জুমার খুতবা-৭ : ক্ষমা প্রার্থনা
মুহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মাসুম
হযরত মূসা আলাইহিস সালাম-এর যুগে একাধিক নবী দুনিয়াতে ছিলেন। গ্রীষ্মকালে বৃষ্টি না হওয়ার কারণে একজন নবীর কাছে উনার উম্মতরা আসলেন এবং বৃষ্টির জন্য দো'আ করতে বললেন। উনি উম্মতদেরকে বললেন, 'তোমরা হযরত মুসা আলাইহিস সালাম-এর কাছে যাও, উনি কলিমুল্লাহ-উনিই পারবেন এ ব্যাপারে আল্লাহ পাকের সাথে কথা বলতে।' ঐ উম্মতরা যখন হযরত মুসা আলাইহিস সালাম-এর কাছে আসলো, তখন হযরত মুসা আলাইহিস সালাম সবাইকে নিয়ে বড় মাঠে গেলেন। তারপর তিনি সবাইকে নিয়ে আল্লাহ পাকের কাছে হাত তুলে বৃষ্টির জন্য দো'আ করলেন। আল্লাহ পাক হযরত মুসা আলাইহিস সালামকে বললেন, 'এই মাঠে এমন একজন ব্যক্তি আছে যে চল্লিশ বছর ধরে আমার নাফরমানি করছে, তাকে মাঠ থেকে বের করে দিন, তাহলে আমি বৃষ্টি দেবো।' হযরত মুসা আলাইহিস সালাম আল্লাহ পাকের এই কথা সবাইকে শুনিয়ে বললেন যেন ঐ ব্যক্তিটি মাঠ থেকে চলে যায়। কিন্তু এই ঘোষণার পরেও কোন ব্যক্তি মাঠ থেকে বের হলো না। এদিকে হযরত মুসা আলাইহিস সালাম বার বার ঘোষণা দেওয়ার পরেও যখন কোন লোক বের হলো না তখন হযরত মুসা আলাইহিস সালাম আল্লাহ পাককে বললেন, 'হে আল্লাহ! আপনিই তার পরিচয় বলে দিন, আমরা তাকে মাঠ থেকে বের করে দেবো।' দোষ গোপণকারী আল্লাহ পাক বললেন, 'চল্লিশ বছর ধরে আমি তার দোষ লুকিয়ে রেখেছি, এখন কিভাবে বলে দেবো? বরং আপনিই তাকে স্বেচ্ছায় বের হয়ে যেতে বলুন।' এ অবস্থা দেখে লোকটি কাঁদতে শুরু করে দিলো এবং বললো, 'হে আল্লাহ! আজ যদি আপনি আমার ইজ্জত রক্ষা করেন, তবে আমি আজকের পর থেকে আর আপনার নাফরমানি করবো না।' এদিকে লোকটি চোখের পানি অঝোর ধারায় ঝরতে লাগলো, আর ঐ দিকে অঝোর ধারায় আল্লাহ পাকের রহমতের বৃষ্টির ফোটাও পড়তে লাগলো! হযরত মুসা আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, 'হে আল্লাহ! লোকটিতো বের হলো না!' তখন অতি দয়ালু ও ক্ষমাশীল আল্লাহ পাক বললেন, 'হে মুসা! আপনি কি মনে করছেন আপনার দো'আর বরকতে আমি বৃষ্টি দিয়েছি? আমি বৃষ্টি দিয়েছি আমার ঐ পাপী বান্দার চোখের পানির কারণে!' সুবহানআল্লাহ!
