মাদকের ভয়ানক কুফল:প্রতিকারের উপায়
মুহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মাসুম
আরবি প্রভাষক, রাণীরহাট আল-আমিন হামেদিয়া ফাযিল মাদরাসা।
একটি সুষ্ঠু সুন্দর সমাজব্যবস্থা বিনির্মাণের জন্য সুস্থ মস্তিস্ক একান্তকাম্য। মাদক মানুষের বিবেক-বুদ্ধিকে নস্যাৎ করে দেয়। ফলে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র তথা গোটা মানব সমাজের অকল্যাণ ও অমঙ্গল সাধিত হয়। মাদকের ভয়াবহ পরিণতি দেখে আজ প্রশাসন বিচলিত, অভিভাবকরা আতঙ্কিত চিকিৎসকেরা দিশেহারা। কারণ যে তরুণ যুবশক্তি দেশের মেরুদন্ড, নেশার ছোবলে আজ সেই মেরুদন্ড ভেঙ্গে পড়ে যেতে বসেছে। নেশার ছোবলে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ছে লক্ষ প্রাণ, ধ্বংস হচ্ছে পরিবার ও সামাজিক শান্তি। রাষ্ট্র অনিশ্চিত ভবিষ্যতের হাতছানি দেখতে পাচ্ছে। এটি অসংখ্য পাপকার্য, অপরাধ ও অসামাজিক কর্মের মূল। ইউরোপীয় ও পাশ্চাত্য সভ্যতা মদ, নারী ও সম্পদের উপর প্রতিষ্ঠিত। ফলে আধুনিক বিশ্বে এ সভ্যতা চরমভাবে বিপর্যস্ত হয়েছে। অথচ ইসলাম চৌদ্দশত বছর পূর্বেই সমাজকে সুসভ্য করার জন্য মাদক নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। ইসলাম মানুষকে দৈহিক, মানসিক, আধ্যাত্মিক, সামাজিক ও নৈতিক অধঃপতন থেকে বিরত থাকার আহবান জানিয়েছে। ইসলাম মানুষের বিবেক-বুদ্ধিকে হেফাযতের জন্য মাদক বিরোধী আইন রচনা করেছে। আর আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রভূত উন্নতি সাধিত হওয়ার কারণে মাদকের মারাত্মক ক্ষতি সর্বজন স্বীকৃত।
মাদকের করাল থাবায় যে একবার পড়েছে তার আর রক্ষা নাই। একটি পরিবার ধ্বংস করতে একজন মাদকসেবী যথেষ্ট। মাদাকাসক্ত ১৫ বছর বয়সী কিশোর ওয়াজির নিজের মা-বাবার সামনেই আত্মহত্যা করে । কিছু দিন আগে মাদাকাসক্ত এক তরুণের অত্যাচার সইতে না পেরে তাকে ভাড়াটিয়া খুনী দিয়ে খুন করায় তার আপন গর্ভধাররিণী মা। আমাদের সমাজের জন্য এ এক বিরাট অশনী সংকেত। মাদকের ভয়াল গ্রাস থেকে সমাজের কোন শ্রেণীই আজ নিরাপদ নয়। মাদক ব্যবসায়ী এবং এর সাথ জড়িত গোষ্ঠিদের এখনই প্রতিরোধ করা না গেলে একদিন পুরো দেশ এদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়বে। এ সময়ে মাদক নির্মূলের অঙ্গীকার সাধুবাদ পাওয়ার দাবী রাখে। তবে প্রশ্ন উঠে নির্মূলের ধরণ নিয়ে। অন্য সব উপকরণ ছাড়া প্রতিদিন শুধুমাত্র পঞ্চাশ লক্ষ ইয়াবার চাহিদা রয়েছে। পুলিশের সাঁড়াশি অভিযানে ধরা পড়ছে কিঞ্চিৎ মাত্র। পার্শবর্তী প্রতিবেশী দেশ থেকে বানের জলের মত মাদক আসে। নিত্য নতুন কৌশল নিয়ে হাজার হাজার মানুষ এ পেশায় জড়িয়ে পড়ছে। বলাবাহুল্য এর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ বহুল আলোচিত চিহ্নিত গডফাদারদের হাতে। তাদের নিয়ে শত শত ধারাবাহিক প্রতিবেদন মিডিয়ায় আসে। আইনের ফাঁক গলে এসব রাঘব বোয়ালরা বরাবর ধরাছোয়ার বাইরে থেকে যায়। প্রমাণ নাই তাই উনারা আছেন বহাল তবিয়তে। খুচরো বিক্রেতা বা পাইকারদের ওপর কঠোর হয়ে আদৌ কি মাদক মুক্ত সমাজ গড়া সম্ভব? টেকনাফসহ সব সীমান্ত পথে আসা মাদক নামমাত্র মূল্যে