেই। তোমরাও নতুন কাপড় পেয়ে যাবে। এ কথা বলে তিনি আল্লাহর দরবারে আরজ করলেন- হে আল্লাহ! আপনার প্রিয় হাবিবের দৌহিত্র আমার নিকট নতুন জামা চাচ্ছে,আমি তাঁদেরকে নতুন জামা দেব বলে প্রতিশ্রæতি দিয়েছি। আপনার দরবারে হাত পেতেছি। আমার খালি হাত ফেরত দিবেন না। দোয়া শেষ হবার সাথে সাথে দরজায় কে এসে করাঘাত করল। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কে? উত্তর আসল,আহলে বায়তের দর্জি শাহজাদাদের জন্য নতুন কাপড় নিয়ে এসেছে। হযরত ফাতিমা রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা তার থেকে কাপড়গুলো নিলেন এবং তাঁদেরকে ঈদের দিন পরিধান করালেন। এ ঘটনা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফাতিমা রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহাকে আরজ করলেন, তুমি কি জান কাল রাতে কে কাপড় নিয়ে এসেছে। তিনি আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনিই বলুন। নবীজি ইরশাদ করেন, কাল রাতে হযরত জিবরাইল আলাইহিস সালাম আল্লাহর পক্ষ থেকে জান্নাতী কাপড় নিয়ে এসেছিলেন।
কারামাত: ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে অসংখ্য কারামত প্রকাশিত হয়েছে। তন্মধ্যে ২/৩টি তুলে ধরার প্রয়াম পেলাম- ১.ফুতরাস ফেরেস্তা হারানো পাখা ফিরে পেল: হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস বর্ণনা করেন, ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর জন্মদিনে আল্লাহ তাআলা হযরত জিবরাইল আলাইহিস সালামকে নির্দেশ দিলেন যাও! আমার হাবীব রাসূলে আরবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আমার ও তোমার পক্ষ থেকে অভিনন্দন জানাও। এই নির্দেশ পালনের উদ্দেশ্যে হযরত জিবরাইল আলাইহিস সালাম একটি দ্বীপের উপর দিয়ে গমন করছিলেন, যেখানে ছিলেন ফুতরাস নামক এক ফেরেশতা, যাঁকে আল্লাহ প্রদত্ত একটি কর্ম সম্পাদনে বিলম্বের দরুন ঐ দ্বীপে নির্বাসন দেয়া হয় এবং তাঁর পাখা খর্ব করা হয়। তিনি কয়েক বছর ধরে ঐ দ্বীপে আল্লাহর ক্ষমা প্রাপ্তির জন্য ইবাদতে রত ছিলেন। জিবরাইল আলাইহিস সালামকে দেখে ফুতরাস জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ভাই! জিবরাইল তুমি কোথায় যাচ্ছ?’ জিবরাইল আলাইহিস সালাম গন্তব্যস্থল এবং গমনের উদ্দেশ্য বর্ণনা করলে তিনি তাঁকে সফর সঙ্গী করতে অনুরোধ জানালেন, যেন তিনি নবীজিকে আল্লাহ তাআলার কাছে তাঁর অনুকূলে সুপারিশ করার অনুরোধ করতে পারেন। জিবরাইল আলাইহিস সালাম ফুতরাসকে সাথে নিলেন। তিনি দরবারে রিসালতে পৌঁছে আল্লাহ তাআলা এবং নিজের পক্ষ থেকে অভিনন্দন জানালেন। পরে ফেরেশতা ফুতরাসের কথাও জানালেন। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিবরাইল আলাইহিস সালামকে বললেন, ‘আপনি ঐ ফেরেশতাকে এই নবজাতক শিশুর শরীর স্পর্শ করে আসমানে আপন জায়গায় ফিরে যেতে বলুন।’ ফুতরাস শিশু হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর শরীর স্পর্শ করা মাত্র আল্লাহর কৃপায় তাঁর পাখা ফিরে পেলেন। অতঃপর তিনি রাসূলুল্লাহ ও তাঁর নবজাতক দৌহিত্রের প্রতি মুবারকবাদ জানিয়ে আসমানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে গেলেন।
