হিংসা মানুষের অন্যতম একটি খারাপ গুণ। আল্লামা জুরজানি রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, ‘হিংসা বলা হয়, হিংসাকৃত ব্যক্তির নিয়ামত দূরীভূত হয়ে হিংসুকের মধ্যে চলে আসার আকাঙ্ক্ষা করা।’
আল্লাহ তাআলা তাঁর কোনো বান্দাকে ধন-দৌলত দান করেছেন, কাউকে স্বাস্থ্য দান করেছেন, কাউকে সুখ্যাতি দান করেছেন, কাউকে সম্মান দান করেছেন, কাউকে নেতৃত্ব দান করেছেন, আবার কাউকে দান করেছেন জ্ঞান। হিংসুকের মনে এ খেয়াল জন্মায় যে এ নিয়ামত কেন তার অর্জিত হলো? যদি তার থেকে এ নিয়ামত চলে যেত, তাহলে ভালো হতো! তাই অন্যের বিপদে সে খুশি হয়, আর যদি অন্যের ভালো কিছু অর্জিত হয়, তাহলে সে অন্তরে ব্যথা পায়। সে আফসোস করতে থাকে, কেন ওই ব্যক্তি আমার চেয়ে বড় হয়ে গেল, উন্নতি লাভ করল! এমন মানসিকতার নাম হিংসা। হিংসা মানুষকে শুধুমাত্র প্রতিপন্নই করে না বরং হিংসুকের জীবন কখনই সুখের হয় না। কেননা সে সবসময় সকল জিনিসের অধিকারী হতে চায়। তার সর্বদা এই চেষ্টাই থাকে যে, অন্যের কাছে যা আছে তার চেয়ে তার জিনিসটা ভাল হওয়া চাই। আর এই হিংসুক ব্যক্তিই সমাজের অন্যান্য সন্মানিত ব্যক্তিদের ব্যক্তিত্বকে হেয় করার চেষ্টা করে। কেননা তার দৃষ্টিতে সে একাই সমাজে সন্মানিত ব্যক্তি, বাকিরা সবাই তার চেয়ে নগন্য। হিংসার নিন্দায় কোরআনুল করিমে ইরশাদ হচ্ছে
قال الله تعالی : ﴿ وَ مِن شَرِّ حَاسِدٍ إِذا حَسَ. ﴾.
অর্থাৎ "এবং হিংসুকের অনিষ্ট থেকে যখন সে হিংসা করে"। (সূরা ফালাক,আয়াত : ৫)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন , ‘তিনটি বদ অভ্যাস আছে, যা থেকে কেউ মুক্ত নয়। ১. কুধারণা, ২. হিংসা এবং ৩. অশুভ ফলে বিশ্বাস। সাহাবিরা জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! এসব থেকে মুক্ত থাকার উপায় কী? রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, কারও প্রতি কুধারণা এলে তা বিশ্বাস না করা, হিংসার উদ্রেক হলে প্রকাশ না করা আর অশুভ ফলের কারণে শুরু করা কাজ থেকে ফিরে না আসা।’ (মাজমাউজ জাওয়াইদ)। ইমাম বাকির রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন :
إنّ الحسد يأکل الإيمان کما تأکل النار الحطب
অর্থাৎ ‘নিশ্চয়ই যেভাবে আগুন কাঠকে ভক্ষণ করে [জ্বালিয়ে নিঃশ্বেষ করে], হিংসাও ঈমানকে ভক্ষণ করে'। (আল কাফী, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৩০৬, হাদীস নং ১)
ইমাম সাদিক রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন
إياکُم أن يحسُدَ بعضکم بعضاً؛ فإنَّ الکفرَ أصله الحسد.
