ইনসাফ ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় আমাদের করণীয়
মুহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মাসুম
সংঘাতপূর্ণ মানব সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে মহান আল্লাহ তায়ালার প্রদর্শিত ও তাঁর হাবীবের অনুসৃত পথ ও মত অনুসরণ করতে হবে। এক আল্লাহর বিশ্বাস, তিনি জগতের সৃষ্টিকর্তা ও তিনি ইবাদতের মালিক এ কথা মেনে চলতে হবে। ইরশাদ হচ্ছে-‘আল্লাহ কি বিচারকদের সর্বোচ্চ বিচারক নয়?’ বিচার দিনের মালিক মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পৃথিবীতে মানুষের মাঝে বিচার ফয়সালার দায়িত্ব দিয়ে কিতাব সহকারে হযরত নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রেরণ করেছেন। ইরশাদ হচ্ছে-‘আমি আপনাকে কিতাব সহকারে প্রেরণ করেছি এ জন্য যে, আপনি মানুষের মাঝে সত্যিকার বিচার করবেন, আল্লাহ যেভাবে দেখিয়ে দিয়েছেন ঠিক সেভাবে। আর আপনি খিয়ানতকারীদের পক্ষে বাদানুবাদ করতে যাবেন না। সুরা নিসা, আয়াত: ১০৫।
পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিচারক, রাসূলুল্লাহ দুষ্টের দমন ও শিষ্টের লালনে সঠিক পন্থা অবলম্বন করে যে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করেছেন, তার নজির পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। প্রিয় নবী কীভাবে ইনসাফ ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে হয়,তা হাতে কলমে শিখিয়েছেন । তিনি নিজের কারণে কখনো কাউকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাননি। নিজের কারণে কারো থেকে প্রতিশোধ কখনো নেননি। কেবল জনগণের জন্যই অপরাধীর উপর দণ্ড কার্যকর করেছেন।
জয়নাব বিনতে হারিস নামক খাইবারের ইহুদী মহিলা নবীজিকে হত্যা করার মানসে ছাগল ভুনা করে বিষ মিশ্রিত করে তাঁর নিকট হাদিয়া পাঠিয়েছিল। সাথে সাথে এ বিষের ক্রিয়া তিনি এবং অন্যরা টের পেলেন। সাহাবীরা তরবারি উঁচিয়ে মহিলার দিকে ধেয়ে আসলে নূর নবী মহিলাকে রক্ষা করেন। তাকে মাফ করে দেন। তাকে কোন শাস্তি দিলেন না। পরবর্তীতে যখন বিশর ইবনে বারা নামক সাহাবী বিষক্রিয়ায় মারা পড়লেন, তখন এ মৃত্যুর বদলে নবী স. সে মহিলাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন। কিন্তু এর আগে তিনি নিজের জন্য এ মহিলাকে কোন শাস্তি দিলেন না।
আমরা যদি প্রিয় নবীর হাতে গড়া ইসলামী প্রজাতন্ত্র মদীনাতুর রাসূলের দিকে অবলোকন করি তবে বলা যায় শান্তি প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত- জাতি, ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। সমাজে ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠা করতে হলে আমাদের কিছু করণীয় রয়েছে। যথা-
১. ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া: ভ্রাতৃত্ব হচ্ছে ফুল ও পল্লবে শোভিত এক বরকতপূর্ণ বৃক্ষ, নানাভাবে নিরবধি যা ফলদায়ক। ভ্রাতৃত্বের মৌল ভিত্তি হচ্ছে আল্লাহর উদ্দেশ্যে ভালোবাসা। ইরশাদ হচ্ছেঃ “তোমরা সকলে আল্লাহর রজ্জু দৃঢ়ভাবে ধরো এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না। তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ করো : তোমরা ছিলে পরস্পর শত্রু এবং তিনি তোমাদের হৃদয়ে প্রীতির সঞ্চার করেন, ফলে তার অনুগ্রহে তোমরা পরস্পর ভাই হয়ে গেলে।” [সূরা আলে ইমরান : ১০৩] রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের অবগত করেছেন এই বলে-সে সত্তার শপথ, যার হাতে আমার প্রাণ! তোমাদের কেউ ততক্ষণ মোমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে যে-কল্যাণ নিজের জন্য পছন্দ করে, তার অপর ভাইয়ের জন্যও তা পছন্দ করে। (বুখারী, মুসলিম)
২. প্রতিপক্ষের প্রতি সম্মান ও দয়া প্রদর্শন করা: বিতর্ক করা হবে সত্য প্রকাশ ও মানুষের প্রতি দয়া-মমতার জন্য। প্রতিপক্ষকে হীন করার উদ্দেশ্যে কিংবা মুর্খ বলার জন্য নয়। মহান আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন, ‘‘আর রাহমানের বান্দা তারাই যারা জমিনে নম্রভাবে চলাফেরা করে এবং অজ্ঞ লোকেরা যখন তাদের সম্বোধন করে তখন বলে ‘সালাম।’’ [সূরা ফুরকান : ৬৩] তাই নবীজিকে হত্যার জন্য হাজার বার যারা চেষ্টা করেছিল বরাবরই তাদের সবাইকে তিনি ক্ষমা করে দিয়ে প্রতিপক্ষের সাথে আচরণের বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
৩. কারো ওপর জুলুম না করা: যার যা প্রাপ্য তাকে তা না দেয়া হলো জুলুম। এটা ব্যক্তির সম্পদ আত্মসাৎ, শারীরিক আক্রমণ বা সম্মানহানির মাধ্যমেও হতে পারে। যা ইসলামের দৃষ্টিতে মস্ত বড় অন্যায় বলে বিবেচিত। আল্লাহর হক আদায় না করলে আল্লাহ ক্ষমা করলেও বান্দার হক বিনষ্টকারীকে আল্লাহ কখনও ক্ষমা করবেন না যতক্ষণ না যার ওপর জুলুম করা হয়েছে, সে ক্ষমা করে দেয়। হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ তা’আলা বলেন, “হে আমার বান্দা, আমি নিজের ওপর জুলুম হারাম করেছি এবং তোমাদের জন্যও একে হারাম করেছি। অতএব তোমরা একে অপরের ওপর জুলুম করো না।’’ [মুসলিম : ৬৭৪০]
৪.সৎ কাজের আদেশ করা ও অসৎ কাজের নিষেধ করা : এটা সংস্কার ও সংশোধনের বিশাল মাধ্যম। এর মাধ্যমে সত্যের জয় হয় এবং মিথ্যা ও বাতিল পরাভূত হয়। যে ব্যাক্তি আন্তরিকতা ও সততার সাথে এ দায়িত্ব পালন করে তার জন্য রয়েছে মহা পুরস্কার ও মর্যাদাপূর্ণ পারিতোষিক। ইরশাদ হচ্ছে, “আর তোমাদের মধ্যে এমন একটা দল থাকা উচিত, যারা সৎকাজের প্রতি আহ্বান করবে, নির্দেশ করবে ভালো কাজের এবং বারণ করবে অন্যায় কাজ থেকে। আর তারাই হলো সফলকাম।” [সূরা আলে ইমরান : ১০৪]
