দ্বিতীয় সহস্রাব্দের সংস্কারক ইমামে রব্বানী শায়খ আহমদ সেরহিন্দি (রহ.)
মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মাসুম
কালের আবর্তে মুসলিম সমাজের মূল্যবোধ, বিশ্বাস, রীতি—নীতিতে যে মেদ, বাহুল্য ও বিকৃতি দেখা দেয়, তা থেকে আত্মরক্ষার একটি পদ্ধতির নাম তাজদিদ। আবু দাউদ শরীফে বর্ণিত হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী মহান আল্লাহ তায়ালা এ উম্মতের (কল্যাণে) প্রত্যেক শতাব্দীতে মুসলিম সমাজে একজন সংস্কারক প্রেরণ করেন। যিনি উম্মাহর দেহে প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি করেন এবং মুসলিম সমাজে শিকড় গাড়া দ্বীনের বিকৃতি ও বিচ্যুতি দূর করেন। তারই ধারাবাহিকতায় ১৫৬৪ খ্রিস্টাব্দের ৫ জুন মোতাবেক ৯৭১ হিজরি সনের ১৪ই শাউয়াল জুমারাত (বৃহস্পতিবার) ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের সেরহিন্দ শরীফে জন্ম গ্রহণ করেন শায়খ আহমদ সেরহিন্দি রহমাতুল্লাহি অঅলাইহি। যিনি এক ক্রান্তিকালে ইসলামের সেবায় আত্মোৎসর্গ করেন এবং বহুবিধ কুফর ও শিরকে লিপ্ত ভারতীয় মুসলিমদের তাওহিদ ও রিসালতের অনুগামী করেন। তিনি বৈপ্লবিক কর্মসূচী গ্রহণ করে ভারত বর্ষের তৎকালীন ধর্মীয় ও রাজনৈতিক জীবনধারার সংস্কার সাধন করেছিলেন, তাই তার সংস্কারকে শত বছরের গন্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে, হাজার বছরের সংস্কার কর্মের রূপরেখায় ব্যাপ্ত করে দিয়েছে।আর তাই তাঁকে মুজাদ্দিদে আলফে সানি তথা দ্বিতীয় সহ¯্রাব্দের সংস্কারক বলা হয়।
ইমামে রব্বানীর আর্বিভাবের শুভ সংবাদ: আল্লামা জালাল উদ্দীন সুয়ূতী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এ প্রসঙ্গে ‘জামউল জাওয়াম’ ও ‘জামিউদ্ দুরার’ গ্রন্থে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
ﺑﻌﺚ ﺍﻟﻠﻪ ﺭﺟﻼ ﻋﻠﻰ ﺭﺃﺱ ﺍﺣﺪ ﻋﺸﺮ ﻣﺄﺓ ﺳﻨﺔ ﻫﻮ ﻧﻮﺭ ﻋﻈﻴﻢ ﺍﺳﻤﻪ ﺍﺳﻤﻲ ﺑﻴﻦ ﺍﻟﺴﻼﻃﻴﻦ ﺍﻟﺠﺎﺑﺮﻳﻦ ﻭﻳﺪﺧﻞ ﺍﻟﺠﻨﺔ ﺑﺸﻔﺎﻋﺘﻪ ﺭﺟﺎﻝ ﺍﻟﻮﻓﺎ
অর্থাৎ “হিজরি একাদশ শতাব্দীর আরম্ভকালে মহান আল্লাহ তাআলা এমন এক ব্যক্তি উনাকে প্রেরণ করবেন, যিনি একটি বৃহৎ নূর। তাঁর নাম হবে আমার নাম মুবারকোর অনুরূপ। দুই অত্যাচারী বাদশাহর রাজত্বকালের মাঝে তিনি আবির্ভূত হবেন এবং উনার সুপারিশে অগণিত মানুষ বেহেশতে প্রবেশ করবে।”
সম্রাট ফিরোজ শাহ্ তুঘলকের রাজত্বকালে একদা একদল শাহী কর্মচারী লাহোর থেকে দিল্লী যাওয়ার পথে পূর্ব পাঞ্জাবের সেরহিন্দের জঙ্গল অতিক্রম করছিলেন। তৎমধ্যে একজন কামেল ব্যক্তি অন্তরদৃষ্টিতে দেখতে পেলেন গভীর জঙ্গল থেকে একটি উজ্জ্বল নূর বিকিরিত হচ্ছে। দিল্লী পৌঁছেই তিনি সম্রাটের মুর্শিদ সৈয়দ জালাল উদ্দীন বুখারী রহমাতুল্লাহি আলাইহিকে এই অলৌকিক ঘটনা অবহিত করলেন। পীর সাহেব বিস্তারিত শুনে সম্রাটকে দ্বিতীয় সহে¯্রর ইসলামের মুজাদ্দিদ আগমনের শুভ সংবাদ প্রদান করে বললেন, ‘ এই সিরহিন্দেই জন্ম লাভ করবেন যমানার মুজাদ্দিদ ও ইমাম, যাঁর ঐশী নূরে সমস্ত পৃথিবী আলোকিত হবে, যিনি পূর্ববর্তী সমস্ত অলী এবং কুতুবগণের কামালাত লাভে ধন্য হবেন।’ যুগপৎ চমকিত ও বিস্মিত সম্রাট পীর সাহেবের কথা শুনে পূণ্য লাভের মানসে সেরহিন্দের জঙ্গল কেটে সেখানে একটি শাহী দূর্গ নির্মাণে মনোনিবেশ করলেন। এদিকে পীর সাহেব তদীয় খলিফা হযরত ইমাম রফিউদ্দীন রহমাতুল্লাহি আলাইহিকে সেরহিন্দের কুতুব মনোনীত করে বললেন, ‘মনে রেখো, সেই মুজাদ্দিদের জন্ম তোমার বংশেই হবে’। তিনি ছিলেন মুসলিম জাহানের দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর বংশধর। আর মুজাদ্দিদে আলফে সানী রহমাতুল্লাহি আলাইহি ছিলেন ফারুকে আজম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর সাতাশতম অধঃস্তন পুরুষ।
তাঁর আগমন কালে ভারত উপমহাদেশের ধর্মীয় অবস্থা: হযরত শায়খ আহমদ সেরহিন্দি রহমাতুল্লাহি আলাইহির আর্বিভাবের সময়কাল ছিল ভারত বর্ষের বিতর্কিত সম্রাট জালালুদ্দীন আকবরের শাসনামল। সম্্রাট আকবরের ১৩ বছর ৪ মাস বয়সে তাঁর পিতা বাদশাহ হুমায়ুন ইন্তেকাল করেন। ফলে স¤্রাট আকবর অল্প বয়সে সিংহাসনে আরোহন করেন। তিনি একাধারে ৫০ বছরের অধিককাল বাদশাহী পদে অধিষ্টিত ছিলেন। পারিবারিকসূত্রে স¤্রাট প্রাথমিক জীবনে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলতেন। ধর্ম ও জ্ঞানের প্রতি তার বিশেষ আকর্ষণ আগ্রহ থাকায় ১৫৭৫ সালে গুজরাট অভিযান থেকে ফিরে এসে স¤্রাট আকবর ফতেহপুর সিক্রিতে ‘ইবাদতখানা’ নামে একটি ধর্ম ও দর্শন বিষয়ক গবেষণাগার প্রতিষ্ঠা করেন। শুরুতে এই ইবাদতখানায় শুধুমাত্র মুসলিম স্কলারদের আমন্ত্রণ জানানো হতো। ইবাদতখানায় তাদের থাকা—খাওয়ার ব্যবস্থা ছিলো। এই সুবাদে দুনিয়াদার আলেম দ্বারা তার রাজসভা সরব ছিল। সম্রাট রাজ দরবারী আলেমদের দিয়ে শরয়ী বিভিন্ন বিষয়ে বিতর্ক অনুষ্ঠান করতেন। প্রতি বৃহস্পতিবার মাগরিবের পর আলোচনা শুরু হয়ে মধ্যরাত পর্যন্ত চলতো। কখনো কখনো আলোচনা এতো দীর্ঘায়িত হতো যে, পরের দিন জুমআর সালাতের পূর্ব পর্যন্ত আলোচনা চলতো। সম্রাটও খুব মনোযোগের সাথে তাদের আলোচনা শুনতেন, আলোচনায় অংশ নিতেন। দরবারী আলেমগণের একজন একটি বিষয় প্রমাণ করেছেন তো আরেকজন ওই বিষয়টিকে প্রতিহত করেছেন। এর দ্বারা ধীরে ধীরে বাদশাহ আকবরের মনে ইসলাম সম্পর্কে সন্দেহ—সংশয় বাসা বাঁধতে থাকে। ফলে ১৫৭৮ সালে থেকে উক্ত গবেষণাগারে হিন্দু, খ্রিস্টান, শিখ, বৌদ্ধসহ অন্যান্য ধর্মের পন্ডিতদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। তারাও নিজেদের ধর্ম নিয়ে আলাপ—আলোচনা করতো। বিভিন্ন ধর্মের বিশেষজ্ঞদের আলোচনা শুনতে শুনতেই সবগুলো ধর্মের মূল কথা নিয়ে একটি সমন্বিত ধর্ম প্রচলনের বিষয়টি স¤্রাট আকবরের মাথায় ঘোরপাক খায়। পরিশেষে ১৫৮২ সালে সম্রাট আকবর একশ্রেণির জ্ঞানপাপী আলেমের প্ররোচনায় প্রথমে নিজেকে মুজতাহিদ দাবী করে বলতে লাগলেন, নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার নবুওয়াতের সীমা ছিলো এক হাজার বছর পর্যন্ত। এখন নতুন যুগের সূচনা হয়েছে। এখন থেকে চলবে সম্রাট আকবরের দ্বীনে ইলাহী। এভাবে সে দ্বীন ইসলামকে রহিত করে, দ্বীনে ইলাহী নামে নতুন ধর্মের প্রবর্তন করে। দ্বীনে ইলাহির অবয়বে পৌত্তলিকতার প্রাধান্য থাকায় ইসলামী বিশ্বাস, সামাজিক মূল্যবোধ, ধর্মাচার ও সংস্কৃতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যেমন—সম্মান প্রদর্শনের নামে সম্রাটকে সিজদা করার ফরমান জারি করেছিলে আকবর। অথচ ইসলামে মহান আল্লাহ ব্যতীত আর কাউকে কোনো অর্থেই সিজদা করার কোনো অবকাশ নেই।