২.কুপের পানি উপচে পড়ল: একদা সৈয়্যিদুনা ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু মদীনা মুনাওয়ারা থেকে মক্কা মুকাররামাতে যাচ্ছিলেন, পথিমধ্যে হযরত সৈয়্যিদুনা ইবনে মুতী রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর সাথে সাক্ষাৎ হলো। ইবনে মুতী তাঁকে আরয করলেন: “হুযুর! আমার কূপের পানি একেবারে কমে গেছে, দয়া করে আমার কূপের পানি বৃদ্ধির জন্য একটু দোয়া করুন। ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু কূপটির পানি নিয়ে আসার জন্য বললেন। যখন পাত্রে করে পানি নিয়ে আসা হলো, তখন তিনি মুখ লাগিয়ে তা থেকে কিছু পানি পান করলেন এবং কুলি করলেন আর পাত্রের অবশিষ্ট পানি কূপে ঢেলে দিলেন। তখন কূপের পানি যথেষ্ট পরিমাণে বৃদ্ধি পেল এবং আগের চেয়েও সুমিষ্ট এবং সুস্বাদু হয়ে গেল।
৩.আহলে বাইত বিদ্বেষীর তৃষ্ণার্ত অবস্থায় মৃত্যু: জনৈক ইয়াযিদী সৈন্য ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে লক্ষ্য করে বলল, হে হুসাইন! দেখো ফুরাত নদী কিভাবে ঢেউ তুলছে। আল্লাহর কসম! তুমি এ নদী থেকে এক ফোটা পানিও পাবে না; বরং পিপাসায় তোমার মৃত্যু হবে। এ কথা শুনে ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বললেন-
اللَّهُمَّ اقْتُلْهُ عَطَشًا وَلَا تَغْفِرْ لَهُ أَبَدًا
অর্থাৎ হে আল্লাহ! তাকে তুমি পিপাসা দিয়ে মৃত্যু প্রদান কর এবং তাকে কখনো ক্ষমা করো না।’ ঘটনাক্রমে দেখা গেল, ঐ ব্যক্তি ঘোড়া থেকে পড়ে গেল এবং ঘোড়াটি দৌঁড়তে আরম্ভ করল। সেও ঘোড়ার পিছনে পিছনে দৌঁড়তে দৌঁড়তে অত্যন্ত পিপাসার্ত হয়ে পিপাসা পিপাসা বলে চিৎকার করতে লাগল। তাকে পানি পান করানো হলে সে পানি সাথে সাথে বমি করে দিত। পরিশেষে সে পিপাসা পিপাসা বলে চিৎকার করতে করতে মৃত্যুবরণ করল।
৪.নূরের স্তম্ভ ও সাদা সাদা পাখি: ইমামে আলী মকাম ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর -শাহাদাতের পর তাঁর শির মুবারক থেকে অসংখ্য কারামত প্রকাশিত হয়েছিল। যেমন- আহলে বাইতের কাফিলার অবশিষ্ট সদস্যরা ১১ই মুহাররামুল হারাম কুফায় পৌঁছে ছিলেন। এর আগেই শোহাদায়ে কারবালার মস্তক মুবারকগুলো সেখানে পৌঁছানো হয়েছিল। ইমামের শির মোবারক যুগের কলঙ্ক, নরপিশাচ ইয়াজিদী খাওলী বিন ইয়াজিদের কাছে ছিল। তাঁর মস্তক মুবারক নিয়ে সে হতভাগা রাতের বেলায় কুফায় পৌঁছেছিল। কিন্তু রাজ প্রাসাদের দরজা বন্ধ থাকায় সে মস্তক মুবারক নিয়ে তার বাড়ীতে চলে এলো। সে হতভাগা নূরানী মস্তককে বেয়াদবীর সাথে মাটিতে রেখে একটি বড় পাত্র দ্বারা ঢেকে রাখল এবং তার স্ত্রী নওয়ারকে গিয়ে বলল: আমি তোমার জন্য আজীবনের