জুমার খুতবা ৩ :জিলহজ্ব মাসের প্রথম ১০ দিনের গুরুত্ব, মর্যাদা ও ফজিলত
মুহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মাসুম
জিলহজ্ব মাসের চাঁদ উদিত হওয়ার পর থেকে দশ তারিখ পর্যন্ত যত দিন সম্ভব নফল রোযা রাখা আর রাতের বেলা বেশী বেশী ইবাদত করা যথা নফল নামায, কুরআন তিলাওয়াত, তাসবীহ–তাহলীল, তাওবা–ইস্তিগফার ও রোনাজারী ইত্যাদি ইবাদতের মাধ্যমে কাটানোর অনেক ফযীলত রয়েছে । এ দিনগুলোর ফযীলতের ব্যাপারে কুরআন–সুন্নায় অনেক দলীল রয়েছে:
** আল্লাহ তায়ালা বলেন:
وَيَذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ فِي أَيَّامٍ مَعْلُومَاتٍ
“তারা যেন নির্দিষ্ট দিন সমূহে আল্লাহর নাম স্মরণ করে। (সূরা হজ্জ: ২৮) ইবনে আব্বাস রা. বলেছেন: “(নির্দিষ্ট দিন সমূহ হল) যিলহজ্জ মাসের প্রথম দশ দিন।” (তাফসীর ইবনে কাসীর)
** আল্লাহ তায়ালা বলেন:
وَالْفَجْرِ وَلَيَالٍ عَشْرٍ
“শপথ ফজরের। শপথ দশ রাতের। (সূরা ফজর: ১ ও ২) ইবনে কাসীর রাহ. বলেছেন: “এর দ্বারা উদ্দেশ্য হল, যিলহজ্জ মাসের প্রথম দশ দিন।” এই মত ব্যক্ত করেন ইবনে আব্বাস, ইবনুয যুবাইর, মুজাহিদ প্রমুখ। (সহীহ বুখারী)
#عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ، عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم أَنَّهُ قَالَ ” مَا الْعَمَلُ فِي أَيَّامِ الْعَشْرِ أَفْضَلَ مِنَ الْعَمَلِ فِي هَذِهِ ”. قَالُوا وَلاَ الْجِهَادُ قَالَ ” وَلاَ الْجِهَادُ، إِلاَّ رَجُلٌ خَرَجَ يُخَاطِرُ بِنَفْسِهِ وَمَالِهِ فَلَمْ يَرْجِعْ بِشَىْءٍ | بخاري
** আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
“যিলহজ্জের প্রথম দশকের চেয়ে উত্তম এমন কোন দিন নেই, যে দিনগুলোর সৎ আমল আল্লাহ্র নিকট অধিক পছন্দনীয়।” সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন: আল্লাহ্র পথে জিহাদও নয় হে রাসূলুল্লাহ্? তিনি বললেন: “আল্লাহ্র পথে জিহাদও নয়। অবশ্য সেই মুজাহিদের কথা ভিন্ন, যে জান–মাল নিয়ে জিহাদে বেরিয়ে পড়ে, কিন্তু আর কোন কিছুই নিয়ে ফিরে আসে না (অর্থাৎ আল্লাহর পথে শহীদ হয়ে যায়)। {বুখারী শরীফ,হাদীস নং–969}
عن ابن عمر رضي الله عنهما عن النبي صلى الله عليه وسلم قال : ( ما من أيام أعظم ولا احب إلى الله العمل فيهن من هذه الأيام العشر فأكثروا فيهن من التهليل والتكبير والتحميد | رواه مسند أحمد )
** ইবনে ওমর রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “এ দশ দিনের তুলনায় অন্য কোন সময় আল্লাহর নিকট এতটা মর্যাদা পূর্ণ নয় বা তাতে আমল করা এতটা পছন্দনীয় নয়। সুতরাং এ দিনগুলোতে তোমরা অধিক পরিমাণ তাহলীল (লা–ইলা–হা ইল্লাল্লাহ), তাকবীর (আল্লাহু আকবার) ও তাহমীদ (আল হামদুলিল্লাহ) পাঠ কর।” (মুসনাদ আহমদ)
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ “ مَا مِنْ أَيَّامٍ أَحَبُّ إِلَى اللَّهِ أَنْ يُتَعَبَّدَ لَهُ فِيهَا مِنْ عَشْرِ ذِي الْحِجَّةِ يَعْدِلُ صِيَامُ كُلِّ يَوْمٍ مِنْهَا بِصِيَامِ سَنَةٍ وَقِيَامُ كُلِّ لَيْلَةٍ مِنْهَا بِقِيَامِ لَيْلَةِ الْقَدْرِ ” | رواه ترميذي
