ঈদ উদযাপনে আমাদের করণীয়
মুহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মাসুম
'ঈদ' মানে খুশি, আনন্দ, উৎসব, ফিরে আসা ইত্যাদি। ঈদের আগমনে স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে শৈশবকালের কথা। এখনো ছোটদের মধ্যে ঈদ আসার আগে থেকেই চলতে থাকে বহু প্রস্তুতি। আর মনে মনে তারা ভাবতে থাকে ঈদের দিন কোন পোশাক পরিধান করবে। পোশাকের সঙ্গে ম্যাচিং করে থাকতে হবে সবকিছু। ঈদের দুই তিন দিন আগ থেকেই রাতে তাদের চোখে ঘুম থাকে না। তাদের মা'র বকাঝকা খেয়ে শেষ রাতে একটু ঘুমাবে। কিছুক্ষণ পরেই ঘুম থেকে উঠে বলবে আম্মু ঈদ এসেছে? এই যে শিশুদের এমন আনন্দ-খুশি, মনের আবেগ সত্যিই বড় মজাদার। কিন্তু বালেগ হওয়ার পর থেকে অর্থাৎ ব্যক্তি যৌবনকালে পদার্পণ করার সঙ্গে সঙ্গে তার ওপর শরিয়তের বিধিবিধান আরোপিত হয়ে যায়, অঘোষিতভাবে ইসলাম তাকে বলতে থাকে এখন থেকে লাগামহীন জীবনের লাগাম টেনে ধর। ইসলামী নীতিমালার ভিত্তিতে মনের আবেগ, আনন্দ, উল্লাস প্রকাশ কর।
ইসলামে ঈদ একটি সুউচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন পরিপূর্ণ প্রতীক। যা দেহ ও মনের প্রয়োজন মিটিয়ে দেয়। মাহে রমজান ও হজ্বের মাসসমূহের ইবাদত বন্দেগির বাহক হিসাবে ঈদের আগমন ঘটে। ঐ মাসসমুহের সকল ইবাদতই রূহের খোরাক যোগায়। ইরশাদ হচ্ছে :
"আপনি বলুন, আল্লাহর অনুগ্রহ ও তাঁর রহমত, সেটার উপর তাদের আনন্দ প্রকাশ করা উচিত।"(সূরা ইউনুস, আয়াত : ৫৮)
ঈদের প্রকৃত অর্থ : শুধু দামী পোশাক, রঙ্গিন জামা, হরেক রকম সুস্বাদু খাবার আর নানা ধরণের আনন্দ-উৎসবের নাম ঈদ নয়। আর ধনী গরিবের এক কাতারে নামাজই শুধু নয় তাদের মধ্যে বৈষম্য কমিয়ে আনাও ঈদের উদ্দেশ্য ৷ ঈদের উদ্দেশ্য কি তা আল্লাহ তায়ালা নিন্মোক্ত আয়াতের মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন:
"আর যেন তোমরা নির্ধারিত সংখ্যা পূরণ করতে পার এবং তোমাদেরকে যে সুপথ দেখিয়েছেন, তার জন্যে তোমরা আল্লাহর মহিমা বর্ণনা করবে এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ হও।” (সূরা বাকারা, আয়াতঃ ১৮৫)
এই আয়াত থেকে প্রমাণিত হচ্ছে, ঈদের উদ্দেশ্য হল দুটি: ক. আল্লাহর বড়ত্ব, মহত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করা এবং খ. আল্লাহ তায়ালা যে নেয়ামত দান করেছেন, তার জন্য আল্লাহর কৃতজ্ঞতা আদায় করা। হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বিশ্ববাসীকে এমন এক দ্বীনের প্রতি আহবান করেছেন, যেখানে রয়েছে আধ্যাত্মিকতার সাথে বৈষয়িতার সমন্বয়, দ্বীনের সাথে দুনিয়া, সামাজিক শৃংখলার সাথে আছে ব্যক্তি মানুষের অধিকার ও মর্যাদার মূল্যায়ন। রাজনৈতিক ও সামাজিক সংস্কার, সামাজিক নেতৃত্ব তৈরি, পারিবারিক জীবনের প্রতি পূর্ণ দায়িত্ব পালনের জন্য বিরামহীন ছুটে চলা তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনের প্রতিটি বাঁকে বাঁকে। শাশ্বত সত্যের সুষমায় মহিমান্বিত এ মহান মানুষ তাঁর শয়নকক্ষে, ইবাদতগৃহে, সামষ্টিক কর্মকান্ডে, যুদ্ধে-সন্ধিতে, বিনোদন-বিষাদে, বেশভূষা-পানাহারে, বক্তব্য-বিবৃতিতে, উৎসব-অনুষ্ঠানে একজন মধ্যমপন্থি, আল্লাহ প্রেমিক সর্বাধুনিক মানবচরিত্রের অনুপম নমুনা। জাহেলী