ঈদ সাম্য ও সম্প্রীতির প্রতীক

মুহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মাসুম বছর ঘুরে আবারো এল মানবিক সাম্য, সহমর্মিতার বিস্ময়কর আলোকপ্রভা ঈদুল ফিতর। আরবি 'আওদ' শব্দ থেকে 'ঈদ' শব্দের উৎপত্তি, যার অর্থ ফিরে আসা, আনন্দ, খুশি ইত্যাদি। কোরআনুল করিমেও ঈদ শব্দের ব্যবহার রয়েছে; যেমন قَالَ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ اللَّهُمَّ رَبَّنَا أَنزِلْ عَلَيْنَا مَآئِدَةً مِّنَ السَّمَاء تَكُونُ لَنَا عِيداً لِّأَوَّلِنَا وَآخِرِنَا وَآيَةً مِّنكَ وَارْزُقْنَا وَأَنتَ خَيْرُ الرَّازِقِينَ অর্থাৎ ঈসা ইবনে মরিয়ম আলাইহিসসালাম বলেন, ‘হে আল্লাহ! আমাদের প্রতিপালক! আমাদের জন্য আসমান থেকে খাদ্যপূর্ণ খাঞ্চা প্রেরণ করুন, তা আমাদের ও আমাদের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সবার জন্য হবে ঈদ (আনন্দোৎসব) এবং আপনার পক্ষ থেকে একটি নিদর্শন। আপনি আমাদের রিযিক প্রদান করেন। আপনিই শ্রেষ্ট রিযিকদাতা।’ আনন্দ উদযাপন প্রসঙ্গে অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে قُلْ بِفَضْلِ اللهِ وَ بِرَحْمَتِهٖ فَبِذٰلِكَ فَلْیَفْرَحُوْا هُوَ خَیْرٌ مِّمَّا یَجْمَعُوْنَ. অর্থাৎ, (হে হাবীব!) আপনি বলুন, এসব আল্লাহর অনুগ্রহ ও তাঁর রহমতেই হয়েছে। সুতরাং এতেই তাদের আনন্দিত হওয়া উচিত। তারা যা-কিছু পুঞ্জীভূত করে, তা অপেক্ষা এটা শ্রেয়। আর ঈদুল ফিতরের অর্থও হচ্ছে রোযা ভাঙার উৎসব। তবে মুসলমানের আনন্দোৎসব আর অমুসলিমের আনন্দোৎসবে ভিন্নতা রয়েছে । মুমিনগণ আনন্দোৎসব করেন আল্লাহর পছন্দনীয় আমলের মাধ্যমে আর অমুসলিম আনন্দ উদযাপন করে তাঁর নাফরমানির মাধ্যমে। কেননা, মুসলমানের জীবন ও চিন্তা আখেরাত কেন্দ্রিক আর কাফেরের সবকিছু দুনিয়াকেন্দ্রিক। ইরশাদ হচ্ছে, وَ فَرِحُوْا بِالْحَیٰوةِ الدُّنْیَا وَ مَا الْحَیٰوةُ الدُّنْیَا فِی الْاٰخِرَةِ اِلَّا مَتَاعٌ. অর্থাৎ তারা (কাফেরগণ) পার্থিব জীবনেই উল্লাসিত, অথচ আখেরাতের তুলনায় পার্থিব জীবন তো মামুলি ভোগমাত্র। বস্তুত ঈদুল ফিতর আনন্দ ও ইবাদত দুটির সমন্বিত রূপ। এ আনন্দ আল্লাহর রহমত ও ক্ষমাপ্রাপ্তির, জাহান্নাম থেকে মুক্তির। এতে নেই কোনো অশ্লীলতা ও পাপ-পঙ্কিলতা। এ আনন্দে শুধুই সওয়াব ও পুণ্যময়তা। সংযুক্ত আছে ইবাদতের নিষ্ঠা ও কর্তব্যের তাগিদ,সামাজিক দায় ও পরিমিতবোধের অনিবার্য যৌথতা। ধনীর সাথে যেন দুঃখী ও দুস্থরা আনন্দে সমান অংশীদার হয়ে উঠে, প্রতিষ্ঠিত হয় সাম্য ও ভ্রাতৃত্ববোধ; ইসলাম ধনীদের ওপর ওয়াজিব করেছে সদকাতুল ফিতর। যা রোযার যাকাত স্বরূপ। যাকাত যেমনি সম্পদকে পরিশুদ্ধ করে তেমনি সদকাতুল ফিতর রোযাকে শুদ্ধতা দান করে। তাই ঈদের জামাতে শরীক হবার আগেই ফিতরা আদায়ের তাগিদ দেয়া হয়েছে। যাতে উৎসবের সাথে যুক্ত হয়ে