আখেরী চাহার শম্বাহ কি?
প্রশ্ন: আখেরী চাহার শম্বাহ দিবসে মুসলিম জাতির করণীয় সম্পর্কে জানিয়ে কৃতজ্ঞ করবেন।
উত্তর:আখেরি চাহার শােম্বাহ। এটি অতিপরিচিত একটি ফারসি বাক্য। আখের অর্থ শেষ । আর চাহার শােম্বা মানে বুধবার। মাহে সফরের সমাপনি বুধবারকে ভারতীয় উপমহাদেশে আখেরি চাহার শােম্বাহ হিসেবে বুযুগানেদ্বীন নামকরণ করেছেন। কেননা, হিজরি ১১ সনের শেষ বুধবারটি পূণ্যবান মুসলমানদের জন্য একটি স্বরণীয় দিন হিসাবে বিবেচিত। কেননা এইদিনে মানবতার মুক্তির দূত রাহমাতুল্লিল আলামিন হযরত রাসুলে করিম সল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শেষ বারের মতাে সুস্থতা বােধ করেছিলেন।
আখেরি চাহার শােম্বায় কী হয়েছিলােঃ
আখেরি চাহার শােম্বায় নবিজি সরকারে দুজাঁহাﷺ সুস্থতা অনুভব করছিলেন মর্মে বর্ণনা রয়েছে। যেমন- হাদিসপাকে হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা বলেছেনঃ
-“নবি করিম সালাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার ঘরে আসার পর রােগ আরাে বেড়ে গেলাে। তখন তিনি ইরশাদ করলেন, এমন সাতটি মশকের পানি আমার উপর ঢাল যে গুলাের বাঁধন খােলা হয়নি। তাহলে হয়তাে লােকদেরকে আরাে কিছু উপদেশ দিতে পারবাে। অতঃপর নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে তাঁর মহিয়সী স্ত্রী হযরত হাফসার গামলায় বসিয়ে আমরা তাঁর উপর মশকের পানি ঢালতে লাগলাম । হুযুর ইশারা করে জানালেন, আমাদের কাজ শেষ। তিনি সুস্থ অবস্থায় লােকদের নিকট বের হয়ে গেলেন, তাদেরকে নামায পড়ালেন ও খুতবা দিলেন।
(ইমাম বুখারী, আস-সহীহ, ৬/১১ পৃ. হা/৪৪৪২, ইমাম নাসাঈ, আস-সুনানুল কোবরা, ৬/৩৮৩ পূ, হা/৭০৪৬)
(ইমাম বুখারী, আস-সহীহ, ৬/১১ পৃ. হা/৪৪৪২, ইমাম নাসাঈ, আস-সুনানুল কোবরা, ৬/৩৮৩ পূ, হা/৭০৪৬)
হুযুর আকদাস সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র শারিরিক সুস্থতার পর হযরত ফাতেমা, ইমাম হাসান ও হােসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমদের ডেকে আনা হলাে। হযরত বেলাল এবং সুফফাবাসি রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমগণ হুযুরের সুস্থতার এ খবর বিদ্যুতের ন্যায় ছড়িয়ে দিলেন মদিনার ঘরে ঘরে। সাহাবা কিরামদের হৃদয়ে আনন্দে তরঙ্গ বয়ে চলছিলাে। রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওসাল্লামার শারীরিক সুস্থ্যতায় তাঁরা কতটুকু প্রফুল্লতাবােধ করেছিলেন তার আন্দাজ করা যায় নি। হাদিসপাকের বর্ণনার নিরিখে।। ‘যখন এ সংবাদ হযরত সিদ্দিকে আকবর রাদিয়াল্লাহু আন