ইস্তেগফার অর্থাৎ আল্লাহ পাকের কাছে ক্ষমা চাইলে শুধুমাত্র বৃষ্টি নয়, আরো অনেক নেয়ামত লাভ করা যাবে। ক্বোরআন মাজীদে আল্লাহ পাকের ঘোষণা:
অতঃপর আমি বললাম ‘আপন রবের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করো। তিনি মহা ক্ষমাশীল; তোমাদের উপর মুষলধারে বৃষ্টি প্রেরণ করবেন; এবং সম্পদ ও সন্তান দ্বারা তোমাদের সাহায্য করবেন আর তোমাদের জন্য বাগান বানিয়ে দেবেন ও তোমাদের জন্য নহরসমূহ প্রবাহিত করবেন। (সূরা নূহ, আয়াত: ১০-১২)
🌺 হে আল্লাহ! আমরাওতো অনেকে বছরের পর বছর আপনার নাফরমানিতে লিপ্ত আছি। প্রিয় নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উসিলায় আমাদেরকেও ক্ষমা করুন এবং আমাদেরকে প্রকৃত অর্থে তাওবাহ করে সংশোধন হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।
🌺 বান্দাকে ক্ষমা করার জন্য আল্লাহ পাকের রহমতপূর্ণ বাণী:
হে আমার বান্দাগণ যারা নিজেদের উপর যুলুম করেছ তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ে যেও না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সমস্ত গোনাহ্ মাফ করেন। তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (আয যুমার : ৫৩)
যে গোনাহ, করে কিংবা নিজের অনিষ্ট করে, অতঃপর আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে, সে আল্লাহকে ক্ষমাশীল, করুণাময় পায়। (আন নিসা:১১০)
হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি যে, আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘‘হে আদম সন্তান! যখন তুমি আমাকে ডাকবে ও আমার ক্ষমার আশা রাখবে, আমি তোমাকে ক্ষমা করব, তোমার অবস্থা যাই হোক না কেন; আমি কোন পরোয়া করি না। হে আদম সন্তান! তোমার গোনাহ যদি আকাশ পর্যন্ত পৌঁছে যায়, অতঃপর তুমি আমার নিকট ক্ষমা চাও, তবুও আমি তোমাকে ক্ষমা করব; আমি কোন পরোয়া করি না। হে আদম সন্তান! তুমি যদি পৃথিবী পরিমাণ পাপ নিয়ে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ কর; কিন্তু আমার সঙ্গে কাউকে শরীক না করে থাক, তাহলে পৃথিবী পরিমাণ ক্ষমা নিয়ে আমি তোমার নিকট উপস্থিত হব।’’ – (তিরমিযী: ৩৫৪০)
সকল সমস্যার সমাধান ইস্তেগফারের (আল্লাহ পাকের কাছে ক্ষমা চাওয়ার) মধ্যে রয়েছেঃ
হযরত আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু হতে বর্ণিত, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
‘যে ব্যক্তি নিয়মিত ইস্তেগফার (অর্থাৎ আল্লাহ পাকের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা) করবে, আল্লাহ তার সকল সংকট থেকে উদ্ধারের পথ বের করে দেবেন, সব দুশ্চিন্তা দূর করে দেবেন এবং অকল্পনীয় উৎস হতে তার রিজিকের ব্যবস্থা করে দেবেন।’ (আবু দাউদ শরীফ: ১৫২০, ইবনে মাজা শরীফ:৩৮১৯)
যে কোন দো'আর আগে পড়ে দরুদ শরীফ পড়লে সে দো'আ কবুল হওয়ার নিশ্চয়তা বেড়ে যায়। তাই নিচে উল্লেখিত ইস্তেগফারসমূহ পড়ার আগে ও পরে দরুদ শরীফ পড়ে নিতে ভুলবেন না।
🌿 নিচে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্তেগফারের উচ্চারণ ও অর্থ দেয়া হল:
🌹 ইস্তেগফার:
اَسْتَغْفِرُ اللهَ رَبِّى مِنْ كُلِّ ذَنْبٍ وَّ اَ تُوْبُ اِلَيْهِ لا حَوْلَ وَلا قُوَّةَ اِلَّا بِاللّهِ الْعَلِىِّ العَظِيْم'