‘দ্বীনে ইলাহি’ প্রবর্তনের কারণে সম্রাট আকবরের সময় যে ধর্মীয় অনাচার ও সামাজিক অস্থিরতা তৈরি হয়েছিল, তার ভেতরই মুজাদ্দিদ আলফে সানি রহমাতুল্লাহি আলাইহি বেড়ে ওঠেন। তিনি দেখেছিলেন একজন পরাক্রমশালী অথচ বিভ্রান্ত সম্রাটের অন্যায়—অবিচারের সামনে রাষ্ট্রের সজ্জনরা কিভাবে অসহায়ত্ব বরণ করেছে। অনুরোপভাবে প্রত্যক্ষ করেছেন অসৎ মানুষগুলো জাগতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য নিজের বোধ, বিশ্বাস ও ধর্মীয় মূল্যবোধ বিক্রি করেছে। কিভাবে তারা ধর্মের অপব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে স¤্রাটের বিকৃত ধর্মচিন্তার বীজ সমাজের পরতে পরতে বপন করছে। বিশেষত আদর্শচ্যুত আলেম নামধারী ভ্রান্ত লোকদের অসততা তাঁকে যারপরনাই ব্যথিত করেছিল।
শিক্ষা জীবন: ইমাম রব্বানী রহমাতুল্লাহি আলাইহি তাঁর পিতার নিকটই প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করেন। অতি স্বল্প বয়সে তিনি পবিত্র কুরআনুল করিম মুখস্থ করে নেন। অতঃপর তিনি ধর্মীয় বিভিন্ন বিষয়ে উচ্চ শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে সুদূর ‘সিয়ালকুট’ আল্লামা কামাল কাশ্মীরী রহমাতুল্লাহি আলাইহির কাছে গিয়ে ইলমে হাদীস অধ্যয়ন করেন। তিনি যুগশ্রেষ্ঠ মুফাসসির ও মুহাদ্দিস হযরত কাজী বাহলুল বখশানী রহমাতুল্লাহি আলাইহির নিকট সিহাহ্ সিত্তাহ্ ও তাফসীর গ্রন্থাদি অধ্যয়নের জন্য হারামাইনে শরীফাইন গমন করেন। এভাবে তিনি নানা বিষয়ে পান্ডিত্য অর্জন করেন। ৯৮৮হিজরি মোতাবেক ১৫৮১ সালে মাত্র ১৭ বছর বয়সে তিনি জাহেরী বাতিনী ইলমের এক বিরাট ভান্ডারে পরিণত হন।
অধ্যাপনা: মুজাদ্দেদ আলফে সানী রহমাতুল্লাহি আলাইহি ইলম হাসিল করার পর যৌবনের প্রারম্ভে হিজরি ৯৯৩ সালে বাদশাহ আকবরের রাজধানী আগ্রায় গমন করেন। বাদশাহর সেনাবাহিনীর অনেকেই তাঁর জ্ঞানের গভীরতায় মুগ্ধ হন। এমনকি তৎকালীন আলেমগণ তাঁর নিকট থেকে হাদীস ও তাফসীরের উপর সনদ গ্রহণ করতে চান। এতে তাঁর ইলম ও ইজতিহাদের খ্যাতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এমনকি শাহী দরবারের দর্শন ও তর্ক শাস্ত্রের বিখ্যাত ও বিচক্ষণ আলেম বাদশাহ আকবরের অতি প্রিয়পাত্র আবুল ফজল ও ফয়জী হযরতের মজলিশে আগমন করেন।
শাদী মুবারক: ইমামে রাব্বানী রহমাতুল্লাহি আলাইহি দীর্ঘদিন আকবরাবাদে অবস্থান করার পর তাঁর শ্রদ্বেয় আব্বাজান কেবলা তাঁকে সেরহিন্দ শরীফে নিয়ে যান। পথিমধ্যে বাদশাহ আকবরের এক বিশেষ আমাত্য শায়খ সুলতানের কন্যার সাথে তাঁর বিবাহ সম্পন্ন হয়। উল্লেখ্য যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম স্বপ্নযোগে শায়খ সুলতানকে এ বিবাহ সম্পর্কে ইশারা প্রদান করেন। যিনি ছিলেন সে সময় থানেশ্বরের শাসন কর্তা। দিল্লীর বাদশাহর পক্ষে তিনি থানেশ্বর এলাকা শাসন করতেন। একদা তিনি স্বপ্নে দেখেন, হুযূর পুরনূর সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম তাঁকে বলেন, ‘হে সুলতান! তুমি তোমার মেয়েকে শায়খ আহমদ সেরহিন্দীর সাথে বিয়ে দাও।’ সুলতান তাঁকে চিনতেন না।