একজন শ্রেষ্ঠ নারী বেগম রোকেয়া


-শাহ্ আবদুল হান্নান
বেগম রোকেয়া ছিলেন একজন চিন্তাবিদ। সেই সঙ্গে সত্যিকার অর্থেই একজন ইসলামী চিন্তাবিদও ছিলেন। যিনি ইসলামের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে চিন্তাভাবনা, গবেষণা ও ব্যাখ্যা করেন তিনিই ইসলামী চিন্তাবিদ। তিনি ইসলাম সম্পর্কে বিভ্রান্তি বা ভুল দূর করেন। কাজেই এসব অর্থে বেগম রোকেয়াকে ইসলামী চিন্তাবিদ বলতে হবে। অবরোধ, নারী স্বাধীনতা, পর্দার প্রশ্ন, অশ্লীলতা, যৌতুক প্রথা, বিধবা বিবাহ, বাল্য বিবাহ, তালাক নিয়ে ভ্রান্তি ও বাড়াবাড়িসহ বিভিন্ন ধরনের কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তিনি ইসলামের সঠিক অবস্থান তুলে ধরেছেন।
রোকেয়াকে নিয়ে যারা বিতর্ক সৃষ্টি করতে চান, তারা তার সামগ্রিক লেখনী ও জীবনের শিক্ষা বাদ দিয়ে খণ্ডিত কিছু উদ্ধৃতি ব্যবহার করেন। এসব বিতর্ক এরই মধ্যে নানাভাবে অত্যন্ত সার্থকতার সঙ্গেই খণ্ডন করা হয়েছে। বেগম রোকেয়ার একটি উদ্ধৃতি দেয়া হয় যাতে তিনি বলেছেন, ‘আমরা প্রথমত যাহা মানি নাই পরে ধর্মের আদেশ ভাবিয়ে শিরোধার্য করিয়াছি। ... আমাদিগকে অন্ধকারে রাখিবার জন্য পুরুষগণ ঐ ধর্মগুলোকে ঈশ্বরের আদেশপত্র বলিয়া প্রচার করিয়াছেন।’ এখানে কিছু ভুল বোঝাবুঝি হতেই পারে। কিন্তু যদি রোকেয়ার সামগ্রিক সাহিত্যের আলোকে এ মন্তব্য ব্যাখ্যা করা হয় তাহলে দেখা যাবে, এসব হচ্ছে মূলত তার ক্ষোভের কথা। এখানে ধর্মগ্রন্থ বলতে কোনোভাবেই কোরআন বা হাদিসকে বোঝানো হয়নি। বরং সে সময় ধর্মগ্রন্থের নামে কিছু অর্ধশিক্ষিত ব্যক্তির বই প্রচলিত ছিল যাতে নারীর অধিকারের বিপক্ষে বলা হতো। কোরআনে সামগ্রিকভাবে নারী-পুরুষের সাম্যের কথা বলা হয়েছে। তিনি আরও বলেছেন, “যদি ঈশ্বর কোনো দূত রমণী-শাসনের নিমিত্তে প্রেরণ করিতেন, তবে সে দূত বোধহয় শুধু এশিয়ায় সীমাবদ্ধ থাকিতেন না। দূতগণ ইউরোপে যান নাই কেন? আমেরিকা এবং সুমেরু হইতে কুমেরু পর্যন্ত যাইয়া ‘রমণী জাতিকে নরের অধীনে থাকিতে হইবে’—ঈশ্বরের এ আদেশ শুনান নাই কেন? ঈশ্বর কি কেবল এশিয়ারই ঈশ্বর?” তার এ কথায় দূত বলতে রাসুল (সা.) কে মনে করা সঙ্গত হবে না। বরং যেসব পুরুষ অন্যায়ভাবে এ অঞ্চলে নারীকে দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করেছেন, তাদেরই বোঝানো হয়েছে। কেননা রোকেয়া তার বিভিন্ন লেখায় হজরত মোহাম্মদ (সা.) কে বিভিন্ন প্রসঙ্গে প্রাণভরে স্মরণ করেছেন। তার চেয়েও বড় কথা, ‘মতিচূর’ প্রথম খণ্ডের দ্বিতীয় প্রবন্ধ ‘স্ত্রী জাতির অবনতি’ ১৩১১ ভাদ্রের ‘নবনূর’-এ প্রকাশিত হয়েছিল ‘আমাদের অবনতি’ শিরোনামে। এতে মূল প্রবন্ধের ২৩শ’ থেকে ২৭শ’ পর্যন্ত পাঁচটি পরিচ্ছদ পরিবর্জিত হয়ে নতুন সাতটি অনুচ্ছেদ সংযোজিত হয়েছিল, যাতে আর কোনো ভুল বোঝাবুঝির সুযোগ ছিল না। অথচ আজও রোকেয়ার এ দু-একটি উদ্ধৃতিকে অপব্যাখ্যা করা হচ্ছে।’ (দ্রষ্টব্য : ‘বেগম রোকেয়া ও ইসলাম’, এ. এ. রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, দি উইটনেস প্রকাশিত ‘রোকেয়া সন্ধানে’ হতে)।
১৩৩৮ সালের মাসিক মোহাম্মদীতে মুসলমানদের নামের বিকৃতির বিষয়ে কঠোরভাবে দৃষ্টি আর্কষণ করেছেন। মুসলমানদের নাম আরবি ভাষায় হবে—এটিই ট্র্যাডিশন। এটি তাকে সঠিক পরিচয় দেয়। রোকেয়া এর উপর দৃঢ় থাকতে বলেছিলেন। অথচ আমাদের বর্তমান প্রজন্মকে এ থেকে দূরে সরানোর চেষ্টা চলছে। এখন আমাদের নামের বিকৃতি থেকে সরে আসতে হবে।
তিনি ১৩৩৮ সালের জ্যৈষ্ঠ সংখ্যা মাসিক মোহাম্মদীতে স্পষ্টভাবে বলেছেন, “ছেলেবেলায় আমি মার মুখে শুনতাম, ‘কোরআন শরীফ ঢাল হয়ে আমাদের রক্ষা করবে’— এসব কথা অতি সত্য। কোরআন শরীফের সার্বজনীন শিক্ষা আমাদের নানা কুসংস্কারের বিপদ থেকে রক্ষা করবে। কোরআন শরীফের বিধান অনুযায়ী ধর্ম-কর্ম আমাদের নৈতিক ও সামাজিক অধঃপতন থেকে রক্ষা করবে।”
এত স্পষ্ট বক্তব্যের পরও কোনো কোনো বুদ্ধিজীবীর মতে রোকেয়া কোনো বিশেষ ধর্মকে বাতিল করেননি, বাতিল করেছেন সব ধর্মকেই—বস্তুত এ ধরনের মন্তব্য চরম মিথ্যাচার ও একাডেমিক ডিজঅনেস্টি। অথচ আশ্চর্যের বিষয়, এরাই বাংলাদেশের বর্তমান সময়ের নেতৃস্থানীয় বুদ্ধিজীবী সেজে বসে আছে। বেগম রোকেয়া একজন উঁচু মানের সমাজ সংস্কারক ছিলেন। উপমহাদেশের গত হাজার বছরের ইতিহাসে তার মতো এত বড় সমাজ সংস্কারক খুব কম ছিলেন। শুধু উপমহাদেশে নয়, সমগ্র বিশ্বের কয়েকজন সেরা সমাজ সংস্কারকের নাম বললে তার নাম বলতে হয়। এটি সরকার ও আমাদের দায়িত্ব যে এত বড় প্রতিভভাকে সমগ্র বিশ্বে পরিচিত করা।
কোরআনে বলা হয়েছে, সব মানুষের রুহ একই সঙ্গে আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন (সূরা আরাফ : আয়াত ২৭২)। অতঃপর আল্লাহ বলেন, তিনি মানব ও মানবী উভয়কে সর্বোত্তম কাঠামোতে সৃষ্টি করেছেন (সূরা তিন)। এরপরও যারা বলেন, নারী পুরুষের চাইতে দুর্বল বা নারীর হৃিপণ্ড ছোট কিংবা মগজ ছোট; তারা কোরআনের বিপরীত কথা বলেন। সূরা নিসার প্রথম আয়াতে বলা হয়েছে, সব মানব-মানবী হজরত আদম (আ.) থেকে সৃষ্ট। অতএব আমাদের মধ্যে অকারণ বিভাজন কেন?