সমাজের বাতিল আনন্দ-উৎসব পরিহার করে ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে তিনি দুইটি ঈদ প্রবর্তন করেছেন। এ সম্পর্কে প্রখ্যাত সাহাবী হযরত আনাস বিন মালেক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় আগমন করার পর দেখলেন মদীনাবাসীদের দু'টি উৎসবের দিন রয়েছে, যাতে তারা খেলাধুলা করে। তিনি তাদের জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের এই দিন দু'টির ছুটি কেমন? তারা বললো, জাহেলী জীবনে আমরা এই দু'দিন খেল তামাশা করতাম। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
"আল্লাহ তায়ালা সেই দু'দিনের পরিবর্তে সেগুলো অপেক্ষা উত্তম দু'টি দিন তোমাদের দান করেছেন। তা হলো ঈদুল আজহা ও ঈদুল ফিতরের দিন"। (সুনানে আবু দাউদ; সুনানে নাসায়ী)
যে দিনে আল্লাহর শুকরিয়া, তাঁর জিকির, দুরুদ-সালাম, তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনার সাথে সাথে পরিমিত আমোদ-ফুর্তি, সাজ-সজ্জা, খাওয়া-দাওয়া করা হবে। আর শরীরের প্রয়োজন পূরণের লক্ষ্যে বিনোদন ইসলামে বৈধ করা হয়েছে। আর এ কারণেই ঈদের দিনগুলোতে সিয়াম সাধনা হারাম করা হয়েছে। কেননা, রোজা রেখে পানাহার ছেড়ে দিয়ে ঈদ উদযাপন করা আদৌ সম্ভব নয়। হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর উপরোক্ত বর্ণনায় এর ইঙ্গিত বহন করে। একজন মানুষ নিজেকে সারা জীবন একেবারে নিরানন্দ করে রাখতে পারে না, বরং তার সুস্থ, সুন্দর জীবন গঠনের জন্য প্রয়োজন কিছুটা ক্রীড়া-কৌতুক। যেমন নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাঝে মাঝে বাস্তবভিত্তিক হাসি-কৌতুক করতেন। তাঁর কৌতুক বাস্তব বহির্ভূত ছিল না। একবার তিনি কৌতুক করে এক বৃদ্ধা মহিলাকে দেখে ইরশাদ করলেন, বৃদ্ধা মহিলারা জান্নাতে যাবে না। ঐ মহিলা এটা শুনে কান্না শুরু করে দিয়েছে, তাহলে আমরা কি জান্নাতে যাবো না? রাসূলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিছুটা মুচকি হেসে বললেন, বৃদ্ধা হয়ে জান্নাতে যাবে না। তারা সুন্দরী রমণীর রূপ ধারণ করে জান্নাতে যাবে। মহান রাব্বুল আলামিন মানুষকে আনন্দ উৎসব পালন করার জন্য দিয়েছেন বছরে উক্ত দুটি ঈদ। এই দুই দিনে মানুষ আনন্দ প্রকাশ করবে। হাসিমুখে একে অপরের সাক্ষাত করবে। আত্মীয়-স্বজনের খোঁজ-খবর নেবে ইত্যাদি। তবে শরিয়তের সীমানার ভেতর থেকে তা প্রকাশ করতে হবে। শরিয়তের বাইরে যাওয়া যাবে না। এই ঈদ উৎসব মুসলিম জাতির অপার্থিব আনন্দের উৎসব। এই উৎসব যেমন একদিকে বাহুল্য বিবর্জিত, অপচয়-অশ্লীলতা মুক্ত তেমনি খোদায়ী প্রেমের সিগ্ধতা-পবিত্রতা ও সামাজিক সম্প্রীতি বন্ধনের এক অপূর্ব নিদর্শন। যা আমরা পাই নবী মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবন থেকে। এক নজরে চলুন দেখা যাক, কেমন ছিল তাঁর ঈদ উৎসব-