যায় সম্পদের সুষম বন্টনের অনিবার্যতা। ফলে এ আনন্দ ছড়িযে যায় হৃদয় থেকে হৃদয়ে। সদ্যপ্রসূত শিশু থেকে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সবার দেহ-মনে ঈদের ছোঁয়া লাগে। হতদরিদ্র, এতিম ও শত শত ছিন্নমূল মানুষের মুখেও হাসি ফোটে কিছু টাকা, কিছু নতুন কাপড় পেয়ে। মুসল্লীগণ যখন ঈদের নামাযের উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বের হয়, তাদের মুখে ¯েøাগান থাকে- ‘আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, ওয়ালিল্লাহিল হামদ’। যেন এক জান্নাতী মনোরম দৃশ্য। কিন্তু কেন সেই আনন্দ? আনন্দের জন্য তো কোনো কারণ আর কোনো অভিবাদন হতে পারে না। ইরশাদ হচ্ছে, সালামের মাধ্যমে পরস্পরের মধ্যে মিল-মহব্বত বৃদ্ধি পায়, ঈমানের পূর্ণতা লাভ হয় এবং জান্নাতে প্রবেশ করার পথ সুগম হয়। অত:পর বলবে ঈদুন সাঈদুন অথবা ঈদুন মুবারকুন। হযরত সাঈদ ইবনে জুবায়ের রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন- كان أصحاب رسول الله صلى الله عليه وآله وسلم إذا التقوا يوم العيد يقول بعضهم لبعض : تَقَبّلَ اللهُ مِنّا وَمِنْكُمْ. অর্থাৎ ঈদের দিন সাহাবায়ে কেরাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম মিলিত হলে একে-অপরের উদ্দেশে বলতেন- تَقَبّلَ اللهُ مِنّا وَمِنْكُمْ [আল্লাহ তায়ালা কবুল করুন আমাদের থেকে এবং আপনাদের থেকে (সকল আমল)]। ঈদে রাসূলুল্লাহর আমল: ঈদের দিনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার বিশেষ কিছু আমল সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো-
১.সুন্দর পোশাক পরিধান করা: প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদের দিনে নিজের সৌন্দর্যের দিকে বিশেষ মনযোগ দিতেন। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, ‘হুযূর পুরনূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদের দিনে লাল চাদর পরিধান করতেন।’ তাই ঈদের দিনে সুগন্ধি ব্যবহার করা ও সুন্দর পোশাক পরা মুস্তাহাব। ২. গোসল করা: না’ফে রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা রাসুলের সুন্নত অনুসরণ করে ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে গোসল করতেন।’ ৩. খেজুর খাওয়া: আনাস বিন মালেক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদুল ফিতরে ঈদগাহে রওনা হবার প্রাক্কালে বিজোড় খেজুর খেতেন অর্থাৎ এক, তিন, পাঁচ বা সাতটির মত খেতেন।’ ৪. পায়ে হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া: আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, ‘রাসূলে আরবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পায়ে হেঁটে ঈদগাহে যেতেন এবং পায়ে হেঁটেই ঈদগাহ থেকে ফিরতেন।’ ৫. পথ পরিবর্তন করা: জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, ‘নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদগাহে যে পথে যেতেন ফিরার সময় সে পথ পরিবর্তন করতেন।