৫. ইনসাফ করা : ইসলামের পরিভাষায় কোনো বস্তু তার হকদারদের মধ্যে এমনভাবে বণ্টন করে দেয়া যাতে কারও ভাগে বিন্দুমাত্র কম বেশি না হয়। বসুন্ধরার বুকে ইনসাফ ও ন্যায়বিচার কায়েম নিয়ে আসে নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা ও শান্তির ফল্গুধারা। ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক জিন্দেগীর সকল পর্যায়ে ইনসাফ ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাকে ইসলাম সমধিক গুরুত্ব প্রদান করেছে। এমনকি মুসলমানদের সাথে কাফিরদের লেনদেন ও সম্পর্কের ক্ষেত্রেও ইনসাফের নীতিতে অবিচল থাকতে হবে। ইরশাদ হচ্ছে, “হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর জন্য ন্যায়ের সাথে সাক্ষ্যদানকারী হিসেবে সদা দণ্ডায়মান হও। কোনো সম্প্রদায়ের প্রতি শত্রুতা যেন তোমাদেরকে কোনোভাবে প্ররোচিত না করে যে, তোমরা ইনসাফ করবে। তোমরা ইনসাফ কর, তা তাকওয়ার নিকটতর এবং আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় তোমরা যা কর, আল্লাহ সে বিষয়ে সবিশেষ অবহিত।” [সূরা আল-মায়েদা : ৮]
৬. দ্বীনী শিক্ষা অর্জন ও প্রচার-প্রসার : দুনিয়ার নিযাম ও ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখার জন্য যেমন জাগতিক শিক্ষার প্রয়োজন তেমনি দ্বীনের হিফাজতের জন্য এবং দুনিয়ার সকল কাজ আল্লাহর সন্তুষ্টি মোতাবেক করার জন্য দ্বীনী শিক্ষার প্রয়োজন। কুরআন-সুন্নাহর চর্চা ও অনুসরণের অভাব হলে সমাজের সকল অঙ্গনে দুর্নীতি ও অনাচার দেখা দেয়। দেখা দেয় অশান্তি। শিক্ষিত মানুষ পথভ্রষ্ট হয়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে সমাজ যতই উন্নতি লাভ করুক ঈমান ও আল্লাহভীতি না থাকলে তা মানুষের ক্ষতি ও অকল্যাণে ব্যবহৃত হয়। মানুষের সকল আবিষ্কারকে অর্থপূর্ণ ও কল্যাণমুখী করার জন্যই অপরিহার্য প্রয়োজন ইলমে ওহীর চর্চা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘আল্লাহ তা’আলা যাকে প্রভূত কল্যাণ দিতে চান তাকে দ্বীনের প্রজ্ঞা দান করেন।’’ [সহীহ বুখারী ১/১৬]
৭. আল্লাহর জন্য বন্ধুত্ব এবং আল্লাহর জন্য শত্রুতা পোষণ করা : শত্রু-মিত্রের বিচার না করে সব মানুষ যদি সঠিক পথের অনুসারী হতো তবে হক্ব-বাতিল, ঈমান-কুফর, আল্লাহর বন্ধু এবং শয়তানের বন্ধুর মাঝে কোনো পার্থক্য যুগ যুগ ধরে চলে আসত না’’। তাই বন্ধু নির্বাচন ও শত্রুতা পোষণ আল্লাহর জন্য হওয়া উচিত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “ঈমানের অধিকতর নিরাপদ বন্ধন হলো আল্লাহর জন্য বন্ধুত্ব এবং আল্লাহর জন্য শত্রুতা। [আবূ দাউদ : ৪৫৯৯]
৮. জবাবদিহিতার মানসিকতা থাকা :মানুষকে নিজ নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য অত্যন্ত সুষ্ঠু ও স্বচ্ছতার সঙ্গে যথাযথভাবে পালন করতে হবে। বিভিন্ন কাজকর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের প্রকাশের উপযুক্ত তত্ত্ব-তথ্য, আয়-ব্যয়, হিসাব-নিকাশ ও লেনদেনকে সুস্পষ্টভাবে জানার জন্য উন্মুুক্ত করাই হলো স্বচ্ছতা। ইহকালীন ও পারলৌকিক উভয় জগতে জবাবদিহিতা রয়েছে। ইরশাদ হচ্ছেঃ ‘অনন্তর যে ব্যক্তি স্বীয় প্রতিপালকের সামনে দণ্ডায়মান হওয়াকে (জবাবদিহি) ভয় করে এবং প্রবৃত্তি থেকে নিজেকে বিরত রাখে, জান্নাতই হবে তার আবাস।’’ [সূরা নাজিয়াত : ৪০]