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর সন্তুষ্টি ও ভালোবাসা প্রাপ্তির নিমিত্তে নামাযের মাধ্যমে আনুগত্যের শির নত করে ঈদের দিনের সূচনা করতেন। (সহীহ বুুখারী; সহীহ মুসলিম) তিনি ঈদুল ফিতরের দিন কয়েকটি খেজুর খেয়ে নিতেন। সেগুলোর সংখ্যা হতো বেজোড়। ঈদুল আযহায় কিছু খেতেন না। নামায থেকে ফিরে কুরবানীর গোশত দিয়ে খাবার গ্রহণের সূচনা করতেন। দুই ঈদের দিন গোসল করতেন ঈদগাহে যাওয়ার আগে। ঈদুল ফিতরের দিন দেরীতে এবং ঈদুল আযহায় সকাল সকাল ঈদের নামায পড়তেন। ঈদগাহের উদ্দেশ্যে বের হবার সময় সাধ্য ও সামর্থানুযায়ী পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও সুন্দরতম পোশাক পরিধান করতেন। দুই ঈদ ও জুমার সময় পরার জন্য তাঁর একটি হোল্ল'া (ঢিলা লম্বা গাউন) ছিলো। ঈদগাহে যাবার সময় তাঁর সামনে নেযা (বল্লম জাতীয়) বয়ে নিয়ে যাওয়া হতো সুতরা (যা নামাযের সামনে দেয়া হয়) হিসেবে ব্যবহারের জন্য। কারণ, ঈদগাহ খোলা মাঠ ছিল। ঈদের নামায শেষে তিনি দু'টি খুতবা দিতেন। জনতা তাদের সারিতে বসা থাকতো। খুতবার এক অংশে থাকতো, অমূল্য পথ নির্দেশনা । অপর অংশে মুসলমানদের উন্নতি, সাফল্য ও বিজয় কামনা এবং ইসলামের শত্রুদের জন্য বদদোয়া থাকতো। (সহীহ বুুখারী; সহীহ মুসলিম) পারস্পরিক দেখা-সাক্ষাত ও ভালোবাসার ভাব বিনিময়ের মাধ্যমে সামাজিক সম্প্রীতি বন্ধন ও ভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত করতে সাহাবীদের সাথে ঈদ পালন করতেন এই বলে ‘তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকা' অর্থাৎ 'আল্লাহ তায়ালা আমাদের এবং আপনার তরফ থেকে ঈদকে কবুল করুন।' এছাড়া বেশি সংখ্যক মানুষের সাথে দেখা-সাক্ষাত ও তাদের অবস্থা জানার জন্য ঈদের দিন গমনাগমনের পথ পরিবর্তন করতেন। এক রাস্তা দিয়ে ঈদগাহে যেতেন অন্য পথ দিয়ে আসতেন। (সহীহ বুুখারী) 'মানুষের কল্যাণ ও সেবার মাধ্যমে খুশি ও আনন্দ ছড়িয়ে দিতেন ঘরে ঘরে, প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে। শহরের অলিতে গলিতে লোক পাঠিয়ে এ ঘোষণা করে দিতেন যে, সাবধান! সদকায়ে ফিতর প্রত্যেক মুসলমান নারী-পুরুষ, আযাদ-গোলাম, ছোট-বড় সকলের উপর ওয়াজিব। (সুনানে তিরমিযি) এর দ্বারা ধনী-গরিব সকলের আনন্দ নিশ্চিত করা লক্ষ্য ছিল। এজন্য ঈদের নামাযের পূর্বেই তা আদায়ের ব্যবস্থা করতেন। তিনি এক ঈদে বাবা-মা হারা এক অনাথ শিশুকে ঘরে নিয়ে আসেন এবং নিজেকে তার পিতা ও হযরত আয়েশা ছিদ্দিকা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহাকে তার মাতা বলে তার ব্যাথা ঘুচানোর উদ্যোগ নেন।
ঈদের দিন সকাল বেলায় নবীঘর ও তার চার পাশে সবকয়টি জায়গায় ঈদ আনন্দের আমেজ পরিলক্ষিত হচ্ছিল। এ সব কিছুই হচ্ছিল নূরনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চোখের সামনে। প্রত্যেকে ঈদ আনন্দে নিজ নিজ অনুভূতি ব্যক্ত করছিল। তারা সকলেই চাইত তাদের নিজ নিজ অনুষ্ঠান সম্পর্কে যাতে হুযূর পুরনূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অবগত হন। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভালোবাসা ও সম্মানের খাতিরেই তারা এসব করেছিল। এ সম্পর্কে উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেন,
“প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদের দিন আমার ঘরে আগমন করলেন, তখন আমার নিকট দুটি ছোট মেয়ে গান পরিবেশন করছিল। তাদের দেখে নূরনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে পড়লেন। ইতোমধ্যে হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু আমার ঘরে প্রবেশ করে এই বলে আমাকে ধমকাতে লাগলেন যে, নবীজির কাছে শয়তানের বাশি? রাসূলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর কথা শুনে ইরশাদ করলেন, মেয়ে দুটিকে গাইতে দাও। অতঃপর যখন প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্য মনস্ক হলেন তখন আমি মেয়ে দুটিকে ইশারা করলে তারা বের হয়ে গেল।”