, তাই এ নির্দেশ কিরূপে পালন করবেন, তা নিয়ে মহা চিন্তায় পড়ে গেলেন। এসময় তিনি আবার স্বপ্ন দেখেন এবং এ সময় তাঁকে শায়খ আহমদ সেরহিন্দী রহমাতুল্লাহি আলাইহির অবয়বও দেখান হয়। কয়েকদিন পর শায়খ আহমদ রহমাতুল্লাহি আলাইহি খানেশ্বর যান এবং সুলতানের সাথে তাঁর দেখা হয়। তাঁকে দেখেই সুলতান চিনতে পারেন যে, ইনিই সেই যুবক, যার সাথে তাঁর কন্যার বিয়ে দেওয়ার নির্দেশ পেয়েছেন। কিন্তু তিনি নিজে একজন অপরিচিত যুবকের কাছে নিজের কন্যার বিয়ের প্রস্তাব দিতে ইতঃস্তত বোধ করছিলেন। ফলে তিনি প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামাকে আবারও স্বপ্নে দেখেন। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘এ ব্যক্তি সম্পর্কেই আমি তোমাকে বলেছি। তুমি সরাসরি তাঁর কাছে প্রস্তাব দাও।’ এরপর ইমামে রব্বানীর নিকট বিয়ের প্রস্তাব পেশ করা হলে, তিনি তাঁর পিতার সম্মতি নিয়ে এ বিয়েতে রাজী হন এবং যথা সময়ে শাদী মুবারক সম্পন্ন হয়। তাঁর সাত পুত্র এবং তিন জন কন্যা সন্তান ছিলেন।
বায়আত গ্রহণ: তাঁর পূর্বপুরুষ সকলেই তাসাউফপন্থী হওয়ায় ওয়ারিশসূত্রে মারফত অর্জন করেছিলেন। প্রথমে তিনি তাঁর পিতার নিকট থেকে চিশতিয়া ত্বরিক্বার খেলাফত প্রাপ্ত হন। অতঃপর তৎকালীন কাদেরিয়া সিলসিলার শ্রেষ্ঠ বুজুর্গ হযরত শাহ সেকান্দর রহমাতুল্লাহি আলঅইহির নিকট থেকে ত্বরিক্বায়ে কাদেরিয়ার খেলাফত লাভ করেন। ১০০৭ হিজরী সনে তার শ্রদ্ধেয় আব্বাজানের ইন্তিকালের পর হজ্ব পালনের উদ্দেশ্যে মক্কা যাওয়ার প্রাক্কালে দিল্লীর প্রখ্যাত অলীয়ে কামিল হযরত খাজা মুহাম্মদ বাকী বিল্লাহ্ রহমাতুল্লাহি আলঅইহির খিদমতে হাজির হন। তিনি তাঁকে দেখে মাত্র বলে উঠলেন, হে শেখ আহমদ! আমি আপনার অপেক্ষায় রয়েছি। তিনি তাঁকে সাদরে গ্রহণ করলেন। অতঃপর তাঁরই হতে নকশবন্দীয়া ত্বরীক্বার বায়আত গ্রহণ করে ধন্য হন। স্বল্প সময়ের মধ্যে তিনি এ ত্বরীকায় সকল স্তর অতিক্রম করে কামালিয়াতের সর্বোচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত হন এবং খিলাফত প্রাপ্ত হন। খাজা বাকী বিল্লাহ্ তার সম্পর্কে বলেন, শেখ আহমদ একটি সূর্য স্বরপ,যার আলোতে নক্ষত্র—রাজির জ্যোতি ঢাকা পড়ে যায়।
মুজাদ্দিদে আলফে সানী উপাধী লাভ: হিজরি ১০১০ সালের ১০ই রবিউল আউয়াল একদিন মুরাকাবার হালতে ইমামে রব্বানী রহমাতুল্লাহি আলাইহি দেখলেন রাসূলে আরবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তথায় তশরিফ এনে তাঁকে একটি মহামূল্যবান পোষাক পরিয়ে বললেন, এটাই মুজাদ্দেদ আল্ফে সানীর পোষাক। একদা হযরতের লাহের অবস্থানকালীন সময়ে প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন মাওলানা জামাল উদ্দীন তিল্ভী ও মাওলানা আবদুল হাকিম শিয়ালকোটি হযরতের কাছে মুরিদ হয়ে যান এবং তাঁর কর্মের অভূতপূর্ব সাফল্যের স্বীকৃতি স্বরূপ তাঁকে রাসূলের দেয়া সেই মুজাদ্দিদে আল্ফে সানী উপাধীতে ভূষিত করেন।
কাইয়ুমে যমান পদে অধিষ্ঠিত: ১০১০ হিজরি সনে ৪০ বছর বয়সে একদিন যোহর নামাযান্তে শায়খ আহমদ রহমাতুল্লাহি আলাইহি পবিত্র কুরআনুল করিম তেলাওয়াত শুনছিলেন, এমতাবস্থায় অন্তদৃষ্টিতে প্রত্যক্ষ করলেন সরওয়ারে কায়েনাত সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তশরীফ এনে তাঁকে একটি মহা মূল্যবান তাজ পরিয়ে দিয়ে কাইউমিয়ত পদ লাভের জন্যে অভিনন্দন জানালেন।
