অপসংস্কৃতির আরেক নাম ভ্যালেন্টাইন্স ডে
বিশ্বের সর্বত্র আজ যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে তা অনেকটা জাহেলী যুগকে হার মানায়। প্রগতিরূপী অশ্লীলতা, ভদ্রবেশী বর্বরতা, নগ্নতা ও বেহায়াপনা, ভ্যালেন্টাইন্স ডে নামে অশ্লীল প্রেম-ভালবাসার জন্য কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতীর অবাধ মেলামেশা প্রভৃতিতে পৃথিবী আজ কলুষিত। পশ্চিমা বিশ্বের অপসংস্কৃতি আমাদের করছে বিপর্যস্ত। যুব সমাজ এর বেড়াজালে পা দিচ্ছে, যা নৈতিকতার অবক্ষয় ঘটিয়ে প্রতি মুহুর্তে নব নব বিপদ সংকেতের আভাস দিচ্ছে। এরপরও আমরা এর বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিচ্ছি না। জগতবিখ্যাত কবি ড. আল্লামা ইকবাল বলেন-
‘‘মুসলমানই হয়েছে আজ অনুসারী, খ্রীস্টানের রীতি-নীতির
না হয়েছে কল্যাণ তাদের, করছে শুধু ধন্য তাদের (খ্রীস্টানদের)।’’
হ্যাঁ, সত্যিই তাই, আমরা তাদেরকে ধন্য করছি। আজ মুসলিম জাতি ঈমানের ঘরে সত্যিকারে ভালবাসার পরিবর্তে স্থান দিয়েছে অশ্লীল প্রেম-ভালবাসার। আর এই প্রেম-প্রীতির পেছনে দাঁড়িয়ে আছে মানবজাতির আজন্ম শত্রæ শয়তান ‘এইডস' নামক মৃত্যুর পেয়ালা নিয়ে। যখন ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে' তথা বিশ্ব ভালবাসা দিবস ছিল না; তখন ‘এইডস দিবস'ও ছিল না। আজ যারা বিশ্ব ভালবাসা দিবসের ঢোল পিটাচ্ছে তারাই আবার আঁতকে উঠছে ‘এইডস'-এর নাম শুনে। যখন মানুষ আল্লাহকে ভুলে গিয়ে পার্থিব ভোগ্যবস্তুতে মেতে থাকে, তখন দারিদ্র্য অতি সত্বর তাকে ঘিরে বসে। এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ্ তায়ালা ইরশাদ করেন-
‘‘শয়তান তোমাদেরকে দারিদ্র্য তথা অভাব অনটনের ভীতি প্রদর্শন করে এবং অশ্লীলতার আদেশ দেয়’’। (সূরা বাকারা, আয়াত:২৬৮)
উপরোক্ত আয়াতে প্রথমে দারিদ্রতা এবং পরে অশ্লীলতার প্রসঙ্গ টেনে আনা হয়েছে। বালাগাত শাস্ত্রে কোন বিষয়ের প্রতি অতি গুরুত্ব বুঝানোর জন্য ক্রমধারা ভঙ্গ করা হয়। অত্র আয়াতে বালাগাত শাস্ত্রের এই নিয়ম অনুসরণ করা হয়েছে। অতএব, অশ্লীলতার মাধ্যমে সমাজে দারিদ্রের অনুপ্রবেশ ঘটে। ফলে সকল প্রকার অপরাধ ও বিশৃঙ্খলা সমাজে অতিদ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং শুরু হয় ভ্রুণ হত্যা। যদিও এ পরিস্থিতির জন্য নতুন প্রজন্ম দায়ী নয়। তবুও এই অপরাধ তাদের ঘাড়ে অর্পণ হয়। তাই প্রবাদ আছে- কেউ মরে পাপে, আর কেউ মরে তাপে। ভ্রুণ তথা শিশু হত্যা কতই যে মারাত্মক অপরাধ এবং এর শাস্তি কি যে ভয়াবহ, তা বুঝানোর জন্য আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন-
‘‘আর যখন জীবন্ত প্রোথিত সন্তানকে জিজ্ঞেস করা হবে, কি অপরাধে তাকে হত্যা করা হলো?’’ (সূরা তাকভীর, আয়াত: ৮, ৯)
