আত্মশুদ্ধি অর্জনের গুরুত্ব ও উপকার
মুহাম্মদ আবদুল্লাহ্ আল মাসুম
দেহ অসুস্থ হলে যেমন চিকিৎসার মাধ্যমে তাকে সুস্থ করে তুলতে হয়, তেমনি আত্মা রোগাক্রান্ত হলে তাকে সুস্থ বা পরিশুদ্ধ করে তুলতে হয়। কারণ অন্তর যদি পবিত্র ও পরিশুদ্ধ হয়, তাহলে মানবদেহের বাহ্যিক কার্যক্রমও পরিচ্ছন্ন, নির্মল ও কল্যাণকর হয়। আর যদি অন্তর অপবিত্র ও কলুষিত থাকে, তাহলে মানুষের বাহ্যিক আচার-আচরণসহ তার কার্যাবলিতে অপরিচ্ছন্নতা ও অকল্যাণের কালো ছায়া পাওয়া যায়। এ প্রসঙ্গে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন -...
وَإِنَّ فِي الْجَسَدِ مُضْغَةً إِذَا صَلَحَتْ صَلَحَ الْجَسَدُ كُلُّهُ، وَإِذَا فَسَدَتْ فَسَدَ الْجَسَدُ كُلُّهُ. أَلاَ وَهِيَ الْقَلْبُ
অর্থাৎ, ‘নিশ্চয় মানবদেহে এমন একটি গোশতের টুকরা আছে যেটা পরিশুদ্ধ হলে পুরো শরীর ঠিক হয়ে যায়। আর যখন তা ময়লা হয়ে যায় তখন সমস্ত শরীর দূষিত হয়ে যায়। জেনে রাখ! সেটা হচ্ছে কলব তথা আত্মা।’ (সহিহ বুখারি; সহিহ মুসলিম)
মহান আল্লাহ তায়ালা কলবকে নির্মল করে সৃষ্টি করেছেন। আর সেই কলবকে সর্বরকম মলিনতা থেকে হিফাযত রাখতে আদেশ করছেন। পবিত্র কুরআনুল করিমে মহান আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন -
﴿ قَدْ أَفْلَحَ مَنْ زَكَّاهَا * وَقَدْ خَابَ مَنْ دَسَّاهَا ﴾
অর্থাৎ ‘সে-ই সফল যে তার আত্মাকে পরিশুদ্ধ করেছে এবং যে তার আত্মাকে কলুষিত করেছে সে ক্ষতিগ্রস্ত।’ (সুরা আশ-শামস, আয়াত : ৮-৯)
আলোচ্য আয়াতে আত্মশুদ্ধির সুফল ও কুফল বর্ণিত হয়েছে। পরিশুদ্ধির অর্থ করতে গিয়ে ড. মুহাম্মাদ তাকিউদ্দীন আল হিলালী ও ড. মুহাম্মাদ মুহ্সীন খান ‘দি নোবল কোরআন’ গ্রন্থে লিখেছেন- Indeed he succeeds who purifies his ownself (i.e obeys and performs all that Allah ordered, by following the true Faith of Islamic Monotheism and by doing righteous good deeds.) অর্থাৎ আল্লাহর যে সব নির্দেশাবলী রাসূলের মাধ্যমে আমাদের কাছে এসেছে, তা পালন করা এবং ইসলামের একত্ববাদগ্রহণ ও আমলে সালেহর মাধ্যমে নফসের পরিশুদ্ধি অর্জন করা সম্ভব। উক্ত আয়াতের আলোকে পরিশুদ্ধির বিষয়টি দুইভাবে ব্যাখ্যা দেয়া যায়ঃ প্রথমত. মন্দর্থক: যা আখলাকে সায়্যিয়াহ বা মন্দ চরিত্রের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। আত্মার পরিশুদ্ধির জন্য যাবতীয় পাপ, অন্যায় ও অপবিত্র কাজ থেকে মুক্ত হওয়া অর্থাৎ যাবতীয় অসৎ গুণাবলী বর্জন করা। যেমন: শিরক, রিয়া, অহংকার, আত্মকেন্দ্রিকতা, স্বার্থপরতা, হিংসা, ঘৃণা, কৃপণতা, ক্রোধ, গীবত, পরনিন্দা, চোগলখুরি, কুধারণা, দুনিয়ার