যারা প্রকৃতই রোকেয়ার চিন্তা-চেতনাকে তুলে ধরতে চান তাদের দায়িত্ব হচ্ছে বেগম রোকেয়ার অপব্যবহার রোধ করা। বেগম রোকেয়াকে যারা ইসলাম-বিরোধীদের দলভুক্ত বলে প্রচারণা চালান তাদের শৃঙ্খল থেকে রোকেয়াকে মুক্ত করে সঠিকভাবে তুলে ধরার দায়িত্ব আমাদেরই। নারী স্বাধীনতা রাসুলের (সা.) সময় থেকেই শুরু হয়েছে।
বর্তমান শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ আল্লামা আবদুল হালিম আবু শুক্কাহ-র গবেষণার ফসল ছয় খণ্ডের বিশাল গ্রন্থ ‘রাসুলের যুগে নারী স্বাধীনতা’ থেকে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। তবে দুঃখের বিষয়, মুসলমানরা রাসুল (সা.)-এর শিক্ষাকে ধারণ করতে পারেনি। রাসুল (সা.) যে দৃষ্টিতে মেয়েদের দেখতেন সে দৃষ্টিতে আমরা দেখি না। প্রাথমিক ইসলামী পৃথিবী ছিল তেমনই এক পৃথিবী, সেখানে পুরুষ ও নারী ছিল একে অপরের বন্ধু ও অভিভাবক। তারা এক সঙ্গে নামাজ পড়তেন, সামাজিক কাজ করতেন, সত্ কাজের আদেশ ও অসত্ কাজের নিষেধ করতেন—এমনকি যুদ্ধেও অংশ নিতেন।
বেগম রোকেয়াও সে রকম এক পরিপূর্ণ ইসলামী সমাজে বিশ্বাস করতেন। তারপরও তাকে ইসলাম-বিরোধী হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়। তার ব্যাপারে সমাজে বিভ্রান্তি লক্ষ্য করা যায়। বলা হয়, তিনি ধর্ম ও পর্দার বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন—এটি একবারেই একটি ভুল ধারণা।
বিশ্বের অন্যান্য স্থানের মতো আমাদের উপমহাদেশের নারীরা বহুকাল ধরে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বঞ্চিত ও নির্যাতিত। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নারীদের ব্যাপারে সংকীর্ণতা আমাদের সমাজের বৈশিষ্ট্য, যার প্রধান কারণ হলো কুসংস্কার ও বাড়াবাড়ি। এসবের বিরুদ্ধে যে কণ্ঠটি সবচেয়ে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছে তা ছিল বেগম রোকেয়ার। তারই প্রচেষ্টায় একশ’ বছর আগের তুলনায় বর্তমানে নারীর অবস্থা কিছুটা উন্নতি লাভ করেছে বলে মনে হয়। বেগম রোকেয়া যে সামাজিক প্রেক্ষাপটে অন্ধত্ব ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন, সে বিবেচনায় তার বলিষ্ঠতা ও সাহসিকতা আমাদের অভিভূত করে। সে সমাজে এমন বিপ্লবী কথা উচ্চারণ করা অত্যন্ত কঠিন ছিল। কিন্তু বেগম রোকেয়া নির্ভীক চিত্তে তার বক্তৃতায়, লেখায় ও কাজে নারী মুক্তির কথা ব্যক্ত করেছেন এবং সামাজিক কর্মকাণ্ডে নারীদের অংশগ্রহণের কথা বলেছেন।
সেসব দিক থেকে বেগম রোকেয়া যে কোনো বিবেচনায় এ উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ কয়েকজন নারীর একজন।
লেখক : সাবেক সচিব
লেখক : সাবেক সচিব, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার