মোঘল বিজয়ের অনন্য স্মারক কদম মোবারক শাহী মসজিদ
মুহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মাসুম
বার আউলিয়ার পুণ্যভূমি চট্টগ্রামে পুরাতাত্তি¡ক কিছু স্মৃতিচিহ্ন আছে মসজিদকে ঘিরে। ২০০ থেকে ৭০০ বছরের পুরনো ঐতিহ্যের এসব স্মারকও সময়ের ব্যবধানে হারিয়ে যাওয়ার পথে। এমনই এক মসজিদ ‘কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ’। যা মোঘল ফৌজদার ইয়াসিন খাঁন কর্তৃক নির্মিত হয়। মসজিদে রক্ষিত শিলালিপি থেকে জানা যায় যে, মুহম্মদ ইয়াসিন নামে এক স্থানীয় ফৌজদার মোঘল সম্রাট মুহম্মদ শাহ এর শাসনামলে ১১৫৬ হিজরিতে (১৭২৩ খ্রি.) এ মসজিদ নির্মাণ করেন। তিনি তাঁর নিজস্ব খরচে চট্টগ্রাম শহরের প্রাণকেন্দ্র চেরাগীর পাহাড় এলাকায় এই মসজিদ নির্মাণ করেন। ১৭১৯ থেকে ১৭২৩ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ চার বছরে মসজিদের নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হয়। মসজিদটি নির্মাণকালে মোঘল স্থাপত্য শৈল্পিক চেতনাকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়। এ মসজিদের নির্মাণ শৈলী এখনো দর্শনার্থীদেরকে আকৃষ্ট করে।
স্থাপত্য শৈলী: কদম মোবারক মসজিদে মোঘল শাসকদের রুচির বহিঃ প্রকাশ ঘটেছে। সমতল ভূমি থেকে অনুচ্ছ পাহাড়ের মাঝখানে উত্তর-দক্ষিণে লম্বাকৃতির এ মসজিদের ছাদ তিনটি গম্বুজ দ্বারা ও দুটি ভল্ট দ্বারা আচ্ছাদিত। চারকোণে রয়েছে তিন-স্তর বিশিষ্ট অষ্টভুজী মিনার বা ব্রæজ। এ মিনারগুলির প্রতিটির শীর্ষে রয়েছে ক্ষুদ্র গম্বুজ ও তারও শীর্ষে গোলাকার শীর্ষালঙ্করণ (ভরহরধষ)। এছাড়া, মসজিদের সামনের দেয়ালের মাঝখানের দরজার দুপাশে দুটি সরু মিনার রয়েছে। আয়তাকার এ মসজিদের মূল কক্ষের উত্তর ও দক্ষিণ দিকে রয়েছে একটি করে পার্শ্বকক্ষ। কদম মোবারক মসজিদ মূল কক্ষটি তিনটি ‘বে’তে বিভক্ত এরং পশ্চিম দেওয়ালের কেন্দ্রে একটি কেন্দ্রীয় মিহরাব রয়েছে। মসজিদের পূর্ব দেয়ালে রয়েছে তিনটি খিলান দেয়া দরজা। মাঝখানের দরজাটির আকার অন্য দুটি দরজার তুলনায় বড়। দরজাগুলো সোজা ভিতরে পশ্চিমে দেয়ালে আছে তিনটি মেহরাব।মেহরাবগুলোর সংলগ্ন স্থানটুকু অপূর্ব সুন্দর কারুকার্য্যময় লতাগুলোর নক্শা ও সুন্দর হস্তাক্ষরে আরবী ভাষায় লিখিত লিপিগুলো এখনো রয়েছে। মসজিদ গৃহের বাইরের দিকের মাপ হচ্ছে ১৩ মি * ৭.৪২ মি। এর সঙ্গে বাড়তি পার্শ্বকক্ষ দুটির দৈর্ঘ্য ২৩.১৬ মিটার। মসজিদের পূর্ব দিকে আছে এক সুপরিসর খোলা আঙ্গিনা। বর্তমানে সম্পূর্ণ কদম রসুল কমপ্লেক্সটিকে ঘিরে গড়ে উঠেছে মসজিদ, মাদরাসা, এতিমখানা, কবরস্থান প্রভৃতি আধুনিক অবকাঠামো। বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন সংস্কার ও সম্প্রসারণ কর্মকান্ডের ফলে মসজিদে কিছুটা আধুনিকতার ছাপ পড়লেও মসজিদটির মূল অবকাঠামো মোঘল স্থাপত্যের অনুপম সৌন্দর্য্যরে কোন পরিবর্তন ঘটেনি। এই মসজিদ যখন নির্মাণ করা হয়েছিল তখন ৫ কাতারের ১০০ জন মুসল্লী একসঙ্গে নামাজ আদাল করতে পারত। বর্তমানে মসজিদটি সম্প্রসারণের ফলে একসাথে এক হাজার মুসল্লী নামাজ আদায় করতে পারেন।