শুনলেন, পাঁচ হাজার। দিরহাম সদকা দিলেন মিসকিনদের মাঝে। হযরত ফারুক আযম রাঃ আনহু হুযুরের সুস্থতার আনন্দময়ী এ বার্তা শুনে সাতহাজার, হযরত ওসমান রাদিয়াল্লাহ আনহু দশহাজার, হযরত মাওলা আলি রাদ্বিয়াল্লাহু তিনহাজার দিরহাম অকাতরে দান করেছিলেন নবিপ্রেমে। তৎকালীন আরবের ধনাঢ্য ব্যবসায়ী হারত আবদুর রহমান ইবনে আওফ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু একশত উট সদকা করেছিলেন। (খাজা নিযাম উদ্দিন আওলিয়া; রাহাতিল কুলুব ১৩৯ পৃষ্ঠা।)
নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র সাময়িক রােগ মুক্তির এই দিবসকে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য পারস্যসহ মধ্য এশিয়ার ভারত উপমহাদেশে অত্যন্ত ভাবগাম্ভির্য্য পরিবেশে দিনটি পালন করা হয়। লক্ষ্য করলে দেখবেন, কুরআনুল করিমে অসংখ্য স্থানে অন্যান্য নবিদের স্মৃতি বিজড়িত দিনগুলিকে মহান রব ‘আইয়ামিল্লাহ' বা আল্লাহর দিন বলে আখ্যায়িত করেছেন। যেমন:
وَلَقَد أَرسَلنا موسىٰ بِـٔايٰتِنا أَن أَخرِج قَومَكَ مِنَ الظُّلُمٰتِ إِلَى النّورِ
وَذَكِّرهُم بِأَيّىٰمِ اللَّهِ إِنَّ فى ذٰلِكَ لَءايٰتٍ لِكُلِّ صَبّارٍ شَكورٍ
"আর নিশ্চয় আমি মুসাকে আমার নিদের্শনাদি সহকারে প্রেরণ
"আর নিশ্চয় আমি মুসাকে আমার নিদের্শনাদি সহকারে প্রেরণ
করেছি। আপন সম্প্রদায়কে অন্ধকার থেকে আলােতে নিয়ে এসাে এবং তাদেরকে আল্লাহর দিন সমূহ স্মরণ করিয়ে দাও, নিশ্চয় তাতে ধৈর্যধারনকারি ও কৃতজ্ঞশীলদের জন্য রয়েছে নিদর্শন’।
(সুরা ইব্রাহীম, আয়াতঃ৫)
উল্লেখিত আয়াতে করিমায় মুফাসসিরিন কেরাম বলেন, بِأَيّىٰمِ اللَّهবলতে যেসব দিনের সাথে আল্লাহর প্রিয়বান্দাদের সম্পর্ক বিশেষভাবে হয়ে যায়; মুলত সেগুলােই بِأَيّىٰمِ اللَّه বা আল্লাহর দিন। (তাফসীরে নুরুল ইরফান, ৬৭০ পৃঃ)
উক্ত আয়াতের আলােকে পরিষ্কার হয়ে যায়, আখেরি চাহার শােম্বা বা সফর মাসের সমাপনি বুধবারের সাথে খােদ নবিজি সরকারে দো জাঁহা সল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র রােগমুক্তির সাথে সম্পর্কিত। সুতরাং এ দিনের মর্যাদা ও স্মৃতি রক্ষার্থে যেসব বুযুর্গানেদ্বীন নফল ইবাদত সমূহের তালিম প্রদান করেছেন তা কোনভাবে নিচক কিংবা অবান্তর বলা যাবে না।
৩৩. খাজা নিযাম উদ্দিন আওলিয়া; রাহাতিল কুলুব ১৩৯ পৃষ্ঠা। (খ) মুফতি হাবিব সামদানি; বার চান্দের ফজিলত ১৫ পৃষ্ঠা। (গ) অধ্যক্ষ এম.এ. জলিল; সায়াদতে আবাদিয়া সূত্রে নূর নবী ২৫০ পৃষ্ঠা। ৩৪. সুরা ইবরাহিম (১৪) আয়াত; ৫। ৫. মুফতি আহমদ ইয়ার খাঁন নঈমি; তাফসিরে নুরুল ইরফান (বাংলা সংস্করণ) ৬৭০ পৃষ্ঠা।