৬.তাকবির পড়া: ইমাম যুহরি রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, ‘ঈদুল ফিতরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় তাকবির পাঠ শুরু করতেন এবং নামায শেষ হওয়া পর্যন্ত তাকবির পড়া চলমান রাখতেন।’ ৭.দোয়া করা: ঈদের নামায আদায়ের পর নিজের জন্য ও জীবিত-মৃত সব মুসলমানদের জন্য দোয়া করা উত্তম। থাকতে হবে! সুখবর পেলেই তো মানুষ আনন্দিত হয়! এ প্রসঙ্গে হযরত আনাস বিন মালেক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘যখন ঈদের দিন তথা ঈদুল ফিতরের দিন আসে, তখন আল্লাহ বান্দাদের বিষয়ে ফেরেশতাদের সঙ্গে গর্ব করেন। বলেন, “হে আমার ফেরেশতারা! যে শ্রমিক তার কর্ম পূর্ণ করেছে, তার বিনিময় কী?” তারা বলে, “তাদের বিনিময় হলো তাদের পারিশ্রমিক পরিপূর্ণরূপে প্রদান করা।” বলেন, “হে আমার ফেরেশতারা! আমার বান্দা-বান্দীরা তাদের দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করেছে, তারপর দোয়ার উদ্দেশ্যে বের হয়েছে। আমার সম্মান, মহত্ত¡, করুণা, মাহাত্ম্য ও উচ্চ মর্যাদার শপথ! আমি তাদের প্রার্থনা গ্রহণ করব।” এরপর আল্লাহ বলেন, “তোমরা ফিরে যাও, আমি তোমাদের ক্ষমা করে দিলাম এবং তোমাদের মন্দ আমলগুলো নেকিতে পরিবর্তন করে দিলাম।” নবীজি বলেন, “তারা ক্ষমাপ্রাপ্ত হয়ে ফিরে যাবে”’। ঈদের প্রবর্তন: নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনা মনোয়ারায় পৌঁছে দেখতে পান যে, মদিনা শরীফে বসবাসকারী ইহুদিরা শরতের পূর্ণিমায় নওরোজ উৎসব এবং বসন্তের পূর্ণিমায় মেহেরজান উৎসব পালন করছে। তারা এ উৎসবে নানা আয়োজন, আচার-অনুষ্ঠান এবং বিভিন্নভাবে আনন্দ উপভোগ করে থাকে। তাদের ভিত্তিহীন সংস্কৃতির মূলোৎপাটন করে শুদ্ধ সংস্কৃতি উদযাপনের নির্দেশনা দিয়ে রাসূলে আরবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘প্রতিটি জাতির আনন্দ-উৎসব আছে।’ মহান আল্লাহ তোমাদের ওই উৎসবের বিনিময়ে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার মতো পবিত্র দুটি দিন দান করেছেন। এতে তোমরা পবিত্রতার সঙ্গে উৎসব পালন করো। ঈদের নামায : ঈদের নামায পড়া পুরুষদের জন্য ওয়াজিব। ঈদের নামাজের সময় হলো সূর্যোদয়ের পর থেকে মধ্য দিবসের পূর্ব পর্যন্ত। ঈদের নামাজের আগে বা পরে কোনো নফল নামাজ পড়া যায় না। ঈদের নামাযের জন্য আজান ও ইকামাত দিতে হয় না। রমযানের ঈদ অপেক্ষা কোরবানি ঈদে জামাত একটু আগেই করা হয়; কারণ তারপরে কোরবানির পশু জবাইসহ নানান কাজ থাকে। রমযানের ঈদের নামাজের আগে এবং কোরবানির ঈদে ঈদের নামাজের পরে নাস্তা খাওয়া সুন্নত। ঈদের নামাযের স্থান: ইদানীং