কদম মোবারক : মসজিদের উত্তর পার্শ্বের একটি কক্ষে পাথরের উপর রাসূলে আরবি হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়াসাল্লাম ) এর পা মুবারকের ছাপ বিশিষ্ট কদম রয়েছে। তার পাশে আরেকটি পায়ের ছাপ বিদ্যামান যা বড়পীর হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রাদ্বিয়াল্লাহু তাআ’লা আনহু) এর বলে প্রসিদ্ধি রয়েছে। কদমের ছাপদ্বয় মোঘল আমল থেকেই এখানে এভাবে সংরক্ষিত আছে। যা নবাব ইয়াছিন খান সুদূর আরব দেশ থেকে সংগ্রহ করেছিলেন বলে জানা যায়। এক পদচিহ্ন বরাবরে বাংলায় লেখা রয়েছে: ‘সরওয়ারে কায়েনাত হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়াসাল্লাম) এর কদম মুবারক’। অপর পদচিহ্ন বরাবরে লেখা রয়েছে : ‘হযরত গাউসুল আজম আবদুল কাদের জিলানী (রাদ্বিয়াল্লাহু তাআ’লা আনহুর) এর কদম মুবারক। অনেকেই দূর-দূরান্ত থেকে আসেন কদমদ্বয়ের ছাপ দর্শন লাভের আশায়। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই ধর্মীয় তীর্থ কেন্দ্র হিসেবে এ মসজিদের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। কদমের ছাপদ্বয় সবসময় পানিতে ডুবানো থাকে। মনোবাসনা পূরনের উদ্দেশ্যে এবং রোগমুক্তির আশায় অনেকেই এই পানি ভক্তি সহকারে পান করে।
এ মসজিদের অতীত ইতিহাস সম্পর্কে জানতে চাইলে মোমিন রোড এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা প্রবীণ ব্যক্তি জাকারিয়া চৌধুরী জানান, মোঘল শাসক নবাব ইয়াছিন খাঁন কর্তৃক এই মসজিদ নির্মিত হয়। যা মোঘল স্থাপত্য শিল্পের এক ঐতিহাসিক নির্দশন হিসেবে আজো টিকে আছে। এই মসজিদের গঠন, অবকাঠামো, নির্মাণ শৈলী, কারুকার্য্য এখনো সবাইকে আকৃষ্ট করে। তিনি আরো বলেন, এই মসজিদের অতীত সম্পর্কে আমাদের পূর্ব পুরুষদের মুখে শুনেছি যে, মোঘল শাসকরা যখন চট্টগ্রামকে মগ এবং পর্তুগীজদের হাত থেকে মুক্ত করেন তখন এখানে মোঘল শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। মোঘল শাসকরা চট্টগ্রাম জয় করার পর এখানে ইসলাম ধর্ম প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করার জন্য এবং তাদের বিজয়ের নির্দশন স্বরূপ বহুমসজিদ নির্মাণ করেন। মোঘল শাসক নবাব ইয়াছিন খাঁন ছিলেন একজন ধর্মভীরু সৎ শাসক। তিনি এ অঞ্চলে ইসলাম ধর্ম প্রচার এবং প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নিজস্ব অর্থয়ানে চট্টগ্রাম শহরের প্রাণ কেন্দ্র চেরাগীর পাহাড় এলাকায় ১৭১৯ সালের দিকে এই মসজিদ নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
লিখক: আরবি প্রভাষক,রাণীরহাট আল আমিন হামেদিয়া ফাযিল মাদরাসা; খতিব, রাজানগর রাণীরহাট ডিগ্রি কলেজ জামে মসজিদ
কোন মন্তব্য নেই