বহন করার জন্য বিপুল সংখ্যক লোক জড়িয়ে পড়ছে। বেঁচে থাকার তাগিদে লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গাসহ দরিদ্র স্থানীয়রাও এ পেশায় জড়িত। টেকনাফ, উখিয়া, রামু, কক্সবাজার , ধুমধুমসহ সব সীমান্ত পথে রমরমা মাদক বাণিজ্য। স্থানীয় অনেক জনপ্রতিনিধি শত শত কোটি টাকার মালিক। সীমান্ত পেরিয়ে ঢুকার সাথে সাথে প্রশাসনের আনুকূল্য। ঢাকা চট্টগ্রামসহ দেশের সব বড় বড় বস্তিতে প্রতি রাতে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা। এ বিপুল পরিমাণ অর্থের হাতছানি উপেক্ষা করা দুঃসাধ্য। নগর ও গ্রামের অলি-গলি সর্বত্র সহজলভ্য। মাদকের সব রুট, সব আখড়া পুলিশ প্রশাসনের জানা। তাদের অগোচরে কোন অবৈধ ব্যবসা চলতে পারে না। এ এমনি ভয়াবহ চক্র যাতে সবাই জড়িয়ে আছে। প্রায়ই দেখা যায় ইয়াবাসহ পুলিশের কর্মকর্তাও হাতে নাতে ধরে পড়েন। সাসপেনশন বদলী সব হয় কিন্তু লোভের ফাঁদে অন্যরা জড়াবে না সে নিশ্চয়তা কিন্তু নাই। সমগ্র দেশের মাদকের এ বিশাল চাহিদার যোগান থেমে নেই। পর্দার আড়ালে কুশীলবগণ ফুলে ফেঁপে ঢোল হচ্ছেন যথারীতি। সমাজ ও দেশের এসব প্রতিভূদের নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারলে মাদক যুদ্ধ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। আগে সর্ষের ভূত তাড়ান, তারপর আসবে সফলতা।
মাদকদ্রব্য হলো ভেষজদ্রব্য যা প্রয়োগে মানবদেহে মস্তিস্কজাত সংজ্ঞাবহ সংবেদন হ্রাস পায় বা থাকে না বললেই চলে। মাদকদ্রব্য গ্রহণে মানুষ স্বাভাবিক অবস্থায় না থেকে অস্বাভাবিক অবস্থায় চলে যায় এবং তার ফলে এক সময় বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়। মাদকদ্রব্যের বেদনা নাশক ক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকে তন্দ্রাচ্ছন্নতা, আনন্দচ্ছাস, মেজাজ পরিবর্তন, মানসিক আচ্ছন্নতা, শ্বাসপ্রশ্বসের অবনমন,বমি কোষ্টবদ্ধতা ও স্বতঃক্রিয় স্নায়ুতন্ত্রের ক্রিয়াকলাপের পরিবর্তনসহ অপর্যাপ্ত ঘুম ও নিদ্রাজনিত সমস্যা।
বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্য : বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে মাদকদ্রব্যেরও যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। মদ, গাঁজা, ভাঙ, আফিম, চরস, ভদকা প্রভৃতির সাথে মাদকদ্রব্য হিসেবে যুক্ত হয়েছে হিরোইন, মারিজুয়ানা এলএসডি, প্যাথেড্রিন, কোকেন, মরফিন, পপি, হাশিশ, ক্যানবিস, স্মাক ইত্যাদি। তাছাড়াও ইয়াবা নামক মাদকের সর্বনাশা ছোবল বর্তমান যুবসমাজকে দংশন করছে। একসময় দেশের তরুণ সমাজের মধ্যে ভারতীয় কফ সিরাপ ‘ফেনসিডিল’ আসক্তি ছিল বড় সমস্যা৷পরে সেই স্থানটি দখল করে নেয় মিয়ানমার থেকে আসা উত্তেজক বড়ি ‘নয়াবা’৷ ২০১৭ সালে বিভিন্ন সংস্থা উদ্ধারই করেছে চার কোটি ইয়াবা, যা ২০১৫ সালের দ্বিগুণ৷