ভ্যালেন্টাইন্স ডে'র মূল রহস্য : তৃতীয় শতাব্দীর ২৭০ খ্রিস্টাব্দে রোমান সম্রাট গতিবাস দ্বিতীয় ক্লডিয়াস বিয়ে-শাদী নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন, প্রেম-ভালবাসা বাদ দিয়ে দেশ রক্ষার নির্দেশ দেন। এ সময় সম্রাটের নির্দেশের বিরোধিতা করেছিল এক যুবক, যার নাম ভ্যালেন্টাইন। সে চেয়েছিল প্রেম-বিয়ে এসব চালু রাখতে। এই বিদ্রোহের শাস্তি স্বরূপ তার আঙ্গুল কেটে ফেলা হলো এবং তাকে কারাবন্দি করা হলো। কারারক্ষীর মেয়ে তার প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং প্রতিনিয়ত মেয়েটি তার কাছে আসতে থাকে। তাদের এ সম্পর্কের কথা জানাজানি হলে তাকে মৃত্যুদন্ডের আদেশ দেয়া হয় এবং ১৪ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুদন্ড কার্যকর হয়। এই ঘটনাকে স্মরণ করে পোপ জেলসিয়ান দিবসটি সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য ১৪ ফেব্রুয়ারিকে আধুনিক নামে সাজিয়ে ভ্যালেন্টাইন্স ডে বলে ঘোষণা দেন। এ দিবসের প্রধান আকর্ষণ ছিল লটারীর মাধ্যমে পরবর্তী ১ বছরের জন্য যুবকদের মাঝে যুবতীদেরকে বিতরণ করা- ‘নাউজুবিল্লাহ'। এ ধরনের অনেক কুরুচিপূর্ণ খ্রিস্টান সংস্কৃতির অংশ ভ্যালেন্টাইন্স ডে। এটি ইসলামী সংস্কৃতির সম্পূর্ণ বিপরীত, এটা মুসলমানদের সংস্কৃতির সাথে সংগতিপূর্ণ নয়। তাই মুসলিম প্রধান দেশে বাস করে পশ্চিমা সংস্কৃতি লালন করা কোন সভ্য ও শিক্ষিত মানুষের কাজ হতে পারে না। কাজেই একথা প্রমাণিত হয় যে, এটি মুসলমানদের কোন বিশেষ দিন নয়, বরং একজন খ্রিস্টানের মৃত্যুদিবস মাত্র। এদিনে ফুল আদান-প্রদান, কার্ড দেয়া, শুভেচ্ছা বিনিময় এবং ভালবাসা দিবস মনে করে এ দিনকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া শরীয়তসম্মত নয়। বরং পর্দাহীন বেগানা নারী-পুরুষ, যুবক-যুবতী, কিশোর-কিশোরী একত্রে মিলিত হওয়া এবং অশ্লীল কার্যকলাপে লিপ্ত হওয়া শরীয়ত বিরোধী কার্যকলাপ। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হলেও সত্য যে, জ্ঞানের রাজ্য-ভান্ডার, গবেষণা কেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে ভ্যালেন্টাইন্স ডে উদযাপনের নামে ঘটছে সব অকল্পনীয় কর্মকান্ড। যেমন-প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৪ ফেব্রুয়ারি’০৫ ভ্যালেন্টাইন্স ডে উদযাপনে তরুণ ছাত্র-ছাত্রীরা একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করেছিল। অনুষ্ঠান হতে সরকারকে অনেক অপ্রত্যাশিত দাবি জানিয়েছিল, যা দৈনিক পত্রিকাসমূহে বিশেষতঃ দৈনিক ইনকিলাবে প্রকাশিত হয়েছিল। অথচ বাংলাদেশ একটি মুসলিম রাষ্ট্র এবং এদেশে ইসলামী মূল্যবোধের সরকার ক্ষমতায় থাকা সত্তে¡ও এর বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় নি। ১৪ ফেব্রুয়ারি’০৬ রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, রমনা পার্ক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাসহ সর্বত্রই ছিল প্রেমিক-প্রেমিকাদের মিলনমেলা। বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ ছেলে-মেয়েরা ফুল, কার্ড আর পছন্দের উপহার নিয়ে দেখা করেছে মনের মানুষের সাথে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি কর্তৃপক্ষ দিবসটি উদযাপন উপলক্ষে ভালবাসার স্মৃতিচারণ, ভালবাসার কবিতা ও গান পরিবেশন, প্রেমপত্র প্রদর্শন করেছে।[বিস্তারিত দেখুন : ১৪ ফেব্রুয়ারি ০৫ ও ০৬ ইংরেজীর দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকা]
