হাজারিখিল: বাংলাদেশের অনন্য বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য
মুহম্মদ আবদুল্লাহ আল মাসুম
পাহাড়, সমুদ্র আর সবুজে ঘেরা চট্টগ্রাম। কর্মব্যস্ত জীবনে একটু সুযোগ পেলেই ভ্রমণ পিপাসু মানুষ চট্টগ্রাম ছুটে যায় সবুজ প্রকৃতির সান্নিধ্য লাভের আশায়। চট্টগ্রাম শহর থেকে ৪৫ কিলোমিটার উত্তরে রামগড়-সীতাকুণ্ড বনাঞ্চল। এ বনাঞ্চলের মধ্যেই রয়েছে বিচিত্র সব বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য হাজারিখিল, যেখানে আছে ২৫ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ১২৩ প্রজাতির পাখি, ৮ প্রজাতির উভচর, ২৫ প্রজাতির সরীসৃপ ও বিলুপ্ত প্রজাতিসহ ২৫০ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে। আছে সর্বোচ্চ উচ্চতার বৈলাম বৃক্ষ ও বন ছাগল।
রঙ-বেরঙের এসব পাখির মধ্যে রয়েছে বিপন্ন প্রায় কাঠময়ূর ও মথুরা। আছে কাউ ধনেশ ও হুতুম পেঁচাও। বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদের সমারোহ থাকার কারণে চিরসবুজ এই বনে এমন কিছু প্রজাতির পাখি পাওয়া গেছে, যা অন্য কোনো বনে সচরাচর দেখা যায় না। এখানে রয়েছে খুদে কাঠঠোকরা, বড় বসন্তবাউড়ি, নীলকান্ত, বেঘবৌ, ছোট বসন্তবাউড়ি, তিত মাছরাঙা, সাদা বুক মাছরাঙা, মেঘ হও মাছরাঙা, সবুজ সুইচোরা, খয়েরি মাথা সুইচোরা, নীল লেজ সুইচোরা, বড় কানাকুকা, বউ কথা কও, কোকিল, সবুজ কোকিল, সুরেলা কোকিল, তোতা, টিয়া, আবাবিল, নাক কাটি, লক্ষ্মীপেঁচা, খুরলে পেঁচা, ডোরা কালি পেঁচা, কালো পেঁচা, জালালি কবুতর, তিলা ঘুঘু, রাম ঘুঘু, ধলা ঘুঘু, ছোট হরিয়াল, কমলা বুক হরিয়াল, হলুদ পা হরিয়াল, ডাহুক, বনমোরগ, জয়াড কাঠঠোকরা, বর্মি কাঠঠোকরা, সবুজ কাঠঠোকরা, সোনালি কাঠঠোকরা, মেটে টুপি কাঠঠোকরা। আরো আছে— জলপিপি, হট্টিটি, মেটে মাথা হট্টিটি, বেশরা, তিলা ঈগল, ভুবন চিল, শঙ্খ চিল, ছোট মাছ মুরাল, ছোট বাজ, পানকৌড়ি, গো-বক, সাদা বক, মাইজলা বক, কানি বক, ওয়াক, শামুক খোল, ধূসর বুক টুনি, সাধারণ বন টুনি, পাতা বুলবুল, সবুজ বুলবুল, ভাত শালিক, ঝুঁটি শালিক, গোবরে শালিক, কাঠশালিক, পাতিকাক, দাঁড়কাক, কুটুম পাখি, সবুজ হাঁড়িচাছা, ফিঙ্গে, কেশরাজ, ভীমরাজ, ছোট ফিঙে, হলদে পাখি, ফটিকজল, লাটোরা, আলতাপরী, লেজ নাচানি, বাদামি কসাই, বড় কাবাশি, চামচ কসাই, মেটে পিঠ কসাই, সিপাহী বুলবুল, কালো বুলবুল, ধূসর বুলবুল, কালো মাথা বুলবুল, শ্যামা, কালোঘর রাজন, দোয়েল, ফুটফুটি চটক, নীল শিলাদামা, শিলাদামা, লাল বুক চটক, মেটে মাথা ছোট চটক, নীলকান্তমণি চটক, এশীয় খয়েরি চটক, লেজ চেরা পাখি, টুনটুনি, সাত ভায়লা, সাদা মুকুট পাঙ্গা, পাঙ্গা, কালচে ফটক, ম্যাকারিন, বেগুনি বুক মৌটুসি, নীল টুনি, মৌচাটুনি, সিঁদুরে লাল মৌটুসি, বাধা টুনি, দাগি সাঁতারে, লাল ফুলঝুরি, তিত পাখি, চড়ুই পাখি, বাবুই, মাঠ চড়াই, তিলা মুনিয়া, বন