অন্যদিকে হুজরা শরিফের খুবই নিকটে আরেকটি অনুষ্ঠান চলছিল, যেটির বর্ণনাও হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা এভাবে দিয়েছেন,
“ঈদের দিন আবি সিনিয়ার কিছু লোকজন লাঠি-শোঠা নিয়ে খেলা-ধুলা করছিল। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে ডেকে বললেন, হে আয়েশা! তুমি কী দেখতে চাও? আমি আরজ করলাম, হ্যাঁ, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তিনি আমাকে তাঁর পিছনে দাঁড় করিয়ে দিলেন, আমার গাল তাঁর গাল মুবারকের উপর রাখলাম। তিনি তাদের উৎসাহ দিয়ে বললেন: হে বনি আরফেদা, তোমরা শক্ত করে ধরো। এরপর আমি যখন ক্লান্ত হয়ে গেলাম তখন তিনি বললেন, তোমার দেখা হয়েছে তো? আমি আরজ করলাম, হ্যাঁ, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তিনি বললেন, তাহলে এবার যাও।” (সহীহ বুুখারী; সহীহ মুসলিম)
নবীজির হুজরার সন্নিকটে আরেকটি স্পটে ঈদ উপলক্ষে আরেকটি অনুষ্ঠান শুরু হল। কতগুলো বালক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শানে উচ্চাঙ্গের ও মানসম্পন্ন কবিতা আবৃতি করতে লাগল। হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেন,
“নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বসা ছিলেন, ইত্যবসরে আমরা বাচ্চাদের চেচামেচি শুনতে পেলাম। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উঠে দেখলেন, হাবশিরা খেলা-ধুলা করছে আর ছোট ছোট শিশুরা তাদের চারদিকে হৈ চৈ করছে। তিনি বললেন, হে আয়েশা! এদিকে এসে দেখে যাও। অতঃপর আমি এসে আমার থুতনি হুযূর পুরনূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের গর্দান মুবারকের উপর রেখে তাঁর পিছনে থেকে তাকাচ্ছিলাম। কিছুক্ষণ পর তিনি বললেন, তুমি পরিতৃপ্ত হওনি? তুমি কী এখনও পরিতৃপ্ত হওনি? আমি তখন তাঁর নিকট আমার অবস্থান পরীক্ষা করার জন্য বলেছিলাম, না এখনও হয়নি। হঠাৎ হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর আগমন ঘটল। সাথে সাথে লোকজন ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। এ দৃশ্য দেখে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মন্তব্য করলেন, আমি দেখলাম জিন ও মানুষ শয়তানগুলো ওমরকে দেখে পালিয়ে গেল।” ( সুনানে তিরমিজি)
হযরত আনাস ইবনে মালেক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, হাবশিরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এমন কিছু কবিতাও আবৃতি করেছিল, যেগুলোর অর্থ বুঝা যাচ্ছিলনা। কেননা, সেগুলো ছিল তাদের নিজস্ব ভাষায়। তাই নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের কবিতাগুলোর অর্থ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন, তারা কী বলছে? সাহাবাগণ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম আরজ করলেন, তারা বলছে : মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সৎ ও নেককার বান্দা। (সহীহ ইবনে হিব্বান)
