Header Ads

Header ADS

বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত



মুহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মাসুম 

নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি কক্সবাজার বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত একটি শহর, মৎস্য বন্দর এবং পর্যটন কেন্দ্র। বঙ্গোপসাগরের তীর ঘেঁষে অবস্থিত এ প্রাকৃতিক   বালুময় সমুদ্র সৈকত শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত। এর দৈর্ঘ্য ১৫৫ কিলােমিটার। এর চেয়ে বৃহৎ সমুদ্রসৈকত পৃথিবীর আর কোথাও নেই । এখানে রয়েছে বাংলাদেশের বৃহত্তম সামুদ্রিক মৎস্য বন্দর এবং সাবমেরিন ক্যাবল ল্যান্ডিং স্টেশন। একসময় কক্সবাজার পানোয়া নামেও পরিচিত ছিল যার আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে হলুদ ফুল।  নবম শতাব্দীর গোড়ার দিক থেকে ১৬১৬ সালে মোঘল অধিগ্রহণের আগে পর্যন্ত কক্সবাজার-সহ  চট্টগ্রামের একটি বড় অংশ আরাকান রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। মোঘল সম্রাট শাহ সুজা পাহাড়ী রাস্তা ধরে আরাকান যাওয়ার পথে কক্সবাজারের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হন এবং এখানেই ক্যাম্প স্থাপনের আদেশ দেন। তার যাত্রাবহরের প্রায় একহাজার পালঙ্কী কক্সবাজারের চকরিয়ার ডুলাহাজারা নামের স্থানে অবস্থান নেয়। ডুলহাজারা অর্থ হাজার পালঙ্কী। মোঘলদের পরে ত্রিপুরা এবং আরকান, তারপর পর্তুগিজ এবং ব্রিটিশরা এই এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেয়। কক্সবাজার নামটি এসেছে ক্যাপ্টেন হিরাম কক্স নামে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক অফিসারের নাম থেকে। কক্সবাজারের আগের নাম ছিল পালংকি। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অধ্যাদেশ, ১৭৭৩ জারি হওয়ার পর ওয়ারেন্ট হোস্টিং বাংলার গভর্নর হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্ত হন। তখন হিরাম কক্স পালংকির মহাপরিচালক নিযুক্ত হন। ক্যাপ্টেন কক্স আরাকান শরণার্থী এবং স্থানীয় রাখাইনদের মধ্যে বিদ্যমান হাজার বছরের পুরোনো সংঘাত নিরসনের চেষ্টা করেন এবং শরণার্থীদের পুনর্বাসনে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি সাধন করেন কিন্তু কাজ পুরোপুরি শেষ করার আগেই মারা (১৭৯৯ সালে) যান। তার পুনর্বাসন অবদানকে স্মরণীয় করে রাখতে একটি বাজার প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং এর নাম দেয়া হয় কক্স সাহেবের বাজার। পরবর্তীতে কক্সবাজারে রূপান্তরিত হয়।

পর্যটন শিল্পকে কেন্দ্র করে এখানে গড়ে উঠেছে অনেক প্রতিষ্ঠান। বেসরকারি উদ্যোগে নির্মিত অনেক হোটেল, বাংলাদেশ পর্যটন কেন্দ্র নির্মিত মোটেল ছাড়াও সৈকতের নিকটেই বিশটি পাঁচতারা হোটেল রয়েছে। এছাড়া এখানে পর্যটকদের জন্য গড়ে উঠেছে ঝিনুক মার্কেট। সীমান্তপথে  মিয়ানমার,  থাইল্যান্ড, চীন প্রভৃতি দেশ থেকে আসা বাহারি জিনিসপত্র নিয়ে গড়ে উঠেছে বার্মিজ মার্কেট। এখানে রয়েছে দেশের একমাত্র ফিস একুরিয়াম । আরো রয়েছে প্যারাসেলিং,ওয়াটার বাইকিং,বিচ বাইকিং,কক্স কার্নিভাল সার্কাস শো,দরিয়া নগর ইকোপার্ক, কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নিমির্ত অসংখ্য স্থাপত্য, ফিউচার পার্ক,শিশুপার্ক এবং অসংখ্য ফোটোসুট স্পট। এখানে আরো আছে টেকনাফ জিওলজিক্যাল পার্ক। এখানে উপভোগের জন্য রয়েছে নাইট বিচ কনসার্ট । সমুদ্র সৈকতকে লাইটিং এর মাধ্যমে আলোকিত করার ফলে এখানে রাতের বেলায় সমুদ্র উপভোগের সুযোগও রয়েছে। কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নিমির্ত হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সী-একুরিয়্যাম। ক্যাবল কার এবং ডিজনি ল্যান্ড।

সূর্যাস্তের দৃশ্য : সমুদ্রসৈকতের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দৃশ্য হলাে সূর্যাস্তের দৃশ্য। পড়ন্ত বিকেলে পশ্চিমাকাশের রক্তিম সূর্যকে দেখে মনে হয় যেন সমুদ্রের জলে তলিয়ে যাচ্ছে। এ দৃশ্য যে কত সুন্দর, নিজের চোখে না দেখলে তা কল্পনা করা যাবে না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে পর্যটনকারীরা কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের এ অপূর্ব রূপ-মাধুর্য অবলােকন করতে আসে।