উচ্চারণ : আসতাগফিরুল্লাহা রাব্বি মিন কুল্লি যাম্বিও ওয়াতুবু ইলাইহি, লা হাওলা ওয়ালা কুয়াতা ইল্লা বিল্লাহিল আলিইল আযীম।
অর্থ : আমি সমস্ত গুনাহ হতে তওবা করছি এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। আল্লাহ পাকের সাহায্য ছাড়া সৎকাজ করার এবং পাপ থেকে বাঁচার ক্ষমতা কারো নেই। তিনি সম্মানিত, তিনি মহান।
🌿 নিচের ইস্তেগফারটি পড়লে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিবেন, যদিও সে জিহাদের ময়দান থেকে পলাতক আসামী হয়। (আবু দাউদ শরীফ- ২:৮৫, তিরমিযি শরীফ-৫:৫৬৯, মিশকাত:২৩৫৩)
🌹 ইস্তেগফার:
أَسْتَغْفِرُ اللَّهَ الَّذِي لاَ إِلَهَ إِلاَّ هُوَ الْحَيُّ الْْقَيُّومُ وَ أَتُوبُ إِلَيْهِ
উচ্চারণঃ আস্তাগফিরুল্লা-হাল্লাযী লা ইলা-হা ইল্লা হুওয়াল হাইয়ুল ক্বাইয়ূমু ওয়া আতূবু ইলাইহে।
অর্থ : আমি আল্লাহর নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। যিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। যিনি চিরঞ্জীব ও বিশ্বচরাচরের ধারক। আমি অনুতপ্ত হৃদয়ে তাঁর দিকে ফিরে যাচ্ছি বা তওবা করছি।
🌿 সাইয়্যেদুল ইস্তেগফার সকল আস্তাগফিরুল্লাহর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ট বলে অভিহিত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
‘দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে সন্ধ্যায় ‘সাইয়্যিদুল ইস্তিগফার’ পাঠ করলে সেই রাতে মারা গেলে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে ও দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে সকালে পাঠ করলে ঐ দিন মারা গেলে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। (বুখারী শরীফ: ৫৮৩১)
🌹 সাইয়্যিদুল ইস্তিগফার:
اَللّٰهُمَّ اَ نْتَ رَبِّى، لَاۤ اِلٰهَ اِلَّا اَ نْتَ خَلَقْتَنِىْ وَاَ نَا عَبْدُكَ، وَاَ نَا عَلٰى عَهْدِكَ. وَوَعْدِكَ مَا اسْتَطَعْتُ، اَعُـْوذُبِـكَ مِنْ شَـرِّ مَا صَنَعْتُ ، اَ بُوْءُ لَكَ بِنِعْمَتِكَ عَلَىَّ ، وَاَ بُوْءُ بِذَنْبِـى فَاغْفِرْلِى، فَاِنَّهُ لَا يَغْفِرُ الذُّنُوْبَ اِلَّا اَ نْتَ.
উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা আনতা রাব্বি,লা ইলাহা ইল্লা আনতা খালাকতানি ওয়া আনা আবদুকা, ওয়া আনা আলা আহদিকা ওয়া ওয়াদিকা, মাছতা তাতু, আউযুবিকা মিন শাররি মা ছানাতু আবুউলাকা, বিনিমাতিকা,আলাইয়্যা ওয়া আবুউ বিজাম্বী ফাগফিরলি, ফাইন্নাহু লাইয়াগ ফিরুজ জুনুবা ইল্লা আনতা।
অর্থ: হে আল্লাহ! আপনি আমার প্রতিপালক, আপনি ছাড়া আর কোন উপাস্য নেই। আপনি আমাকে সৃষ্টি করেছন আর আমি আপনার বান্দা। আমি আমার সাধ্যানুযায়ী আপনার সাথে যে ওয়াদা করেছি তা পূরণ করার চেষ্টায় রত আছি, আমি আমার কর্মের অনিষ্ট থেকে পানাহ্ চাই, আমি স্বীকার করছি আমার প্রতি আপনার প্রদত্ত নিয়ামতের কথা এবং আমি আরো স্বীকার করছি আমার পাপে আমি অপরাধী, অতএব আপনি আমাকে ক্ষমা করুন, আপনি ছাড়া ক্ষমা করার আর কেউ নেই।
🌿 নিচের কালেমা শরীফটির অর্থ পড়ে দেখুন! অসীম দয়ালু ও ক্ষমাশীল আল্লাহ পাকের কাছে সকল পাপ ক্ষমা চাওয়ার জন্য কত উত্তম বাণী!
🌹 কালেমা-ই-ইস্তেগফার:
اسْتَغْفِرُ اللّهَ رَبِّىْ مِنْ كُلِّ ذَنْبٍ اَذْنَبْتُه عَمَدًا اَوْ خَطَاً سِرًّا اَوْ عَلَانِيَةً وَاَتُوْبُ اِلَيْهِ مِنْ الذَّنْبِ الَّذِىْ اَعْلَمُ وَ مِنْ الذَّنْبِ الَّذِىْ لا اَعْلَمُ اِنَّكَ اَنْتَ عَلَّامُ الغُيُبِ وَ سَتَّارُ الْعُيُوْبِ و َغَفَّارُ الذُّنُوْبِ وَ لا حَوْلَ وَلا قُوَّةَ اِلَّا بِاللّهِ الْعَلِىِّ العَظِيْم'
উচ্চারণ: আস্তাগফিরুল্লাহা রাব্বি মিন কুল্লি জামবিন আয নাবতুহু আমাদান আও খাতা আন সিররান আও আলা নিয়াতান ওয়াতুবু ইলাইহি মিনায যামবিল্লাজি আলামু ওয়া মিনায যামবিল্লাজি লা আলামু ইন্নাকা আনতা আল্লামুল গুয়ুব, ওয়া সাত্তারুল ওয়ুব, ওয়া গাফফারুজ জুনুব, ওয়ালা হাওলা ওয়ালা কুয়াতা ইল্লা বিল্লাহিল আলিইল আযীম।
অর্থ: আমি আল্লাহ্র কাছে ক্ষমা চাই সকল পাপ থেকে, যা আমি সংঘটিত করেছি আমার জ্ঞাতসারে অথবা অজ্ঞাতসারে, গোপনে বা প্রকাশ্যে এবং আমি আমার পালনকর্তার আশ্রয় চাই সেই পাপ থেকে, যে পাপ আমি জানি এবং যে পাপ আমি জানিনা। অবশ্যই আপনি লুকানো এবং গোপন (ভুল) পাপ সম্পর্কে জানেন এবং আপনি ক্ষমাশীল। আল্লাহ্ ছাড়া কোন শক্তি নেই, কোন ক্ষমতা নেই, তিনি সম্মানিত, তিনি মহান।
তাওবার পরিচয়:
তাওবা হলো অতীতের গুনাহের অনুশোচনা, দুনিয়ার কোন উপকারিতা অর্জন অথবা ক্ষতি থেকে বাঁচার জন্য নয় একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার জন্যই সার্বক্ষণিকভাবে সে গুনাহ ছেড়ে দেওয়ার উপর দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করা। জবরদস্তির মাধ্যমে নয় বরং শরী‘আতের বিধি-নিষেধ তার উপর বহাল থাকবে ততক্ষণ স্বেচ্ছায় এ প্রতিজ্ঞা করবে।
তাওবা (توبة) শব্দের তা (تا) বর্ণে যবর ওয়া (واو) বর্ণে সুকুন যোগে গঠিত হয়। আভিধানিক অর্থ পাপ থেকে ফিরে আসা, প্রত্যাবর্তন করা, প্রত্যাগমন করা ইত্যাদি। বিশেষ পদে অর্থ অনুতাপ, অনুশোচনা। ড. মুহাম্মদ ড. হামিদ সাদিক বলেন:
التوبة: مصدر تاب ، الرجوع عن الذنب الندم على فعل الذنب ، وعقد العزم على عدم العودة إليه والتوجه إلى الله طلبا للمغفرة.