অর্থাৎ ‘একে অপরের সাথে হিংসা করা থেকে বিরত থাকো, কেননা হিংসা হল কুফরের ভিত্তি স্বরূপ'। (আল কাফী, খণ্ড ৮, পৃ. ৮, হাদীস নং ১)
আল্লামা গাজ্জালী (রহ.) হিংসার সাতটি কারণ উল্লেখ করেছেন : ১. শত্রুতা ২. নিজের ওপর অন্য কেউ সম্মানিত হয়ে যাওয়া ৩. অহংকার ৪. অস্বাভাবিকভাবে কেউ এগিয়ে যাওয়া। ৫. নিজের পদ বা মর্যাদা হারিয়ে যাওয়ার ভয় করা। ৬. নেতৃত্ব ও সম্মানের লোভ ৭. নিচু বা খারাপ মানসিকতা। হিংসুকের আলামত : ১. অন্যের ভালো অবস্থা দেখে তাকে শত্রু ভাবা। ২. তার প্রতি অসন্তুষ্ট হওয়া। ৩. অন্যের কল্যাণের কারণে সব সময় অন্তরে এক ধরনের কষ্ট ও ব্যথা অনুভব করা। ৪. যার প্রতি হিংসা করে তার কাছ থেকে নিয়ামত চলে গেলে আনন্দিত হওয়া যদিও এতে তার কোনো লাভ বা ক্ষতি না থাকা। ৫. সব সময় এ ব্যাপারে সতর্ক ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত থাকে যেন কোনোভাবেই চলে যাওয়া সেই নিয়ামত আর ফিরে না আসে। হিংসুককে চেনার জন্য লোকমান হাকিম স্বীয় পুত্রকে তিনটি লক্ষণ বলেছেন
قال لُقمان لابنه: و للحاسد ثلاثُ علاماتٍ: يغتبُ إذا
غابَ وَ يَتملّقُ إذا شهَدَ وَ يَشمَتُ بَالمُصيبةِ
১. পেছনে গিবত করে ২. সামনাসামনি তোষামোদি করে। ৩. বিপদে পড়লে তিরস্কার করে।
শিক্ষণীয় ঘটনা : আনাস ইবনে মালিক রাদ্বিল্লাহু আনহু বলেন, একদিন আমরা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট বসা ছিলাম। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি গলির দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, এই গলি দিয়ে এখন একজন জান্নাতি লোক বেরিয়ে আসবে। অতঃপর দেখলাম সেদিক দিয়ে এক আনসারি সাহাবি হযরত সা’আদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বের হয়ে এলেন। তাঁর দাড়ি থেকে তখন অজুর পানি গড়িয়ে পড়ছিল। তিনি সবাইকে সালাম দিলেন, অন্য আরেক দিনও রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এভাবে বললেন এবং সেই লোকটিই বেরিয়ে এলেন। এভাবে তিন দিন এমন হলো। তৃতীয় দিন রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মজলিস থেকে উঠে যাওয়ার পর আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ওই সাহাবিকে অনুসরণ করলেন, আমার পিতার সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে এ কারণে বাড়িতে যাব না বলে শপথ নিয়েছি। যদি আপনি ভালো মনে করেন, আমাকে আপনার সঙ্গে তিন দিন থাকতে অনুমতি দিন। তিনি রাজি হলেন, আবদুল্লাহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি তাঁর সঙ্গে তিন দিন থাকলাম। তাকে এমন বিশেষ কোনো আমল করতে দেখিনি। তবে যখনই তার ঘুম ভাঙত তিনি জিকির করতেন। আর একটি হলো আমি তাকে ভালোটি ছাড়া কোনো মন্দ কাজ করতে দেখিনি। তিন দিন পর আমি তাকে সব খুলে বললাম এবং জানতে চাইলাম আপনার কাছে তো এমন কোনো বিশেষ আমল পেলাম না যার কারণে আপনি জান্নাতের এমন সুসংবাদ পেতে পারেন। তখনই ওই সাহাবি বললেন, আপনি ঠিক বলেছেন আমার বিশেষ কোনো আমল নেই তবে আমি কখনো আমার অন্তরে কারও ব্যাপারে হিংসা বিদ্বেষ অনুভব করি না। তখন আবদুল্লাহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বললেন হ্যাঁ, এই আমলই আপনাকে ওই মর্যাদায় পৌঁছে দিয়েছে। (মুসনাদে আহমাদ)