মাদকের উৎস ভূমি : গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল (লাওস, মায়ানমার, থাইল্যান্ড) গোল্ডেন ক্নিসেন্ট (আফগানিস্তান, ইরান, পাকিস্তান) গোল্ডেন ওয়েজ হেরোইনের মূল উৎস। এ সমস্ত দেশে আফিমের চাষ করা হয় যা মাদকের প্রাচীন উপাদান। পপি ফুলের নির্যাস থেকে কৃষকরা তৈরি করেন কাঁচা আফিম। তা থেকে মরফিন ও বিশেষ প্রক্রিয়ায় হেরোইন উৎপন্ন হয়। একটি জরিপে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্র , কলম্বিয়া, ব্রাজিল, জ্যামাইকা, প্যারাগুয়ে, ঘানা, নাইজেরিয়া, কেনিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, থাইল্যান্ড প্রভৃতি দেশে মারিজুয়ানা উৎপন্ন হয়। দক্ষিণ আমেরিকা, পেরু, কলম্বিয়া, ব্রাজিল, বলিভিয়া কোকেন উৎপাদনকারী দেশ। মেক্সিকো, যুগোস্লাভিয়া, হাঙ্গেরীর সীমান্ত প্রদেশ, সাইপ্রাস, ইরান, আফগাস্তিসান, পাকিস্তান, ভারত, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, নেপাল, অস্ট্রেলিয়ার তাসমেনিয়ায় হেরোইন ও আফিমের উৎপাদন হচ্ছে। বিভিন্ন অবৈধ পন্থায়, চোরাচালানের মাধ্যমে বাংলাদেশে এসব মাদক পাঁচার হয়ে আসে।
মাদকাসক্তির কারণ : বিজ্ঞানী গবেষক ও চিকিৎসকরা মাদকদ্রব্য বা নেশার আসক্তির যে কারণগুলো চিহ্নিত করেছেন, তন্মধ্যে ১. সঙ্গীদের চাপ এবং বন্ধুদের কাজ সমর্থনের চেষ্টা, ২. নেশার প্রতি কৌতুহল, ৩. সহজে আনন্দ লাভের বাসনা, ৪. প্রথম যৌবনের বিদ্রোহী মনোভাব, ৫. মনসÍাত্ত্বিক বিশৃঙ্খলা, ৬. প্রতিকূল পারিবারিক পরিবেশ,৭.ধর্মীয় অনুভূতির অভাব,৮. মাদকের সহজলভ্যতা ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেকযোগ্য।
মাদকের কুফল: এইডস, ক্যান্সার ও হৃদরোগের মতো মাদকাসক্তিও ভয়াবহ রোগ। মাদকাসক্তির ফলে শরীর ও মন এমন অবস্থায় পৌঁছে যে মাদক না নিলে প্রত্যাহারজনিত কারণে আসক্তের শরীরে নানারকম উপসর্গ দেখা দেয়। মাদকের আসক্তি মানুষের জীবনে শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, পারিবারিক, অধ্যাত্মিক বিভিন্ন ধরণের কুফল দেখা দেয় নিন্মে বিশদভাবে বর্ণনা করা হলো।
মাদকের শারীরিক কুফল : সাধারণভাবে তামাক বা সিগারেটের মাধ্যমে মাদকাসক্তের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হয়। একজন ধূমপায়ী নিজের ও অধুমপায়ীদের নানা শারীরিক সমসন্যা ও জটিল রোগের কারণ হতে পারে। ধুমপানের মাধ্যমে যে ক্ষতিপয় দিকগুলো সমীক্ষায় উঠে এসেছে তা হলো: ১. একটি সিগারেটের ধোয়ায় ১৫ বিলিয়ন পদার্থের অনু থাকে যা সব মানুষের জন্যেই ক্ষতিকর। ২. একটি সিগারেট সেবনের ফলে একজন ধুমপায়ীর ৫.৫ মিনিট আয়ু কমে যায়। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। ৩. ধুমপায়ীদের মধ্যে পুরুষত্বহীনতা, গর্ভের সন্তান বিকলাঙ্গ বা অন্ধ হতে পারে, স্ট্রোক ও হৃদরোগের মতো জটিল রোগ হতে পারে। ৪. বিশ্বে প্রতি বছর ১০ লাখ মানুষ ধুমপানের কারণে ক্যান্সরে আক্রান্ত হয়। ফুসফুস ক্যান্সারে যতো লোক মারা যায় তাদের ৮৫ জন ধুমপায়ী। ব্রংকাইটিস ও হৃদরোগ ধুমপায়ীদের স্বাভাবিক অসুখ। প্রতি বছর ৫০ লাখ মানুষ অর্থাৎ ৬.৫ সেকেন্ডে ১ জন প্রাণ হারায়। ৫. এছাড়া হাঁড় ও দাঁতের মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতিসহ বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিকল হয়ে যেতে পারে। এছাড়া অন্যান্য মাদক যেমন : হেরোইন, গাঁজা, মদ, আফিম, পেথেডিন প্রভৃতি মাদক গ্রহণে কর্মক্ষমতার অবনতি, ক্ষয় রোগ, স্নায়ুবিক দুর্বলতা, যকৃতের তীব্র প্রদাহ, রক্ত দূষণ, এইডস ও প্রজননতন্ত্রের সমস্যাসহ নানা জটিলতায় ও রোগে ভোগে মাদকাসক্তরা।