সমাজে অরাজকতা, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের কয়েকটি মূল কারণ রয়েছে:
(১) সাম্রাজ্যবাদী নিপীড়ন, আগ্রাসন ও ষড়যন্ত্র,
(২) বেকারত্ব ও হতাশা
(৩) অপরাধ নিয়ন্ত্রণের নামে নিরপরাধের শাস্তি
(৪) জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণের নামে ইসলামী দাওয়াতের কণ্ঠরুদ্ধ
সাম্রাজ্যবাদী নিপীড়ন, আগ্রাসন ও ষড়যন্ত্রঃ যতদিন এরূপ আগ্রাসন, নিপীড়ন ও ষড়যন্ত্র থাকবে ততদিন যে কোনো দেশে কিছু মানুষ অজ্ঞতা ও আবেগের প্রেষণে উগ্রতায় লিপ্ত হয়ে যেতে পারেন। এরূপ সম্ভাবনা একেবারে রহিত করা যায় না। অনুরূপভাবে যে মুসলিম দেশের ভৌগলিক বা অর্থনৈতিক গুরুত্ব আছে সে দেশে আধিপত্য বিস্তার করতে বা সে দেশের সরকারকে ছাড় দিতে বাধ্য করতে কিছু ‘‘জঙ্গি’’ তৈরি করা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির জন্য অত্যন্ত সহজ ও কার্যকরী পন্থা। তবে আমরা বাকি তিনটি কারণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে প্রথম কারণটিও নিয়ন্ত্রিত হয়ে যাবে।
বেকারত্ব ও হতাশাঃ বেকারত্ব, বঞ্চনা ও হতাশার পাশাপাশি জ্ঞানহীন আবেগ চরমপন্থা ও জঙ্গি কর্মকান্ডের জন্ম দেয়। আমাদের সমাজে যারা সর্বহারার রাজত্বের জন্য বা ইসলামী রাজত্বের জন্য সহিংসতায় লিপ্ত তাদের প্রায় সকলের জীবনেই এ বিষয়টি পরিলক্ষিত হয়। অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত বা শিক্ষিত বেকার যুবককে কেউ বুঝিয়েছে, এরূপ সহিংসতার মাধ্যমে অতি তাড়াতাড়িই তোমার ও অন্যদের কষ্ট ও বঞ্চনার সমাপ্তি ঘটবে এবং সর্বহারার রাজত্ব বা ইসলামী রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। তুমি ক্ষমতা ও কর্ম অথবা জান্নাত লাভ করবে। হতাশগ্রস্থ যুবকরা সহজেই এ কথা বিশ্বাস করে এ সকল কর্মে লিপ্ত হয়। কারণ তার অন্য কোনো কর্ম নেই এবং তার পাওয়ার আশার বিপরীতে হারানোর তেমন কিছই নেই।
বেকারত্ব, সামাজিক অবহেলা, ন্যায় বিচারের দুর্লভতা, বঞ্চনা ও অজ্ঞতা দূর না করে শক্তি বা আইন দিয়ে কঠোর হস্তে ‘‘জঙ্গি’’ নির্মূলের চেষ্টা করলে জাতির ক্ষতি হবে। এতে এদেশের অনেক সন্তান ‘‘নির্মূল’’ হলেও ‘‘জঙ্গিবাদ’’ নির্মূল হবে না। যারা চরমপন্থা বা জঙ্গি কর্মকান্ডে লিপ্ত তারা আমাদের সামাজিক বঞ্চনা ও অবিচারের শিকার। তাদেরকে শত্রু বিবেচনা করে নির্মুল করার চেয়ে নাগরিক ও দেশের সন্তান বিবেচনা করে যথাসম্ভব সংশোধন করে সমাজের মূলধারায় সংযুক্ত করাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। বিশেষত যারা হত্যা বা অনুরূপ অপরাধে জড়িত হয় নি এরূপ যুবকদের সংশোধনের জন্য সচেষ্ট হতে হবে।