প্রতি মোহ, আখেরাতের উপর দুনিয়াকে প্রাধান্য দেওয়া, জীবনের প্রতি অসচেতনতা, অর্থহীন কাজ করা, অনধিকার চর্চা প্রভৃতি হতে নিজেকে এবং দেহ ও আত্মা মুক্ত করা। আত্মা মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রুতে পরিণত হয় যখন সে তাকে পাপাচার ও সীমালংঘনের দিকে আহবান করে। কেননা এই অপরিশুদ্ধ, পাপাচারী, ব্যাধিগ্রস্ত অন্তর মানুষকে আল্লাহর স্মরণ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। ইরশাদ হচ্ছে -
فَقُلْ هَلْ لَكَ إِلَىٰ أَنْ تَزَكَّىٰ وَأَهْدِيَكَ إِلَىٰ رَبِّكَ فَتَخْشَىٰ
অর্থাৎ ‘ অতঃপর তাকে (ফিরআউনকে) বল ‘তোমার কি ইচ্ছা আছে যে, তুমি পবিত্র হবে’? ‘আর আমি তোমাকে তোমার প্রতিপালকের দিকে পথ দেখাব, যাতে তুমি তাঁকে ভয় কর?’ (সূরা নাযিআত: আয়াত-১৯)
দ্বিতীয়ত. সদর্থক: যা আখলাকে হাসানা বা সচ্চরিত্র-এর মাধ্যমে প্রকাশ পায়। উত্তম গুণাবলী দ্বারা আত্মার উন্নতি সাধন করা অর্থাৎ প্রশংসনীয় গুণাবলী অর্জনের মাধ্যমে পরিত্যাগকৃত অসৎ গুণাবলীর শূন্যস্থান পূরণ করা। সৎ গুণাবলী হল তাওহীদ, ইখলাছ, ধৈর্যশীলতা, তাওয়াক্কুল বা আল্লাহর প্রতি নির্ভরতা, তওবা, শুকর বা কৃতজ্ঞতা, আল্লাহভীতি, আশাবাদিতা, লজ্জাশীলতা, বিনয়-নম্রতা, মানুষের সাথে উত্তম আচরণ প্রদর্শন, পরস্পরকে শ্রদ্ধা ও স্নেহ, মানুষের প্রতি দয়া, ভালবাসা ও সহানুভূতি প্রদর্শন, ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ের নিষেধ, পরোপকার প্রভৃতির মাধ্যমে সর্বোত্তম চরিত্র অর্জন করা।
এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনে আমর রাদ্বিয়াল্লাহ আনহু বলেন-
قِيلَ لِرَسُولِ اللَّهِ ـ صلى الله عليه وسلم ـ أَىُّ النَّاسِ أَفْضَلُ قَالَ " كُلُّ مَخْمُومِ الْقَلْبِ صَدُوقِ اللِّسَانِ " . قَالُوا صَدُوقُ اللِّسَانِ نَعْرِفُهُ فَمَا مَخْمُومُ الْقَلْبِ قَالَ " هُوَ التَّقِيُّ النَّقِيُّ لاَ إِثْمَ فِيهِ وَلاَ بَغْىَ وَلاَ غِلَّ وَلاَ حَسَدَ "
অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলা হলো, কোন ব্যক্তি সর্বোত্তম? তিনি ইরশাদ করেন, প্রত্যেক বিশুদ্ধ অন্তরের অধিকারী সত্যভাষী ব্যক্তি। তারা বলেন- সত্যভাষীকে তো আমরা চিনি, কিন্তু বিশুদ্ধ অন্তরের ব্যক্তি কে? তিনি বলেন- সে হলো পূত-পবিত্র, নিষ্কলুষ চরিত্রের মানুষ, যার নাই কোন পাপাচার এবং নাই কোন দুশমনি, হিংসা-বিদ্বেষ, আত্মহমিকা ও কপটতা। (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস: ৪২১৬)
আর নাফস পরিশুদ্ধ করার মাধ্যমে একজন ব্যক্তির ঈমান, আমল ও আখলাক পরিশুদ্ধ হয়। ইরশাদ হচ্ছে -
