স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা কঠিন
মুহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মাসুম
عن أبي هريرة رضي الله عنه قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: ما من مولود إلا يولد على الفطرة، فأبواه يهودانه أو ينصرانه أو يمجسانه،
হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন- প্রত্যেক নবজাতকই ফিতরাতের (স্বাধীন সত্তা/স্বভাবধর্ম) উপর জন্মলাভ করে। অতঃপর তার পিতামাতা তাকে বিভিন্ন আদর্শে শৃঙ্খলিত করে ইহুদী, নাসারা কিংবা মাজুসী (অগ্নিপূজারী) রূপে গড়ে তোলে। (সহিহ বুখারী, হাদীস: ১৩৫৯; সহিহ মুসলিম,হাদীস: ২৬৫৮)
রাবী পরিচিতি: প্রখ্যাত সাহাবী হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিল্লাহু আনহুর প্রকৃত নাম আবদুর রহমান বা আবদুল্লাহ। ইসলাম গ্রহণের পূর্বে তাঁর নাম ছিল আবদুশ শামস। তিনি ৬২৯ খৃস্টাব্দ মোতাবেক সপ্তম হিজরিতে হুদায়বিয়ার সন্ধি ও খায়বরের যুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে হযরত তুফাইল ইবনে আমরের হাতে ইসলাম গ্রহণ করে সাহাবীয়ে রাসূলের মর্যাদা অর্জন করেছেন। তিনি হুযূর পুরনূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার পক্ষ থেকে বিশেষ জ্ঞান লাভে ধন্য হয়েছেন। তিনি সর্বমোট ৫৩৭৫টি হাদিস শরীফ বর্ণনা করেন। তিনি ফকীহ সাহাবীদের অন্যতম ছিলেন। তিনি ৭৮ বছর বয়সে ৫৯ মতান্তরে ৬০ হিজরি ইন্তেকাল করেন। হযরত ওয়ালিদ ইবনে উকবার ইমামতিতে নামাযে জানাযা শেষে তাঁকে জান্নাতুল বকীতে দাফন করা হয়। (ছিহাহ ছিত্তাহর রাবী পরিচিতি,পৃ: ১৩)
প্রাসঙ্গিক আলোচনা: জন্মগতভাবে প্রতিটি মানুষই স্বাধীন সত্তার অধিকারী। স্বাধীনতা হলো সত্য প্রকাশে ভীতিহীনতা, সত্য ও ন্যায়ের পথে চলার স্বাতন্ত্রতা। স্বাধীনতা মানে অন্যায়ের প্রতিবাদ করার সাহসিকতা। স্বাধীনতা যেমন মানুষের মৌলিক অধিকার, তেমনি ইসলামের মূল শিক্ষা। তাই নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুধু দাসদের মুক্ত করেই ক্ষান্ত হননি; তিনি ক্রীতদাসকে সন্তান বানিয়েছেন, করেছেন ভাইয়ের মর্যাদায় অভিষিক্ত, নির্বাচিত করছেন সেনা অধিনায়ক। কৃষ্ণবর্ণের সৈয়্যদুনা বিলাল হাবশী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে মসজিদে নববির প্রধান মুয়াজ্জিনের দায়িত্ব অর্পণ করেছেন। স্বাধীনতাকামী প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার সহচর সাহাবীগণ ছিলেন স্বদেশ প্রেমের মূর্ত প্রতীক। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌম রক্ষায় নূরনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখনই আহ্বান করেছেন তখনই সাহাবায়ে কেরাম সর্বাত্মক ডাকে সাড়া দিয়েছেন। তারা জানতেন, নিজেদের বিশ্বাস, আদর্শ ও দ্বীন-ধর্মমত প্রতিষ্ঠার জন্য একটি স্বাধীন ভূখন্ডের প্রয়োজন। ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য তারা যেমন আন্তরিক ছিলেন, তেমনি নিবেদিত প্রাণ ছিলেন দেশের স্বাধীনতা রক্ষায়।
ইসলামের সেই মহান আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ভারতবর্ষের শ্রেণিবৈষম্য ও বর্ণবৈষম্যের শিকার নির্যাতিত-নিপীড়িত কোটি কোটি জনতা স্বাধীনতার স্বাদ আস্বাদন করার জন্য ইসলামে দীক্ষিত হয়েছে। মুক্তির সুধা পান করেছে বিভিন্ন ধর্ম ও জাতিগোষ্ঠীর মানুষ। সময়ের পরিক্রমায় ভারতের মুক্ত আকাশে নেমে আসে অন্ধকার অমানিশা। ভারতের জনগণ আবার ব্রিটিশের জালে বন্দী হয়, হারায় তাদের স্বাধীনতা। মুক্তির জন্য ছটফট করে চিন্তাশীল ও বিবেকসম্পন্ন জনগণ। কালক্রমে ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র বিশ্বের মানচিত্রে স্থান করে নেয়। তবে স্বাধীনতা অর্জন হলেও ইসলামের নামে সৃষ্টি হওয়া পাকিস্তান মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর অপকৌশলে ইসলামের প্রকৃত মুক্তির স্বাদ জনগণকে উপহার দিতে পারেনি। ফলে ইয়াহিয়া, টিক্কা, আইয়ুব ও ভুট্টোর মতো নরাধমেরা আবার পূর্ব-পশ্চিমের পার্থক্য তৈরি করল; বাঙালি আর পাঞ্জাবির মধ্যে মনস্তাত্তি¡ক দেয়াল সৃষ্টি করল। বাঙালি যেন স্বাধীন হয়েও আবার পরাধীন হয়ে গেল।