লক্ষ করা যাচ্ছে, মসজিদগুলোতেই ঈদের জামাত আদায়ের প্রবণতা বেড়ে গিয়েছে। অথচ পাশেই ঈদের বড় জামাতের মাঠ কিংবা স্কুল-কলেজের বিশাল ময়দান আছে। মূলত ঈদের নামায ঈদগাহে আদায় করাটাই হচ্ছে সুন্নত। মসজিদে নববী, যেখানে এক রাকাত নামায যদি কেউ আদায় করে থাকে, তাহলে পঞ্চাশ হাজার রাকাত নামাজের সওয়াব রয়েছে। এত ফজিলত পূর্ণ হওয়া সত্তে¡ও রাসূলে আরবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেই মসজিদে ঈদের নামায আদায় না করে ময়দানে গিয়ে নামায আদায় করেছেন, যাতে সেখানে সবাই অংশগ্রহণ করতে পারে। অবশ্য বৃষ্টির কারণে বা অন্য কোনো ওযরে যেমন জায়গা সংকুলান না হওয়া বা ঈদগাহ না থাকার কারণে মসজিদে ঈদের জামাত করা মাকরূহ নয়। ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময়: ঈদে পরস্পরকে শুভেচ্ছা জানানো শরিয়ত অনুমোদিত একটি বিষয়। বিভিন্ন বাক্য দ্বারা এ শুভেচ্ছা বিনিময় করা যায়। সর্বপ্রথম একে-অপরকে সালাম দেবে। কেননা এর চেয়ে উত্তম ১০. ঈদগাহ থেকে ফিরে দু’রাকাত সালাত আদায় করা: আবু সাঈদ খুদরি রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদের সালাতের পূর্বে কোনো সালাত পড়তেন না বরং বাড়ি ফিরে দু’রাকাত নামাজ আদায় করতেন।’ সাহাবাদের আমল: সাহাবায়ে কেরাম মাহে রমযানে গুনাহ মাফ হয়েছে কি না, এ ব্যাপারে বেশি চিন্তিত থাকতেন। বর্ণিত আছে, আমিরূল মু’মিনিন হযরত ওমর ফারুক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ঈদুল ফিতরের নামাযে ইমামতি করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন। তিনি ঘরের দরজা বন্ধ করে বলতেন, আমার গুনাহ মাফ না হলে আমি ঈদগাহে গিয়ে কিভাবে ইমামতি করতে পারি। তাঁদের নিকট ঈদে নতুন পোশাক-পরিচ্ছদ ও পানাহার মুখ্য ছিল না। বরং প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার সান্নিধ্য লাভ করা, তাঁর নির্দেশ পালন করাই ছিল তাঁদের প্রকৃত আনন্দ। ঈদের দিন অনেক দূর থেকে সাহাবায়ে কেরাম ছুটে যেতেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য এবং তাঁর পেছনে দুই রাকাত নামাজ পড়ার জন্য। বঞ্চিত মানুষের মাঝে ঈদ: ফুটপাতই যাদের আবাসস্থল ঈদের দিনে আনন্দের বদলে তাদের চোখে-মুখে পরিলক্ষিত হয় অসহায়ত্বের ছাপ। অনেকে নতুন কাপড় পাওয়ার আশায় অপেক্ষার প্রহর গুনে। ভাসমান এসব মানুষদের নির্দিষ্ট কোনো আশ্রয় থাকে না। আজ এখানে তো কাল ওখানে। ফুটপাতে মাথার উপর কিছু প্লাস্টিক ও পলিথিন দিয়ে সামিয়ানা টাঙিয়ে কোনো রকমে আবাসের বন্দোবস্ত করে এমন পরিবারও এই শহরেই রয়েছে। একজন মানুষের থাকার জায়গা যেখানে হয় না সেখানে পুরো পরিবারকেই কষ্ট করে দিন পার করতে হচ্ছে। নানান প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে মা বড় করছে আপন সন্তানকে। অনেকের