قَدْ أَفْلَحَ مَنْ تَزَكَّىٰ وَذَكَرَ اسْمَ رَبِّهِ فَصَلَّىٰ
অর্থাৎ "নিশ্চয়ই সে সাফল্য লাভ করবে যে নিজেকে পরিশুদ্ধি করবে, আর তার প্রতিপালকের নাম স্মরণ করবে, অতঃপর সালাত আদায় করবে। ( সূরা আলা, আয়াত: ১৪)
কোরআন-হাদীসে আত্মা পরিশুদ্ধ করার বিভিন্ন উপায় ও পদ্ধতি বিদ্যমান। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি তুলে ধরার প্রয়াস পেলাম-
১. ঈমানের পরিশুদ্ধি : আত্মশুদ্ধির চাবি হল ঈমানকে পরিশুদ্ধ করা। তাওহিদ ও রিসালত তথা সপ্ত বিষয়ে পরিপূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করা।। নতুবা আত্মশুদ্ধির সমস্ত প্রচেষ্টাই পন্ডশ্রম। ইরশাদ হচ্ছে : যে ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালা, তাঁর ফেরেশতাগণ, কিতাবাদি,রাসূলগণ ও পরকালের প্রতি অবিশ্বাস করে, সে পথভ্রষ্টতায় অনেক দূরে সরে পড়েছে। (সূরা নিসা, আয়াত: ১৩৬)
২. নামায: সালাত আত্মশুদ্ধি অর্জনের অনন্য মাধ্যম, যা বান্দার অপরাধ ও পাপ মোচন করে দেয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীগণ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘তোমাদের কারো বাড়ির সামনে যদি একটি নদী থাকে, আর সে যদি ওই নদীতে দৈনিক পাঁচবার গোসল করে, তার শরীরে কি কোনো ময়লা থাকতে পারে?’ তারা বললেন,না, ওই ব্যক্তির দেহে কোনো ময়লা থাকবে না। তিনি বললেন, ‘পাঁচ ওয়াক্ত সালাতও এরূপ। সালাত অপরাধ ও পাপ মোচন করে।’ (সহিহ বুখারী; সহিহ মুসলিম)
অনুরূপভাবে রোযা, যাকাত- সদকা ও হজ্ব পালনের মাধ্যমেও অন্তর পরিশুদ্ধ হয়। ইরশাদ হচ্ছে - ‘হে নবী! আপনি তাদের সম্পদ থেকে সদকা গ্রহণ করে তাদেরকে পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করুন।’(সূরা তাওবা, আয়াত:১০৩) ঈমানদারদের উপর রোযা ফরয করা হয়েছে তাকওয়া অর্জনের মানসে। (সূরা বাকারাহ, আয়াত: ১৮৩) অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে - ‘যে আল্লাহর উদ্দেশ্যে হজ্জ করলো, আর এতে সে কোনো ধরনের অশ্লীলতা ও পাপাচারে লিপ্ত হলো না, সে হজ্জ থেকে ফিরে আসবে ওই দিনের মতো যেদিন তার মা তাকে প্রসব করেছিলো।’ (সহিহ বুখারী; সহিহ মুসলিম; মিশকাত, হাদীস:২৩৮৪)
৩.ইস্তেগফার করা (তাওবা) : আল্লাহর হুকুম অমান্য বা সীমালঙ্ঘনকারী ব্যক্তি কর্তৃক চরম অনুশোচিত হয়ে আল্লাহর কাছে অপরাধ স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে বিনয়ের সাথে ক্ষমা প্রার্থনা করাই তাওবা বা ইস্তেগফার। আর তাওবার মাধ্যমেই কলবের রোগ দূরীভূত হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন , ‘বান্দা যখন কোনো অপরাধ করে, তখন তার অন্তরে একটি কালো দাগ পড়ে যায়। যদি সে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে তাওবা করে, তাহলে অন্তর পরিচ্ছন্ন হয়ে যায়।’ (জামে তিরমিযী) অন্যত্র ইরশাদ করেন, তামা ও লোহার ন্যায় অন্তরেও মরিচা পড়ে। এই মরিচা পরিষ্কার করার মাধ্যম হলো ইস্তিগফার তথা তাওবা করা। (আদ দুআ, তাবরানী, হাদীস: ১৭৯১; আল মু'জামুছ ছাগীর, তাবরানী, হাদীস: ৫০৯; আল মুজামুল আওসাত, হাদীস:৬৮৯৪) ইস্তিগফারের মাধ্যমে অন্তর পরিষ্কার হওয়ার মূল কারণ হলো- গুনাহের জন্য বান্দা যখন অনুতপ্ত হয়ে ইস্তিগফার করে, তখন লজ্জার কারণে অন্তরে আপনা আপনি নরমী ও কোমলতা সৃষ্টি হয় এবং আল্লাহর বড়ত্ব ও নিজের অপারগতা অনুভব হয়। এই অনুভূতি আত্মশুদ্ধির পথে অধিক কার্যকর কৌশল।
৪. পরকালকে ভয় করা : আত্মশুদ্ধি ছাড়া কিয়ামতের দিন কোনো কিছুই উপকারে আসবে না। সুতরাং পরকালের ভয় অন্তরে উপস্থিত রাখতে হবে। ইরশাদ হচ্ছে ,
يَوْمَ لَا يَنفَعُ مَالٌ وَلَا بَنُونَ إلا من أتى الله بقلب سليم
অর্থাৎ ‘আজ সম্পদ ও সন্তান কোনো উপকার করতে পারবে না, কেবল যে পরিশুদ্ধ আত্মা নিয়ে আল্লাহর কাছে আসবে।’ (সুরা শুআরা, আয়াত : ৮৮-৮৯)
৫. তাওয়াক্কুল : সর্বাবস্থায় কেবল আল্লাহর উপর নির্ভর হওয়াকে তাওয়াক্কুল বলে। তাওয়াক্কুল ছাড়া কলবকে সংশোধন করা সম্ভব নয়।
৬. আল্লাহর যিকির : কলবের যত ময়লা আবর্জনা আছে তা থেকে পাক সাফ করার অন্যতম মাধ্যম আল্লাহর যিকির। আর যিকিরে মানব হৃদয় প্রশান্ত ও নরম হয়। এতে আত্মা পরিশুদ্ধ হয়। ইরশাদ হচ্ছে-
أَلا بِذِكرِ اللَّهِ تَطْمَئِنُّ القُلُوبُ
অর্থাৎ‘জেনে রেখো! আল্লাহর যিকিরেই অন্তর প্রশান্ত হয়।’ (সুরা রা'দ, আয়াত : ২৮) এ ব্যাপারে দিক নির্দেশনা দিয়ে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘প্রত্যেক বস্তুকেই পরিষ্কার করার যন্ত্র আছে। আর আত্মাকে পরিষ্কার করার যন্ত্র হলো আল্লাহর যিকর। বস্তুত আল্লাহর আযাব থেকে রক্ষাকারী হিসাবে যিকরের চেয়ে অধিক প্রভাবশালী আর কোনো বস্তু নেই। (শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস: ৫১৯; কানযুল উম্মাল, হাদীস:১৭৭৭) অন্য বর্ণনায় এসেছে, যিকরুল্লাহ আত্মার রোগ মুক্তির মহৌষধ। (কানযুল উম্মাল, ১/২১২,হাদীস:১৭৫১)
৭. কুরআন তিলাওয়াত : এটি সর্বোত্তম নফল ইবাদত। ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম বলেন, কুরআন হলো দৈহিক, মানসিক, দুনিয়া ও আখিরাতের সকল ব্যাধির প্রতিকার। ইরশাদ হচ্ছে -'এটি মানুষের অন্তরের ব্যাধির জন্য নিরাময় এবং মুমিনদের জন্য হেদায়াত ও রহমত।’ (ইউনুস: ৫৭) কুরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে বান্দার সাথে আল্লাহ পাকের কথোপকন হয় এবং তার মানবিক গুণাবলি বৃদ্ধি পায়।