উপরোল্লেখিত আলোচনা থেকে আলেমগণ কয়েকটি বিষয় উদঘাটন করেছেন-
১. পরিবারের দেহ ও মন যেভাবে উৎফুল্ল হয় ঈদ মৌসুমে উদারতার সাথে তার আয়োজন করা শরীয়তসম্মত। সম্মানিত ব্যক্তি তার বয়স ও ষ্ট্যাটাজের দরূন যদিও সে নিজে আনন্দ উৎসবে জড়িত হতে পারে না বটে। তার জন্য যা মানানসই সে তাতে যোগ দেবে। কিন্তু পরিবারের যে সব সদস্যের বয়স কম তারা স্বভাবগতভাবেই ঐসব খেল-তামাশার দিকে ধাবিত হয়. তাদের জন্য শরীয়তের সীমার ভিতর থেকে খেলা-ধুলা ও আনন্দ-ফুর্তির ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
২. ঈদ উৎসবে আনন্দ প্রকাশ করা দ্বীনের একটি প্রতীক। এ কারণেই নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুটি বালিকাকে গান গাইতে দেখে বারণ করেননি। শুধু তা-ই নয়, যখন হযরত সিদ্দীকে আকবর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু তাদের বাঁধা দিতে চাইলেন, তখন তিনি তাঁকে নিষেধ করলেন। অপর একটি বর্ণনায় আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, হে আবু বকর! প্রত্যেক জাতির ঈদ আছে, আর এটি আমাদের ঈদের দিন। অন্য একটি বর্ণনায় আছে- ইহুদিরা যেন বুঝতে পারে, আমাদের ধর্মেও আনন্দ উৎসবের সুযোগ আছে। আর নিশ্চয় আমি উদার ও ভারসাম্যপূর্ণ আদর্শ নিয়ে প্রেরিত হয়েছি।
৩. স্ত্রীর প্রতি সদয় আচরণ এবং তাকে ভালোবেসে কাছে টেনে আনার প্রতি উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। কেননা, নারী জাতিকে নরম হৃদয় দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। তার প্রকৃতিগত স্বভাবের প্রতি কেউ সাড়া দিলে সে সহজেই তার দিকে ঝুকে পড়ে। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্ত্রীদের ভালোবেসে কাছে টানার উত্তম দৃষ্টান্ত পেশ করেছেন। তাঁর ঘর ছিল মুহাব্বত, ভালোবাসা, অনুগ্রহ ও পরস্পর শ্রদ্ধাবোধের উজ্জল নমুনা। হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহার বর্ণনা (আমার চোয়াল নবীর চোয়াল মুবারকের সাথে মিশে গেল) দ্বারা স্ত্রীর প্রতি প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কতটুকু আন্তরিকতা ছিল তা প্রকাশ পাচ্ছে, যা ঈদ উপলক্ষে বাস্তবায়িত হয়েছে।
৪. হুযূর পুরনূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুউচ্চ মর্যাদা, তাঁর ব্যক্তিত্ব ও সুমহান দায়িত্ববোধ থাকা সত্ত্বেও তিনি হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর মনে তৃপ্তিদানের জন্য দাঁড়িয়ে থাকার মাঝে পিতা-মাতা, ভাই-বন্ধু ও স্বামীদের জন্য শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। স্বামীগণ স্ত্রীদের আর পিতা-মাতা সন্তানদের মনোবাসনা পূরণ করার ব্যাপারে যদি এগিয়ে না আসে তাহলে স্ত্রী ও সন্তানদের মনে এর একটা বিরূপ প্রভাব পড়ে, যা তাকে মানসিক ও সামাজিক ভাবে বিপর্যস্ত করে ফেলে।
