চট্টগ্রামের জাতি-তাত্ত্বিক জাদুঘর এশিয়ার অনন্য জাদুঘর
মুহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মাসুম
বন্দর নগরী চট্টগ্রামের বাণিজ্যিক এলাকা আগ্রাবাদের বাদমতলী সংলগ্ন ১.২৫ একর (০.১৫ হেক্টর) জুড়ে অবস্থিত দেশের একমাত্র জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘর। এশিয়া মহাদেশের দুটি জাতি-তাত্ত্বিক জাদুঘরের মধ্যে এটি অন্যতম। বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকের গোড়ার দিকে, ১৯৬৫ সালে তৎকালীন পাকিস্তান প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের উদ্যোগে জাদুঘরটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ১৯৭৪ সালের ৯ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী ইউসুফ আলী উদ্বোধন করার মধ্য দিয়ে সর্বসাধারণের পরিদর্শনের জন্য জাদুঘরটি উন্মুক্ত করা হয়। মূলত এটি প্রতিষ্ঠা করা হয় বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর জীবনযাপন, সাংস্কৃতিক আচার, ঐতিহ্যের নমুনা সংরক্ষণের উদ্দেশ্যেই।
বর্তমানে জাদুঘরটিতে বাংলাদেশের ২৫টি জাতিগোষ্ঠীর পাশাপাশি পাকিস্তান, ভারত সহ বিদেশি ৫টি দেশের জাতিতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর বিভিন্ন সামগ্রীর তুলনামূলক বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এতে রয়েছে সাংস্কৃতিক আচার, পোশাক, অলংকারের অনন্য নিদর্শন । আলোকচিত্র, মডেল, নমুনার মাধ্যমে জাতিগোষ্ঠীগুলোর নিজস্বতা তুলে ধরা হয়েছে।
বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, মুরং, বম, খিয়াং, খুমি, চাক, রাখাইন, পাংখোয়া; সিলেট অঞ্চলের খাসিয়া, মনিপুরী, পাঙন, পাত্র; ময়মনসিংহ অঞ্চলের গারো, হাজং, দালু, মান্দাই, কোচ; রাজশাহী-দিনাজপুর অঞ্চলের সাঁওতাল, ওরাঁও, রাজবংশী, পলিয়া; এবং যশোর-ঝিনাইদহ অঞ্চলের বুনো বা বোনা, বাগদি অর্ন্তভুক্ত রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘরের কর্মকর্তা বলেন, ভারতের কয়েকটি জাতিগোষ্ঠী, জার্মানির বার্লিন প্রাচীরের টুকরো, কিরগিজস্তান, অস্ট্রেলিয়া জাতিগোষ্ঠীর কিছু নিদর্শনও রয়েছে জাদুঘর কর্তৃপক্ষের কাছে। সংস্কারকাজের জন্য সাময়িকভাবে এগুলো সরিয়ে রাখা হয়েছে।
একতলা বিশিষ্ট দক্ষিণমুখি জাদুঘরটি পাঁচটি ভাগে বিভক্ত, যেখানে রয়েছে একটি কেন্দ্রীয় হলঘরসহ সর্বমোট চারটি গ্যালারি। প্রাথমিকভাবে প্রতিটি গ্যালারিতে তিনটি করে কক্ষ নির্মাণের পরিকল্পনা থাকলেও শুধুমাত্র পশ্চিমের দুটি গ্যালারিতে দুটি করে কক্ষ নির্মিত হয়েছে। ফলে বর্তমানে জাদুঘরে সর্বমোট প্রদর্শনী কক্ষের সংখ্যা ১১টি। এক নম্বর গ্যালারির প্রথম কক্ষে রয়েছে বাঙালি জাতিগোষ্ঠীর সংস্কৃতি, জীবনযাপনের বিভিন্ন চিত্র ও নমুনা। দ্বিতীয় কক্ষে উপস্থাপন করা আছে পাকিস্তানের পাঠান, পাঞ্জাবসহ চারটি জাতির পোশাক, হস্তশিল্প, অস্ত্র, বাদ্যযন্ত্রের নমুনা। জাদুঘরের কেন্দ্রীয় গ্যালারিতে রয়েছে বিভিন্ন জাতির ব্যবহৃত অলংকারের নিদর্শন। বাকি কক্ষগুলোতে বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠীকে তুলে ধরা হয়েছে। বর্তমানে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর ৩ হাজার ২০০–এর মতো নিদর্শন আছে জাদুঘরটিতে। হলরুমের মানচিত্র ও দেয়ালচিত্রের মাধ্যমে উপজাতিদের বিভিন্ন রকম উৎসব ও সংস্কৃতি সম্পর্কেও দর্শনার্থীদের ধারণা দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। আর ভবনের সামনে রয়েছে সবুজ বাগান, যা দর্শকদের আকর্ষণ বাড়ায়। এছাড়াও এখানে রয়েছে ১৯৮৯ সালে ভেঙে ফেলা জার্মানির বার্লিন প্রাচীরের টুকরো অংশ বিশেষ।
জাদুঘরে রয়েছে একটি ছোট গ্রন্থাগার। জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘর শুধু দেশি-বিদেশি পেশাদার দর্শকদের জ্ঞানানু সন্ধানের আকাঙ্ক্ষাই নিবৃত করে না, বরং সকল শ্রেণীর দর্শক পর্যটকদের বিপুল আনন্দেরও খোরাক যোগায়।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘরের সাবেক কিউরেটর শামসুল হোসাইন বাহাদুর বলেন, জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘর একটি বিশেষায়িত জাদুঘর। কিন্তু বাংলাদেশে এ ধরনের একটি জাদুঘর চালানোর মতো প্রয়োজনীয় লোকবল আছে কি না এটি একটি বড় প্রশ্ন। জাতিতত্ত্ব নৃবিজ্ঞান–সংশ্লিষ্ট বিষয়। অথচ এটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অধীনে আছে। জাদুঘরটিতে যেসব নিদর্শন রয়েছে বছরের পর বছর ধরে একইভাবে প্রদর্শন করা হচ্ছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রদর্শন–ব্যবস্থায় নতুনত্ব আনা উচিত।