(‘তাবা (تاب) ক্রিয়া হতে তাওবা (توبة) হলো মাসদার। অর্থ পাপ থেকে ফিরে আসা। কৃতপাপের অনুশোচনা করা। পুনরায় না করার দৃঢ়সংকল্প করা।’ শব্দটি মহান সৃষ্টিকর্তার সত্তা ও তাঁর সৃষ্টিকুল বান্দাগণ উভয়ের সম্পর্কে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। আল্লাহ তা‘আলার জন্য এ মর্মে যে, তিনি স্বীয় মাগফিরাত (মার্জনা) ও রাহমাত (করুণা) সহকারে বান্দাহদের প্রতি করুণা দৃষ্টি প্রদান করেন অর্থাৎ তিনি বান্দাদের তাওবা কবুল করেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ وَهُوَ ٱلَّذِي يَقۡبَلُ ٱلتَّوۡبَةَ عَنۡ عِبَادِهِۦ ١٠٤ ﴾ [التوبة: ١٠٤]
‘তিনি স্বীয় বান্দাদের তাওবা কবুল করেন।
তওবার শর্তাবলী
ওলামায়ে কেরাম কুরআনের আয়াত ও সহীহ হাদীসের আলোকে তওবার শর্তাদি বর্ণনা করেন। কেননা তওবা নিছক মুখে উচ্চারণের মত বিষয় নয় বরং এর থেকে এমন আমল বিকাশ হবার বিষয় যা তওবাকারীর সত্যতার উপর ইঙ্গিতবহ। গোনাহটি যদি আল্লাহ ও বান্দার মাঝে হয় অর্থাৎ হাক্কুল্লাহ বিষয়ক হয়; তাহলে এখানে তিনটি শর্ত প্রণিধানযোগ্য:
ক. গোনাহটি মূলোৎপাটিত করতে হবে।
খ. কৃত গোনাহটির প্রতি অবশ্যই অনুতপ্ত হতে হবে।
গ. এই পরিপক্ক সংকল্প করা যে, ভবিষ্যতে আর এ ধরনের কাজ করব না।
উপরোক্ত তিনটি শর্তের যদি কোনও একটি শর্ত ছুটে যায় তাহলে তওবা শুদ্ধ হয়নি বলে মনে করতে হবে।
ঘ. পক্ষান্তরে যদি গোনাহটি হাক্কুল ইবাদ সম্পর্কিত হয় তখন এক্ষেত্রে ৪টি শর্ত লক্ষণীয়। উপরিউক্ত তিনটি তো আছে। অপরটি হল, কোনো ভাইয়ের মাল হলে তা আদায় করে দিতে হবে। যদি অপরকে অপবাদ দেয়া হয়, আর এ জন্য দণ্ড আসে (হদ্দে কযফ) তাহলে তার সেই অপবাদ দূর করার উদ্যোগ নিতে হবে কিংবা তার কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। পরচর্চাজনিত গোনাহ হলে তাকে বলে মাফ চেয়ে নিবে। আর এ সকল গোনাহ থেকে তওবা করে নিবে।
ঙ. তওবা নিছক আল্লাহর উদ্দেশ্যেই হতে হবে। এ কথা মনে রাখতে হবে, ‘তওবাটি হতে হবে নিছক আল্লাহকে রাযী-খুশি করানোর উদ্দেশ্যে- ভিন্ন কোনও উদ্দেশ্যে নয় । যেমনটি হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
« «إِنَّ اللَّهَ لَا يَقْبَلُ مِنَ الْعَمَلِ إِلَّا مَا كَانَ لَهُ خَالِصًا، وَابْتُغِيَ بِهِ وَجْهُهُ».
‘নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা খালিছ আমল কিংবা তাকে উদ্দেশ্য করা আমল ছাড়া কিছুই কবুল করেন না।’[56]
তওবার নেপথ্যে কিছু নির্ধারিত ও স্থিতিশীল কাজ
১. তওবাসহ যাবতীয় কাজকর্মে নিয়ত খালেস করা। কেননা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
‘আল্লাহ তা‘আলা খালেস আমল কিংবা তাকে উদ্দেশ্য করা আমল ছাড়া কিছুই কবুল করেন না।
২. তওবাকারী তওবার পরও যথাসম্ভব স্থিতিশীলভাবে আমালে সালিহা করে যাবে। সর্বদা সৎকর্মের প্রাধান্য দেবে ও অসৎকর্ম পরিহার করবে। আল্লাহ বলেন:
﴿ إِنَّ ٱلۡحَسَنَٰتِ يُذۡهِبۡنَ ٱلسَّئَِّاتِۚ ﴾ [هود: ١١٤]
‘নিশ্চয় সৎকর্ম অসৎকর্মকে বিদূরিত করে।[58]
আল্লাহর নবী মু‘আয ইবনে জাবাল রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু-কে ইয়ামেনে প্রেরণকালে নসিহতস্বরূপ বলেছিলেন:
« يا معاذ اتق الله حيثما كنت ، واتبع السيئة الحسنة تمحها ، وخالق الناس بخلق حسن».
