আদর্শ শিশু জাতির কর্ণধার

মুহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মাসুম এ বসুন্ধরার মাঝে শিশুরা আল্লাহর দেয়া শ্রেষ্ঠ সম্পদ। ইরশাদ হচ্ছে, ধনৈশ্বর্য এবং সন্তান-সন্ততি পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য। বিশ্বব্যাপী শিশুদের অধিকার সংরক্ষণের জন্য ১৯২৪ সালে জেনেভায় এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের মাধ্যমে ‘শিশু অধিকার’ ঘোষণা করা হয়। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৫৯ সালে জাতিসংঘে ‘শিশু অধিকার সনদ’ ঘোষণা করা হয়। আর এদেশে ১৯৭৪ সালে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শিশু আইন প্রণয়ন করেন। এ আইনে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত শিশু হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। শিশু অধিকার সনদে ৫৪টি ধারা এবং ১৩৭টি উপ-ধারা আছে। এই উপ-ধারাগুলোতে বলা হয়েছে, শিশুদের ক্ষেত্রে কোন ধরনের বৈষম্য করা যাবে না। সমাজকল্যাণমূলক কাজ এবং আইনের ক্ষেত্রে প্রধান বিবেচ্য হবে শিশুর সর্বোত্তম স্বার্থ। প্রতিটি রাষ্ট্র শিশুদের পরিচর্যা ও সুবিধাদি প্রদান করবে। শিশুদের মৌলিক অধিকার যেমন- শিক্ষা, সামাজিক, সাংস্কৃতিক প্রভৃতি অধিকারগুলো নিশ্চিত করবে। বস্তুত একটি শিশুর জন্মের আগ থেকেই তার অধিকার শুরু হয়ে যায়। আলোচ্য নিবন্ধে শিশুর অধিকার সমুহ দুই ধাপে আলোকপাত করার প্রয়াস পেলাম। জন্মলাভের আগে শিশুর অধিকার: প্রথমত, মায়ের চরিত্র উত্তম হওয়া। কারণ শিশুর ওপর তার মায়ের প্রভাব পড়বেই। তাই শিশুকে সুন্দর ও সফল জীবন উপহার দিতে চাইলে তার প্রস্তুতি নিতে হবে বিয়ের আগেই। তাই নূরনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, পাত্রী নির্বাচনের ক্ষেত্রে তুমি দ্বীনদারী-ধার্মিকতাকে প্রাধান্য দেবে নতুবা তুমি ক্ষতিগ্রস্থ হবে। দ্বিতীয়ত, বৈধভাবে জন্মলাভের অধিকার। জন্মগত বৈধতা এমন বিষয়, যা পরিবার গঠনের ভিত্তি ও শিশুর ন্যায্য অধিকার। অবৈধ সন্তান অনেক ক্ষেত্রেই মানবিক অধিকার হতে বঞ্চিত হয়, তার জীবনধারণ এবং লালন পালনের সুযোগ-সুবিধা সহজলভ্য হয় না। যদিও বা মাতাপিতার অপরাধ সন্তানের ওপর বর্তায় না, কিন্তু সমাজ অবৈধ সন্তানকে পূর্ণ সামাজিক মর্যাদা দিতে সম্মত নয়। তৃতীয়ত, গর্ভের সন্তানের যতœনেয়া। অর্থাৎ অন্তঃসত্ত¡া স্ত্রীর যতœ নেয়া। অন্তঃসত্ত¡া স্ত্রীকে যদি তালাকও দেয়া হয় তখনো ভরণ-পোষণের দায়িত্ব শরয়ি বিধান মতে স্বামীর ওপর। ইরশাদ হচ্ছে, তারা গর্ভবতী হলে সন্তান প্রসব পর্যন্ত তাদের জন্য ব্যয় করবে। জন্মলাভের পর শিশুর অধিকার: ক. কানে আযান শোনার অধিকার: সন্তান জন্মলাভের সাথে সাথেই অভিভাবকদের দায়িত্ব, সহনীয় আওয়াজে নবজাতকের ডান কানে আযান, বাম কানে ইকামত দেওয়া, এটা মুস্তহাব। হযরত ফাতেমা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা যখন ইমাম হাসান রাদিয়াল্লাহু আনহুকে প্রসব করলেন, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর কানে নামাযের আযানের মতো আযান দিয়েছিলেন। খ. দুধপানের ব্যবস্থা করা: জন্মের পর শিশুর অন্যতম অধিকার, তার দুধপানের ব্যবস্থা করা। ইরশাদ হচ্ছে, মায়েরা তাদের সন্তানদেরকে পূর্ণ দু’বছর দুধ পান করাবে। গ. শিশুর সুন্দর নাম রাখা: এটা শিশুর আরেকটি মৌলিক অধিকার। শিশুর সুন্দর নাম রাখা মুস্তাহাব। ইরশাদ হচ্ছে, তোমরা নবীগণের নামে নিজ সন্তানের নাম রাখবে। আর আল্লাহর নিকট সবচেয়ে পছন্দনীয় নাম হল আব্দুল্লাহ ও আব্দুর রহমান। ঘ. শিশুর আকিকা করা: অভিভাবক নবজাতকের পক্ষ হতে, তার জন্মের খুশিতে মহান আল্লাহর কৃতজ্ঞতা স্বরূপ পশু জবাই করার মাধ্যমে আকিকা করা মুস্তাহাব। ইরশাদ হচ্ছে, প্রত্যেক শিশু তার আকিকার সাথে দায়বদ্ধ থাকে, তার জন্মের সপ্তম দিনে তার পক্ষ থেকে পশু যবেহ করতে হবে, তার মাথা (চুল) কামাতে হবে এবং নাম রাখতে হবে। ঙ.