বাবার সন্ধান নেই। বাবাকে চেনেও না । মা টুকটাক কাজ করে সন্তানের আহার যোগাড় করে। কোনো কোনো দিন অনাহারেও থাকতে হয়ে তাদের। ঈদ এলেই তাদের চেয়ে থাকতে হয় কারো সাহায্যের আশায়। সাহায্য মিললে হয়তো বছরে একদিন নতুন কাপড় পড়ার সৌভাগ্য হয় আর ভাগ্য খারাপ হলে সেটিও জোটে না। তাদের ভাষ্য ‘ঈদ বড়লোকদের ব্যাপার, দিনের খাবারই জোগাড় করতে পারি না, ঈদ কেমনে করবো! মাঝে মাঝে কেউ নতুন-পুরাতন কাপড় দেয় সেইগুলা পরি। আমাগো জীবনডাই কষ্টের, আমাগো জীবনে ঈদ আসে না।’ আত্মীয়কে ঈদোপহার: হজরত সালমান ইবনে আমের রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘সাধারণ দরিদ্র ব্যক্তিকে সাদকা বা দান করেল কেবল সাদকার সাওয়াব পাওয়া যায়। কিন্তু রক্তসর্ম্পীয় আত্মীয়কে সাদকা বা দান করলে সাদকাও হবে, আত্মীয়তাও রক্ষা হবে। অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে, তার দ্বিগুণ সাওয়াব হবে। সাদকার সাওয়াব এবং আত্মীয়তা রক্ষা করার সাওয়াব।’ সুতরাং আত্মীয়তার সম্পর্ক বিনষ্ট নয় বরং আত্মীয়দের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা উত্তম। ঈদোপহার কিংবা যাকাত-সাদকা দেয়ার মাধ্যমে আপনজনদের সাহায্য-সহযোগিতা করা সুন্নাতে নববির একান্ত দাবি। এতে আত্মীয়দের সম্পর্ক জোরদার হয়। ঈদ উৎসবে বর্জনীয়: অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, বর্তমানে ঈদ উদযাপন যেন বড়ই আনুষ্ঠানিকতা ও ভোগসর্বস্ব হয়ে গেছে। এর মূল তাৎপর্যই যেন অনুপস্থিত। ঈদ নেহাত প্রথাগত, অপসংস্কৃতি ও জাগতিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে পালিত হচ্ছে। ঈদকে কেন্দ্র করে নাটক, সিনেমা, হারাম খেলাধুলার হিড়িক পড়ে সমাজে, যা বর্জনীয়। ঈদের জন্য নতুন ড্রেস মূখ্য নয়, অথচ কর্পোরেট কোম্পানিগুলোর চোখধাঁধানো বিজ্ঞাপন দেখে অনেকেই ঈদের জন্য পোশাক, মোবাইলসহ বিভিন্ন পন্যকে টার্গেট করে। কিনতে না পারলে কষ্ট পায়, আত্মহত্যা পর্যন্ত করে, যা অত্যন্ত গর্হিত। হুযূর পুরনূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘ঈদের আনন্দ তার জন্য নয়, যে নতুন ও ভালো কাপড় পরিধান করে। বরং তাদের জন্য যারা আল্লাহ তায়ালাকে ভয় করে, যে আল্লাহর প্রতি রুজু হয়।’ হযরত আনাস ইবনে মালিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘মুমিনের জন্য ঈদ পাঁচ দিন; এক. যেদিন গুনাহমুক্ত কাটাবে। দুই. শয়তানের প্রতারণা থেকে মুক্ত হয়ে যেদিন ঈমান অক্ষুন্ন রাখতে সক্ষম হবে। তিন. যেদিন নির্দ্বিধায় দোজখের ওপর দিয়ে পুলসিরাত অতিক্রম করতে সক্ষম হবে। চার. যেদিন দোজখের অগ্নি থেকে মুক্ত হয়ে জান্নাতে প্রবেশ করবে। পাঁচ. যেদিন মহান রাব্বুল আলামিনের দিদার লাভ করবে। জনৈক ব্যক্তি ঈদের দিন মাওলা আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে শুকনো রুটি চিবুতে দেখে জিজ্ঞেস করেন- হে আবু তুরাব! আজ তো ঈদের দিন! হজরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমার ঈদ সেই দিন, যেদিন গুনাহমুক্ত হবো।