৮. সুন্নাহর অনুসরণ : সুন্নাতে রাসূলের অনুসরণের মাধ্যমে বান্দা নিজ আত্মাকে পরিশুদ্ধ করতে পারে। তাই মুসলমান মাত্রই সুন্নাহর অনুসরণ করা সকলের জন্য জরুরি।
৯. অন্তরের পবিত্রতার জন্য দোয়া করা : অন্তরের পবিত্রতা ও পরিশুদ্ধির জন্য এবং আল্লাহর বিধান পালনে দৃঢ়তার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করা আবশ্যক। হুযূর পুরনূর সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দোয়া করতেন,
اللَّهُمَّ آتِ نَفْسِي تَقْوَاهَا وَزَكِّهَا أَنْتَ خَيْرُ مَنْ زَكَّاهَا
‘হে আল্লাহ! আমার নাফসকে তাকওয়া দাও; তাকে তুমি পরিশুদ্ধ করে দাও। তুমি সর্বোত্তম পরিশুদ্ধকারী।’ (সহিহ মুসলিম; মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ১৭১১৪) অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে -
‘হে অন্তর পরিবর্তনকারী! আমার অন্তরকে আপনার আনুগত্যে দৃঢ় করে দেন।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ৯৪২০)
১০.অসহায় মানুষের পাশে থাকা : একদা এক ব্যক্তি রাসূলে আকরম সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে তার অন্তরের কঠোরতা সম্পর্কে অভিযোগ করল। রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, ‘যখন তুমি তোমার অন্তরকে নরম করার ইচ্ছা করবে তখন এতিমের মাথায় হাত বোলাবে এবং মিসকিনকে খানা খাওয়াবে।’ (মুসনাদ আহমদ, হাদিস : ৯০১৮)
১১.সবর করা : সবর অর্থ হল ধৈর্য বা অটলতা। মুমিন মাত্রই বিপদে-আপদে, সুখে-দুঃখে, ক্ষুধা- তৃষ্ণায়, অত্যাচার-অবিচার সর্বাবস্থায় ধৈর্যধারণ করে এক আল্লাহর ইবাদত বন্দেগিতে মগ্ন থাকা এবং আল্লাহ ও তার রাসুলের পথ অনুসরণ করবে।
১২. কলুষিত আত্মার পরিণতি স্মরণ রাখা : হুযূর সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কলুষিত আত্মার পরিণতির ব্যাপারে সতর্ক করে ইরশাদ করেন, ‘সাবধান! নিশ্চয়ই মানবদেহে একখণ্ড গোশতের টুকরো আছে, যখন তা সুস্থ হয়ে যায় গোটা শরীরটাই সুস্থ হয়ে যায় এবং যখন তা অসুস্থ হয়ে যায় গোটা শরীরই অসুস্থ হয়ে যায়। জেনে রেখো! এটাই হচ্ছে কলব।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৪১৭৮)
১৩. পশুবৃত্তিক চরিত্র বর্জন : আত্মশুদ্ধি অর্জনের জন্য গিবত করা, মিথ্যা বলা, অপবাদ দেওয়া, উপহাস করা, সুদ খাওয়া, ঘুষ খাওয়া, ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়া প্রভৃতি জঘন্য পশুবৃত্তিক চরিত্র থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা আত্মসংশোধনের অন্যতম পন্থা।