মানসিক কুফল : মাদকের কালো থাবা এমনভাবে মানুষকে গ্রাস করে যাতে মানসিক উশৃঙ্খলা, অবসাদ, বিষন্নতায় ভোগে আসক্তরা। মাদকের প্রতি নির্ভরশীল হয়ে ওঠে। নেশার ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে নেশাগ্রহণ করতে হয়। মাদকদ্রব্য ক্রয় করতে প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহের জন্যে অপরাধ জগতে সে নিজেকে সমর্পন করে। ড্রাগ নেয়ার স্বার্থপরতা, প্রতিশোধ স্পৃহা রাগ, জিদ, ভয়, লজ্জা, হিংসা, ঘৃণা, সংকোচ, হতাশা, আত্মদুঃখ, একাকিত্ব ইত্যাদি নেতিবাচক পরিবর্তন তার আচরণের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। কোনো ঘটনায় সে অতি প্রতিক্রিয়া করে আবার কখনো কোনো প্রতিক্রিয়াই দেখায় না। প্রকৃতপক্ষে কোনো অনুভূতির মূল্য সে দিতে জানে না। সে শুধু বেঁচে থাকে ড্রাগ ব্যবহারের জন্যে। আর ড্রাগ নেয় বেঁচে থাকার জন্যে।
সামাজিক কুফল : কোনো পরিবারের ছেলে, স্বামী, মেয়ে যে কোনো সদস্য মাদকাসক্ত হলে সমগ্র পরিবার সমাজে হেয়প্রতিপন্ন হয়। সমাজে সবাই এদের অপরাধী মনে করে এবং সে নজরেই দেখে। কারণ নেশার পয়সা জোগাড় করতে এ ব্যক্তিরা নানা অসামাজিক কাজে জড়িয়ে পড়ে। আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশি কারো কাছে মান সম্মান থাকে না। ঘরে ভাই বা বাবা কেউ মাদকাসক্ত হলে বিবাহযোগ্য মেয়ের বিয়ে দেয়া দুষ্কর হয়ে পড়ে। কারণ এ পরিবারের সদস্যদের কেউ সহজভাবে মেনে নিতে পারে না। সমাজে এরা অবহেলিত, অযাচিত। সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণও মাদকাসক্তি।
অর্থনৈতিক কুফল : নেশার টাকা যোগানোর জন্যে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই অপকর্ম ছাড়াও ঘরবাড়ি হতে আসবাবপত্র ও তৈজসপত্র বিক্রি করে মাদকাসক্তরা নিজে সর্বশান্ত হচ্ছে, পরিবারকেও পথে বসাচ্ছে। এমনও ঘটনা আছে যে, নেশার টাকা না দিতে পারায় মাদকসক্তরা খুন পর্যন্ত করছে পরিবারের সদস্যকে। কারণ তখন বাবা-মা, ভাই-বোন সম্পর্কে হিতাহিত জ্ঞান থাকে না।
পারিবারিক কুফল : পরিবারের কোনো সদস্য মাদকাসক্ত হলে সে পরিবারের অশান্তি আর ভোগান্তির সীমা থাকে না। মাদকাসক্তি কেবল নিজেকেই ক্ষতিগ্রস্থ করে না। তার পরিবারের সকল সদস্যদের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। কত ঘর ভেঙ্গে গিয়েছে। বিকশিত হবার আগেই হারিয়ে যায় কত উদীয়মান প্রতিভা। বিধবা হয় কত নারী, কত শিশু এতিম হয়।
প্রতিকারের উপায় : মাদকের প্রতিকার করতে হলে নিম্নলিখিত বিষয়াদি কার্যকর করা একান্ত প্রয়োজন। ১. পরিবার থেকেই শুরু করতে হবে মাদক বিরোধী অভিযান, এক্ষেত্রে মা-বাবা কিংবা বড় ভাই-বোন মাদকের কুফল ও ভয়াবহতা সম্পর্কে পারিবারিক আলোচনা ও তা থেকে বিরত থাকতে পরিবারের সদস্যদেরকে উৎসাহিত করবে। ২. পিতা-মাতাকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে তার সন্তান কোথায় যাচ্ছে কাদের সাথে মিশছে। কারণ, ছেলে