খঞ্জন, সাদা খঞ্জন, ধূসর খঞ্জন ও হলদে মাথা খঞ্জন। এসব পাখির আকার-আকৃতি, বর্ণ ও স্বভাবে বৈচিত্র্যময়। সম্প্রতি বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে এক গবেষণায় পাখির এসব প্রজাতির সন্ধান পায় গবেষক দল। এ অভয়ারণ্যে নানা প্রজাতির পাখির সঙ্গে শীতকালে যোগ দেয় অতিথি পাখির দল। এদের বিচরণে চিরসবুজ বন পরিণত হয় পাখিরই আলাদা এক রাজ্যে। ১১৭৭.৫৩ হেক্টর জমি নিয়ে গঠিত এই বনাঞ্চলটিকে ২০১০ সালের ৬ এপ্রিল বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা দেয় সরকার, যা হাজারিখিল অভয়ারণ্য নামে পরিচিত।
পর্যটকদের কাছে খুব বেশি পরিচিত না হলেও এই এলাকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মনোমুগ্ধকর। ইউএস এইড এবং বনবিভাগের সমন্বয়ে পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে এখানে ট্রি এক্টিভিটি, ক্যাম্পিং ছাড়াও নানান ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এখানকার উল্লেখযোগ্য বন্যপ্রাণীর মধ্যে রয়েছে— বানর, হনুমান, মায়া হরিণ, বুনো ছাগল, চিতা বিড়াল ও মেছো বাঘ। মিশ্র চিরসবুজ বনসমৃদ্ধ এ অভয়ারণ্যের প্রধান বৃক্ষ গর্জন, চাপালিশ, সেগুন, কড়ই, মেহগনি ও চুন্দুল।
অভয়ারণ্য এর ভিতর ঢুকতেই দেখবেন হাতের ডান পাশেই সিড়ি বেয়ে উঠেই বন্য প্রাণীর অভয়ারণ্য। এখানে আপনি হারিয়ে যাবেন চা বাগানের বাতাস আর মাঝের দৃষ্টিনন্দন রোডের মায়ায়। খানিক সময়ের জন্য হলেও মনে হবে পাহাড়ি অঞ্চলে বসবাস করতে পারলেই ভালো হতো। তারপর অভয়ারণ্য প্রবেশের গেটের ডান পাশেই আছে আরেকটি চমকপ্রদ এডভ্যান্সার যেখানে আপনি ট্রি এক্টিভিটিস করতে পারবেন। গেটে ঢুকেই একজন কর্মকর্তার কার্যালয় আছে। ওখানেই খুজে পাবেন একজন গাইডকে, যিনি আপনাদের নাম এন্ট্রি করিয়ে টাকাটা নিয়ে দেখিয়ে দিবে। ৫ স্টেপের এই চ্যালেঞ্জের জন্য জনপ্রতি ১০০ টাকা করে ফি নেওয়া হয়ে থাকে। এরপর আপনাকে জ্যাকেট, হেলমেট সব পরিয়ে দিবে।।। দেখতে বুঝা যায় কতোটা সহজ কিন্তু যে করে সে বুঝতে পারে অতটা আবার ইজি না আশা করি যারা যারা করতে ইচ্ছুক তারা ভালো একটা এক্সপেরিএন্স পাবেন।
এক্টিভিটির দিকে না গিয়ে সামনের দিকে কিছুদূর হাঁটলেই বাম পাশের এলাকাজুড়ে অবস্থিত সবুজে ঘেরা বিখ্যাত রাঙ্গাপানি চা বাগানের সৌন্দর্য মুগ্ধ করবে যে কাউকে। চা বাগান পেরিয়ে একটু সামনে যেতেই একটা খাবারের দোকান রয়েছে। দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা তারাই করে থাকে৷ যদি ট্রেকিং করে ফিরতে দুপুর হলে আগেই খাবারের অগ্রিম অর্ডার করে দেয়া উচিত। আর ঝিরিপথ ধরে সাত-আট কিলোমিটার দূরত্বের ট্রেইলটি কালাপানি ঝরনায় গিয়ে মিলেছে। এই পাহাড়গুলো মিরসরাই –সীতাকুণ্ড রেঞ্জের সঙ্গে মিলেছে বলেই ঐদিকের ট্রেইলের সঙ্গে বেশ মিল আছে। ঘণ্টাখানেকের লম্বা