‘জাওয়াহেরুল কুনুজ’ কিতাবের ৫ম খণ্ডের ৬১৬ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে সফর মাসের শেষ বুধবার সূর্যোদয়ের আগে গোসল করা উত্তম। সূর্যোদয়ের পর দুই রাকাত নফল নামায পড়া ভাল। নামাযের নিয়ম হল প্রথম রাকাতে সূরা ফাতেহার পর কুলিল্লা হুম্মা মালিকাল মূলক শেষ পর্যন্ত এবং দ্বিতীয় রাকাতে ফাতেহার পর কুলিদ্ উল্লাহা আবিদ উর রহমানা আয়্যামান তাদ্য়ু ফালাহুল আসমাউল হুসনা ওলা তজহার বেছালাতিকা ওয়া তোখাফিত বিহা অয়াবতাগী বাইনা জালিকা সাবিলা’ থেকে শেষ পর্যন্ত পাঠ করবে। সালাম ফিরানোর পর নিম্নোক্ত দোয়া পাঠ করবে আল্লাহুম্মাছরাফ আন্নী শররা হাজাল ইউওমে ওয়াছিমনী মিন শাওমিহি ওয়াজ তানিরনী আম্মা আখাফু ফিহি মিন নখুছাতিহী ওয়া কুরবাতিহী বিফদলিকা ইয়া দাফিয়াশ শুরুরী ইয়া মালিকান নুশুরী ইয়া আরহামার রাহিমীন।
অনুরূপভাবে জাওয়াহেরুল কুনুজ ৫মখণ্ড ৬১৭ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে মাহে সফরের শেষ বুধবার সপ্ত সালাম তথা সাতটি আয়াতে সালাম লিখে তা পানিতে ধুয়ে পানিটুকু পান করবে। মাওলানা আবদুল হাই লক্ষ্মৌভী ও তার ‘মজমুয়ায়ে ফতোয়ায়’ একথা উল্লেখ করেছেন।
‘তাযকিরাতুল আওরাদ’ কিতাবে উল্লেখ আছে যে ব্যক্তি আখেরি চাহার শম্বা তথা মাহে সফরের শেষ বুধবারে প্রত্যেক ওয়াক্ত নামাযের পর আয়াতে রহমত (সাত সালাম) পাঠ করে নিজের শরীরে ফুঁক দেয় বা তা পানের উপর লিখে ধুয়ে পান করে আল্লাহ পাক তাকে সব রকম বালা মুসিবাত ও রোগ ব্যাধি হতে নিরাপদ রাখবেন।
‘আনওয়ারুল আউলিয়া’ কিতাবে বর্ণিত আছে, যে ব্যক্তি আখেরি চাহার শম্বার দিন দুই রাকাত নফল নামায আদায় করবে আল্লাহ পাক তাকে হৃদয়ের প্রশন্ততা দান করবেন। প্রত্যেক রাকাতে সূরা ফাতিহার পর এগারবার করে সূরা এখলাস পাঠ করবে এবং নামায শেষে ৭০ বার দরূদ শরীফ পড়বে অথবা প্রতি রাকাতে ৩বার সূরা ইখলাস দ্বারা নামায শেষ করে ৮০ বার সূরা আলাম নাশরাহলাকা এবং সুরা নসর, সূরা ত্বীন ও সূরা এখলাস পাঠ করবে। উপরিউক্ত নিয়মে পড়া ভাল নতুবা স্বীয় সুযোগ অনুযায়ী সূরা কেরাত দিয়ে পড়লেও অসুবিধা নাই। এ বিষয়ে ইমাম শেরে বাংলা আল্লামা সৈয়দ আজিজুল হক আলকাদেরী (রাহ.) ফতোয়ায়ে আজিজী শরীফে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।
সুতরাং মাহে সফরের শেষ বুধবার দোয়া দরূদ পড়া, কলার পাতায় আয়াতে শেফা লিখে গোসল করা এবং আয়াতে সালাম লিখে পাানিতে ঢেলে তা পান করা ভাল ও উত্তম আমল। শরিয়তের দৃষ্টিতে বাধা নাই।
কোন মন্তব্য নেই