৫. খেলা-ধুলায় ব্যস্ত হওয়ার সময় অবশ্যই শরীয়তের সীমারেখার ভিতর থাকতে হবে। কোন গুনাহে লিপ্ত হয়ে অথবা আল্লাহর বিধান নষ্ট করে কখনও খেলা-ধুলা করা যাবে না। হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহার বক্তব্যে বিষয়টি স্পষ্ট হচ্ছে। তিনি বলেন : আমি হাবশিদের খেলা দেখার সময় নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে আড়াল করেছিলেন। বর্ণনা থেকে বুঝা গেল যে, মেয়ে দুটো গাইতেছিল তারাও ছিল নাবালেগা। তাই উপযুক্ত প্রাপ্তবয়স্কা মেয়েদের গাওয়ার প্রশ্নই আসে না। তাছাড়া গান গাওয়া তাদের পেশা ছিল না। তারা শুধু কবিতা আবৃতির মাধ্যমে তাদের অনুভূতি প্রকাশ করেছিল যা শরীয়ত বহির্ভূত ছিল না।
বস্তুত ঈদ কোন ব্যক্তি কেন্দ্রীক আনুষ্ঠানিকতার নাম নয়। তাই কিছু মানুষের আনন্দ উৎসবের মাধ্যমে এর হক আদায় হবে না। বরং ঈদ হলো সমগ্র মুসলিম জাতির আনন্দ। শরীয়ত বিষয়টিকে খুব গুরুত্ব দিয়েছে। সবচেয়ে কাছের মানুষ পিতা-মাতা থেকে শুরু করে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন সকলে মিলে আনন্দ উপভোগ করবে। এটাই শরীয়তের দাবি। ঈদুল ফিতরের দিন সকাল বেলা সকল মুসলমানের জন্য খাবার ব্যবস্থা নিশ্চিত করার মাধ্যমে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিষয়টি আরো পরিস্কারভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন। আর ঈদুল আজহার দিন কুরবানির ব্যবস্থা করেও তিনি ব্যাপারটি ফুটিয়ে তুলেছেন। পৃথিবীতে ইসলাম ব্যতীত অন্য কোন রীতি আদর্শ ফকির মিসকিনদের জন্য এমন ব্যাপকভাবে পানাহারের আয়োজন করতে সক্ষম হয়নি। তাই তো মুসলমানদের মধ্য থেকে মহান দানশীল ব্যক্তিবর্গ মানুষের প্রয়োজন মিটানোর ব্যাপারে খুবই গুরুত্ব দিতেন। ঈদ হলো আনন্দ, দয়া, ভালোবাসা ও মিল মুহাব্বতের আদান প্রদানের নাম। ইতিহাস স্বাক্ষ্য বহন করে, ঐ সকল মহামানবগণের আনন্দ পরিপূর্ণ হত না যতক্ষণ না তারা তাদের আশপাশের ফকির ও অভাবী মানুষের প্রয়োজন মেটাতে না পারতেন। তাই তারা গরীব-দুঃখীকে খাবার খাওয়াতেন, তাদের মাঝে পোশাক বিতরণ করতেন এবং তাদের পাশে এসে দাঁড়াতেন। কবি কাজি নজরুল ইসলাম কতইনা সুন্দর বলেছেন
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশির ঈদ
তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানী তাকীদ
তোর সোনা-দানা, বালাখানা সব রাহে লিল্লাহ
দে যাকাত, মূর্দা মুসলিমের আজ ভাঙ্গাতে নিঁদ।
সবচেয়ে বড় কথা হলো অমুসলিমদেরকে দাওয়াত দেয়া ও তাদের ইসলামের হাকীকত সম্পর্কে অবগত করানোর জন্য ঈদ একটি বড় ধরণের মাধ্যম। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কালামে এর প্রতি উৎসাহ দিয়েছেন। ইরশাদ হচ্ছে-
"আল্লাহ তায়ালা তোমাদেরকে ঐ সকল লোকের সাথে ভাল ব্যবহার করতে ও তাদের প্রতি অনুগ্রহ করতে নিষেধ করেন না, যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি এবং তোমাদেরকে ঘর থেকে বের করে দেয়নি"। (সূরা মুমতাহিনাহ, আয়াত : ৮)
আল্লাহ রব্বুল ইজ্জত আমাদেরকে মহিমান্বিত দিবস ঈদকে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাত অনুযায়ী পালন করার তওফিক দান করুক, যেন ঈদের অনাবিল আনন্দে ভরে উঠে আমাদের জীবন এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের মাধ্যমে ধন্য হয় আমাদের পরকালীন জীবন। আমিন বিহুরমাতি সৈয়্যদিল মুরসালিন সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
লিখক: আরবী প্রভাষক, রাণীরহাট আল-আমিন হামেদিয়া ফাযিল মাদ্রাসা।
কোন মন্তব্য নেই