গাউছে পাকের জুব্বা লাভ: কাদেরীয়া তরীকার প্রবর্তক গাউছুস সাকলাইন আবদুল কাদের জিলানী রহমাতুল্লাহি আলাইহি একদা কোন এক জঙ্গলে মুরাকাবায় অবস্থায় লক্ষ্য করলেন, হঠাৎ একটি নূর আকাশ থেকে বিদ্যুৎ বেগে প্রকাশিত হয়ে সমগ্র জাহান আলোকিত করে ফেলল। ঠিক এমতাবস্থায় তিনি ইলহাম প্রাপ্ত হলেন, এখন থেকে পাঁচশত বৎসর পরে যখন বিশ্বে শিরক ও বিদআত ছড়িয়ে পড়বে তখন একজন বুযর্গ অলী বিদআত সমূহ নিশ্চিহ্ন করে দুনিয়ার বুকে দ্বীনে মুহাম্মদীকে পুন প্রতিষ্ঠিত করবেন। এ ঘটনার পর তিনি স্বীয় জুব্বা মুবারক কামালাতে পরিপূর্ণ করে নিজ পুত্র সৈয়দ তাজ উদ্দীন আবদুর রাজ্জাক রহমাতুল্লাহি আলাইহিকে সোপর্দ করে আদেশ করলেন, যখন ঐ বুযর্গের প্রকাশ হবে তখন তাঁকে যেন এই জুব্বাটি উপহার স্বরূপ প্রদান করা হয়।
১০১১ হিজরি সনে ৪১ বছর বয়সে একদা মুজাদ্দিদ রহমাতুল্লাহি আলাইহি মুরিদ পরিবেষ্টিত হয়ে হালকার মধ্যে মুরাকাবায় মগ্ন ছিলেন থাকা অবস্থায় কাদেরীয়া ত্বরীকার বরেণ্য সূফী সাধক কামাল কায়্থলী রহমাতুল্লাহি আলাইহির পৌত্র হযরত শাহ্ সেকান্দর এসে একটি জুব্বা মুবারক ইমামে রব্বানীন কাঁধে স্থাপন করেন। মুরাকাবা শেষে তিনি তাঁর সাথে কোলাকুলি করতঃ অত্যন্ত আদবের সাথে পার্শ্বে বসালেন। অতঃপর মুজাদ্দিদ রহমাতুল্লাহি আলাইহি তাঁর পক্ষ থেকে প্রদত্ত জুব্বাটি পরিধান করে খাস কামরায় প্রবেশ করলেন। তখনি অন্তর্দৃষ্টিতে অবলোক করলেন যে, গাউছে পাক ও শাহ্ কামাল কায়থলী রহমাতুল্লাহি আলাইহিমা স্বীয় খলিফাদের নিয়ে তশরীফ আনলেন এবং তাঁকে রূহানী জগতের অফুরন্ত নিয়ামত দিয়ে ধন্য করলেন। অতঃপর ইমামে রব্বানীর স্বীকৃতি লাভ করেন।
দ্বীনে ইলাহির বিরুদ্ধে সংগ্রাম: কর্মজীবনে পা রেখেই তিনি বুঝতে পারেন ভারতবর্ষের মুসলমানরা যেসব ব্যাধিতে ভুগছে তার আরোগ্য আলেমদের হাতেই রয়েছে, যদিও তারা ক্ষমতার মোহ বা ভয়ে নিজেকে গুটিয়ে রেখেছেন। আলেম সমাজ যদি অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে, তবেই মুসলিম সমাজ মুক্তির পথ খুঁজে পাবে। কুসংস্কার ও বিকৃতির হাত থেকে সাধারণ মানুষের চিন্তা, বিশ্বাস ও ধর্মাচার রক্ষা পাবে। আলেমদের ভেতর দায়িত্ববোধ জাগিয়ে তুলতে ৯৮৯হিজরি মোতাবেক ১৫৮২ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে তিনি ‘ইসাবাতুন নুবুওয়াহ’ নামে একটি বই লিখেন, যাতে তিনি নবীর উত্তরসূরি হিসেবে আলেমদের করণীয় ও বর্জনীয় বিষয়গুলো তুলে ধরেন। আলেমদের বিচ্যুতি, শাসকদের ঘনিষ্ঠতা ও দায়িত্ব পালনে অবহেলার ভয়াবহতা সম্পর্কেও এই বইয়ে তিনি বিস্তারিত আলোচনা করেন।
তিনি রাজ্যের সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাদের কাছে যাতায়াত শুরু করলেন। শুরুতে তাঁকে অন্যদের মতোই ধান্দাবাজ মনে করলেও খুব দ্রুতই তাঁর ব্যাপারে তাদের ধারণা পাল্টে যেতে থাকে। ফলে তারা শায়খের সামনে নিজেদেরকে সোপর্দ করে দিলো। ১০১৪ হিজরি মোতাবেক ১৬০৭ সালে সম্রাটের ঘনিষ্ঠজনদের ডেকে সতর্ক করে সম্্রাট আকবরের প্রতি নসিহত ও হুমকি প্রদান করে পত্র প্রেরণ করেন যে, ‘সম্রাট আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অবাধ্যতায় লিপ্ত হয়েছেন। যদি তিনি পাপাচার থেকে ফিরে না আসেন, তবে সা¤্রাজ্য ধ্বংস হবে এবং তাঁর রাজত্বে ধস নামবে। সুতরাং সম্রাট যেন স্বীয় কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পথে ফিরে আসেন।’ তাঁর এই সাহসী উচ্চারণ উপস্থিত ব্যক্তিদের হতভম্ব করে দেয়। তাঁর নির্ভীক দাওয়াতি কার্যক্রম (ইত্তেবায়ে সুন্নাত আন্দোলন) সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সম্রাটের ঘনিষ্ঠজনদের ভেতর ঈমানি চেতনা জাগ্রত করে। তারা সত্যের পক্ষে কাজ করার সাহস ফিরে পায়। তাঁর প্রচেষ্টায় ভারতবর্ষে ক্রমেই তওবা করে ফিরে আসা মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকে। তাঁর অনুসারী, শিষ্য ও খলিফাগণ সত্য ও সংস্কারের দাওয়াত নিয়ে ভারতবর্ষের আনাচে—কানাচে ছড়িয়ে পড়েন।
আন্দোলনের চার দফা কর্মসূচী: মুজাদ্দিদে আলফে সানি রহমাতুল্লঅহি আলাইহির প্রচেষ্টা ও সংগ্রামের প্রধান বৈশিষ্ট্য চারটি। যথা— ১. ইসলামের বিশ্বাস: সবার আগে মানুষের আক্বিদা ও বিশ্বাস ঠিক করা।
২. দ্বীনের বোধ তৈরি: ঈমান ঠিক হওয়ার পর তিনি মুসলমানের ভেতর দ্বীনের বোধ ও মূল্যবোধ তৈরির চেষ্টা করেছেন।
৩. দ্বীনের প্রচার ও প্রসার: তিনি ধর্মহীনতার বিরুদ্ধে দ্বীনের জোরাল প্রচারে গুরুত্ব দিয়েছিলেন।
৪. দ্বীন রক্ষায় আত্মোৎসর্গ করা: তিনি দ্বীন রক্ষায় নিজেকে যেমন উৎসর্গ করেছিলেন, তেমনি মানুষের ভিতর দ্বীনের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করার মানসিকতা তৈরি করেছিলেন।
বহির্বিশ্বে পরিচিতি ও প্রতিনিধি প্রেরণ: ১০১৫ হিজরি মোতাবেক ১৬০৮ সালে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে ইমামে রব্বানীর পরিচিতি ছড়িয়ে পড়ে। দূর—দুরান্ত থেকে লোকজন এসে হযরতের হাতে বায়আত গ্রহণ করতে থাকে। জনৈক বাদশাহ অনুরোধে ১০১৬ হিজরি মোতাবেক ১৬০৯ সালে রিসালয়ে রদ্দে শিয়া নামক তাঁর লিখিত গ্রন্থখানা ইরানের বাদশাহ নিকট প্রেরণ করেন। সত্য ও সংস্কারের দাওয়াতি মিশন বাস্তবায়নে বহির্বিশ্বে বিশেষত তুরস্কে ৭০ জনের কাফেলা, আরবে ৪০ জনের কাফেলা, কাশগরে ১০ জনের কাফেলা এবং পারস্যে ৩০ জনের কাফেলা এভাবে বিভিন্ন দেশে তাঁর অনুসারী ও খলিফাদের প্রেরণ করেন।
মুজাদ্দিদে আলফে সানী রহমাতুল্লাহি আলাইহির কারাজীবন: ১৬০৫ খ্রিস্টাব্দে বাদশাহ আকবর মৃত্যুবরণ করার পর তার পুত্র জাহাঙ্গীর ৩৬ মতান্তরে ৩৮ বছর বয়সে সিংহাসনে আরোহণ করেন। শাহজাদা জাহাঙ্গীর বাদশাহী পদে বসে প্রাথমিক পর্যায়ে পিতার অনুকরণ ও অনুসরণে দৃঢ় অবস্থানে থাকেন। পরবতীর্তে ইমামে রব্বানীর কৌশলগত হিকমতপূর্ণ দাওয়াতে অনুতপ্ত হয়ে সংশোধনের চেষ্টা করেন। যদিও অর্ধ শতাব্দীকাল ধরে রাষ্ট্রীয়ভাবে চর্চিত অনেক কুসংস্কার পরিহার করা তাঁর পক্ষেও সম্ভব হয়নি। সম্্রাট জাহাঙ্গীর স্বীয় পিতার তুলনায় তাঁকে বেশি সম্মান করতেন। তবে তাঁর এই সহানুভূতিকে সহজভাবে নিতে পারেননি বাদশাহ আকবরের সং¯্রবপ্রাপ্ত সুবিধাভোগী রাজন্যবর্গ ও সভাসদরা। তাঁরা সম্রাটকে এই বলে খেপিয়ে তুলল যে, এই ব্যক্তি রাষ্ট্রীয় আইন—শৃঙ্খলার প্রতি শ্রদ্ধাশীল নন। দিন দিন তাঁর অনুসারীর