‘হে মু‘আয! যেখানেই থাকো আল্লাহকে ভয় করো, একটা গোনাহর কাজ করে ফেললে সঙ্গে সঙ্গে একটা নেক কাজ করে ফেলো। তাহলে তা ওই কৃত গোনাহকে মোচন করে দেবে। মানুষের স্রষ্টার সাথে সদাচার কর।’
আল্লামা ইবনে তাইমিয়া বলেন:فالكيس هو الذى لا يزال يأتى من الحسنات بما يمحو السيئات ‘প্রকৃত বুদ্ধিমান সেই লোক, যে সর্বদা এমনসব সৎকাজ করে যা তার মোচন করে ফেলে।’
৩. গোনাহর অনিষ্টতা উপলব্ধি, এর দ্বারা দুনিয়া আখিরাতের ক্ষতি অনুধাবন করা।
৪. যেখানে গোনাহ-চর্চা হয়, সেখান থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলা, যাতে ওইস্থানে গোনাহে লিপ্ত হবার সমূহ সম্ভাবনাটুকুও না থাকে।
৫. গোনাহর উপকরণটি তছনছ করে ফেলা, যেমন: মাদক ও খেলাধুলার সরঞ্জামাদি ভেঙ্গে ফেলা।
৬. নিজের আত্মিক উন্নতি সাধনকল্পে কোনও আলেমের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করা। কোনো দুষ্ট বন্ধুর সংমিশ্রণে না যাওয়া।
৭. কুরআন-হাদীসে বর্ণিত পাপীদের আযাব-গযবে ফেলা ভীতিকর আয়াতসমূহ তেলাওয়াত করা।
৮. দ্রুত আগুয়ান শাস্তিসমূহ স্মরণ করা। যেমন আল্লাহ বলেন: “তোমরা প্রভুর দিকে ধাবিত হও এবং আজ্ঞাবহ হও আযাব আসার পূর্বেই, যখন তোমাদের কোনও সাহায্য করা হবে না।”
৯. সর্বদা আল্লাহর যিকর করতে থাকা। শয়তানকে দমন করার মহৌষধ হল যিকরুল্লাহ।
তওবার উপকারিতা ●●●●
1. তওবা গুনাহ বিদূরক:
আল্লাহর হাবীব সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
«التائب من الذنب كمن لا ذنب له»
“গোনাহ থেকে তওবাকারীর কোন গোনাহই থাকে না।”
2. গুনাহকে নেকীতে রূপান্তরকারী :
আল্লাহ বলেন,
﴿ إِلَّا مَن تَابَ وَءَامَنَ وَعَمِلَ عَمَلٗا صَٰلِحٗا فَأُوْلَٰٓئِكَ يُبَدِّلُ ٱللَّهُ سَئَِّاتِهِمۡ حَسَنَٰتٖۗ وَكَانَ ٱللَّهُ غَفُورٗا رَّحِيمٗا ﴾ [الفرقان: ٦٩]
“কিন্তু যারা তওবা করে, ঈমান আনে ও আমলে সালিহা করে, এদের সকল পাপরাশি নেকীতে রূপান্তর করে দেন আল্লাহ তা‘আলা। আর আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়ালু।”[সূরা ফোরকান:আয়াত-69]
৩. তওবাকারীর হৃদয়কে পরিচ্ছন্ন করে দেয়।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