১৪. কবর জিয়ারত ও মৃত্যুর স্মরণ : কবর জিয়ারত ও মৃত্যুর স্মরণের মাধ্যমে মানুষের অন্তর আল্লাহমুখী হয়। রাসূলে আরবি সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘ইতোপূর্বে আমি তোমাদেরকে কবর জিয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম, এখন তোমরা তা জিয়ারত করো। কেননা নিশ্চয়ই তা আখিরাতকে স্মরণ করিয়ে দেয় এবং অন্তরের উন্নতি ঘটায়।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ২৩০০৫)
১৫. অন্তরের কঠোরতা পরিহার : কোরআনুল করিমে আল্লাহ তাআলা একাধিক স্থানে কঠোর হৃদয়ের নিন্দা করেছেন। ইরশাদ হচ্ছে ‘... দুর্ভোগ সে কঠোর হৃদয় ব্যক্তিদের জন্য যারা আল্লাহর যিকির হতে বিমুখ। তারা স্পষ্টত বিভ্রান্তিতে রয়েছে।’ (সুরা জুমার, আয়াত : ২২)
১৬.দৃষ্টিকে সংযত রাখা : ইরশাদ হচ্ছে -
قُل لِّلْمُؤْمِنِينَ يَغُضُّوا مِنْ أَبْصَارِهِمْ وَيَحْفَظُوا فُرُوجَهُمْ ۚ ذَٰلِكَ أَزْكَىٰ لَهُمْ ۗ
‘ হে হাবীব! আপনি মুমিনদের বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখে এবং লজ্জাস্থানের হিফাজত করে। এটি তাদের পরিশুদ্ধতার জন্য অধিক কার্যকরী।’ (সূরা নূর, আয়াত:৩০) ইমাম ইবনুল কাইয়্যুম বলেন,অধিকাংশ পাপের সুতিকাগার হচ্ছে অপ্রয়োজনীয় কথা ও দৃষ্টি। এ দুটি শয়তানের প্রবেশদ্বার।
১৭. নেককারদের সুহবত: তাযকিয়া বা আত্মশুদ্ধির জন্য আল্লাহ ওয়ালাদের সুহবত অসাধারণ ক্রিয়া করে থাকে। আকীদা ও জাহেরী আমল দুরস্ত হয়। অন্তরে এক নতুন অবস্থা অনুভূত হয়, যা ইতিপূর্বে ছিলো না। যে অবস্থার প্রতিক্রিয়া এই যে, প্রতিনিয়ত ইবাদতের প্রতি আগ্রহ, গুনাহের প্রতি ঘৃণা ও আকীদা-বিশ্বাসের দৃঢ়তা বৃদ্ধি পায়। তাই আল্লাহ ওয়ালাদের সুহবত গ্রহণের নির্দেশ দিয়ে মহান আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَكُونُوا مَعَ الصَّادِقِينَ
‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যবাদীদের সাথে থাকো। (সূরা তাওবা,আয়াত:১১৯) আত্মশুদ্ধি কেবল কিতাব মুতালাআ ও জ্ঞানের বিশাল ভান্ডার সঞ্চয় করার দ্বারা অর্জিত হয় না। বরং এর জন্য প্রয়োজন আল্লাহর মারেফত প্রাপ্ত ও নৈকট্য লাভকারী সাধকদের সুহবত ও তাঁদের পরামর্শ মতে জীবন পরিচালনা করা। মানুষ যেভাবে দৈহিক রোগ-ব্যধির সুচিকৎসার জন্য অভিজ্ঞ ও দক্ষ ডাক্তার খোঁজে বের করে নিজেকে তার নিকট সোপর্দ করে দেয় এবং তার প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী চলে ও বিধি-নিষেধ পুরোপুরি মেনে আরোগ্য লাভ করে; ঠিক তেমনি আত্মিক