পাথুরে রাস্তা ধরে হাঁটার পর কিছু জায়গায় পার হতে হয় গ্রীষ্মকালে কোমর পানি। বৃষ্টি হলে এই পথের অবস্থা তাই সহজেই অনুমেয়। প্রায় দেড় ঘণ্টার ট্রেকিং শেষে কালা পানির ঝরনার কাছে পৌঁছা সম্ভব। প্রকৃতির মায়াময় রুপ দেখা যায় যদিও এখনো বৃষ্টির সময় শুরু হয় নাই তারপরো কিছু কিছু জায়গা আছে যেখানে হাঁটু সমান, গলা সমান পানি পাড় হয়ে সামনে আগাইতে হয়। হাজারিখিল ট্রেইলে ঢুকে ঝিরিপথ, ক্যাসকেডের এক একটা মোড় পার হয়ে যতই সামনে আগাবেন ততই অবাক হবেন কারণ এতোটা অসাধারণ সুন্দর এই হাজারিখিল ট্রেইল’টা।
এখানে যে কেউ ইচ্ছা করলেই রাতে থাকতে পারবে,বন বিভাগের আওতাধীনে তাবুর ব্যবস্থা আছে। এক তাবুতে ২ জন করে থাকতে পারবেন, তাবু জন প্রতি ১৫০ টাকা ভাড়া,পুরো তাবু নিলে ৩০০ টাকা ভাড়া পড়বে।। আপনারা চাইলে রাতে নিজেরা বারবিকিউ করতে পারবেন অথবা বন বিভাগের লোকদের বললেই তারাই বারবিকিউ করে আপনাদের দিবে।। আর হ্যা তাবুর মধ্যে থাকার জন্য সব ব্যবস্থাই আছে,সো নো টেনশন। রাতের ফিল পাবেন যা আপনাকে মুগ্ধতায় ভরিয়ে দিবে,কনর্ফাম।। ঝিঝি পোকার শব্দ,কপাল ভালো হলে বন্যপ্রাণীর শব্দ,আর সাথে তো থাকছেই নিরবতা,প্রকৃতিকে অপারভাবে কাছে পাওয়া আপনি নিজে কথা বললেই সাউন্ড পাবেন।
প্রাকৃতকি সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সরকারের বন, পরিবেশ ও মৎস্য অধিদপ্তরের যৌথ উদ্যোগে ইউএসএইডের আর্থিক সহযোগিতায় গত ২৭ নভম্বের ২০১৪ সালে হাজারীখিল বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটি (সিএমসি) গঠন করে। কমিটির তত্ত্বাবধানে সংরক্ষিত এলাকার সম্পদ রক্ষা ও অবৈধ কার্যক্রম বন্ধের লক্ষ্যে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সমন্বয়ে গঠন করা হয়েছে যৌথ টহল দল (সিপিজি)। সিপিজি সদস্যবৃন্দ নিয়মিত বনবিভাগের নির্দেশনা মোতাবেক বন পাহারার কাজে দায়িত্ব পালন করছে।
এ প্রসঙ্গে ‘ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্টে ইকোসিস্টেম এন্ড লাইভলিহুডস’ বা ক্রেল এর সাইড কর্মকর্তা মো. তানজিবুল আলম আরিফ বলেন, ‘সরকারের উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা হিসেবে ক্রেল প্রকল্পকে সহযোগিতা করছে। এ অভয়ারণ্যে রয়েছে আইইউসিএন এর করা বাংলাদেশের রেড লিস্টে থাকা বিলুপ্তপ্রায় বিভিন্ন পাখিও। এখানে যে পরিমাণ প্রাণী ও উদ্ভিদ রয়েছে তা আর দেশের অন্যকোন অভয়ারণ্যে নেই। এখন শেষ পর্যায়ে চলছে পর্যটন কেন্দ্র করার কাজ। আমরা ক্রেলের পক্ষ থেকে পিকনিট স্পট, ইকোট্যুরিজম ম্যাপও করছি। যাতে পর্যটকরা বিভিন্নস্থান ঘুরে দেখতে পারে। তাছাড়া অভয়ারণ্যে ছোট ছোট অনেক ছড়া রয়েছে। এসব ছড়াগুলো আরো সংস্কার করলে পশু-পাখির জন্য আরো ভালো হবে।’
লিখক: আরবি প্রভাষক, রাণীরহাট আল-আমিন হামেদিয়া ফাযিল মাদরাসা;খতিব, রাজানগর রাণীরহাট ডিগ্রি কলেজ জামে মসজিদ
কোন মন্তব্য নেই