«إِنَّ العَبْدَ إِذَا أَخْطَأَ خَطِيئَةً نُكِتَتْ فِي قَلْبِهِ نُكْتَةٌ سَوْدَاءُ، فَإِذَا هُوَ نَزَعَ وَاسْتَغْفَرَ وَتَابَ سُقِلَ قَلْبُهُ، وَإِنْ عَادَ زِيدَ فِيهَا حَتَّى تَعْلُوَ قَلْبَهُ، وَهُوَ الرَّانُ الَّذِي ذَكَرَ اللَّهُ» {كَلَّا بَلْ رَانَ عَلَى قُلُوبِهِمْ مَا كَانُوا يَكْسِبُونَ} [المطففين: 14]
“বান্দা যখন কোন গোনাহর কাজ করে তখন তার অন্তরে এক ধরনের কালো দাগ পড়ে যায়। যদি ইস্তেগফার করে তাহলে এই দাগ দূরীভূত করে তার অন্তর সূচালু, ধারালো ও পরিশীলিত হবে। আর এই দাগের কথা কুরআনেই আছে, খবরদার! তাদের অন্তরে দাগ রয়েছে যা তারা কামাই করেছে।”[সূরা মুতাফফিফীন:আয়াত-14]
৪. তওবা সুখী সুন্দর জীবনের গ্যারান্টি
আল্লাহ বলেন:
﴿ وَأَنِ ٱسۡتَغۡفِرُواْ رَبَّكُمۡ ثُمَّ تُوبُوٓاْ إِلَيۡهِ يُمَتِّعۡكُم مَّتَٰعًا حَسَنًا إِلَىٰٓ أَجَلٖ مُّسَمّٗى وَيُؤۡتِ كُلَّ ذِي فَضۡلٖ فَضۡلَهُۥۖ وَإِن تَوَلَّوۡاْ فَإِنِّيٓ أَخَافُ عَلَيۡكُمۡ عَذَابَ يَوۡمٖ كَبِيرٍ ٣ ﴾ [هود: ٣]
আর তোমরা নিজেদের পালনকর্তা সমীপে ক্ষমা প্রার্থনা কর, অনন্তর তারই প্রতি মনোনিবেশ কর। তাহলে তিনি তোমাদেরকে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত উৎকৃষ্ট জীবনোপকরণ দান করবেন এবং তিনি অধিক আমলকারীকে বেশি করে দেবেন। [সূরা হুদ: আয়াত-3]
তিনজন লোক হুসাইন বিন আলী (রা:) এর নিকট আসল। প্রথমজন অনাবৃষ্টির অভিযোগ করে বলল অনেকদিন বৃষ্টি হচ্ছে না।
একথা শুনে হুসাইন বিন আলী (রা;) বললেন বেশী করে তওবা কর।
দ্বিতীয়জন অভিযোগ করল আমার কোনো সন্তান নেই, আমি সন্তান পেতে আগ্রহী।
একথা শুনে হুসাইন বিন আলী (রা;) বললেন বেশী করে তওবা কর।
৩য়জন ব্যক্তি অভিযোগ করল এলাকায় দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে , ফসল উৎপন্ন হচ্ছে না।
তখনও হুসাইন বিন আলী (রা;) বললেন বেশী করে তওবা কর।
তার সামনে যারা বসা ছিল তারা বলল হে রসুলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম ) এর নাতি, তিনজন ৩ ধরনের অভিযোগ করল আর আপনি একই উত্তর দিলেন, তিনি একথা শুনে বললেন:
তোমরা কি আল্লাহ সুবহানাহু তাআলার এই বানী পড় নাই ? স্বীয় প্রভুর নিকট তাওবা কর, নি:সন্দেহে তিনি তাওবা কবুলকারী, তিনি তোমাদের জন্য প্রচুর বৃষ্টিপাত করবেন, তিনি তোমাদেরকে সমৃদ্ধ করবেন ধন-সম্পদ ও সন্তান সন্তুতিতে এবং তোমাদের জন্য স্হাপন করবেন উদ্যান ও প্রবাহিত নদী-নালা৷
কোন মন্তব্য নেই