রোগ-ব্যধির সুচিকিৎসার জন্যও অভিজ্ঞ ডাক্তার খোঁজা উচিত। অন্তরের ভিতর লুক্কায়িত সুক্ষ রোগ-ব্যধির চিকিৎসা নিজে নিজে কোনো ব্যক্তি করতে পারে না। নফস ও শয়তানের ধোঁকা এত সুক্ষ যে, মানুষ নিজে তা বুঝতে পারে না। অনেক সময় এমনও হয় যে, সে যেটাকে ইবাদত মনে করছে সেটাই তার দ্বীনি তরক্কী ও উন্নতির পথে প্রধান অন্তরায়। এ জাতীয় রোগ-ব্যধি কেবল একজন হক্কানী ও কামিল পীরই ধরতে পারে এবং তার সুচিকিৎসা দিতে পারে।
কামেল পীরের পরিচয় : আল্লামা শাহ ওলী উল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী, আল্লামা কাজী সানা উল্লাহ পানিপথী ও আলা হযরত ইমাম আহমদ রেজা খান রহমাতুল্লাহি আলাইহিম কামেল পীর হওয়ার জন্য কিছু শর্তারোপ করেছেন, সর্বমোট ১৫টি, যা নিম্নরূপ- (১)সহিহ আক্বিদা (আক্বীদায়ে আহলে সুন্নাহ) সম্পন্ন হওয়া, (২) তাফসির, হাদীস, ফিক্বহ শাস্ত্রে বিজ্ঞ হওয়া (কমপক্ষে তাফসিরে জালালাইন অথবা তাফসিরে মাদারেক, হাদীস শাস্ত্রে কমপক্ষে মিশকাত অথবা তার সমপরিমাণ কোন হাদীসের কিতাব শুরু থেকে শেষ পযর্ন্ত শরীয়ত সম্মত আলেমের নিকট ভালোভাবে বুঝে পড়ে আয়ত্ব করা, ফিক্বহ শাস্ত্রের ইবাদাত ও মোয়ামেলাত এর মৌলিক ২০ প্রকার ইলম যথা-আকাইদ,ত্বাহারাত, নামাজ,যাকাত, রোজা,হজ্ব, তেলাওয়াতে কোরআন, যিকির ও দোয়া,তারতীবুল আওরাদ, পানাহার,নিকাহ, রোজগার, হালাল-হারাম, সফর,পিতা-মাতা ও সন্তানের হক্ব, আত্বীয়-স্বজনের হক্ব, পীর ও মুরীদের হক্ব, ইয়াতীম,মিসকীন, প্রতিবেশী,পথিক, ধনী- গরীব, রাজা-প্রজা প্রভৃতির হক্বসহ সকল প্রকার মাসায়েলে আবশ্যক পরিমাণ জ্ঞানার্জন করা), (৩)মুত্তাকি- পরহেজগার হওয়া (ফাসিক্ব না হওয়া), (৪) দুনিয়া বিমুখ ও আখেরাতমুখী হওয়া, (৫) ইবাদত-বন্দেগী ও যিকির-আযকারে মাশগুল থাকা, (৬) উত্তম চরিত্রবান, (৭) আরবি সাহিত্য, আরবি ব্যাকরণ, মানতিক প্রভৃতি শাস্ত্রে পারদর্শী হওয়া, (৮) তাছাউফের কিতাব সমূহ ভালভাবে পড়ে দীক্ষা নেয়া, (৯) সৎ কাজে আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধকারী হওয়া,(১০)ন্যায়-পরায়ণ হওয়া(১১)স্বাধীনচেতা হওয়া,(১২) সহিহ সিলসিলা, যা সংশ্লিষ্ট মুরশিদ থেকে আরম্ভ করে যোগ্য ও পরহেযগার বুযুর্গদের মাধ্যমে হুযূর আকরম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত পৌছে, মাঝখানে যেন কোন অযোগ্য ও বাতিল আক্বীদার লোক পড়ে ওই কর্তিত হয়ে না যায়, (১৩) দীর্ঘদিন কামেল পীরের সঙ্গ লাভ করা,(১৪) কামেল মোর্শেদের সঙ্গ লাভ করে আত্মশুদ্ধি করে কামালিয়্যাতের নুর এবং ফয়েজে পরিপূর্ণতা অর্জন করা, (১৫) শায়েখের অনুমতি প্রাপ্ত হওয়া। (আল কওলিল জামীল, পৃ: ১৩; ইরশাদুত তালিবীন পৃ: ২৬৩; ইরশাদাত-ই আলা হযরত; কাসদুস সাবিল)