রাজধানী ঢাকা থেকে বেড়াতে আসা মুহাম্মদ আফজাল হোসেন জানান, ‘১০-১৫বছর আগে কক্সাবাজারের অন্যতম আকর্ষণীয় স্পট ছিল ঝাউবাগানটি। কিন্তু বর্তমানে অপরিকল্পিতভাবে সমুদ্রতটের কাছে আবাসিক হোটেল ও স্থাপনা নির্মাণের কারণে বাগানটি আর আগের মতো সুন্দর নেই। ঝাউবাগানটি রক্ষার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেয়া প্রয়োজন।’

বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে ১৯৭২-৭৩ সালে সমুদ্র সৈকতের বালিয়াড়িতে ৫৮৫ হেক্টর জমিতে লাগানো হয় ১৪ লাখেরও বেশি ঝাউগাছ। ইতোমধ্যে সাগরের ঢেউয়ে বিলীন হয়ে গেছে প্রায় ২৭৪ হেক্টর জমির ৭ লাখ ঝাউগাছ। কক্সবাজারের ঝাউবাগানটি হুমকির মুখে, এ ব্যাপারে দুযোর্গ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমানের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি জানান, যদিও এটি পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে। সরকারের পক্ষ থেকে ঝাউবাগানসহ মেরিন ড্রাইভ রোডের অন্যান্য বাগান ও শহর রক্ষায় প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে বলে জানান প্রতিমন্ত্রী।

লাবণী পয়েন্ট: কক্সবাজার শহর থেকে নৈকট্যের কারণে লাবণী পয়েন্ট কক্সবাজারের প্রধান সমুদ্র সৈকত বলে বিবেচনা করা হয়। নানারকম জিনিসের পসরা সাজিয়ে সৈকত সংলগ্ন এলাকায় রয়েছে ছোট বড় অনেক দোকান যা পর্যটকদের জন্য বাড়তি আকর্ষণ।

হিমছড়ি: হিমছড়ি কক্সবাজারের ১৮ কি.মি. দক্ষিণে অবস্থিত। ভঙ্গুর পাহাড় আর ঝর্ণা এখানকার প্রধান আকর্ষণ। কক্সবাজার থেকে হিমছড়ি যাওয়ার পথে বামদিকে সবুজঘেরা পাহাড় আর ডানদিকে সমুদ্রের নীল জলরাশি মনোমুগ্ধকর দৃশ্যের সৃষ্টি করে। বর্ষার সময়ে হিমছড়ির ঝর্ণাকে অনেক বেশি জীবন্ত ও প্রাণবন্ত বলে মনে হয়। হিমছড়িতে পাহাড়ের চূড়ায় একটি রিসোর্ট আছে যেখান থেকে সাগরের দৃশ্য অপার্থিব মনে হয়। হিমছড়ির প্রধান আকর্ষণ এখানকার ক্রিসমাস ট্রি। সম্প্রতি হিমছড়িতে গড়ে উঠেছে বেশ কিছু পর্যটন কেন্দ্র ও পিকনিক স্পট।

ইনানী সমুদ্র সৈকত: দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত ছাড়াও কক্সবাজারে সৈকত সংলগ্ন আরও অনেক দর্শনীয় এলাকা রয়েছে যা পর্যটকদের জন্য প্রধান আকর্ষণের বিষয়। সৈকত সংলগ্ন আকর্ষণীয় এলাকাগুলোর মধ্যে রয়েছ, ইনানী সমুদ্র সৈকত যা কক্সবাজার থেকে ৩৫ কি.মি দক্ষিণে অবস্থিত। অভাবনীয় সৌন্দর্যে ভরপুর এই সমুদ্র সৈকতটি কক্সবাজার থেকে রাস্তায় মাত্র আধঘণ্টার দূরত্বে অবস্থিত। পরিষ্কার পানির জন্য জায়গাটি পর্যটকদের কাছে সমুদ্রস্নানের জন্য উৎকৃষ্ট বলে বিবেচিত।

কক্সবাজারে বিভিন্ন উপজাতি বা নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী বাস করে যা শহরটিকে করেছে আরো বৈচিত্র্যময়। এইসব উপজাতিদের মধ্যে  চাকমা সম্প্রদায় প্রধান। কক্সবাজার শহর ও এর অদূরে অবস্থিত রামুতে রয়েছে  বৌদ্ধ  ধর্মাবলম্বীদের পবিত্র তীর্থস্থান হিসেবে বৌদ্ধ মন্দির। কক্সবাজার শহরে যে মন্দিরটি রয়েছে তাতে বেশ কিছু দুর্লভ বৌদ্ধ মূর্তি আছে। এই মন্দির ও মূর্তিগুলো পর্যটকদের জন্য অন্যতম আকর্ষণ।

কক্সবাজারকে আধুনিক পর্যটন নগরী হিসেবে গড়ে তোলার মহা-পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ২০১৬ সালে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গঠন করে সরকার। বর্তমানে বেশ কিছু পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে কক্সবাজার কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান লে: কর্ণেল (অব:) ফোরকান আহমদ। 
কক্সবাজারের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং ইতিহাস ঐতিহ্য তুলে ধরা গেলে বিশ্ব পর্যটকদের আকৃষ্ট করা সহজ হবে বলে অভিমত প্রকাশ করেন বিশেষজ্ঞগণ।

লিখক: আরবি প্রভাষক: রাণীরহাট আল-আমিন হামেদিয়া ফাযিল মাদরাসা; রাজানগর রাণীরহাট ডিগ্রি কলেজ জামে মসজিদ, রাঙ্গুনিয়া, চট্টগ্রাম।              

কোন মন্তব্য নেই

 

Blogger দ্বারা পরিচালিত.