মেয়েদের সঠিক তথ্য জানানোর দায়িত্ব স্কুল ও অভিভাবকের উপর। তা না হলে ভুল মাধ্যমে তারা বিষয়টিকে সঠিকভাবে বুঝতে নাও পারে। ৩. সর্বোপরি পরিবারে সদস্যদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকতে হবে। ৪. সাংস্কৃতিক দিক হতে তরুণদের আকর্ষণযোগ্য আদর্শিক কার্যক্রম তাদের সামনে তুলে ধরতে হবে। যা তাদের গতানুগতিক ব্যস্ত জীবন থেকে স্বস্তি ও বিনোদন দেবে। ৫. ধূমপানসহ অন্যান্য মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার দমন আইন ও ধারাসমূহ কঠোর হস্তে বাস্তবায়ন করতে হবে। ৬. মানবিক ও নৈতিক মূল্যবোধ গঠনে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলতে হবে। ৭. বেকার যুবকদের জন্যে কর্মসংস্থান বা আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। ৮. শিক্ষা ও সহশিক্ষা কার্যক্রমে মাদক বিরোধী সচেতনতামূলক পাঠ অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ৯. বিভিন্ন প্রচারমাধ্যম, টেলিভিশন, বেতার ও পত্র-পত্রিকায় মাদক ও মাদকাসক্তদের ভয়াবহ অবস্থার কথা প্রচার করতে হবে যাতে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এ ব্যপারে অনুৎসাহিত মনোভাব গড়ে ওঠে।
মহান আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘তারা আপনাকে মদ, জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। আপনি বলে দিন, এ দুইয়ের মধ্যেই রয়েছে বড় পাপ। আর মানুষের জন্য উপকারিতাও রয়েছে, তবে এগুলোর পাপ উপকারিতা অপেক্ষা অনেক বড়।’ (সূূরা বাকারা : ২১৯)
নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন হিজরত করে মদিনায় আগমন করেন, তখনও মদিনাবাসীর মধ্যে মদপান ও জুয়ার প্রথা প্রচলিত ছিল। সাধারণ মানুষ এ দুটি বস্তুর শুধু বাহ্যিক উপকারিতার প্রতি লক্ষ করেই এতে মত্ত ছিল। অত:পর কয়েকজন সাহাবি মদের অকল্যাণগুলো অনুভব করেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে হযরত উমর ফারুক, মুয়ায ইবন জাবাল ও কিছু সংখ্যক আনসার সাহাবি (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম) নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম) এর দরবারে উপস্থিত হয়ে আরজ করলেন, মদ ও জুয়া মানুষের বুদ্ধি-বিবেচনাকে বিলুপ্ত করে দেয় এবং ধনসম্পদও ধংস করে দেয়; এ সম্পর্কে আপনার নির্দেশ কী- এ প্রশ্নের উত্তরেই উপরোক্ত আয়াতটি নাজিল হয়। এতে বলা হয়েছে, মদ ও জুয়ায় যদিও বাহ্যিক দৃষ্টিতে কিছু উপকারিতা পরিলক্ষিত হয়; কিন্তু বাস্তবে এ দুটির মাধ্যমে অনেক বড় বড় পাপের পথ উন্মুক্ত হয়ে থাকে; যা এর উপকারিতার তুলনায় অনেক বেশি ক্ষতিকর ও ধংসাত্মক। পাপ অর্থে এখানে সেসবও বোঝানো হয়েছে, যা পাপের কারণ হয়ে থাকে। যেমন মদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বড় দোষ হচ্ছে, তা মানুষের সবচেয়ে বড় গুণ ‘বুদ্ধি-বিবেচনা’কে বিলুপ্ত করে দেয়। কারণ, বুদ্ধি এমন একটি গুণ যা মানুষকে মন্দ, অশ্লীল কাজ থেকে বিরত রাখে। তা যখন বিলুপ্ত হয়ে যায় তখন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির জন্য যে-কোনো পাপের পথই সুগম হয়ে যায়।
অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে-‘হে ঈমানদারগণ! নিশ্চয়ই মদ, জুয়া, মূর্তি এবং ভাগ্য নির্ধারণের জন্য তীর নিক্ষেপ- এ সবগুলোই নিকৃষ্ট শয়তানি কাজ। কাজেই এসব থেকে সম্পূর্ণভাবে বিরত থাক, যাতে তোমরা মুক্তিলাভ ও কল্যাণ পেতে পার। শয়তান মদ ও জুয়ার দ্বারা তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক শত্রুতা-তিক্ততা সৃষ্টি করে থাকে; আর আল্লাহর স্মরণ এবং নামাজ থেকে তোমাদের বিরত রাখাই হলো শয়তানের একান্ত কাম্য; তবুও কি তোমরা তা থেকে বিরত থাকবে না?’ (সূরা মায়েদা:আয়াত ৯০-৯১) উক্ত আয়াত দ্বারা মদকে সর্ম্পূণরূপে হারাম করা হয়েছে। চূড়ান্ত পর্যায়ে কঠোরভাবে হারাম ঘোষণার পর নিষিদ্ধতার আইনকানুন শক্তভাবে জারি করাও বিজ্ঞতারই পরিচায়ক। এ জন্য রাসূলে করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম) মদ সম্পর্কে কঠোর শাস্তির ভয় প্রদর্শন করেছেন। তিনি বলেন, ‘সব ধরনের অপকর্ম ও অশ্লীলতার জন্মদাতা হচ্ছে মদ। এটা পান করে মানুষ নিকৃষ্টতর পাপে লিপ্ত হয়ে যেতে পারে।’ অপর হাদিসে এসেছে, ‘মদ ও ঈমান কখনো একত্রিত হতে পারে না।’ (সুনানে নাসাঈ) হযরত আনাস বিন মালিক (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, হুযূর পুরনূর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম) মদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে এমন দশ শ্রেণির লোকের প্রতি লানত করেছেন। যথা- ১. যে লোক মদের নির্যাস বের করে, ২.যে তা প্রস্তুত করে, ৩.যে তা পান করে, ৩.যে পান করায়, ৪.আমদানিকারক, ৫.যার জন্য আমদানি করা হয়, ৬. বিক্রেতা, ৭. ক্রেতা, ৯.সরবরাহকারী এবং ১০. এর লভ্যাংশ ভোগকারী। (জামে তিরমিজি : ১২৯৫)
মাদক নিয়ন্ত্রণ করতে হলে কয়েকটি বিষয় বিবেচনায় আনা জরুরি৷প্রথমত, সন্ত্রাস আর জঙ্গিবাদের মতো মাদকও একটি আন্তঃ রাষ্ট্রীয় সমস্যা, যা কোনো একটি দেশের পক্ষে একা মোকাবিলা বা নির্মূল করা সম্ভব নয়৷সংশ্লিষ্ট অন্যান্য দেশকে নিয়ে মাদকের উৎপাদন ও পাচার নির্মূলের চেষ্টা করতে হবে৷যেমন ইয়াবা বাংলাদেশ-মিয়ানমার ও থাই-মিয়ানমার সীমান্তে তৈরি হয় এবং সেটি বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডে পাচার হয়৷কিন্তু দুই দেশের কেউই তাদের অভিযানে মিয়ানমারকে সম্পৃক্ত করেনি বা করতে পারেনি৷তবে বাংলাদেশ কয়েকবার মিয়ানমার সরকারকে ইয়াবা কারখানা বন্ধের আহবান জানিয়েছে৷মিয়ানমার সরকার কারখানা বন্ধের আশ্বাস দিলেও এখনো বন্ধ হয়নি৷অন্যদিকে, বাংলাদেশ বার বার অনুরোধ করার পরেও ভারত তার সীমান্তে অবস্থিত ফেনসিডিলের কারখানাগুলো বন্ধ করেনি৷তাই ফেনসিডিল নিয়ন্ত্রণ করাও সম্ভব হয়নি৷
দ্বিতীয়ত, কোনো দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠী যদি মাদকাসক্ত হয়, তাহলে সেখানে মাদকের চাহিদা থাকবে৷যেভাবেই হোক, মাদকসেবীরা মাদক পেতে চাইবে আর পাচারকারীরাও মাদক সরবরাহ করার চেষ্টা করবে৷কিন্তু উৎপাদন ও চাহিদা বন্ধে কার্যকর কোনো উদ্যোগ বাংলাদেশ নিতে পারেনি৷তাছাড়া মাদকাসক্তদের নিরাময় ও পুনর্বাসনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থাও নেই, যেটি মাদক নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে অন্যতম অন্তরায় বলে সমাজবিদ ও মনস্তত্ববিদরা মনে করেন৷তাঁদের মতে, শুধু বল প্রয়োগ করে নয়, মাদক নির্মূলের জন্য প্রয়োজন সামগ্রিক উদ্যোগ৷
তৃতীয়ত, মাদকাসক্তির কারণ খুজে বের করা জরুরি৷মানুষ কেন মাদকাসক্ত হচ্ছে, এর সামাজিক, অর্থনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক কারণগুলো কী কী এবং কী ধরনের পদক্ষেপ নিলে তাদের ফেরানো সম্ভব, তা গবেষণা করে বের করা দরকার৷প্রয়োজন একটি মাদকবিরোধী সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা এবং সবাইকে সেই আন্দোলনে সম্পৃক্ত করা৷বাংলাদেশে এর কোনোটাই আগে হয়নি৷ ‘
বাংলাদেশে থাইল্যান্ড ও ফিলিপাইন্সের ঢঙে মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হয়েছে মে মাসের প্রারম্ভে৷এই অভিযানের ফলে হয়ত কিছুদিনের জন্য মাদকের ব্যাপকতা কিছুটা কমবে, কিন্তু মাদক নির্মূল বা এর পাচার ও সেবন কোনোটাই পুরোপুরি বন্ধ হবে না৷কারণ, অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও ভুল পদ্ধতি বেছে নিয়েছে৷আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যবহার করে তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধের মাধ্যমে মাদক নিয়ন্ত্রণ করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে, যা কোথাও সফল হয়নি৷কক্সবাজারের তথাকথিত ‘বন্দুক যুদ্ধে’ নিহত মেয়র একরামুল হকের এক অডিও নিন্দা আর প্রতিবাদের ঝড় তুলেছে দেশে-বিদেশে৷ নিহত হওয়ার পূর্ব মুহূর্তের কথোপকথনের অডিওটি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধের দাবিকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করে, যা জনমনে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে৷তাছাড়া নিহতের নাম মাদক চোরাচালানকারীদের তালিকাতেও ছিল না৷বরং তালিকায় থাকা গডফাদাররা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে৷তাদের অনেককেই আত্মগোপন ও পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে৷জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থাসহ বেশ কয়েকটি আর্ন্তজাতিক সংস্থা বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধসহ একরামুল হকের মৃত্যুর ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের আহ্বান জানিয়েছে৷সরকার নিশ্চয়ই এক্ষেত্রে করণীয় বিষয়গুলোর প্রতি নজর দেবে৷পাশাপাশি থাইল্যান্ড ও ফিলিপাইন্সের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাবে৷সরকারের উচিত, একটি সঠিক তালিকা তৈরি করে নিরপেক্ষভাবে অভিযান শুরু করা, যে অভিযানে সমাজের সকল স্তরের মানুষের সহযোগিতা থাকবে এবং প্রকৃত মাদক চোরাচালানকারীরা রেহাই পাবে না৷অন্যথায়, চলমান অভিযানে আরও মানুষ প্রাণ হারাবে, সরকার আরও সমালোচনার মুখোমুখি হবে৷আমদের প্রত্যাশা, সময়ের ব্যবধানে এসব জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উদ্যোগ আগামী প্রজন্মকে উপহার দেবে একটা মাদকমুক্ত সুন্দর আদর্শিক সমাজ।
কোন মন্তব্য নেই