ধন দৌলত নিয়ে এসেছি। তুমি গিয়ে দেখো, হুসাইন বিন আলীর মস্তক তোমার ঘরে পড়ে আছে। সে ক্রুদ্ধ হয়ে বলে উঠল: “হে পাপীষ্ঠ! তোর উপর আল্লাহর লানত বর্ষিত হোক, তুই চিরতরে ধ্বংস হয়ে যা। মানুষ তো স্বর্ণ-রৌপ্য, মনি-মাণিক্য নিয়ে আসে, আর তুই আমার জন্য নূর নবীর দৌহিত্রেরই পবিত্র মস্তক নিয়ে আসলি। দূর হও! আমার কাছ থেকে, তুই দূর হয়ে যা। খোদার কসম! আমি আর কখনো তোর সাথে থাকব না।” এ বলে নওয়ার তার শয্যা থেকে উঠে দাঁড়াল এবং যেখানেই সে নুরানী মস্তক মোবারক রাখা হয়েছিল সেখানে গিয়ে বসল। নওয়ারের বর্ণনা: “খোদার কসম! আমি দেখতে পেলাম, আসমান থেকে মস্তক মুবারক রক্ষিত সে পাত্র পর্যন্ত একটি নূরের স্তম্ভ ঝলমল করছিল এবং ঐ পাত্রের চারদিকে সাদা সাদা পাখি উড়ছিল। যখন সকাল হলো খাওলী বিন ইয়াজিদ সে নূরানী মস্তক ইবনে যিয়াদের কাছে নিয়ে গেলো।
সুপ্রিয় ঈমানদার ভাইয়েরা! ইমামে আলী মকাম, ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর প্রতি আমাদের ভালবাসা কেমন? আমরাও একটু ভাবি- মুহাররামুল হারামের দশম রজনী ইমাম আলী মকামের জীবনের শেষ রাত ছিলো, কিন্তু আল্লাহ পাকের ইবাদতের প্রতি তাঁর আগ্রহ দেখুন! আর একেবারে শাহাদতের মুহুর্তেও তিনি আল্লাহ পাকের দরবারে সিজদা অবস্থায় ছিলেন। সুতরাং আমরা ইমাম হুসাইনের গোলামরাও যেনো আমাদের মাহবুবের পদাঙ্ক অনুসরন করে চলে ইবাদত ও রিয়াযত করে নিজের জীবনের দিন রাত অতিবাহিত করে চলি। মনে রাখবেন! হাদীসে পাকে বর্ণিত রয়েছে: বান্দা তারই সাথে হবে, যাকে সে ভালবাসবে, যদি আমরা মুখে ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে ভালবাসার দাবী করে থাকি কিন্তু ইমামে আলী মকামের চরিত্র অনুসরন না করি তবে আমাদের ভালবাসা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। হযরত সৈয়্যিদুনা ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু আপন নানাজান প্রিয় নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাতে মুবারকা দাঁড়ি দ্বারা স্বীয় চেহেরাকে সাজিয়েছিলেন, আমাদের চেহারায় এই সুন্নাতে রাসূল আছে কি? তিনি জীবনের শেষ ফজরের নামায তাঁর তাবুতে জামাআত সহকারে আদায় করেছেন আর শত্রুরা চারিদিকে তরবারী প্রদর্শন করছিলো? ইমামের জীবনী থেকে আমরা এই শিক্ষা পাই যে, আমাদের পাঁচ ওয়াক্ত নামায জামাআত সহকারে আদায় করা এবং প্রয়োজনে দ্বীনের জন্য সবকিছু কুরবানী করার জন্য প্রস্তুত থাকা ঈমানী দায়িত্ব। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদেরকে ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর পদাংক অনুসরণ করার তওঢিক দান করুন। আমিন বিজাহিন নবিয়্যিল আমিন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
লেখক: আরবি প্রভাষক, রাণীরহাট আল-আমিন হামেদিয়া ফাযিল মাদরাসা; খতিব, রাজানগর রাণীরহাট ডিগ্রি কলেজ জামে মসজিদ,রাঙ্গুনিয়া,চট্টগ্রাম।
কোন মন্তব্য নেই