সরকার ও প্রশাসনের দায়িত্ব পিতৃত্বের বা অভিভাবকের দায়িত্ব নিয়ে সকল নাগরিকের অধিকার রক্ষায় সচেষ্ট হওয়া। প্রকৃত অপরাধীর শাস্তি প্রদান এবং নিরপরাধকে শাস্তি থেকে রক্ষার পাশাপাশি কম অপরাধীকে সংশোধনের সুযোগ দেওয়া তাদের কর্তব্য। বিভিন্ন হাদীসে রাসূলুল্লাহ ইরশাদ করেন, ইনসাফ, বৈষম্যহীন ন্যায়বিচার ও নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট শাসক ও প্রশাসকগণ আল্লাহর সর্বোচ্চ দয়া ও পুরস্কার লাভ করবেন।
অপরাধ নিয়ন্ত্রণের নামে নিরপরাধের শাস্তিঃ
জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে বড় ভয়ঙ্কর দিক হলো নিরপরাধের শাস্তি। জঙ্গিবাদ দমনের নামে শুধু সন্দেহের ভিত্তিতে নিরপরাধ মাদ্রাসা ছাত্র বা ধার্মিক মানুষদেরকে আটক, জিজ্ঞাসাবাদ, কারাগারের অন্তরীন রাখা, রিমান্ডে নেওয়া ইত্যাদি কর্ম একদিকে মানবাধিকার ভূলণ্ঠিত করবে, এ সকল নিরপরাধ মানুষ ও তাদের আপনজনদেরকে জঙ্গিবাদের প্রতি আকৃষ্ট করবে এবং সর্বোপরি আমাদেরকে আল্লাহর গযব ও শাস্তির মধ্যে নিপতিত করবে। কারণ নিরপরাধের শাস্তি ও বিচারবহির্ভুত হত্যা, শাস্তি ও কষ্টদান যখন রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক রূপ প্ররিগ্রহণ করে তখন আল্লাহর গযব ও জাগতিক শাস্তি সে দেশের ভাল ও মন্দ সকল মানুষকে গ্রাস করে।
জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণের নামে ইসলামী দাওয়াতের কণ্ঠরুদ্ধকরণঃ
আরো বেশি ভয়ঙ্কর বিষয় জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণের নামে ইসলামী দাওয়াতের কণ্ঠরুদ্ধ করা। মাওবাদী সন্ত্রাসীগণ বা আমাদের দেশের চরমপন্থী বলে কথিত ‘‘বামপন্থী জঙ্গিগণ’’ যে মতাদর্শ ও দাবি দাওয়া প্রচার করেন মূলধারার মার্কসবাদী, সাম্যবাদী, সমাজতন্ত্রী বা বামপন্থীগণও একই মতাদর্শ ও দাবিদাওয়া প্রচার করেন। অনুরূপভাবে ইসলামের নামে উগ্রতায় লিপ্ত বা জঙ্গিবাদীরা যে সকল মতাদর্শ ও দাবি দাওয়া পেশ করেন প্রায় একইরূপ মতাদর্শ ও দাবি দাওয়া প্রচার করেন মূলধারার ইসলমী রাজনীতিবিদ, আলিম, শিক্ষাবিদ, চিন্তাবিদ ও পীর-মাশাইখগণ। পার্থক্য হলো কর্মপদ্ধতিতে। চরমপন্থী ও জঙ্গিরা বলপ্রয়োগ, আইন অমান্য ও খুন-খারাপির মাধ্যমে তাদের আদর্শ চাপিয়ে দিতে চান। পক্ষান্তরে মূলধারার মানুষেরা দেশের আইনের আওতায় গণতান্ত্রিক অধিকারের মধ্যে নিজেদের দাবি-দাওয়া পেশ করেন। গ্রহণ করা বা না করা জনগণের ইচ্ছাধীন।
সাম্যবাদী জঙ্গি বা সমাজতন্ত্রী সন্ত্রাসীদের কারণে কেউ মূলধারার সাম্যবাদী বা সমাজতন্ত্রীদেরকে দায়ী করেন না বা ‘‘চরমপন্থা’’ দমনের নামে বামপন্থী রাজনীতি ও কর্মকান্ড নিষিদ্ধ করার দাবি তোলেন না। কেউ বলেন না যে, সাম্যবাদী রাজনীতির কারণেই চরমপন্থী ও সন্ত্রাসী জন্ম নিচ্ছে; কাজেই সাম্যবাদী রাজনীতি বন্ধ করা হোক। কিন্তু ইসলামের ক্ষেত্রে অনেক সময় বিষয়টি সম্পূর্ণ বিপরীত হয়ে যায়। জঙ্গিবাদ দমনের অযুহাতে অনেক সময় ইসলামী রাজনীতি, ইসলামী আইন ও বিচার প্রতিষ্ঠার দাবি বা ইসলামী মূল্যবোধ বিকাশের দাবি বন্ধ করার চেষ্টা করা হয়।