এদিন সে-ই কৃতকার্য হল, যার ইবাদত কবুল হল, গুনাহ মাফ হল। যার গুনাহ মাফ হল না, ইবাদত কবুল হল না, তার চেয়ে হতভাগা আর কে হতে পারে! এমন ব্যক্তির জন্য রাসূলও ধিক জানিয়েছেন। হযরত ওমর ইবনে আবদুল আযীয রহমাতুল্লাহি আলাইহি তাঁর গভর্নরদের এ মর্মে চিঠি লিখতেন-ঈদের নামাযের আগে সাধ্যানুযায়ী দান-সদকা করবে। যাদের দান করার সামর্থ্য নেই তারা যেন ঈদের পরে রোযা রাখে। এরপর তিনি বলেন, ঈদের দিন তোমরা বেশি বেশি বলতে থাকবে, যেমন বলেছিলেন আমাদের পিতা হযরত আদম আলাইহিস সালাম- رَبَّنَا ظَلَمْنَاۤ اَنْفُسَنَا وَ اِنْ لَّمْ تَغْفِرْ لَنَا وَ تَرْحَمْنَا لَنَكُوْنَنَّ مِنَ الْخٰسِرِیْنَ. অর্থাৎ হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা নিজ সত্তার উপর জুলুম করে ফেলেছি। আপনি যদি আমাদেরকে ক্ষমা না করেন ও আমাদের প্রতি রহম না করেন, তবে আমরা অবশ্যই অকৃতকার্যদের অন্তভুর্ক্ত হয়ে যাব। ঈদের ম্যাসেজ: কেউ খাবে আর কেউ খাবে না, এই অবস্থার অবসান কল্পে এবং গরিব, সর্বহারা ও অবহেলিত মানুষকে কাছে টেনে নেয়ার প্রত্যক্ষ প্রশিক্ষণের দিন হচ্ছে ঈদুল ফিতর। আর এর সাথে জড়িয়ে রয়েছে জান্নাতী সুখের আমেজ। কবি নজরুল বলেন : ‘ঈদ এনেছে দুনিয়াতে শিরণী বেহেশতী, দুশমনে আজ গলায় ধরে পাতাব ভাই দোস্তী যাকাত দেব ভোগ-বিলাস আজ গোস্সা বদমাস্তী, প্রাণের তশ্তরীতে ভরে বিলাব তৌহীদ-চল ঈদগাহে।’ ইমাম ইবনুল জাওযী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন- إخواني: ليس العيد ثوبا يجر الخيلاء جره، ولا تناول مطعم بكف شره لا يؤمن شره، إنما العيد لبس توبة عاص تائب يسر بقدوم قلب غائب. বন্ধুগণ! জমকালো জামা পরা, যা অহংকার সৃষ্টি করে এবং আড়ম্বরপূর্ণ খাবার খাওয়া, যার অনিষ্ট থেকে বাঁচা যাবে না- এর নাম ঈদ নয়; ঈদ হল আল্লাহ বিমূখ কলবে তাওবার জামা পরিধান করানো, যা অদৃশ্যের (আল্লাহর) সঙ্গে মিলনের আনন্দে আন্দোলিত থাকে। ঈদের প্রকৃত তাৎপর্য উপলব্ধি করে আমাদেরও নতুনভাবে জাগতে হবে। সমাজের অভাবী-দুঃখী মানুষগুলোকে সুখী-স্বাবলম্বী করে তুলতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। মহান আল্লাহ গরিব ও অসহায়দের সঙ্গে সঙ্গে নিজের আপনজনদেরকেও সাহায্য-সহযোগিতা করার মধ্য দিয়ে ইবাদতের মাধ্যমে সঠিকভাবে ঈদ উদযাপনের তাওফীক দান করুন। আমীন। লিখক: আরবী প্রভাষক, রাণীরহাট আল আমিন হামেদিয়া ফাযিল মাদ্রাসা;এমফিল গবেষক,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। # দৈনিক সময়ের আলো, ১ মে ২০২২ রবিবার https://www.shomoyeralo.com/details.php?id=178797