সত্য ও ন্যায়ের পথে ইমাম হোসাইন এক আপোষহীন সৈনিক

কিয়া বাত রযা উস চমনিস্তানে করম কি, যাহরা হে কলি জিস মে হোসাইন অউর হাসান ফুল। সুলতানে কারবালা, ইমামে আলী মকাম ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু চতুর্থ হিজরির শা'বান মাসের ৪র্থ দিবস মঙ্গলবার শুভক্ষণে (৮ জানুয়ারি ৬২৬খ্রি:) কুরাইশ রাজবংশের বনু হাশেম গোত্রে মাওলা আলী শেরে খোদা ও ফাতেমা বিনতে রাসূল রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমার ঔরশে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি জন্ম গ্রহণের পর তাঁর পিতা মহব্বত করে তাঁর নাম রাখেন হারব। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর জন্মের শুভ সংবাদে শুনে খুবই আনন্দিত হয়ে তাঁকে দেখতে এসে জিজ্ঞেস করলেন নাম কী? হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, তাঁর নাম হারব। তখন নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তাঁর নাম হারব নয় ; বরং হুসাইন। উপনাম হলো আবু আব্দুল্লাহ। রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর তাহনিক করালেন ও তাঁর কানে আযান দিয়েছেন এবং জন্মের সপ্তম দিনে স্বয়ং নিজে একটি মতান্তরে দু’টি মেষ জবেহ করে তাঁর আকীকা দিয়েছেন। অতঃপর তিনি তাঁর মাথার চুল কামিয়ে তাঁর ওজনের সমপরিমাণ রৌপ্য গরীবদের মধ্যে বিতরণ করে দেয়ার জন্য নির্দেশ দেন। ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু দরবারে রিসালত ও বেলায়তের কেন্দ্রস্থলে লালিত পালিত হয়ে একজন যুগশ্রেষ্ঠ আলেমে দ্বীন এবং মুহাদ্দিসে রূপান্তরিত হন। তাঁর যুগের লোেেকরা তাঁর নিকট থেকে ফতোয়া গ্রহণ করতেন। তিনি অত্যন্ত সাবলিল ভাষায় নজির বিহিন বক্তব্য রাখতেন। তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে ১২৯ টি হাদিস বর্ণনা করেছেন। তিনি বহুগুণে গুণান্বিত ছিলেন। ইবনে আছাকির বর্ণনা করেছেন, তিনি অত্যন্ত দানশীল ছিলেন। যখনই তাঁর নিকট কোন ফকির আসত, তখন তাঁর নিকট যা থাকত, তা দিয়ে দিতেন। যেমন একদা এক ফকির তাঁর দরবারে এসে আরজ করলেন,হুযূর! আমি অত্যন্ত গরিব আর আমার পরিবার অনেক বড়। আমার কিছু টাকার প্রয়োজন। ইমামে আলী মকাম এ কথা শুনে তাকে বললেন, তুমি বস। কিছুক্ষণ পর জনৈক ব্যক্তি পাঁচ থলে দিনার নদরবারে উপস্থিত হলো। ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু পাঁচ থলে দিনার ঐ ফকিরকে দিয়ে দিলেন এবং নিজের জন্য কিছুই রাখেননি। তিনি দিন-রাত ইবাদতে লিপ্ত থাকতেন। তিনি সর্বদা তাহাজ্জুদ নামায আদায় করতেন এবং কুরআন তেলাওয়াত করতেন আর আল্লাহর স্মরণে সদা মশগুল থাকতেন। এমনকি তিনি শাহাদাত বরণের আগ মুহুর্ত পর্যন্ত কোন নফল নামাযও ত্যাগ করেননি। তিনি অন্তিম মুহুর্তেও দুই রাকাত নামায আদায় করেছেন। হযরত ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন অত্যন্ত সাহসী, দৃঢ় মনোবলের অধিকারী, অকুতোভয় সৈনিক। তাঁকে একবার হযরত মুয়াবিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর নিকট দূত হিসেবে