খতনা করানো: ছেলে শিশুদের খতনা করানো সুন্নত। (নবীগণের সুন্নত) স্বভাবগত বিষয় হলো পাঁচটি, খতনা করা, ক্ষৌরকর্ম করা (অর্থাৎ অবাঞ্ছিত লোম পরিষ্কার করা), বগলের লোম উপড়ে ফেলা, নখ কাটা ও গোঁফ খাটো করা। চ. নবজাতককে পিতার বংশের সাথে সম্পৃক্ত করা: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যে লোক নিজের সন্তানকে অস্বিকার করে, অথচ শিশুটি তার মমতার আকাক্সক্ষা করে, মহান আল্লাহ তাকে তাঁর রহমত থেকে বঞ্চিত করবেন এবং তাকে কেয়ামতের দিন পূর্বাপর সকল লোকের সামনে লাঞ্ছিত করবেন। ছ. শিশুর ভরণপোষণ দেয়া: নবজাতক ছেলে হোক বা মেয়ে পিতার জন্য সামর্থ্য অনুপাতে নবজাতকের ভরণপোষণের ব্যয় বহন করা ওয়াজিব বা আবশ্যক। জ. ভদ্রতা ও ধর্মীয় জ্ঞান শিক্ষা দেয়া: জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলিমের (পুরুষ হোক বা নারী) ওপর ফরয। তাই সন্তানকে তার দৈনন্দিন ইবাদতের জন্য যতটুকু ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন করা দরকার, অন্তত ততটুকু ধর্মীয় জ্ঞান শেখার ব্যবস্থা করতেই হবে। তাকে পরিচ্ছন্নতা-পবিত্রতা শিক্ষা দিতে হবে, শুদ্ধভাবে কোরআন তেলাওয়াত শিক্ষা দিতে হবে, প্রয়োজনীয় মাসায়েল শেখাতে হবে। ঝ. শিশুদের স্নেহ করা: শিশুদের স্নেহকারীর জন্য রয়েছে পরকালের উত্তম পুরস্কার, আর শিশুদের যে স্নেহ করে না তার জন্যে রয়েছে কঠিন সাজা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, “যে লোক আমাদের শিশুদের স্নেহ করে না এবং আমাদের বড়দের সম্মানের প্রতি খেয়াল করেনা; সে (চারিত্রিকভাবে) আমাদের দলভুক্ত নয়। ঞ.সন্তানকে পেশা শিক্ষা দেয়া: পিতা-মাতার অবর্তমানে বা শিশু প্রাপ্ত বয়স্ক হয়ে সে যেন জীবিকা নির্বাহ করতে পারে এমন যে কোন একটা পেশা সন্তানকে শিখিয়ে দেয়া অভিভাবকের দায়িত্ব। যেন সে অনাহারে কষ্ট না পায়, বিপদগ্রস্থ না হয়। যেমন চাষাবাদ, গাড়ি চালানো,ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার ইত্যাদি যার উপর নির্ভর করে সে জীবিকা নির্বাহ করতে পারে এরকম যে কোন একটা শিখিয়ে দেয়া পিতা-মাতার দায়িত্ব। ইরশাদ হচ্ছে, তোমার বংশধরদের অন্যের ওপর নির্ভরশীল করে রেখে যাওয়ার চেয়ে তাদের অপেক্ষাকৃত সচ্ছল রেখে যাওয়া অনেক ভাল।
ট.ছেলে মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা করা: পিতামাতার বিশেষত: পিতার দায়িত্ব যে, তাদের ছেলেমেয়েদের জন্য বিয়ের ব্যবস্থা করবে যখন তারা প্রাপ্ত বয়সে উপনীত হয়। যদি তারা তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয় এবং ছেলেমেয়েরা পাপে লিপ্ত হয়ে পড়ে তবে পিতাও তাদের পাপের জন্য দায়ী সাব্যস্ত হবে। আসুন! সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মাঝে শিশুদের নিরাপত্তা ও অধিকারের ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধিতে এগিয়ে আসি। শিশু সন্তান নির্যাতনসহ হত্যার মতো সীমা লংঘনের অপরাধে আল্লাহকে ভয় করি। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে শিশুদের কল্যাণে কাজ করা এবং তাদের স্বার্থ রক্ষায় সতর্কতা অবলম্বন করার তাওফিক দান করুন। লিখক: আরবি প্রভাষক ও এমফিল গবেষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।