সংখ্যা বাড়ছে এবং সেনাবাহিনীতেও তাঁর বিপুল সংখ্যক অনুসারী রয়েছে। তাঁর কার্যক্রমের ওপর বিধি—নিষেধ আরোপ না করলে ভবিষ্যতে তিনি সম্রাটের জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারেন। ১০২৬ হিজরি মোতাবেক ১৬১৯ সালে বাদশাহ জাহাঙ্গীর সভাসদদের চাপ ও প্ররোচনায় পড়ে তাঁকে ৫৫ বছর বয়সে রাজ দরবারে তলব করলেন। ওই সময় নিয়ম ছিলো, যারা রাজ দরবারে আসবে সম্রাটকে সম্মানের সেজদা করবে। এ ব্যাপারে ইসলামের রীতি হচ্ছে, আগন্তুক সালাম দিবে, সেজদা নয়। তাই মুজাদ্দিদ রহমাতুল্লাহি আলাইহি দরবারে প্রবেশের পর সেজদা না করে, সালাম দিলেন। এতে সম্রাট ক্ষিপ্ত হয়ে তাঁকে বন্দি করে ‘কুলয়ারু দুর্গে’ প্রেরণ করেন।
কারামুক্তি: জেলে আটক করা মুজাদ্দিদ আলফে সানী রহমাতুল্লাহি আলাইহির জন্য সাপেবর হলো। তিনি সুযোগকে কাজে লাগালেন। জেলখানায় তিনি দাওয়াতি কাজ শুরু করে দিলেন। এতে কয়েকজন অমুসলিম তাঁর হাতে মুসলমান হয়। অসংখ্য অপরাধী তওবা করে গুনাহ থেকে ফিরে আসে। ইতোমধ্যে তাঁর মুরিদরা মুক্তির জন্য চতুর্দিক থেকে আন্দোলন শুরু করে। ১০২৭ হিজরি মোতাবেক ১৬২০সালে স¤্রাট নিজেও জেলারের নিকট জেলখানার ভিতরগত আসামীদের আমূল পরিবর্তনের কথা শ্রবণ করে তাঁর সিদ্ধান্তের জন্য অনুতপ্ত হন এবং তাঁকে মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
শাহী দরবারে অবস্থান: স¤্রাট মুজাদ্দিদ আলফে সানি রহমাতুল্লাহি আলাইহিকে মুক্তির দেওয়ার পর ধর্ম বিষয়ে তাঁর পরামর্শক হওয়ার প্রস্তাব করেন। তিনি এই প্রস্তাবকে ইসলাম ও মুসলমানের সেবা করার সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করে স¤্রাটকে কয়েকটি প্রস্তাব দিলেন। যেমন—ক. স¤্রাটের সামনে সিজদার প্রথা রহিত করতে হবে; খ. ইতিপূর্বে যেসব মসজিদ ধ্বংস করা হয়েছে তা পুনর্নির্মাণ করতে হবে; গ. পশু কোরবানির অনুমতি দিতে হবে; ঘ.বিচারকার্যে্য ইসলামী আইনের অনুসরণ করতে হবে; ঙ. জিজিয়া বা নিরাপত্তা কর পুনর্বহাল করতে হবে; চ. সব ধরনের বিদআত ও কুসংস্কার পরিহার করতে হবে; ছ. ধর্মীয় কারণে যাদের বন্দি করা হয়েছে তাদের মুক্তি দিতে হবে ইত্যাদি। সম্রাট ধীরে ধীরে এসব প্রস্তাব বাস্তবায়নের আশ্বাস দেন এবং মসজিদ পুনর্নির্মাণের মাধ্যমে সুপারিশ বাস্তবায়ন শুরু করেন। ফলশ্রম্নতিতে মুজাদ্দিদ আলফে সানি রহমাতুল্লাহি আলাইহি দীর্ঘ চার বছর স¤্রাটের পরামর্শক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এভাবে আবারো রাজ পরিবার দ্বীনের পথে আসতে থাকে। যার সর্বশেষ ফলাফল হচ্ছে, বাদশাহ আলমগিরের মতো ন্যায়পরায়ন, আল্লাহভীরু শাসক ও মুজাদ্দিদ। এমনকি সম্রাট আওরঙ্গজেব আলমগীরকে ষষ্ঠ খলিফায়ে রাশেদ বলা হয়। খলিফা ওমর ইবনে আবদুল আজিজ রহমাতুল্লাহি আলাইহির পর আল্লাহভীতি, ইবাদত—বন্দেগি, সুন্নতের অনুসরণ ও আল্লাহর বিধান বাস্তবায়নে সম্রাট আওরঙ্গজেব অগ্রগামী।
রচনাবলী: ইমামে রব্বানী রহমাতুল্লাহি আলাইহি ইসলামী বিশ্বাস, সুফিবাদ, আইন, নৈতিকতা এবং আরও অনেক বিষয়ে অনেক গ্রন্থ লিখেছেন। তাঁর রচিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে মাকতুবাত শরীফ, মাবদা ও মাআত, মাআরিফে লাদুন্নিয়া, মুকাশিফাতে আয়নিয়া, ইস্বাতুন নবুয়ত, আদাবুল মু’রিদীন এবং তাহলিলিয়া বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