হযরত আবু হুরায়রা রা.থেকে বর্ণিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, জিলহজ্বের দশ দিনের ইবাদত আল্লাহর নিকট অন্য দিনের ইবাদত তুলনায় বেশী প্রিয়, প্রত্যেক দিনের রোযা এক বছরের রোযার ন্যায় আর প্রত্যেক রাতের ইবাদত লাইলাতুল কদরের ইবাদতের ন্যায়। {তিরমিজী শরীফ,হাদীস নং–৭৫৮,সুনানে বায়হাকী কুবরা, হাদীস নং–৩৭৫৭)
** সাঈদ ইবনে জুবাইর (যিনি পূর্বোক্ত ইবনে আব্বাস রা. এর হাদীস বর্ণনাকারী) জিলহজ্জের দশ দিন শুরু হলে ইবাদত–বন্দেগীতে এত বেশী পরিশ্রম করতেন যে, অন্য কারো জন্য এত ইবাদত করা প্রায় অসম্ভব হয়ে যেত। (দারেমী)
** ইবনে হাজার রহ. ফাতহুল বারীতে বলেন: “এই দশ দিন বিশেষ বৈশিষ্ট্য মণ্ডিত হওয়ার কারণ হিসেবে আমার নিকট এটাই প্রতিভাত হচ্ছে যে, এ দিনগুলোতে সালাত, সিয়াম, দান–সদকা, হজ্জ ইত্যাদি মৌলিক ইবাদতগুলোর সমাবেশ ঘটেছে। এ ছাড়া অন্য কখনো এগুলো একসাথে পাওয়া যায় না।”
এ দিনগুলোতে যেসব আমল করা মুস্তাহাব:
** সালাত: ফরয সালাতগুলো যথাসময়ে সম্পাদন করার পাশাপাশি প্রচুর নফল সালাত আদায় করা। কারণ, সালাতই হল আল্লাহর নৈকট্য লাভের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপায়। সাওবান রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি: “তুমি আল্লাহর উদ্দেশ্যে অধিক পরিমাণ সেজদা কর (নফল সালাত আদায় কর), কারণ যখনই তুমি সেজদা কর বিনিময় আল্লাহ তোমার মর্যাদা বৃদ্ধি করেন এবং গুনাহ মোচন করেন।” (মুসলিম) এটি কেবল যিলহজ্জ মাস নয় বরং অন্য সকল সময়ের জন্য প্রযোজ্য।
** সিয়াম: রোজা রাখা অন্যতম একটি নেক কাজ। তাই এ দিনগুলোতে নফল রোজা রাখা খুবই ফযীলতের। হুনাইদা বিন খালেদ তার স্ত্রী থেকে, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জনৈক স্ত্রী থেকে বর্ণনা করেন: “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যিলহজ্জ মাসের নয় তারিখ, আশুরার দিন ও প্রত্যেক মাসের তিন দিন রোজা পালন করতেন।” (আহমদ, আবু দাউদ ও নাসায়ী) ইমাম নববী যিলহজ্জ মাসের শেষ দশ দিনে রোযা রাখার ব্যাপারে বলেছেন, এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ মুস্তাহাব।
** তাকবীর, তাহলীল ও তাহমীদ: পূর্বে ইবনে ওমর রা. এর হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। তাতে রয়েছে, তোমরা বেশি বেশি তাকবীর (আল্লা–হু আকবার), তাহলীল (লা–ইলা–হা ইল্লাল্লাহ), ও তাহমীদ (আল হামদুলিল্লা–হ) পড়। ইমাম
فقد كَانَ ابْنُ عُمَرَ، وَأَبُو هُرَيْرَةَ: «يَخْرُجَانِ إِلَى السُّوقِ فِي أَيَّامِ العَشْرِ يُكَبِّرَانِ، وَيُكَبِّرُ النَّاسُ بِتَكْبِيرِهِمَا | رواه بخاري »