কিয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা বলবেন-ঐ সব লোক কোথায়? যারা আমার ইজ্জতের খাতিরে একে অপরকে ভালবাসত। আজ আমি তাদেরকে আমার বিশেষ ছায়ায় স্থান দিব। আজ এমন দিন, আমার ছায়া ব্যতীত আর কোন ছায়া নাই। (সহিহ মুসলিম; মিশকাত)
একদা এক ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! কিয়ামত কখন হবে? নবীজি বললেন,
তোমার জন্য আফসোস, কিয়ামতের জন্য তুমি কি প্রস্তুতি নিয়েছ? সে বলল, আমি এর জন্য কিছুই প্রস্তুত করিনি। তবে আমি আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলকে ভালবাসি। তখন নবীজি ইরশাদ করেন , তুমি তার সাথেই থাকবে, যাকে তুমি ভালবাস। রাবী হযরত আনাস বিন মালিক (রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ) বলেন, ইসলামের পর মুসলমানদেরকে আমি কোন বিষয়ে এতটা খুশি হতে দেখিনি, যতটা খুশি হয়েছিল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই বাণী শুনে। (সহিহ বুখারী; সহিহ মুসলিম )
সাহাবায়ে কেরামের আদর্শ নিজেদের মাঝে বাস্তবায়ন করতে প্রত্যেকের উচিত হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে স্বীয় মা-বাবা, সন্তান-সন্তুতি এমনকি নিজের প্রাণের চেয়েও বেশি ভালবাসা। কেননা, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহববত রুকনে ঈমান। এজন্য রাহমাতুল্লিল আলামীন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতেকে উদ্দেশ্য করে ইরশাদ করেন,
তোমাদের মধ্যে কোন ব্যক্তি ততক্ষণ পর্যন্ত পরিপূর্ণ ঈমানদার হতে পারবে না, যতক্ষণ না আমি তার নিকট তার পিতা-মাতা, সন্তান-সন্তুতি এবং অন্যান্য সকল মানুষ হতে অধিক প্রিয় হব। (সহিহ বুখারী ; সহিহ মুসলিম; মিশকাত শরীফ)
যার ভালবাসায় বিশ্ব সিক্ত, তিনি আমাদেরকে অশ্লীল প্রেম-ভালবাসা, নগ্নতা ও বেহায়াপনা থেকে বারেগাহে ইলাহির নিকট আশ্রয় চাওয়ার দোয়া শিখানোর নিমিত্তে ইরশাদ করেন, ‘‘হে আল্লাহ! আপনার নিকট মহিলাদের ফিতনা হতে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।’’ নবীজি নিজেই যাকে ফিতনা বলেছেন, বর্তমান বিশ্বের মানুষ তাকেই ভালবাসা বলছে। অথচ এরই মাধ্যমে ঘটছে ধোঁকাবাজি, হত্যা ও ধর্ষণ প্রভৃতি অপকর্ম। তাই ইরশাদ হচ্ছে,
হে মাহবুব! আপনি মুমিনদের বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে অবনত রাখে এবং স্বীয় লজ্জাস্থানকে হিফাজত করে’’। (সূরা নূর)
অত্র আয়াতে দৃষ্টিকে অবনত রাখার সাথে সাথে নিজেকে পাপকার্য থেকে হিফাজত করার জন্য বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রথমটি দ্বিতীয়টির নিকটতম। কেননা দৃষ্টি দেয়া ব্যতীত না হয় প্রেম, না ঘটে অশ্লীল কর্মকান্ড। অতএব, আসুন! আমরা পশ্চিমা সংস্কৃতি, সর্বপ্রকার অন্যায় ও অশ্লীল কর্মকান্ড পরিহার করে ইসলামী সংস্কৃতি গ্রহণ করে রাসূলের অনুপম আদর্শ নিজেদের জীবন ও চরিত্রে বাস্তবায়ন করি।
কোন মন্তব্য নেই