১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি কথা বলার মৌলিক অধিকার ফিরে পেলেও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী জনমতের বিপরীতে অবস্থান গ্রহণ করে আবারও মুক্তিপাগল জনগণকে পরাধীনতার শিকলে আবদ্ধ করে রাখতে চেয়েছিল। কিন্তু এ দেশের জনগণ, যাদের ঈমানে মুক্তির বাণী, বিশ্বাসে স্বাধীনতার ধ্বনি, তারা তা মানতে অস্বীকৃতি জানায়। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধের পর পরাজয় বরণ করে জালিম শাসক। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় লাভ করে মুক্তিকামী জনগণ। জন্ম হয় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের।
কাক্সিক্ষত বিজয় গৌরবের। কিন্তু বিজয় যদি হয় লক্ষ্যভ্রষ্ট আর বিজেতারা যদি হন নীতিভ্রষ্ট; কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর হীন স্বার্থ যদি পায় অগ্রাধিকার, তাহলে সে বিজয় প্রকৃত আনন্দ উপহার দেয় না। সমাজে যদি আইনের শাসন না থাকে, দুষ্ট ব্যক্তি তার অন্যায় কর্মের শাজা না পেয়ে অন্যায়ের মাধ্যমে লাভবান হতে থাকে, সৎ ও যোগ্য ব্যক্তি তার যোগ্যতার মূল্যায়ন ও পুরস্কার না পান তবে সে সমাজের সাধারণ মানুষের মধ্যে হতাশা ও দুর্নীতি মুখিতা সৃষ্টি হয়। যা দেশ ও সমাজ ধ্বংসের প্রধান বাহন। তাই স্বাধীনতা লাভকারী জনগোষ্ঠীর অন্যতম দায়িত্ব সমাজের সর্বস্তরে আইনের শাসন, ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়র নিষেধের শক্তিশালী ধারা তৈরি করা। রাসূলে আরবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মক্কা বিজয় করেন, তখন আল্লাহ তাআলা বিজয়-পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে নির্দেশনা প্রদান করেন। ইরশাদ হচ্ছে – ‘তারা এমন জাতি যদি আমি তাদেরকে পৃথিবীতে বিজয় দানের মাধ্যমে ক্ষমতাবান করি, তবে তারা সালাত কায়েম করবে, যাকাত আদায় করবে এবং সৎকাজের নির্দেশ দেবে ও অসৎকাজ নিষেধ করবে। (সূরা হজ্ব, আয়াত: ৪১) সুতরাং স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের করণীয় হলো-
ক. মহান আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা।
খ. যে সকল মানুষের মাধ্যমে স্বাধীনতার মহান নেয়ামত অর্জিত হয়েছে তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। তাদের অবদানের কথা স্মরণ ও আলোচনা করা। তাঁদের জন্য কল্যাণের দোয়া করা।
গ. দেশের ভূখন্ড এবং ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল জনগণকে ভালোবাসা।
ঘ. নামায প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে আল্লাহর ভয়, আখিরাতে জবাবদিহিতার সচেতনতা, নৈতিক মূল্যবোধ ও দুর্নীতির প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি করা।
ঙ. সম্পদের বৈষম্য, সচ্ছল ও অভাবী মানুষদের মধ্যকার দূরত্ব ও বিদ্বেষ এবং দারিদ্রতা দূরীভূত করে পারস্পরিক সহমর্মিতামূলক মানব সমাজ গঠনে ধর্নাঢ্য ব্যক্তিরা সঠিকভাবে যাকাত আদায় করা।
চ. সৎ কাজের আদেশ করা এবং অন্যায়-পাপাচার প্রতিরোধ করা তথা দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন নিশ্চিত করা। ইরশাদ হচ্ছে “কোনো জাতি যতক্ষণ না তাদের অবস্থার পরিবর্তন করে ততক্ষণ আল্লাহ তাদের অবস্থার পরিবর্তন করেন না।” (সূরা রা‘দ, আয়াত : ১১) রব্বে করিম বাংলার স্বাধীনতাকে কিয়ামত পর্যন্ত অক্ষুন্ন রাখুন, মুক্তির প্রকৃত স্বাদ আস্বাদন করে বিজয়-পরবর্তী করণীয় অনুধাবন ও প্রতিপালনের তাওফিক দান করুন।
লিখক: আরবী প্রভাষক ও এম ফিল গবেষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যলয়।
কোন মন্তব্য নেই