কামিল পীর হওয়ার জন্য অলৌকিক কোনো কিছু প্রকাশ পাওয়া জরুরী নয়, যার মাঝে উপরোক্ত আলামতগুলো পাওয়া যাবে তিনি একজন শায়খে কামিল ও হক্কানী পীর। তাঁর থেকে কোনো কারামত বা অলৌকিক ঘটনা প্রকাশ পায় কিনা, তাঁর কাশফ হয় কি না, অথবা তিনি দুআ করলে কবূল হয় কি না, আধ্যাতিক শক্তি দ্বারা কোনো কিছু করতে পারে কি না? ইত্যাদি তালাশ করার প্রয়োজন নেই। কারণ কামিল পীর বা ওলী হওয়ার জন্য এগুলো থাকা জরুরী নয়। মূলত এসব কর্মকান্ড নফসের সাথে সম্পৃক্ত। যা সাধনা করলে বৃদ্ধি পায়। সাধনা করলে যে কারো দ্বারাই এ ধরনের কর্মকান্ড প্রকাশ পেতে পারে। একজন কাফেরের দ্বারাও প্রকাশ পেতে পারে। [ কাসদুস সাবীল ও তালীমুদ্দীন:৮০১-৮০২, ৪৫৬পৃ:]
মুমিনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো আত্মশুদ্ধির জন্য সক্রিয় হওয়া। ইমাম ইবনে কাসীর বলেন, যে ব্যক্তি আত্মাকে পরিশুদ্ধ করবে আল্লাহ তাকে অনুগ্রহ করবেন ও সম্মান দিবেন। যদি বান্দার ওপর আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়া না থাকতো তাহলে কেউ পরিশুদ্ধি অর্জন করতে পারতে না।’ আখিরাতে জান্নাত তো তাদের পুরস্কার যারা নিজকে সংশোধন করতে পেরেছে। ইরশাদ হচ্ছে
وَمَنْ يَأْتِهِ مُؤْمِنًا قَدْ عَمِلَ الصَّالِحَاتِ فَأُولَئِكَ لَهُمُ الدَّرَجَاتُ الْعُلَى
جَنَّاتُ عَدْنٍ تَجْرِي مِن تَحْتِهَا الأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا وَذَلِكَ جَزَاء مَن تَزَكَّى
‘যারা মুমিন হয়ে ও নেক কাজ নিয়ে তাঁর কাছে আসবে, তারা হচ্ছে সেসব লোক যাদের জন্য রয়েছে সমুচ্চ মর্যাদা। আর সে মর্যাদা হলো এমন স্থায়ী জান্নাত যার পাশ দিয়ে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত হবে। সেখানে তারা থাকবে চিরকাল। এ হচ্ছে সে ব্যক্তির পুরস্কার যে নিজকে পরিশুদ্ধ রেখেছে।’ (সূরা ত্বা-হা: ৭৫-৭৬) আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে অন্তর পরিশুদ্ধ করার তওফিক দান করুক, আমিন বিহুরমাতি সৈয়্যদিল মুরসালিন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম!
প্রবন্ধটির মাসিক তরজুমান লিংক
http://www.anjumantrust.org/2020/11/24/%e0%a6%86%e0%a6%a4%e0%a7%8d%e0%a6%ae%e0%a6%b6%e0%a7%81%e0%a6%a6%e0%a7%8d%e0%a6%a7%e0%a6%bf-%e0%a6%85%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%9c%e0%a6%a8%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%97%e0%a7%81%e0%a6%b0%e0%a7%81%e0%a6%a4/
কোন মন্তব্য নেই