পাঠানো হয়েছিল। তিনি সামরিক বাহিনীর সাথে কনস্টান্টিনোপলে (ইস্তাম্বুল অভিযানের) যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। যখনই আল্লাহর পথে যুদ্ধের আহবান এসেছে তখনই তিনি তাতে সাড়া দিয়েছেন, শুধুমাত্র আল্লাহর ধর্মের মর্যাদা রক্ষার জন্যই তিনি তা করেছিলেন। ৬৮০খ্রিস্টাব্দে সাহাবীয়ে রাসূল হযরত আমীরে মুয়াবিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর মৃত্যুর পর ইয়াজিদ বিন মুআবিয়া ক্ষমতায় বসেই স্বৈরাচারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। বস্তুত সে ছিল দুশ্চরিত্রের, বেনামাজি ও মদ্যপায়ী। তাই সে ইসলামে চিরতরে নিষিদ্ধ মধ্যপান, সুদ ও একই সাথে দুই সহোদরাকে বিবাহ করা প্রভৃতি হারাম কাজকে বৈধ বলে ঘোষনা দেয়। ফলে সমাজে ব্যভিচার, জুয়া, মদ্যপান ও নানা রকম অনাচার বিস্তার লাভ করে। এ অবস্থায় ধর্মপ্রাণ, সজ্জন ও বিবেকবান মুসলমানগণ উদ্বিগ্ন ও বিচলিত হয়ে পড়েন। দুঃশাসন, অন্যায়, অনাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কিংবা প্রতিরোধ গড়ে তোলার পরিবেশ পর্যন্ত উধাও হয়ে যায়। দমন, পীড়ন ও জুলুমের ভয়ে মানুষ নিশ্চুপ থাকাকেই শ্রেয়জ্ঞান করে। এহেন অবস্থার প্রেক্ষাপটে কুফাবাসী ইমাম আলী মকাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে ১৫০ মতান্তরে ১২০০ চিঠির মাধ্যমে কুফায় যেতে অনুরোধ করে। তারা ইয়াজিদকে খলিফা হিসেবে দেখতে চায় না, তারা তাঁকে খিলাফতের অধিক যোগ্য, তাঁর জন্য জানমাল কোরবানির জন্য প্রস্তুত এবং আহলে বায়াতের অনুরক্ত এমন পয়গাম পাঠায়। কুফাবাসীর এই পুনঃ পুনঃ ডাক ও স্বনির্বদ্ধ অনুরোধে সাড়া দিতে মনস্থির করেন তিনি। তাদের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য তিনি আপন চাচাতো ভাই মুসলিম বিন আকিল রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে কুফায় পাঠান। কুফার গভর্নর নুমান বিন বশিরসহ ৪০ হাজার মানুষ ইমাম মুসলিমের হাতে হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর নামে বায়াত গ্রহণ করেন। পরিস্থিতি তাঁর অনুকূলে এমন বর্ণনা দিয়ে একজন পত্রবাহককে চিঠি দিয়ে তাঁকে কুফায় আসতে অনুরোধ করা হয়। চিঠি লেখার পর পরই অবস্থা অন্যরকম হয়ে যায়। তাঁর আগমনের সংবাদ ইয়াজিদ জানতে পেরে উত্তেজিত হয়ে কুফার গভর্ণর নোমান ইবনে বশিরকে পদচ্যুত করে ওবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদকে কুফার দায়িত্ব প্রদান করে এবং হুকুম জারি করে হুসাইন যেন কোনোভাবেই কুফায় প্রবেশ করতে না পারে। প্রয়োজনে তাঁর সাথে যুদ্ধ করার সে নির্দেশও দেয় ইয়াজিদ। ওবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদ দ্রæত কুফায় এসে দেখে, তার প্রাসাদ মুসলিম ইবনে আকিল ও তাঁর অনুসারীরা ঘেরাও করে আছেন। তিনি সৈন্য দিয়ে হামলা চালিয়ে তাদের হত্যার হুমকি দেন। এতেই কাজ হয়। সবাই দ্রæত সে স্থান ত্যাগ করে। একজনকেও মুসলিম ইবনে আকিল তার পাশে দেখতে পান নি। অতঃপর ইবনে জিয়াদ তাঁকে গ্রেফতার করে নির্মমভাবে