আবদুর রহিম নামক এক পর্যটক বলেন, প্রায় দুই দশক পরে তিনি আবারও জাদুঘরটি দেখতে এসেছেন। তিনি হতাশ কণ্ঠে বলেন, ২০ বছরে কোনো পরিবর্তন হয়েছে বলে তো মনে হচ্ছে না। তারপরও অবশ্য ঘুরে দেখতে ভালো লাগছে। তার সফর সঙ্গী আবু তাহের প্রথমবার এসেছেন। তিনি বলেন, জাতিগোষ্ঠীগুলোর একটা বিবরণমূলক ক্যাপশন থাকলে ভালো হতো।
অবশ্য কর্তৃপক্ষ বলছে, জাদুঘর আধুনিকায়নের জন্য একটি প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়ন করছে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। প্রকল্পটির নাম ‘চট্টগ্রামের জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘরের প্রদর্শনী উন্নয়ন, সংগ্রহ বৃদ্ধি ও আধুনিকায়ন’। তিন বছর মেয়াদি এ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ কোটি ২১ লাখ টাকা। ২০১৪ সালের জুলাইয়ে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। এর মেয়াদ আছে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত।
জাদুঘর সূত্র জানায়, এই প্রকল্পের আওতায় জাদুঘরের মূল ফটকের ডানে একটি টিকিট কাউন্টার ও বামে একটি স্যুভেনির শপ (দোকান) নির্মাণ করা হয়েছে। জাদুঘরের ছাদ সংস্কার, ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা সংযোজন ও সার্বক্ষণিক বিদ্যুতের জন্য একটি বড় জেনারেটরও কেনা হয়েছে। এ ছাড়া একটি দোতলা অফিস ভবন ও ডরমিটরি নির্মাণ চলছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রাহমান নাসির উদ্দিন বলেন, ‘একটি দেশের সংস্কৃতির বৈচিত্র্য যথাযথভাবে উপস্থাপন এবং সংরক্ষণের জন্য জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘরের একটি বড় ধরনের ভূমিকা রয়েছে। সে বিবেচনায় চট্টগ্রামের জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘরের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু যথাযথ উপস্থাপনা ও সংরক্ষণের বিষয়টি বিবেচনায় নিলে বলতে হয়, জাদুঘরটি কোনো কোনো ক্ষেত্রে খণ্ডিত ও অপর্যাপ্তভাবে তার দায়িত্ব পালন করছে। সংখ্যায় হয়তো অনেক জাতিগোষ্ঠী উপস্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু একটি জাতির সামগ্রিকতার জায়গা থেকে এটি একেবারেই অপর্যাপ্ত।’
জাদুঘর কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী প্রতিদিন দেশি-বিদেশি গবেষকসহ ২০০-৩০০ জন দর্শনার্থী এই জাদুঘর পরিদর্শন করেন। জাদুঘরের মূল ফটকের সঙ্গেই রয়েছেে টিকিট কাউন্টার। এটি শীতকালে অর্থাৎ অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত সকাল ৯.০০ থেকে বিকাল ৫.০০ আর গ্রীষ্মকালে অর্থাৎ এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর সকাল ১০.০০ থেকে বিকাল ৬.০০ পর্যন্ত উম্মুক্ত থাকে।দেশী পর্যটক: ২০ টাকা, সার্কভুক্ত দেশের পর্যটক: ৫০ টাকা, বিদেশী পর্যটক: ১০০ টাকা এবং মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত (হাইস্কুল শিক্ষর্থী): ০৫ টাকা প্রবেশ মূল্য নির্ধারণ করা আছে। রবিবার এবং সরকার ঘোষিত দিবসে জাদুঘরটির প্রদর্শনী বন্ধ থাকে।
প্রকল্পটির পরিচালক ও প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর চট্টগ্রাম বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক লাভলী ইয়াসমিন বলেন, নিদর্শনগুলো আধুনিকভাবে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর নতুন নতুন নিদর্শন সংগ্রহ করা হচ্ছে। এ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে তিন শ নতুন নিদর্শন সংগ্রহ করা গেছে। এগুলো জাদুঘরে প্রদর্শন করা হবে। জাদুঘরের ওপর ছোট ছোট পুস্তিকাও বের করা হবে।
লিখক: আরবি প্রভাষ, রাণীরহাট আল-আমিন হামেদিয়া ফাযিল মাদরাসা; খতিব, রাজানগর রাণীরহাট ডিগ্রি কলেজ জামে মসজিদ।
কোন মন্তব্য নেই