অনেক সময় ‘‘ধর্মনিরপেক্ষতার’’ নামে বা ‘‘জঙ্গি’’ নির্মূল করার নামে ‘‘ইসলামী রাজনীতি’’ বা ইসলামী মূল্যবোধ প্রসারমূলক কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রণের দাবি করা হয়। অথচ ধর্মনিরপেক্ষতার মূল দাবী হলো সকল ধর্মের মানুষকে তার ধর্ম পালন ও ধর্মের বিষয়ে তার নিজের ব্যাখ্যা ও মতবাদ প্রচারের সুযোগ দেওয়া। গ্রহণ করা বা না করা জনগণের ইচ্ছা। গণতান্ত্রিক অধিকারের আওতায় মতপ্রকাশের অধিকার দিলে উগ্রতার পথ রুদ্ধ হয়। অতীতে কোনোকোনো দেশে সমাজতান্ত্রিক রাজনীতি নিষেধ করার ফলে সমাজতান্ত্রিক জঙ্গিবাদের উন্মেষ ঘটে। পরবর্তীতে মূলধারায় সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির সুযোগ দেওয়ার ফলে ‘‘সর্বহারার রাজত্বের’’ জন্য বা সাম্যবাদের নামে সন্ত্রাস ক্রমান্বয়ে কমে যায়।
বস্তুত, গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় এক দল আরেক দলের বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করতে পারেন। যারা ইসলামী মূল্যবোধ, আখলাক-আচরণ, শিক্ষা ইত্যাদি সবকিছুকেই ‘‘আফিম’’, ‘‘প্রতিক্রিয়াশীলতা’’ বা উন্নয়নের প্রতিবন্ধক বলে বিশ্বাস করেন, অথবা তাদের বাণিজ্যিক, সাম্রাজ্যবাদী বা অনুরূপ স্বার্থের প্রতিবন্ধক বলে মনে করেন তারা জঙ্গিবাদের অযুহাতে ইসলামী শিক্ষা ও মূল্যবোধ বিস্তারের বা ইসলামী আদর্শ বিস্তারের সকল কর্ম নিষিদ্ধ করার দাবি করতে পারেন। মত প্রকাশের অধিকার তাদের আছে।
অনুরূপভাবে ‘‘ইসলামপন্থীরা’’ চরমপন্থা নির্মূল বা অনুরূপ কোনো অযুহাতে সাম্যবাদী বা সমাজতন্ত্রী আদর্শ প্রচার নিষিদ্ধ করার দাবি করতে পারেন। মত প্রকাশের অধিকার তাদের আছে। তবে সরকার ও প্রশাসনকে অত্যন্ত সতর্ক হতে হবে। তাদের নিজস্ব কোনো মত বা পক্ষ থাকলেও সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পর তাদের দায়িত্ব হয় সকলের অধিকার রক্ষা করা এবং দেশের স্বার্থ সমুন্নত রাখা। আমাদের বুঝতে হবে যে, ভাল বা মন্দ কোনো কথারই ‘‘কণ্ঠ’’ রুদ্ধ করার প্রবণতা কখনোই ভাল ফল দেয় না। বিশেষত জঙ্গিবাদের নামে ইসলামী রাজনীতি, ইসলামী আদর্শ প্রচার, শিক্ষা বিস্তার ও ইসলামী আইন প্রতিষ্ঠার আইনসম্মত দাওয়াতকে নিষিদ্ধ বা বাধাগ্রস্ত করলে তা নাগরিকদের মৌলিক অধিকার হরণের অপরাধ ছাড়াও দেশ ও জাতির জন্য ভয়ঙ্কর বিপদ দেকে আনবে। এ জাতীয় যে কোনো কর্ম জঙ্গিদেরকে সাহায্য করবে, তাদের প্রচার জোরদার করবে, তাদের নতুন রিক্রুটমেন্ট দ্রুত বাড়বে এবং দেশ ও জাতিকে এক ভয়ঙ্কর রক্তক্ষয়ী অশান্তির মধ্যে ফেলে দিবে।
মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে প্রিয়নবী এর রাষ্ট্র পরিচালনার অনুপম আদর্শে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত হয়ে ন্যায় বিচার ফিরিয়ে আনার মাধ্যমে সমাজ-রাষ্ট্রে শান্তি প্রতিষ্ঠায় অংশগ্রহণের তাওফিক দান করুন। আমীন বিজাহিন নবিয়িল আমীন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
লিখক: আরবি প্রভাষ, রাণীরহাট আল-আমিন হামেদিয়া ফাযিল (ডিগ্রী) মাদরাসা
খতিব, রাজানগর রাণীরহাট ডিগ্রি কলেজ জামে মসজিদ, রাঙ্গুনিয়া, চট্টগ্রাম।
http://dailypurbodesh.com/%e0%a6%87%e0%a6%a8%e0%a6%b8%e0%a6%be%e0%a6%ab%e0%a6%ad%e0%a6%bf%e0%a6%a4%e0%a7%8d%e0%a6%a4%e0%a6%bf%e0%a6%95-%e0%a6%b8%e0%a6%ae%e0%a6%be%e0%a6%9c-%e0%a6%aa%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a6%a4%e0%a6%bf%e0%a6%b7/ via @দৈনিক পূর্বদেশ
দৈনিক ইনকিলাব
https://m-dailyinqilab-com.cdn.ampproject.org/v/s/m.dailyinqilab.com/article/274560/%E0%A6%87%E0%A6%A8%E0%A6%B8%E0%A6%BE%E0%A6%AB%E0%A6%AD%E0%A6%BF%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A6%BF%E0%A6%95-%E0%A6%B8%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%9C-%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%A4%E0%A6%BF%E0%A6%B7%E0%A7%8D%E0%A6%A0%E0%A6%BE%E0%A6%87-%E0%A6%86%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%95%E0%A6%B0%E0%A6%A3%E0%A7%80%E0%A7%9F?amp_js_v=0.1&usqp=mq331AQHKAFQArABIA%3D%3D#origin=https%3A%2F%2Fwww.google.com&prerenderSize=1&visibilityState=prerender&paddingTop=32&p2r=0&csi=1&aoh=16067417604277&viewerUrl=https%3A%2F%2Fwww.google.com%2Famp%2Fs%2Fm.dailyinqilab.com%2Farticle%2F274560%2F%2525E0%2525A6%252587%2525E0%2525A6%2525A8%2525E0%2525A6%2525B8%2525E0%2525A6%2525BE%2525E0%2525A6%2525AB%2525E0%2525A6%2525AD%2525E0%2525A6%2525BF%2525E0%2525A6%2525A4%2525E0%2525A7%25258D%2525E0%2525A6%2525A4%2525E0%2525A6%2525BF%2525E0%2525A6%252595-%2525E0%2525A6%2525B8%2525E0%2525A6%2525AE%2525E0%2525A6%2525BE%2525E0%2525A6%25259C-%2525E0%2525A6%2525AA%2525E0%2525A7%25258D%2525E0%2525A6%2525B0%2525E0%2525A6%2525A4%2525E0%2525A6%2525BF%2525E0%2525A6%2525B7%2525E0%2525A7%25258D%2525E0%2525A6%2525A0%2525E0%2525A6%2525BE%2525E0%2525A6%252587-%2525E0%2525A6%252586%2525E0%2525A6%2525AE%2525E0%2525A6%2525BE%2525E0%2525A6%2525A6%2525E0%2525A7%252587%2525E0%2525A6%2525B0-%2525E0%2525A6%252595%2525E0%2525A6%2525B0%2525E0%2525A6%2525A3%2525E0%2525A7%252580%2525E0%2525A7%25259F&history=1&storage=1&cid=1&cap=navigateTo%2Ccid%2CfullReplaceHistory%2Cfragment%2CreplaceUrl%2CiframeScroll
কোন মন্তব্য নেই