হিংসুক ব্যক্তি শত চেষ্টায়ও তা গোপন রাখতে পারে না। কেননা শত্রুকে ঘায়েল করার পূর্বে সে নিজেই ঘায়েল হয়। যার নমুনা তার চেহারায় ও কর্মে ফুটে ওঠে। জনৈক কবি তাই বলেন,
يا حاسداً لي على نعمتي + أتدري على من أسأتَ الأدبْ
أسأتَ على الله في فعلهِ + لأنكَ لم ترضَ لي ما قسمْ
فأخزاكَ ربي بأنْ زادني + وسدَّ عليكَ وجوهَ الطلبْ
অর্থাৎ (১) ‘হে হিংসুক ব্যক্তি! যে আমার নে‘মতে হিংসা করে থাক। তুমি কি জানো তুমি কার সাথে মন্দ আচরণ করো? (২) তুমি আল্লাহর কর্মকে মন্দ বলে থাক। কেননা তিনি আমাকে যা (রহমত) বণ্টন করেছেন তুমি তাতে সন্তুষ্ট নও। (৩) অতএব আমার প্রভু তোমাকে লাঞ্ছিত করুন এ কারণে যে তিনি আমাকে রহমত বেশী দিয়েছেন। আর তোমার উপরে তা বন্ধ করেছেন’।
হিংসার ভয়াবহ পরিণতি
ক) দুনিয়াবী পরিণতি :
হিংসুক ব্যক্তি অন্যকে ক্ষতি করার আগে সে নিজেকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। কেননা (১) শুরুতেই সে হিংসার আগুনে জ্বলতে থাকে। হিংসা দূর না হওয়া পর্যন্ত এটাই তার জন্য স্থায়ী দুনিয়াবী শাস্তি। (২) তার চেহারা সর্বদা মলিন থাকে। তার সাথে তার পরিবারে হাসি ও আনন্দ থাকে না। (৩) অন্যের ক্ষতি করার চক্রান্তে ও ষড়যন্ত্রে সে সর্বদা ব্যস্ত থাকে। প্রতিপক্ষের হামলার ভয়ে সে সর্বদা ভীত ও সন্ত্রস্ত থাকে। নিশুতি রাতে বাঁশঝাড়ে কঞ্চির শব্দে কল্পিত জিনের ভয়ে হার্টফেল করার মত হিংসুক ব্যক্তিও সর্বদা কল্পিত শত্রুর ভয়ে আড়ষ্ট থাকে। (৪) তারই মত লোকেরা তার বন্ধু হয়। ফলে সৎ সঙ্গ থেকে সে বঞ্চিত হয়। (৫) ঘুণ পোকা যেমন কাঁচা বাঁশকে ভিতর থেকে কুরে কুরে খায়, হিংসুক ব্যক্তির অন্তর তেমনি হিংসার আগুন কুরে কুরে খায়। এক সময় সে ধ্বংস হয়ে যায়, যেমন ঘুণে ধরা বাঁশ হঠাৎ ভেঙ্গে পড়ে শেষ হয়ে যায়।
খ) আখেরাতের পরিণতি :
মৃত্যুর পর কবরে তাকে গ্রাস করে ভয়াবহ আযাব। অতঃপর কিয়ামতের দিন সে উঠবে ভীত-নমিত ও মলিন চেহারায় অধোমুখি হয়ে। আল্লাহ বলেন,
وَوُجُوْهٌ يَوْمَئِذٍ عَلَيْهَا غَبَرَةٌ- تَرْهَقُهَا قَتَرَةٌ- أُوْلَئِكَ هُمُ الْكَفَرَةُ الْفَجَرَةُ
অর্থাৎ অনেক মুখমন্ডল সেদিন হবে ধূলি-ধূসরিত’। ‘কালিমালিপ্ত’। তারা হ’ল অবিশ্বাসী পাপিষ্ঠ’ (‘সূরা আবাসা, আয়াত: ৪০-৪২)।
তাদেরকে দেখে যেমন দুনিয়াতে চেনা যেত। আখেরাতেও তেমনি চেনা যাবে। যেমন আল্লাহ বলেন,
يُعْرَفُ الْمُجْرِمُوْنَ بِسِيمَاهُمْ فَيُؤْخَذُ بِالنَّوَاصِيْ وَالْأَقْدَامِ ‘
অর্থাৎ অপরাধীদের চেনা যাবে তাদের চেহারা দেখে। অতঃপর তাদেরকে পাকড়াও করা হবে কপালের চুল ও পা ধরে’ (সূরা রহমান, আয়াত:
কোন মন্তব্য নেই