ইন্তেকাল: শেষ জীবনে তিনি সেরহিন্দে ফিরে যান, মানুষের আত্মশুদ্ধি ও আধ্যাত্মিক সাধনায় মনোযোগ দেন। একান্ত আপনজন ছাড়া কেউ তাঁর কক্ষে প্রবেশের অনুমতি পেতেন না। যিলহজ মাসে প্রচণ্ড অসুখ দেখা দেয়। এ সময় তিনি ‘আল্লাহুম্মা আর—রাফিকুল আলা’ (হে আল্লাহ, আপনিই সর্বোত্তম বন্ধু) এই দোয়া বেশি বেশি পাঠ করতেন। তিনি ১০৩৪ হিজরির ২৮ সফর মোতাবেক ১৬২৪ সালে ১০ ডিসেম্বর ৬৩ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। সেরহিন্দ শরীফে তাঁর আলীশান মাজার শরীফ অবস্থিত। প্রতিবৎসর ২৮শে সফর হযরতের ওরশ শরীফ সেরহিন্দ শরীফে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।
বর্তমান সময়ের আলেম—ওলামার করণীয়: বর্তমান সময়ে বিরাজমান ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যাবলী থেকে উত্তরণের জন্যে ইমামে রব্বানী শায়খ আহমদ সেরহিন্দি রহমাতুল্লাহি আলাইহির কর্মধারা বিশ্লেষণ ও অনুসরণ করা অতীব প্রয়োজন। কারণ, তিনি একদিকে যেমন শিরক ও বিদআতের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন, অন্যদিকে সম্রাট আকবরের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক লড়াইও করেছিলেন। আজ থেকে চারশত বছর আগে ভারত বর্ষে ইসলামের নাম—নিশানা মিটিয়ে দেবার জন্যে যে ষড়যন্ত্রের যে বীজ বপন হয়েছিল, তার গতিধারাও পরিবর্তিত করে দেন। এছাড়া আরো দুটো বিরাট কার্যও তিনি সম্পাদন করেছিলেন। এক, দার্শনিক ও বৈরাগ্যবাদী ভ্রষ্টতার কারণে তাসাউফের নির্মল ঝরণাধারায় যেসব ময়লা—আবর্জনা মিশ্রিত হয়েছিল, তা থেকে তাকে পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র করে ইসলামের প্রকৃত তাসাউফ জাতি সমীপে পেশ করেন। দুই, তৎকালীন জনসাধারণের মধ্যে যে সব জাহেলি প্রথা বিস্তার লাভ করেছিল তিনি তার কঠোর বিরোধিতা করেন এবং আধ্যাত্মিক নেতৃত্ব ও সংস্কার সাধনের মাধ্যমে শরিয়ত অনুসারণের এক শক্তিশালী আন্দোলন পরিচলনা করেন। এই আন্দোলনের হাজার হাজার সুদক্ষ কর্মী কেবল ভারতের বিভিন্ন এলাকায়ই নয় বরং মধ্য এশিয়ায়ও পৌঁছে যায় এবং সেখানকার জনগণের চরিত্র ও আকিদার সংস্কার সাধনের প্রচেষ্টা চালায়।
দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বর্তমান সময়ের তথাকথিত কিছু আলেম ওলামা সম্্রাট আকবরের রাজ দরবারী দুনিয়াদার আলেমদের চরিত্র ধারণ করেছে। অর্থ—কড়ি ও পদ—পদবীর লোভে পড়ে নিজেদের দায়িত্ব ভূলে গিয়ে বাতিল সম্প্রদায় ও ভন্ড দরবারের পৃষ্ঠপোষকতা করে সাধরণ ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের প্রতি নিয়ত বিভ্রান্ত করছে । আল্লাহ তা’আলা আলেম সমাজকে নিজেদের দায়িত্ব পালনে সচেতন হওয়া এবং মুসলমানদের জ্ঞান পাপী আলেমদের সংশ্রব থেকে বেঁচে থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন বিজাহিন নবিয়্যিল আমিন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
লেখক : আরবি প্রভাষক, তাজুশ শরী'আহ দরসে নিযামী মাদরাসা।
খতিব, রাজানগর রাণীরহাট ডিগ্রি কলেজ জামে মসজিদ, রাঙ্গুনিয়া, চট্টগ্রাম।
কোন মন্তব্য নেই