বুখারী রহ. বলেছেন, ইবনে ওমর রা. এবং আবু হুরায়রা রা. এ দশ দিন তাকবীর বলতে বলতে বাজারে বের হতেন, আর মানুষরাও তাদের দেখে তাকবীর বলত। তিনি আরও বলেছেন, ইবনে উমর রা, মিনায় তাঁর তাঁবুতে তাকবীর বলতেন, তা শুনে মসজিদের লোকেরা তাকবীর বলত এবং বাজারের লোকেরাও তাকবীর বলত। এক পর্যায়ে পুরো মিনা তাকবীর ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠত।
ইবনে উমর রা. মিনায় অবস্থানের দিনগুলোতে, পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের পরে, তাঁবুতে, বিছানায়, বসার স্থানে, চলার পথে সর্বত্র তাকবীর পাঠ করতেন।
এ তাকবীরগুলো উচ্চ আওয়াজে পাঠ করা মুস্তাহাব। কারণ, সাহাবী উমর রা., তাঁর ছেলে আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা., আবু হুরায়রা রা. তা উচ্চ আওয়াজে পাঠ করতেন।
মুসলমানদের উচিত এ সুন্নতটি পুনর্জীবিত করা, যা বর্তমান যুগে প্রায় হারিয়ে গেছে এবং দু:খ জনক হলেও সত্য, সাধারণ মানুষের পাশাপাশি নেককার লোকেরাও এটি প্রায় ভুলতে বসেছে। অথচ আমাদের পূর্বপুরুষগণ ছিলেন এর সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম।
তাকবীর বলার নিয়ম: নিন্মোক্ত যে কোন পদ্ধতিতে তাকবীর পাঠ করা যায়:
১) আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার কাবীরা।
২) আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লাইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, ওয়া লিল্লাহিল হামদ।
৩) আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লাইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, ওয়া লিল্লাহিল হামদ।
**আরাফার দিন রোজা: আরাফার দিন রোজা রাখা খুব গুরুত্বপূর্ণ। যেহেতু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমাণিত, তিনি আরাফার দিনের রোজার ব্যাপারে বলেছেন:
عَنْ أَبِي قَتَادَةَ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ ـ صلى الله عليه وسلم ـ “ صِيَامُ يَوْمِ عَرَفَةَ إِنِّي أَحْتَسِبُ عَلَى اللَّهِ أَنْ يُكَفِّرَ السَّنَةَ الَّتِي قَبْلَهُ وَالَّتِي بَعْدَهُ ” (رواه ابن ماجه، كتاب الصيام)
“আমি আল্লাহর কাছে আশাবাদী, এটি পূর্ববর্তী এক বছর ও পরবর্তী এক বছরের গুনাহের কাফফারা হবে।”
তবে আরাফায় অবস্থানকারী হাজীদের জন্য রোযা রাখা মুস্তাহাব নয়। কারণ, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরাফায় অবস্থান করেছিলেন রোজা বিহীন অবস্থায়।
** কুরবানীর দিন (দশম যিলহজ্জ) এর মর্যাদা: এই মহান দিনটির মর্যাদার ব্যাপারে অনেক মুসলমানই অসচেতন। কতিপয় বিদ্বান এ মত ব্যক্ত করেছেন যে, সাধারণভাবে সারা বছরের মধ্যে–এমনকি আরাফার দিনের চেয়েও নহর তথা কুরবানীর দিন উত্তম।
ইবনুল কাইয়িম রহ. বলেছেন, আল্লাহর নিকট সর্বোত্তম দিন নহরের দিন। এটিই হল, হজ্জে আকবর (বড় হজ্জ) এর দিন। যেমন সুনানে আবু দাউদে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “আল্লাহর নিকট সর্বাধিক মহিমান্বিত দিন হল নহর তথা কুরবানীর দিন। অতঃপর কুরবানীর পরের দিন (অর্থাৎ যিলহজ্জের এগারতম দিন যে দিন হাজীগণ কুরবানী করার পর মিনায় অবস্থান করেন)।
কোন মন্তব্য নেই