হত্যা করেন। হত্যার আগে তিনি ইমাম হযরত হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে আরেকটি চিঠি দিয়ে কুফায় আসতে নিষেধ করেন। এই চিঠি তাঁর কাছে পৌঁছার আগেই তিনি কুফাবাসীর অস্থির চিত্তের জন্য আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু সহ অনেকের বাধা সত্তে¦ও ৬০ হিজরির ৮ জিলহজ পরিবার-পরিজন, বন্ধু-বান্ধব ও প্রিয়জনদের সঙ্গে নিয়ে তিনি মক্কা মুকার্রমা থেকে কুফার উদ্দেশে রওনা দেন। পথিমধ্যে তাঁর চাচাতো ভাই আবদুল্লাহ বিন জাফর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু সাক্ষাৎ করে মদিনার গভর্নর কর্তৃক প্রদত্ত নিরাপত্তা সনদের ভিত্তিতে মদিনায় ফিরে যাওয়ার অনুরোধ করলে তিনি বলেন, আমি স্বপ্নে নানাজির সাক্ষাৎ পেয়েছি। তিনি আমাকে একটি কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন। ফলাফল যাই হোক না কেন, আমি অবশ্যই তা করব আর কাজটি কী, সে সম্পর্কে মৃত্যুর আগে আমি কাউকে কিছু বলতে পারি না। কুফা থেকে দুই মঞ্জিল দূরে তিনি ‘যি জাশাম’ নামক স্থানে ইয়াজিদ বাহিনীর দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হন। এক হাজার সৈন্যের এ বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন হুর ইবনে ইয়াজিদ। তিনি হযরত ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও সহানুভূতিপ্রবণ ছিলেন। তবে নির্দেশিত দায়িত্ব পালনেও ছিলেন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। হযরত ইমাম আলী মকাম তার কাছে কুফাবাসীর চিঠি ও দূত মারফত তাঁকে আমন্ত্রণ জানানোর কথা বলেন। হুর ইবনে ইয়াজিদ এ ব্যাপারে তার অজ্ঞতার কথা উল্লেখ করেন। এক পর্যায়ে হযরত ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু তাঁকে সামনে যাওয়ার অথবা ফিরে যাওয়ার অনুমতি দিতে অনুরোধ জানান। হুর ইবনে ইয়াজিদ তার অপারগতা প্রকাশ করেন। বরং ইবনে জিয়াদের নির্দেশ মোতাবেক এমন একটা জায়গায় হযরত ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর কাফেলাকে ঠেলে নিয়ে যান, যেখানে কাফেলা অধিকতর অনিরাপদ হয়ে পড়ে। হুর ইবনে ইয়াজিদ কাফেলাকে কারবালা প্রান্তরে নিয়ে যান। ইমাম আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু স্থানটির নাম জানতে চাইলে তাঁকে জানানো হয়, জায়গাটির নাম কারবালা। শুনে হযরত ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন: এটা দুঃখ ও বালা মুসিবতের জায়গা। এখানেই আমাদের অবতরণের, রক্ত ঝরানোর ও কবরের স্থান। ওদিকে ওবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদ আমর ইবনে সাদের নেতৃত্বে চার হাজার সৈন্যের একটি দল প্রেরণ করে হযরত ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য। পরবর্তীতে আরো সৈন্য পাঠানো হয় এবং ঐতিহাসিকদের মতে, মোট সৈন্য সংখ্যা অন্তত ২০ হাজারে গিয়ে দাঁড়ায়। অথচ, যার বিরুদ্ধে যুদ্ধের এই বিশাল আয়োজন, তাঁর কাফেলায় মোট লোকসংখ্যা একশ’র বেশি নয়। যাদের মধ্যে কিছু নারী ও শিশুও ছিলেন। বস্তুত হযরত ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু যুদ্ধ করার জন্য আসেননি। ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ, সংঘাত, হানাহানি তিনি একেবারেই পছন্দ করতেন না। তিনি শান্তি-নিরাপত্তা, ভ্রাতৃত্ব, পারস্পারিক সহাবস্থান দৃঢ় করার পক্ষে আন্তরিক ছিলেন। যখন কারবালা প্রান্তরে তিনি, তাঁর পরিবার ও সঙ্গী-সাথীরা ইয়াজিদের সৈন্যদের ঘেরাওয়ের মধ্যে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় পতিত, অবরুদ্ধ ইমাম বাহিনীর তাঁবুর পাশেই ফোরাত নদী। তাঁবু থেকে নদীর বয়ে যাওয়া কলকল ধ্বনি কানে আসে; কিন্তু ফোরাতের এক ফোঁটা পানিও মুখে পড়ে না ইমাম বাহিনীর। কারণ এজিদের পাপিষ্ঠ সৈনিক দল যে নদীও অবরুদ্ধ করে রেখেছে। মরুভূমির প্রচন্ড গরম এবং উত্তপ্ত বালিতে সকলেরই প্রাণ যেন ওষ্ঠাগত। এতদসত্তে¡ও তিনি পাপীষ্ঠ ইয়াজিদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ না করার সিদ্ধান্তে অটল এবং আত্মসমর্পণে একেবারেই নারাজ। তিনি বরং যুদ্ধ ও রক্তপাত এড়ানোর জন্য সচেষ্ট। তিনি আমর ইবনে সাদের কাছে এই মর্মে প্রস্তাব দেন: ১. আমাকে সেখানেই যেতে দাও, যেখান থেকে আমি এসেছি। ২. আমাকে স্বয়ং ইয়াজিদের সঙ্গে বসে একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হতে দাও। ৩. আমাকে কোনো মুসলিম দেশের সীমান্তে পাঠিয়ে দাও। সে দেশের জনগণের যে অবস্থা হয় আমিও তা গ্রহণ করবো। যা আমর বিন সাদের পছন্দ হয়। সে তা ওবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদের কাছে পাঠায়। প্রস্তাব ৩টি ইবনে জিয়াদেরও মনোপূত হয়। কিন্তু বাধা আসে সিমারের কাছ থেকে। তার প্ররোচনায় ওবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদ আমর বিন সাদকে এ মর্মে বার্তা পাঠায় যে, ‘ইমাম হুসাইন যদি তাঁর সঙ্গী-সাথীরাসহ আমার কাছে আত্মসমর্পণ করে তবে যুদ্ধ করবে না। তাদের আমার কাছে নিয়ে আসবে। আর যদি তারা আত্মসমর্পণ না করে তবে যুদ্ধ ছাড়া গত্যন্তর নেই।’ কিন্তু বাতিলের বিরুদ্ধে আপোষহীন, হক্বের ঝান্ডা বাহক ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ইবনে যিয়াদের সেই প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করেন। অবশেষে ৯ই মুহাররম রাতে ইমাম আলী মকাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু নিজ সাথীদের সাথে পরামর্শ করেন। পরদিন ১০ই মুহাররম ৬১ হিজরীতে ফজর নামাজের পর যুদ্ধ যখন অনিবার্য তখন ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এক আবেগঘণ ভাষণ দেন। তাঁর সেই ভাষণ পাপিষ্ট অন্তরগুলোয় কোন রেখাপাত করেনি। এরপর শুরু হয় তুমুল যুদ্ধ। অন্যায়, অবিচার, স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে ন্যায় ও সত্যের জন্য রণাঙ্গনে অকুতোভয় লড়াই করে একে একে তিনি সহ ৭২ জনের সবাই বীরত্বের সাথে শাহাদাতের সুধা পান করেন। কুখ্যাত সীমারের নির্দেশে সিনান বিন আনাস হযরত ইমাম হুসাইনের মাথা মুবারক শরীর থেকে আলাদা করে। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন) হত্যা ও মাথা বিচ্ছিন্ন করার পরও উন্মত্ত সীমার ঘোড়ার খুরের আঘাতে তাঁর মৃতদেহ ক্ষতবিক্ষত করতে থাকে। জাতীয় কবি নজরুলের ভাষায়- “কাঁদে কোন ক্রন্দসী কারবালা ফোরাতে সে আঁসু আনে সীমারেরও ছোরাতে।” কিন্তু সে কাঁদন পাষাণ হৃদয় সীমারদের কাঁদাতে পারেনি। তবে সে দৃশ্যে আজও মুসলিম উম্মাহর অশ্রæ ঝরছে। পরিবারের নারী ও শিশুসহ বাকি ১২৮ জন সদস্য বন্দী হন। যুদ্ধ শেষে শহীদদের শিরোচ্ছেদ করে ইয়াজিদের বেরহম সৈনিকরা। শহীদদের লাশ বিকৃত করা হয় এবং ঘোড়া দিয়ে পাড়ানো হয়। হযরত ইমামের পরিবারের শিবিরের তাবুতে লুটপাট করা হয়। তাদের হত্যা বা পুড়িয়ে মারার চেষ্টাও হয়। ছিন্ন মস্তকসমূহ ওবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদের কাছে পাঠানো হয়। কারবালার ঘটনায় ইয়াজিদের ভুমিকা: ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে শহীদ করার ব্যাপারে ইয়াজিদ সরাসরি জড়িত ছিল। ইয়াজিদ শাসক হওয়ার পর মদিনায় নিযুক্ত উমাইয়া শাসক ওয়ালিদ ইবনে উতবাকে নির্দেশ দিয়েছিল-“হুসাইনকে, আবদুল্লাহ ইবনে ওমরকে, আবদুর রহমান ইবনে আবু বকরকে ও আবদুল্লাহ ইবনে যোবাইরকে শক্তভাবে বায়আত করার জন্য পাকড়াও কর। যেই বায়আত তথা আমার আনুগত্য প্রকাশ করতে অস্বীকার করবে তার মাথা কেটে আমার কাছে পাঠিয়ে দাও”। এ প্রসঙ্গে ইমাম জালাল উদ্দিন সুয়ুতি রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, ইরাকবাসী ইমাম হোসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুর নিকট অসংখ্য পত্রাদি প্রেরণ করে তাকে সেখানে আসতে আহবান জানানোর সংবাদ ইয়াজিদ জানতে পেরে উত্তেজিত হয়ে কুফার গভর্ণর নোমান ইবনে বশিরকে পদচ্যুত করে ওবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদকে কুফার দায়িত্ব প্রদান করে এবং হুকুম জারি করে হুসাইন যেন কোনোভাবেই কুফায় প্রবেশ করতে না পারে। প্রয়োজনে তাঁর সাথে যুদ্ধ করার সে নির্দেশও দেয় ইয়াজিদ। যুদ্ধ করতে আদেশ দেওয়া মানেই হত্যার আদেশ দেওয়া। উবায়দুল্লা ইবনে যিয়াদের স্বীকারোক্তিই তার প্রমাণ বহন করে। সে উল্লেখ করেছে,“আমি হুসাইনকে হত্যা করেছি ইয়াজিদের কথায় অন্যথায় সে আমাকে হত্যা করে ফেলবে। সুতরাং আমি হুসাইকে হত্যা করার বিষয়টিকে বেছে নিয়েছি।” প্রখ্যাত তাবেয়ী হযরত হাসান বসরী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ইযাজিদের কুকর্মের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন,যখন ইমামের কর্তিত শির মুবারক আনা হয় তখন ইয়াজিদ তার হাতে থাকা বেতের ছড়িটি দিয়ে ওই পবিত্র শিরে খোঁচা মারতে থাকে। এ প্রসঙ্গে ইমাম ইবনে কাসির বলেন, “ইয়াজিদের হাতে একটি বেতের ছড়ি ছিল। সে তা দিয়ে হযরত হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর দাঁত মুবারকের ওপর প্রহার করে দাগ বসিয়ে দেয়। এরপর (অভিশপ্ত) ইয়াজিদ বলে: এর এবং আমাদের দৃষ্টান্ত হল যেমনটি হুসাইন ইবনুল হারাম মুররি বলেছে: আমাদের কাছে শক্তিমান বহুজনের মস্তক চৌচির করে ফেলা হয় এমতাবস্থায় যে তারা ‘বড় নাফরমান’ ও ‘চরম জালিম’। কাযী সানাউল্লাহ পানিপথি রহমাতুল্লাহি আলাইহি সুরা ইব্রাহিমের ২৮ নম্বর আয়াতের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লিখেছেন, ইয়াজিদ ও তার সঙ্গীরা আল্লাহর নেয়ামতের কুফরি করেছে এবং রাসূলের আহলে বাইতের বিরুদ্ধে শত্রæতার পতাকা তুলে শেষ পর্যন্ত পৈশাচিকভাবে ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে শহীদ করেছে। সে এতটা শত্রæতা করেছে যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার ধর্মকেই অস্বীকার করেছে। পরিশেষে বলা যায়, কারবালার ঘটনার একপিঠে ছিল পাশবিক নৃশংসতা ও নির্মমতা। যার হোতা ছিল ইয়াজিদ, ইবনে সা’দ, ইবনে জিয়াদ এবং শিমার। আর অপর পিঠে ছিল একত্ববাদ, দৃঢ় ঈমান, মানবতা, সাহসিকতা, সহানুভূতি ও সহমর্মিতা এবং সত্য প্রতিষ্ঠায় আত্মদানের বিরল কাহিনী। হযরত ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন, তবু ক্ষমতার লোভে কিংবা ন্যায়নীতির প্রশ্নে আপস করেননি। বিশ্ববাসীর কাছে তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও ন্যায়ের পক্ষে প্রতিরোধ সংগ্রামের এক জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। ইয়াজিদ যেমন অভিশপ্ত তেমনি ইয়াজিদীরাও অভিশপ্ত,নির্লজ্জ ও অবিবেচক। আর যারা ইয়াজিদের পক্ষে সাফাই গায় তারা ইসলামের দুশমন। ইয়াজিদ কোন মতেই কুসতুনতুনিয়া-বিষয়ক হাদীসের সুসংবাদের আওতায় আসবে না। সে ক্ষমা পাবার উপযোগীও নয়। ইমামে আহলে সুন্নাত শাহ্ আহমদ রযা খাঁন রহমাতুল্লাহি আলাইহির দরবারে যখন ইয়াজিদের ব্যাপারে প্রশ্ন করা হল তিনি বলেন, ইয়াজিদ নিঃসন্দেহে অপবিত্র ছিল, তাকে অপবিত্র বলা ও লিখা জায়েয এবং তাকে রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলা যাবে না। কেননা, সে তার অন্তরে হযরত আলী এবং হাসান ও হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমের প্রতি রাগ ও শত্রæতা পোষণকারী। সে আহলে বাইতে রিসালাতের শত্রæ। পক্ষান্তরে হযরত ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু সত্যের উপর ছিলেন। তিনি ইয়াযীদ ও ইয়াযীদের বাতিল খিলাফতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে শহীদ হয়ে ইসলামের গৌরবকেই অক্ষুন্ন রেখেছেন। সত্য ও ন্যায়, সাম্য ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য স্বৈরাচারী ইয়াজিদের বিরুদ্ধে হজরত ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ও তাঁর সঙ্গী-সাথিরা যেভাবে বীর বিক্রমে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন, সেই ত্যাগ চিরকাল দেশে দেশে যুগে যুগে এ ধরনের সঙ্কট ও সমস্যা উত্তরণের ব্যাপারে প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। সত্যের পথে এবং অসত্যের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারীদের তা জোগাবে হিম্মত ও প্রেরণা। লেখক: আরবি প্রভাষক, রাণীরহাট আল-আমিন হামেদিয়া ফাযিল মাদরাসা; খতিব, রাজানগর রাণীরহাট ডিগ্রি কলেজ জামে মসজিদ,রাঙ্গুনিয়া,চট্টগ্রাম।